অসমাপ্ত…

ফজরের আজান শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় কাশেম আলীর। অযু করে নামায পড়ে সে। পাশে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তার স্ত্রী আর চারটি ছেলেমেয়ে। কাশেম আলীর তিনটি মেয়ে আর একটি ছেলে। বড় মেয়েটির বয়স সতেরো, ছেলে মানিকের এগার আর বাকি দুই জমজ মেয়ের বয়স সাত বছর। নামায শেষে ডেকে তোলে তার স্ত্রীকে। বলে, “খাইতে দেও, আর মানিকরে ডাইকা তোল”।

ছেলেটির গায়ে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তোলে তার মা। ঘুম ভেঙ্গে উঠে চোখ কচলে অবাক হয়ে তাকায় মানিক। সে কোনদিনও এত সকালে ঘুম থেকে ওঠে না। তার স্কুল শুরু হয় সেই সকাল ১০ টায়, তাই সে সাধারণত ৮টা ৯টার দিকে ঘুম থেকে ওঠে। তার বাপ তাকে বলে, “মানিক উইঠ্যা পর, আইজ না আমাগো ঢাকায় যাওয়ার কতা”।

তখনি সবকিছু মনে পরে যায় মানিকের। সে আর তার বাপ আজকে ঢাকায় যাবে। না ঘুরতে টুরতে না,কাজ করতে।

পাঠক হয়তো ভাবছেন এত ছোট ছেলে কী কাজ করতে যাবে ঢাকায়…

কাশেম আলি কাজ করতে যাবে মাটি আর বালি পরিবহনের ট্রলারে আর মানিক যাবে তার এক মামার কাছে। দুঃসম্পর্কের এক মামা, ফজলু। সে নাকি ঢাকায় কোন এক ভার্সিটির হলের ডাইনিং এ কাজ করে।  সে বলেছে মানিককেও নাকি সে ওই হলের ক্যান্টিনে একটা কাজে লাগিয়ে দেবে।

প্রচন্ড অভাবের সংসার নিরক্ষর কাশেম আলির। বাপ মারা যাওয়ার পর ১০-১২ কাঠা জমি পেয়েছিল বটে। ওগুলো সব দেনার কারণে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। দিন-মজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করছিল সে এতদিন। কিন্তু এই বছরে প্রচন্ড খরার জন্যে লোকজনের ক্ষেতের ধান সব নষ্ট হয়ে গেল। দিন মজুরী ও আর জোটে না। ছয়জনের সংসার চালানো তাই অসম্ভব এখন।

শেষমেশ স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে সেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার গ্রামের আরো অনেকেই ট্রলারে কাজ করে। তাদের মারফত শুনেছে যে এখানে টাকা-পয়সা নাকি মোটামুটি ভালই দেয়, সাথে দেয় থাকার জায়গা।

আর মানিকের জন্যেও চিন্তা নেই। ফজলু তো সবসময় ওকে দেখবেই। সে বলেছে যে ক্যান্টিনের কাজ করলে খাওয়া ও থাকার জায়গা দিবে। আর ওখানকার ছাত্রদের টুকিটাকি কাজকর্ম করে দিলে কিছু টাকা পয়সাও নাকি পাওয়া যায়।

সবকিছু শুনে অনেক কষ্টে রাজি হয় মানিকের মা। মানিকও যেতে রাজি হচ্ছিল না। পরে তার বাপ তাকে বলেছে যে তাকে বেশিদিন ওখানে থাকতে হবে না। শুধু এই মঙ্গার মাসগুলো। খুব বেশি হলে মাস ছয়েক। আর এর মধ্যে তার বাপ তো তার সাথে দেখা করবেই, তাকে বাড়িতেও নিয়ে যাবে দু-একবার। এসব শুনে অবশেষে রাজি হয় মানিক। এছাড়া আরেকটি কারণ ছিলো। তাহলে ফজলু মামা তাকে বলেছে ক্যান্টিনের কাম কাজ শুধু সকালে আর বিকেলে, বাকি সময় নাকি সে ইচ্ছে করলেই শহরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। এই ঘুরে বেড়ানোর লোভেই সে আসলে রাজি হয়।

বাপ-ব্যাটা দুজন খেয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে রওনা দেয়। মানিকের মা খুব কান্নাকাটি করছিলো ওকে জড়িয়ে ধরে। প্রথমে কিছুক্ষণ হাটাপথ তারপর ভ্যানে করে স্টেশনে। এরপর ট্রেনে সরাসরি ঢাকা কমলাপুর। ট্রেনে আসার সময় মায়ের কান্নাভরা মুখের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় মানিকেরও বুকের ভেতর হু-হু করে উঠছিল।

স্টেশন থেকে ফজলু মামা মানিককে নিয়ে আসে তার কর্মস্থলে। দু-একটি গেট পেরিয়ে মানিকের আগমন ঘটে দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটির খুবই পরিচিত একটি হলে।

শুরু হয় তার হল জীবন। ক্যান্টিনের ম্যানেজারের সাথে কথা বলিয়ে দেয় ফজলু। প্রথমদিন বলে তাকে কোন কাজকর্ন করতে হয় না। সেদিন শুধু তাকে বিভিন্ন নিয়ম-কানুন ও আদব-কায়দা শেখানো হয়। যেমন- হলের ছাত্ররা হইল সবকিছু। তাগোর লগে কথা কওনের সময় স্যার কইতে হইবো, তারা যা কয় তা-ই করতে হইবো ইত্যাদি। এছাড়াও ক্যান্টিনের বিভিন্ন কাজ-কর্ম শেখানো হয় তাকে। কিভাবে অর্ডার নিতে হয়, কিভাবে খাবার পরিবেশন করতে হয় আর থালা বাসন পরিষ্কার করতে হয়।

এখানকার জিনিসপত্র কেমন অদ্ভূত লাগে মানিকের। যেমন-ছাত্রদের স্যার বলে ডাকা। সে জানতো যে শুধু স্কুলের মাষ্টারদের স্যার বলে ডাকতে হয়। এইসব ছাত্রদের বয়স তো তার পাড়ার বড়ভাইদের মতো। কিন্তু ওদের স্যার তো কখনোই বলে নি…।

ছাত্রদের কাজ-কর্মগুলোও বেশ আজব। এরা বন্ধুদের একে-অন্যকে মামা বলে ডাকে, আবার সময়-সময় দোস্ত বলে কিংবা নাম ধরেও ডাকে। সে বোঝে না সবাই সবার মামা হয় ক্যামনে।

এদের মধ্যে কেউ কেউ আছে সারাদিন পড়াশোনা করে। আবার কেউ কেউ সারাদিন কম্পিউটারে বইসা থাকে। মানিক এগুলো খেয়াল করে যখন সে বিভিন্ন কাজ-কর্ম করতে এদের রুমে যায়। এদের আচার-আচরণ ও বেশ অদ্ভুত প্রকৃতির। ক্যান্টিনে অর্ডার দেয়ার সময় এরা ক্যান্টিন বয়দের ডাক দেয় বিভিন্ন ভাবে। কেউ বলে, “এই পিচ্চি”, কেউবা নাম ধরে, কেউ কেউ বলে “ওই এদিকে আয়” ইত্যাদি। ‘পিচ্চি’ ডাকটা শুনলে বা কেউ তুই করে বললে মানিকের বেশ খারাপ লাগে। মনে হয় সবাই যেন তাকে অবহেলা করছে। আবার অনেক ছাত্র আছে বেশ ভাল করে কথাবার্তা বলে; কোন কাজ করে দিলে সাথে সাথে কিছু টাকা পয়সাও দেয়।

একটা বিষয় সে খেয়াল করেছে, ছাত্রদের বেশিরভাগই খুব বেশি সিগারেট খায়। আবার ওর মামা বলেছে যে এরা নাকি দেশের সবচেয়ে ভাল ছাত্র। মানিক ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। তার গ্রামের স্কুলের মাস্টার বলছিল যে, ভাল ছেলেরা কোন সময় সিগারেট খায়না, খাইলে নাকি ক্যান্সার হয়। ক্যান্সার কি রোগ তা মানিকের জানা নাই, তবে সে শুনেছে এই রোগ হইলে নাকি মানুষ বাঁচে না।

বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে তার। সেদিন ফজলু মামার মোবাইল দিয়ে মায়ের সাথে কথা বলেছে সে। তার মায়ের অবশ্য মোবাইল নাই, পাশের বাড়ির একজনের মোবাইল দিয়ে কথা বলেছে। মাকে সে বলেছে সে এখানে ভালই আছে; তার থাকা-খাওয়ার কোন সমস্যা নাই। শুনে তার মা একটু আশ্বস্ত হলেও কিছুক্ষন কান্নাকাটি করেছে।

মানিক আসলে খুব বেশি ভাল নাই। ক্যান্টিনে খাওয়া-দাওয়া দেয় মোটামুটি। কোন টাকা দেয় না। তার বেশি কষ্ট হয় রাতে ঘুমানোর সময়। অন্য সব ক্যান্টিন বয়দের সাথে সে ক্যান্টিনের মেঝেতে কাঁথা পেতে শোয়। এখন গরমের সময়, ফ্যানগুলো সব অন থাকলেও বেশ গরম লাগে। তখন বাড়ির কথা, মায়ের কথা মনে পড়ে। মা গরমের সময় রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতো তাকে।

সকালে আর রাতে অসুবিধা বেশি। অনেক সকালে উঠে নাস্তা পরিবেশন করতে হয় আবার কাজ শেষ করে ঘুমাতে হয় অনেক রাতে। রাত প্রায় ২টা পর্যন্ত মাঝে মাঝে কাজ করতে হয়।

সে দেখেছে, হল কখনো ঘুমায় না। কোন কোন ছাত্র সারারাত জেগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলে মোবাইলে। এত কী কথা বলে, কার সাথে বলে এসব তার ছোট, অনভিজ্ঞ মাথায় আসেনা। ওরই মত আরেক ক্যান্টিন বয় হোসেন এর কাছে সে শুনেছে ছাত্ররা নাকি প্রেম করে, তাই সারারাত মোবাইলে কথা কয়।

মানিক অনেক সময় দেখেছে সুন্দর জামা পড়া সুন্দর সুন্দর আপারা ছাত্রদের হলের ভিতরে এসে গেস্ট রুমে বসে থাকে। কেউ কেউ বসে পড়াশুনা করে। বেশিরভাগই  করে গল্প, আর কেউ কেউ ঝগড়া। আপাগুলোর বয়স তার বোনের মতই। তার বোনকে দেখতে তার কাছে ভালই মনে হয় কিন্তু ওই মেয়েগুলো বেশি সুন্দর। সে ভাবে- এরা বড়লোকের মেয়ে, শহরে থাকে, এরা তো সুন্দর হবেই।

মানিক দেখেছে  হলের ছাত্ররা খুব খেতে পছন্দ করে। সে ওদের কথা-বার্তায় বুঝতে পারে  যে এরা মাঝে মাঝেই ভাল হোটেল থেকে খেয়ে আসে। মাসের একদিন হলের ডাইনিং এ বড় রকমের খাওয়া-দাওয়া হয়। ছাত্ররা বলে Feast।  সেইদিন ছাত্ররা সব লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডাইনিং এর সামনে।

মানিক বোঝে না এরা এত ভাল জায়গায় খায় তবে Feast এর দিন এভাবে লাইন দিয়ে থাকে কেন???

Feast এর খাওয়া দেখে অবশ্য মানিকের ও খেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু কি আর করা। ওর কপালে জোটেনা ওইসব খাবার। ওর ভাগ্যটাই যে খারাপ।

একদিন অবশ্য বেশ মজা হয়। হলের কয়েকজন ছাত্র মিলে সব ক্যান্টিন বয়কে খাওয়ায়। পোলাও,মাংস,কোক; বেশ ভাল খাওয়া হয় সেদিন। মানিকের কাছে মনে হয় ছাত্রদের মাঝে এরকম লোকও আছে তাহলে।

হঠাৎ একদিন মানিক শোনে যে ওদেরই এক ক্যান্টিন বয় এক ছাত্রের মোবাইল চুরি করে ধরা পড়ছে। ওরে নাকি কেউ মাইর-ধইর করে নাই। খালি হল থেইকা বাইর করে দিছে।

এরপর থেকে ও খুব সাবধানে থাকে। কোন উল্টা পাল্টা কাজকর্ম করে না। যাতে তাকে কেউ হল থেকে বের না করে দেয়। তাহলে যে তার বাপ সংসার চালাতে পারবে না।

দিন এভাবেই কাটতে থাকে মানিকের। ছাত্রদের কাজ কর্ম করে দেয়। কেউ টাকা দেয়, কেউ দেয় না। ছয় মাস থাকার কথা থাকলেও সে আট-নয় মাস ধরে আছে এখানে। এর মধ্যে আসে নতুন ছাত্র। এক ব্যাচ ছাত্র পাস করে চলে যায়। কিছু দিন পরে মাঝে মাঝে তারা হলে বেড়াতে আসে। মানিকদের সাথে দেখা হয়। তারা হেসে কথা বলে, খোঁজ খবর নেয়। ভালোই লাগে তার।

কত ছাত্র যায়, কত ছাত্র আসে। পড়ে থাকে মানিকেরা। ওদের মধ্যেও কেউ কেউ চলে যায়। নতুন মানিকেরা আসে। পরিবর্তন হয় ওদের অবস্থানের; কিন্তু পরিবর্তন হয় না ওদের অবস্থার, ওদের ভাগ্যের…।

১,২৬৪ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “অসমাপ্ত…”

  1. রেজা শাওন (০১-০৭)

    আরেহ সামি, তুমি তো শিশু ছিলা কয়েকদিন আগেও। তোমার লেখা পড়লেই কলেজের শিশু- সামির চেহারা ভেসে ওঠে।

    তুমি আর শিশু নাই। তোমার এই লেখা অনেক পরিণত। লেখালিখি চালু রেখো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামি(২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।