কিজন্য আমি “বন্ধুবৃত্ত” নাটকের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করেছি

আসসালামু আলাইকুম। আমাকে বোধহয় কমবেশি অনেকেই চেনেন। আমি সালেহ তিয়াস নামেই বেশি পরিচিত, এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করছি।

গত বছর আমি এবং আমার দুই বন্ধু মিলে একটা টিভি নাটক বের করি। এই নাটকে আমার ভূমিকা ছিল অতি নগন্য, কাহিনীর কিছু অংশ লিখেছি, স্ক্রিপ্টের কিছু অংশ লিখেছি, এবং নিরুপায় হয়ে এক অংশে অভিনয়ও করতে হয়েছে। এই নাটকে আমাদের পুরো ব্যাচ থেকে অনেকে অভিনয় করেছিল।

প্রথমত এই নাটক ব্যাচের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। আই রিপিট, বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ঢাকা মেডিকেলের গন্ডি ছাড়িয়ে বাইরের বিভিন্ন সরকারী ও প্রাইভেট মেডিকেলে ছড়িয়ে যায় এর জনপ্রিয়তা। অবশেষে ঈদের দিন চ্যানেল আইতে এই নাটক সম্প্রচারিত হয়। এই নাটক থেকে লোভনীয় অঙ্কের লাভ চলে আসে নাটকের পরিচালকদ্বয়ের পকেটে। সেই টাকা দিয়ে আবার সারা ব্যাচকে খাওয়ানোও হয়। এমনকি পরবর্তী ঈদের জন্য আবার নাটক জমা দেবার তাগিদ দেয়া হয়। ইউটিউবে সম্ভবত এক লাখের উপরে এই নাটকের ভিউ।

এবার শুনুন, কেন আমি এই প্রবন্ধের শিরোনাম এমন দিলাম।

আমার হাত আমার নিজের সৃষ্টি নয়। আমার মায়ের সৃষ্টি নয়। আমার বাবার সৃষ্টি নয়। এটা আল্লাহর সৃষ্টি। একইভাবে আমার পাও আমার নিজের সৃষ্টি নয়। আল্লাহর সৃষ্টি। আমার মস্তিষ্কও আল্লাহর সৃষ্টি। আমার পুরো শরীর আল্লাহর সৃষ্টি। আমার সামাজিক অবস্থান আল্লাহর সৃষ্টি। আমার সম্মান ইজ্জত আল্লাহর সৃষ্টি। আজকে আমি যে পর্যন্ত পৌঁছেছি সব আল্লাহর সৃষ্টি।

যে জমিনের উপর আমি বর্তমানে অবস্থান করছি তা আল্লাহর সৃষ্টি। যে ল্যাপটপে লিখছি তা যেসব জিনিস দিয়ে বানানো হয়েছে সব আল্লাহর সৃষ্টি। সকালে যে পরোটা খেয়েছি সেটা যে আটা থেকে এসেছে তা আল্লাহর সৃষ্টি। খাবার পরে যে পানি খেয়েছি তা হয়তো মাস ছয়েক আগে মেঘ হয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ভিতরে দুর্গম কোন দ্বীপের উপরে ভেসে বেড়াচ্ছিল, ওটা যে কোন ফিল্টারিং ছাড়া, ওয়াসার পাইপলাইন ছাড়া বিশুদ্ধ অবস্থায় আমার নিকট পৌঁছালো সেটাও আল্লাহর সৃষ্টি।

সুতরাং সবই যখন আল্লাহর সৃষ্টি, তাই আল্লাহ যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই এগুলো ব্যবহার করতে হবে। এর অন্যথা হলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আর আল্লাহ নারাজ হলে আপনি দুনিয়াতে যত বড় রাজা বাদশাই হোন না কেন, লাভ নেই। আজকে সব আছে, কালকে ফুস হয়ে যাবে। আজকের ফুলের শয্যা হয়ে যাবে আগুনের চিরস্থায়ী বিছানা।

বিশ্বাস হচ্ছে না? আমারও হত না। মাস দুয়েক আগে একবার ভাবছিলাম, যার টাকাও আছে, পয়সাও আছে, স্ত্রীও আছে, সম্মানও আছে, সামাজিক অবস্থানও আছে, বাড়িও আছে, গাড়িও আছে, তাকে আল্লাহ কিভাবে এক মুহূর্তের মধ্যে ফকির বানাবেন? এও কি সম্ভব? আল্লাহ কি তার বাড়ি ধ্বসিয়ে দেবেন? নাকি সব সম্পত্তিতে আগুন ধরিয়ে দেবেন?

দেন, ইট হ্যাপেন্ড। ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল, একেবারেই ছোট্ট একটা ঘটনা। শুধু আমি বুঝে গেলাম, কিভাবে কালকের রাজা আজকের ফকির হতে পারে।

ঘটনার নায়ক আমার আব্বাজান। আব্বাজানের কি নাই? টাকা আছে। বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। আমার আম্মাজান আছে। দুইটা ছেলে আছে। সম্মান আছে। সুখ আছে। শান্তি আছে। আর কি লাগে?

আমি তখন চিল্লার জন্য বাইরে। আব্বাজানের মনে কষ্ট যে আমি স্বাভাবিক সময়ে ইন্টার্নশিপ শুরু করি নি। তার মনে সুপ্ত আশংকা যে আমি হয়তো মেডিকেল পড়া ছেড়েই দেব। আম্মাজান প্রায় এক বছর ধরে অসুস্থ, মাঝে মাঝে হালকা জ্বর আসে, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের একাধিক ডাক্তার বহু টেস্ট করে ধরতে পারে নি জ্বরের কারণ কি। সিঙ্গাপুরে কেউ বলেছিল অকাল্ট লিম্ফোমা হতে পারে। লিম্ফোমা হলে তো পারমানেন্ট টেনশন, রোগ ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত অন্য ধরণের টেনশন। তো স্বাভাবিকভাবেই এর মধ্যে আমার আব্বাজান-আম্মাজানের সংসারের সুখের অনেকটাই আবর্তিত হচ্ছে আমার ছোট ভাইকে ঘিরে।

সেই ছোট ভাই রিং ঝুলতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে মাথায় আঘাত খেয়ে ড্রাউজি হয়ে গেল। ডিজওরিয়েন্টেড হয়ে গেল। আম্মাজান বাসায় এসে ধাক্কা দেবার দশ মিনিট পর সে কোনোভাবে টলতে টলতে এসে দরজা খুলল। খুলে ভুলে গেল। একটু পরে বলল, দরজা কে খুলে দিল? অতঃপর ঘুমিয়ে গেল। ঘুম আর ভাঙ্গে না। সারা মাথা তার ফোলা। ইন্ট্রা ক্র্যানিয়াল হেমোরেজ নয় তো? ভাবতেও চাই না।

এই ঘটনা আমাকে আম্মাজান ফোন দিয়ে অবহিত করলেন। অনুভব করলাম, আম্মাজানের গলায় কি যেন একটা। এমন কিছু একটা, যা বর্ণনা দেবার ভাষা আমার নেই। আম্মাজানের অনুভূতির কিছু অংশ আমার মধ্যেও চলে এল। আমার তো তখন আল্লাহ ছাড়া দুঃখ শেয়ার করার কেউ নেই। সাথীরা ঘুমিয়ে গেলে আমি নামাজে দাঁড়িয়ে ভাঙ্গা স্বরে বললাম, আল্লাহ, ছোট মানুষ, হয়তো অনেক গুনাহ করেছে, ওর তো দোষ নেই, আমরাই ওকে দ্বীনের শিক্ষা দিতে পারি নি। তুমি ওকে তওবার সুযোগ দাও, আরেকটা চান্স দাও, আরেকটু হায়াত দাও, আমি প্রতিজ্ঞা করছি ওকে তোমার দ্বীনের দায়ী বানিয়েই ছাড়ব। ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছোট ভাইকে নিয়ে আমাদের এবং চাচা ফুপু ইত্যাদি আত্মীয়দের পরিবার খুব শঙ্কার মধ্যে কাটালাম। কখন বিপদ কাটে। কখন সূর্য ওঠে। অবশেষে খবর পাওয়া গেল, বিপদ কেটে গেছে। ব্যস, সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

এখন দেখুন, আল্লাহ যদি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে নিতেন, তাহলে কিন্তু আমার আব্বাজানের এত সুখ, এত প্রতিপত্তি, এত সম্পদ সব ধুলিস্যাত হয়ে যেত। মরুভূমির মধ্যে পিপাসার্ত পথিকের কাছে যেমন এক বস্তা সোনার কোন দাম নেই, কারণ সেটা তো আর গ্লাসে ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে তৃষ্ণা মেটানো যায় না, তেমনই এই সব কিছুই অর্থহীন হয়ে যেত ছোট ভাই হুট করে মারা গেলে। যাদের সন্তানাদি মারা গেছে তারা হয়তো ভালো বুঝবেন।

মূল আলোচনায় ফিরে আসি। এখন আল্লাহ যখন মহান কুরআন পাকে প্রাচীন জাহেলী যুগের মত মহিলাদেরকে নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বের হতে নিষেধ করেছেন, সুতরাং নাটক তৈরির ছুতায় এতগুলো মহিলার সৌন্দর্য হাজার হাজার পুরুষের সামনে উন্মোচিত হওয়া আল্লাহর আদেশের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একইভাবে কুরআন যেখানে নারীদেরকে পরপুরুষের সাথে কোমল এবং আকর্ষণীয় ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করেছে, সেখানে নাটকের ছুতায় নারীর সুললিত কণ্ঠস্বর এতগুলো পুরুষের কর্ণকুহরে পৌঁছানো কুরআনের আদেশের স্পষ্ট খেলাফ। ঠিক একইভাবে কুরআনের এক অংশে যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে মর্মান্তিক শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এখন এই নাটকে যে ছেলে মেয়ে অবাধ বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে, সেটা ইসলামের দৃষ্টিতে অশ্লীলতা ছাড়া আর কিছুই না। কারণ ইসলাম চায় না বেগানা নারী পুরুষ একে অপরকে দেখুক, কথা বলুক, সম্পর্ক করুক, সেটার নাম বন্ধুত্বই হোক আর প্রেমই হোক। আল্লাহ মানুষের জৈবিক চাহিদা মেটানো এবং মানসিক শান্তি পাবার সহজ রাস্তা বৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে করে দিয়েছেন, সরল রাস্তা ফেলে মাটির নিচ দিয়ে গর্ত খুঁড়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর কোন প্রয়োজন নেই। এবং শেষ কথা হচ্ছে, আল্লাহর দূত রাসুল (সা) এর একাধিক হাদিস রয়েছে ছবি সংরক্ষণকারীদের কঠিন শাস্তির ব্যাপারে, সুতরাং ভিডিওর মাধ্যমে এতগুলো মানুষের ছবি সংরক্ষণকেও কোনোভাবেই আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় মনে করার সুযোগ নেই।

এই সমস্ত জিনিস জানার পরে আমি এই সমস্ত নাটকের মোহ হতে দূরে সরে আসি। আলহামদুলিল্লাহ যে চ্যানেল আই থেকে প্রাপ্ত টাকার এক পয়সাও আমাকে ছুঁতে হয় নি। টিভির ৯৯.৯৯% কার্যক্রম যেহেতু আল্লাহর কালাম এবং রাসুলের হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় হারাম, টিভিতে চাকরি করা বা এখান থেকে কোনরূপ উপার্জন করা হারাম। ইসলামের দৃষ্টিতে অশ্লীল নাটক বানিয়ে কামানো টাকা তো আরও বড় হারাম, হারামের বাপ।

হারাম টাকা খেলে কি হয় জানেন? নামাজ কবুল হয় না। রোজা কবুল হয় না। যাকাত কবুল হয় না। হজ কবুল হয় না। কোন দোয়াই কবুল হয় না। ঠিকানা একটাই, সোজা জাহান্নাম।

চিন্তা করুন তো, আপনি সারাজীবন নামাজ পড়লেন, রোজা রাখলেন, হজ করলেন, সমাজসেবা করলেন, মা-বাবাকে দেখলেন, সন্তানদের বড় করলেন, প্রতিষ্ঠিত করলেন, আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করলেন, সত্য কথা বললেন, ঝগড়া-ফ্যাসাদ থেকে দূরে থাকলেন, যেনা ব্যভিচার করলেন না, পরস্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন না, আর একটা লোক সারা জীবনে নামাজ পড়ল না, রোজা রাখল না, হজ করল না, যেনা ব্যভিচারেই জীবন কাটিয়ে দিল, মিথ্যাই বলে গেল শুধু, দুজনের মাঝে কত ফারাক, কত ব্যবধান, অথচ দুজনেই জাহান্নামে গেল। কারণ আপনার টাকা ছিল হারাম। আপনি সুদ খেয়েছেন, ঘুষ খেয়েছেন, সুদের ব্যাংকে চাকরি করে লাখ টাকা কামিয়েছেন, সিনেমায় অভিনয় করে টাকা কামিয়েছেন, আপনি জাল সার্টিফিকেট দিয়ে অযোগ্য হয়েও যোগ্যের পদে বসে চাকরি করেছেন, আপনি বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেছেন, আপনি লটারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন, আপনি গানের সিডি বিক্রি করেছেন, আপনি বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন, আপনি অশ্লীল বই প্রকাশ করে লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

দিন কয়েক আগেও আবার গল্প জমা দেবার অফার পেয়েছিলাম। না করে দিয়েছি। যে লোক কোন খারাপ দিকের পথ দেখাবে সে ঐ পথের সব পথিকের গুনাহের ভাগীদার হবে। আর যে লোক কোন ভালো দিকের পথ দেখাবে, সে ঐ পথের সব পথিকের নেকির ভাগীদার হবে। এতদিন গুনাহের ভাগীদার হয়েছি, এবার আল্লাহ আমাকে সওয়াবের ভাগীদার হবার তাওফিক দান করুন। আমিন।

(লেখক তার স্বাভাবিক অতিরঞ্জনের স্বভাব পুরোপুরি বর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী।)

৭ টি মন্তব্য : “কিজন্য আমি “বন্ধুবৃত্ত” নাটকের সাথে সংশ্লিষ্টতা পরিত্যাগ করেছি”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    কি কারণে বন্ধুবৃত্ত এর সাথে সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করেছো বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয়না। আই গট ইয়োর পয়েন্ট, ভাইয়া। আমি বরং জানতে চাই তোমার মত মানুষ কি করে বা কেন সেখানে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল। একটু খুলে বলবে, প্লিজ?

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    করার মতো কোন মন্তব্য খুজে পেলাম না বলে দুঃখিত।
    সুখপাঠ্য তো নয়ই, ভাবনার কোন খোরাকও পেলাম না।
    অনেকদিন পর সিসিবিতে এসে এসব লিখা দেখে কেবলই হতাশা বাড়ছে।
    আবারো দুঃখিত...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবাবা সাইনী (২০০৬-২০১২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।