আমার মন কেমন করে……

একটা গান শুনছি বেশ কয়েকদিন ধরে। রবীন্দ্রনাথ এর “আমার মন কেমন করে……”। ঘুরে ফিরে বারবার শুনছিলাম গানটা। শুনতে শুনতে আমারও মন কেমন করে উঠছিলো। জানিনা গানটি লেখার সময় রবিঠাকুরের মন তার প্রেমিকা কিংবা কোন আপনজনের জন্য কেমন করছিল কিনা। কিন্তু আমার ‘মন কেমন’ করে উঠছিলো কিছু তুচ্ছ, ক্ষুদ্র জিনিসের জন্য। আমাদের সবারই এই রকম অসংখ্য মন কেমন করা স্মৃতি আছে। এই জিনিসগুলো আমরা নিজেরা ছাড়া আর কেউ বোঝেনা; বুঝবেনাও কোনদিন।

কোথাকার, কবেকার ছোট খাটো কিছু ঘটনা, কিছু টুকরো স্মৃতির জন্যে মন কেমন করে। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের রোদে খেলতে যাওয়া, বর্ষার শুরুতে বাড়ির সামনের রাস্তায় কিংবা দূরের মাঠের হাঁটু পানিতে নেমে জল ছুড়াছুড়ি করা। অথবা চাচার সাথে সাঁতার শিখতে গিয়ে অনেক ঢোক পানি খাওয়ার পর আস্তে আস্তে সাঁতার শিখে যাওয়া।

একটু বড় হওয়ার পর গ্রামের স্কুলে(ক্লাস ১-৬) ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে দৌড়ের পাল্লা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসা। অসম্ভব ভাল কিছু বন্ধু পাওয়া, যাদের সাথে শীতের সকালে কুয়াশার আঁধার ভেঙ্গে খেজুরের রস খাওয়া মুড়ি দিয়ে, তারপর কাঁপতে কাঁপতে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া। কিংবা রোজার সময় সবাই মিলে নৌকায় বসে মাঝনদীতে ইফতার করা।

তারপর আমার মুক্ত স্বাধীন দিনগুলোর অবসান। ক্যাডেট কলেজে যাওয়া। ২০০৪-১০, ছয় বছর। বন্দীদশার মাঝেও আমার একান্ত কিছু প্রিয় মুহূর্ত এখনো দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আসে। কাউকে বলিনি কখনো হাউজের সামনের কদম গাছটার সাথে আমার কত সখ্যতা ছিল। বর্ষায় ফুলে ফুলে ভরে যেত গাছটা। তারও অনেক দুঃখ ছিল, আমার মত। তার ফুল নিত না কেউ। ফুলগুলো পঁচে গিয়ে গন্ধ বের হত। আমি একটা দুটো নিয়ে আসতাম মাঝে মাঝে। আমার তো আর কেউ ছিল না ফুল দেয়ার মত, যে তাকে গিয়ে “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল” দান করবো। রেখে দিতাম টেবিলের উপর মাথার কাছে আর ভাবতাম একদিন আমিও এই ফুল দান করবো কাউকে।ফুল দেয়া হয়নি কোনদিন কাউকে। সেই গাছটা, তার ফুলগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে।

মন খা-খা করে সেসব পাগলামি ভরা দিনগুলোর জন্য; মন কেমন করে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে একা হাঁটা বিকেল বেলা গুলোর জন্য। কিংবা বৃহস্পতিবার রাতের ঝুম বৃষ্টিগুলো। ঠাণ্ডা, শীত শীত লাগতো। বিছানায় ডাকতো চোখে জড়ানো ঘুম। তবু জেগে থাকতাম জোর করে। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির স্পর্শ নিতাম। রুমমেট বলতো, “তুই শালা একটা আতেল”। আমি কিছু বলতাম না। চুপচাপ বৃষ্টির শব্দ শুনতাম।

কলেজে বিকালের খেলার পর ক্যান্টিনে কাটতো অনেক সময়। খেলার ফলাফল নিয়ে চিল্লাচিল্লি আর কোক-চিপসের সাথে আড্ডা। সেই বন্ধুগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে।

সন্ধ্যায় পড়তে যাওয়া ক্লাসরুমে। হাউজ থেকে ক্লাসরুম খুব বেশী দূরের পথ ছিলনা। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চলে যেত পড়তে যাওয়ার পথে। সেদিনও গিয়েছিলো হঠাৎ। আমি থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সামনে হাজার হাজার মিটি মিটি আলো। নড়েচড়ে, আমার চারদিকে উড়ে বেড়ায়। সেদিনের সেই ছোট জোনাকি গুলো আমাকে যেন তারার দেশে নিয়ে গিয়েছিল। সেই রকম অদ্ভুত আলোর মেলা দেখিনি আর কোন দিন। এখনো লোডশেডিং এর সময় দাঁড়িয়ে থাকি বারান্দায় আর একবার সেই মেলা দেখার আশায়। আমার সাধ আর মিটে না। ক্ষুদ্র, তুচ্ছ সেই জোনাকি গুলোর জন্য এখনো আমার মন কেমন করে।

বন্ধুতা, ভালবাসা ভরা দিনগুলোর জন্য আমার মন কেমন করে।

বড় হয়ে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। এখন অচেনা লোকজন তুমি না বলে আপনি বলে সম্বোধন করে। মাঝে মাঝে মুখে এক সপ্তাহ না কামানো দাড়ি থাকা অবস্থায় কোন অচেনা পিচ্চি হয়তো ভাইয়া না বলে আঙ্কেলই বলে ফেলে। তখন বুঝি আমার সুখের দিন শেষ। দায়িত্ব বাড়ছে, বাড়ছে চাপ- পড়াশোনার, কাজের। কিছুদিন পর হয়তো ঢুকতে হবে কর্মজীবনে।

মন কেমন করা মুহূর্ত গুলো হয়তো বারবার হাতছানি দিবে। জানিনা আমি তার ডাকে সাড়া দিতে পারবো কিনা। হারিয়ে যাবে সেই সময় গুলো, মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়।

এভাবেই আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক কিছু হারিয়ে যায়। আমরা ঘুণাক্ষরেও তা টের পাই না…।

১,০০৪ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “আমার মন কেমন করে……”

মওন্তব্য করুন : নাফিস (২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।