আমাদের এন্টোনিও

২০৬৫ সাল……

ভিক্টোরিয়ার আন্তঃপ্রদেশ ক্রিকেট শিল্ডের ফাইনাল ম্যাচ। শেষ বলে দরকার ৪ রান।ব্যাটিংয়ে ভিক্টোরিয়া হিরোজ এর ক্যাপ্টেন গ্রাহাম আর বোলিংয়ে মার্লবরো ইউনাইটেডের বাংলাদেশী বংশদ্ভুত ১৬ বছরের তরুন তুর্কি খালিদ।টান-টান উত্তেজনা। কে জিতবে?? বল করল খালিদ। পুরা স্টেডিয়াম ফেটে পড়ল উল্লাসে।শেষ বলে গ্রাহামের মিডল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দিলো খালিদ। আর তারপর সেই চিরচেনা উদযাপন। ম্যাচ এর পর খালিদের বেস্ট ফ্রেন্ড ফিলিপ এসে বলল, কিরে তুই নাকি ফুটবল পছন্দই করিস না!! তাইলে উইকেট পাওয়ার পর রোনালদো সেলিব্রেশান দিলি যে?? মুহুর্তেই বদলে গেল খালিদ। কি বললি তুই?? রোনালদো?? ওইটা তো মাশরাফির সেলিব্রেশান। আমার ‪#‎পাগলা‬ মাশরাফি।

কিছুদিন পরের কথা, ফিলিপ যখন খালিদের বাসায় বসে মাইক্রবায়োলজী বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিল তখন হঠাত তার চোখ পড়ল লাল-সবুজে মোড়া একটা ডাইরীর দিকে; ওটাতে হাত বাড়াতেই আবার চেচিয়ে উঠল খালিদ; ধরবি না বলছি খবরদার। পরে খালিদ যখন ভিতরের ঘরে নাস্তা আনতে গেল, তখন তাড়াতাড়ি ওই বইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল ফিলিপ। তারপর আর ভাল্লাগছে না বলে বাড়ি চলে এলো।
সন্ধ্যায় মাইক্রবায়োলজীর এক্সপেরিমেন্ট বুঝতে বুঝতে যখন বোরিং লাগছিলো তখন ওই বইটা হাতে নিল ফিলিপ। প্রথম পৃষ্ঠায় একটা ছবি দেখে চোখ আটকে গেল তার। ২৫-২৬ বছরের এক ক্রিকেটারের ছবি। সুঠাম গড়ন; চোখে যেন অজেয় সেনাপতি এন্টোনিওর মত সর্বজয়ী দৃষ্টি। এই চোখ যেন যে কোন মানুষকে নিজের বাধ্য করে তুলতে যথেষ্ট।

২য় পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করল সে……

৫ অক্টোবর ১৯৮৩……..
খুলনা বিভাগের এক অখ্যাত জেলার নাম নড়াইল। এই জেলায়ই জন্ম নেন সুন্দরবনের দেশ বলে খ্যাত বাংলাদেশের সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অনুপ্রেরণাদায়ী ক্রিকেটারটি। নড়াইলের মত এক অখ্যাত শহরকে নিজ গুনে আলোকিত করেছেন “নড়াইল এক্সপ্রেস” বলে খ্যাত এই পেসার। ছোটবেলা থেকেই এক কথার, একরোখা এই ছেলেটিকে সবাই খুব আদর করত। কিন্তু ওই সময় ক্রিকেট খেলা খুব একটা হত না কৌশিকের। পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে আর স্কুল পালিয়ে চিত্রা নদীতে সাতার কাটা এই ছিলো কৌশিকের জীবন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল স্কুল পালানো এই চিত্রা পাড়ের ছেলেটিই আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিষয়ে স্নাতক!! আর, নড়াইল গভ ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হওয়া সুমী আপু তো আজ তার জীবনসঙ্গীনী। যে কিনা এই বীর যোদ্ধাটির প্রতিটি দুঃখ-কষ্টের সময়কার অন্যতম ভরসাদাতা।

যাই হোক,পড়াশোনার চেয়ে ছুটে বেড়ানোই যার প্রিয় ছিলো, সে তো খেলাধুলাকেই আপন করে নিবে। তাই হল; ফুটবলে জেলা দল না থাকায় সুযোগ পেলেন নড়াইল জেলা ক্রিকেট দলে তাও মাত্র ১৫ বছর বয়সে। তারপরি তো শুরু হল সপ্নের সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা আর উথথান পতনের সেই রুপকথা।

______ ২০০১ সাল। অনুর্দ্ধ ১৯ দলে ডাক পেল ১৬ বচরের এক কিশোর; নাম তার কৌশিক। দলের বোলিং কোচ তখন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সাবেক পেসার এন্ডি রবার্টস। এক দেখাতেই তার মনে ধরে গেল কৌশিককে। তার ভিতর যেন খুজে পেলেন নিজেকে। রবার্টসের অনুরোধে কৌশিককে তখনই পাঠানো হল বাংলাদেশ-এ দলে। অবাক করা বিষয় হল, জীবনের একমাত্র বাংলাদেশ-এ দলের হয়ে ম্যাচ খেলার পরই ৮ নভেম্বর ২০০১ সালেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তার মাথায় ওঠে টেস্ট ক্যাপ। অভিষেকেই নিজের করে নেন ৪ উইকেট!!

____ সপ্নপুরন কি এতই সহজ?? এই ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়া পড়ে ফিলিপ, তা নিজেই বুঝতে পারে না সে। ঘুম থেকে উঠে দেখে ১০ টা বাজে। আসলে পড়তে পড়তে কখন যে রাত ৩ টা বেজে গিয়েছিলো তা সে টের ই পায় নাই। হঠাত তার বন্ধু জ্যাসন ফোন করল; ফুটবল খেলতে ডাকছে। ফিলিপ বলল নারে, আজ পারব না। শরীরটা ভালো নেই বলে ফোন রেখে দিল। উদ্দেশ্য, বইটা যে শেষ করতে হবে—-

___________
মাত্র ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপান কৌশিক। তখন বাংলাদেশের অত নাম ডাক নেই। তেস্ট স্ট্যাটাস ই তো পেল কেবল এক বছর আগে!! তাও কৌশিকের আগুন ঝরানো বোলিং বুক কাপিয়ে দিত বিশ্বের নামকরা ব্যাটারদের। যেন একাই জয় করে ফেলবেন যুদ্ধটা।
স্বপ্নপুরনের চেয়ে তা ধরে রাখা বেশি কঠিন তারই যেন এক মোখখম প্রমান কৌশিকের ক্যারিয়ার। ইঞ্জুরির কালো থাবা তাকে বারবার পাঠিয়ে দিয়েছে মাঠের বাইরে। অভিষেকের ১ বছর যেতে না যেতেই ইঞ্জুরি হানা দিল তাকে। ২০০২ সালে পাকিস্তান সিরিজের আগে ব্যাক ইঞ্জুরিতে পরেন তিনি। রিকভারি টাইমে স্কিপিং করতে গিয়ে আবার ইঞ্জুরি। প্রথমবারের মত তাকে বসতে হল শল্যবিদের ছুরির নিচে। এক বছরের মাথায় আবার ইঞ্জুরী। আবারও বসতে হল অপারেশান টেবিলে। সেবার ফিরে এসে হোম সিরিজে ইডিয়ার সাথে তো এক ম্যাচে অল্রাউন্ডারই হয়ে গিয়েছিলেন। ২ উইকেট,২ ক্যাচ, আর ৩১* রান যা পরাজিত দলে থাকা সত্তেও তাকে পাইয়ে দিয়েছিলো ম্যান অব দ্যা ম্যাচের সম্মান। এখনো পর্যন্ত দেশের হয়ে সর্বোচচ স্ট্রাইক রেট(৮৬.৪৪) আর ছক্কার রেকর্ডটা নাকি তারই আছে!! ২০০৫ সালে আবার সেই ইঞ্জুরি। এবার শ্রীলঙ্কা সফরের মাঝে তাকে ফিরে আস্তে হল্র দেশে। অবাক করার মত হলেও সত্যি, এই নিয়ে ৬ষ্ঠ বারের মত ইঞ্জুরির কারনে সিরিজের মাঝে ফিরতে হল তাকে!!

২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরটা কৌশিকের জীবনের অন্যতম স্বরনীয় একটা ঘটনা। সেবারই যে প্রথমবারের মত তার নামের পাশে যুক্ত হয়েছিল অধিনায়ক এবং সেটা পূর্ণমেয়াদে। কিন্তু বাধ সাধল ১ম টেস্টের ৪র্থ দিনটা। বল ডেলিভারি করার সময় আবার সেই ইঞ্জুরী।৫ম দিন তো আর মাঠেই নামা হল না।ক্যারিবিয়ানের তীর থেকে সোজা তাকে পাঠিয়ে দেয়া হল আতলান্তিকের ওপারে; প্রিয় শল্যবিদ ডেভিড ইয়াং এর ছুরির নিচে। জানা গেছে কৌশিককে নাকি ৭ বার বসতে হয়েছিল অপারেশান টেবিলে!! তাও তিনি দমবার পাত্র নন। বারবার ফিরে এসেছেন বীরের বেশে। আহত বাঘ হয়েও লড়াই চালিয়ে গেছেন শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে। তাতে কি?? ইঞ্জুরী যে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু!! ২০১১ সালের কথা কৌশিক কেন কোনো বাংলাদেশীই ভুলতে পারবে না। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ ই যে খেলা হল না তার!! সবাইকে কাদিয়ে নিজে কাদতে কাদতে তিনি সেদিন বলেছিলেন, “আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন, এটা আমার হাতে নেই। কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি হারব না। আমি আবার ফিরে আসব, ইনশাআল্লাহ।

এসব পড়তে পড়তে ভাবছে ফিলিপ, আমি এগুলো কি পড়ছি?? কোন মানুষের জীবন কাহিণী নাকি কোনো ফিল্মি স্টোরী!! যাই হোক, সে চালিয়ে গেলো…………

দেশের মানুষ নাকি আজও গর্ব করে বলে, আমরা হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিনি, কিন্তু কৌশিককে দেখেছি, যে কিনা প্রতিটি বাংলাদেশীর সবচেয়ে বড় প্রেরনার নাম!! তুলনাটা অযৌক্তিক হলেও বাংলাদেশীরা নাকি এতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, এক সময়কার বিশ্বকাপানো, কোটী তরুণীর হৃদয়ে ঝড় তোলা পেসার তাসকিন আহমেদ ও নাকি তারই খুজে পাওয়া রত্ন!!

শুধু খেলোয়াড় হিসেবেই নয় মানুষ হিসেবেও কৌশিক এক অনুপ্রেরনার নাম। তার বাবার মতে যতই কায থাকুক না কেন, পাচ ওয়াক্ত নামায কখনো ছাড়েননি তিনি। তাহাজ্জুদ ও পড়তে দেখা যেত প্রায়ই। বয়সে ছোট কারও সাথে কথা বলার সময় এমন ব্যাবহার করতেন যেন মনে হত নিজের আপন ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলছেন।

বছর ঘুরে এল ২০১৫, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল একটি বছর। বছরের শুরুতেই কৌশিক পেয়ে যান দেশের ওয়ানডে টিমের দায়িত্ব। আর বিশ্ব চেয়ে চেয়ে দেখল নতুন সেনাপতির হাতে এক অজেয় দলের বীরত্বগাথা। ইংলিশদের বধ করে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে ওঠা, পাকিস্তানকে দেশের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ, ইন্ডিয়াকে ২-১ এ সিরিজ হারানো… আরো কত কি!! তখন নাকি দেশের সবচেয়ে প্রচলিত কথা ছিল, “যতদিন গুরুর হাতে দেশ, পথ হারাবে না বাংলাদেশ”।

কিন্তু ফিলিপ বারবার ভাবছে, ইংল্যান্ডকে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ওইরকম একটা নার্ভি ম্যাচে হারিয়ে শেষ আটে ওঠা। এও কি সম্ভব?? তাও এটা নাকি আবার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অম্যতম সেরা অর্জন!! তাহলে সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটা?? তখন তার মনে পড়ে গেল ২০২৩ বিশ্বকাপটা সাব্বির রহমান নামে এক খুনে ব্যাটস্ম্যানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে নিজেদের করে নিয়েছে টাইগাররা। যাই হোক ইউটিউব খুলে ফিলিপ অন করল ইংল্যান্ডকে হারানো সেই ম্যাচের হাইলাইটস। লাস্ট উইকেটটা নেওয়ার পর রুবেলের সেই দৌড়। আর কানে বার বার বাজতে লাগলো “The Bangladeshi Tigers Have Knocked England Lions Out Of The WC 2015”!! তারপর পোস্ট ম্যাচ প্রেজেন্টেশান দেখে তো সে আরও অবাক, দেশের পতাকা মাথায় বেধে আসলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। তার চোখ, দেহের গড়ন সবই ওই ছবির খালোয়াড়টার মতন। কিন্তু নাম যে দেখাচ্ছে “মাশরাফি বিন মর্তুজা”!! এসব ভাবতে ভাবতে পিছন ফিরলো সে, দেখলো তার বন্ধু খালিদ দাড়িয়ে আছে।।

খালিদ তাকে বলল আমি অনেকক্ষন হলো এসেছি, তুই বই পড়ছিলি তাই খেয়াল করিস নি। আর হ্যা, পতাকা বাধা অই মাশরাফিই এই বইয়ের কৌশিক। এটা তো ওর ডাক-নাম। সবাই ওকে মাশরাফি নামেই চেনে। সে আরও বলল, ডঃ ডেভিড ইয়ং বলেছিল, মাশরাফি নাকি ৪০ বছর বয়সেই হুইলচেয়ারে যাবে!!! তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৮৩ বছরের চিরতরুণ মাশরাফি আজও দিব্যি হেটে বেড়াচ্ছে!!

এসব শুনে ফিলিপের চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে শুরু করল। আবেগাপ্লুত ফিলিপ তখনই খালিদকে নিয়ে মেলবোর্ণের সবচেয়ে বড় স্পোর্টস শপে গেল। সেখান থেকে লাল-সবুজের একটা জার্সি কিনে তাতে মাশরাফির নাম লেখালো। আর চিৎকার করে বলল __________________

You are my ‪#‎Inspiration‬, ‪#‎Mashrafee‬…….

I am proud to be a fan of ‪#‎Mad_Mash‬…..

১,১৯২ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “আমাদের এন্টোনিও”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ডঃ ডেভিড ইয়ং বলেছিল, মাশরাফি নাকি ৪০ বছর বয়সেই হুইলচেয়ারে যাবে!!! তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৮৩ বছরের চিরতরুণ মাশরাফি আজও দিব্যি হেটে বেড়াচ্ছে!!

    - বাহহহ !

    জবাব দিন
  2. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
    সে আরও বলল, ডঃ ডেভিড ইয়ং বলেছিল, মাশরাফি নাকি ৪০ বছর বয়সেই হুইলচেয়ারে যাবে!!! তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ৮৩ বছরের চিরতরুণ মাশরাফি আজও দিব্যি হেটে বেড়াচ্ছে!!

    🙂


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম আবদুল্লাহ। প্রথম লেখা বেশ ভাল লাগলো। আশা করি আরো লেখা পাব তোমার কাছ থেকে 🙂

    নামসহ প্রোফাইলের অন্যান্য তথ্যগুলো সময় করে বাংলা করে দিও। আর ব্লগের মত মন্তব্যগুলোও কিন্তু বাংলাতেই করার কথা 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।