জাম্প (Jump)

19320_10200491878566480_299407434_n
“­Which one for you dear?”
একটু অবাক হয়েই উপরে তাকিয়ে দেখি একজন বয়স্কা মহিলা হাতে একটি ক্লিপবোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে। বুঝতে পারিনি আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কিনা।
আসলে অনেক্ষন ধরেই বসে আছি এই অজানা জায়গাতে। একটি বড় রুম। রুমের এক সাইডে একটি বড় টিভি। আর সাথে টিভি দেখার জন্যেই বোধহয় অনেক গুলো চেয়ার রুম জুড়ে গোল করে সাজানো। আমি একা নই, জনা বিশেক অপরিচিত মানুষ আশপাশ জুড়ে। “স্কাইডাইভ স্পেস সেন্টার, ফ্লোরিডা” এর একটি কমন রুম। টিভিতে তাই স্কাইডাইভ এরই কিছু শুট করে রাখা ভিডিও চলছে। এখানে এসছি প্রায় আধা ঘন্টা হচ্ছে। আসার পরই এই রুমে বসতে বলেছিল একজন হাসি মুখে। রুমের সবায় বিদেশী, না বিদেশী বললে মনে হয় ভুল হয়,রুমের সবায় আমেরিকান আমি একাই বিদেশী। আর ভুল এর বালাই না করি সত্যি বলতে, আমি মাসুদ রানার মত এস্পিওনাজ তো নই বা কাজী আনোয়ার হোসেন এর মত চোখ দিয়ে দেখার ইন্টারেস্ট ও আমার নেই; সবাই সাদা আমি বাদে তাই আমার কাছে আমেরিকান।
“Excuse me!” বলতেই মহিলা বললেন “Oh dear! I meant from what height you wanna jump on today. We have 3 options you know I suppose?
“Oh yeah! Me 11000 feet. Will that be okay? Actually I am not sure about which one would be good.”
“Sure! What you do at first read these forms carefully and sign on it. We gonna decide it later okay!”
“That’s fine” বলতেই মহিলা একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন। পরে জেনেছিলাম তার নাম ক্রিস্টিনা, সংক্ষেপে ক্রিস।
ফর্ম গুলো হাতে নিয়ে প্রথম টা পড়া শুরু করতে গিয়ে দেখলাম লেখা আছে “Rules before the amazing experience of Skydiving.” কেমন বুক টা ভারি হয়ে এলো। অবশেষে একটু পর আমি স্কাইডাইভিং করতে যাচ্ছি।
সাত দিনের একটা অফিসিয়াল ট্রেনিং এ আমার আমেরিকায় আসা। আজ দশম দিন, কেননা সাথে করে আমি আরও ১৪ দিন এর একটা ছুটিও আদায় করে নিয়েছিলাম। আমার প্রথম দেশ থেকে এত দূরে আসা। তাই আসার আগে থেকেই বেশ নার্ভাস ছিলাম। এই ৯ দিন এর অভিজ্ঞতা বলতে গেলে এক কথায় Awesome. মানুষজন থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট সব ই নতুন। আমি এই দেশে সব কিছুর ই একজন পর্যটক। এখানে আসার আগে থেকেই মাথায় একটা চিন্তা খেলা করছিলো। নিজের প্রথম এডভেঞ্চার কে কিভাবে স্মরণীয় করে রাখা যায়, সেই চিন্তা। স্মরণীয় বললে কমই হয়, কারন আমি এমন কিছু করে যেতে চাইছিলাম যা কেও করেনি বা খুব কমই করেছে এর আগে, something grand. সেই ইচ্ছা পুরনের জন্য NASA ভ্রমণ, বাঞ্জি জাম্পিং থেকে শুরু করে রোমহর্ষক অনেক কিছুই করা হয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো অন্য এক গল্পের অংশ। এত কিছু করেও কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো, কি যেন হচ্ছে না। তারই ফলস্রুতিতে আজ আমার এখানে অবস্থান। যেই কোম্পানিতে ট্রেনিং এ এসেছিলাম তারই এক এমপ্লয়ি, Cyras. আমার মতই সে তার গ্রুপ এর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। ওর সাথে কথা বলে জেনেছিলাম যে সে এক্স প্যারাট্রুপার। আগে বলা রোমহর্ষক কান্ড গুলোর বেশীরভাগ ই তার সাথেই করা। ট্রেনিং শেষে বিদায় নিতে যাবার সময় সে বলেছিল,
“Hey buddy, why don’t you skydive here beside NASA if you are looking for adventure?”
তারপর! আর কি যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম। Cyras আমার চেহারা দেখেই বুঝে গিয়েছিল কি করতে চাই। ও নিজেই আগ্রহ নিয়ে আমার সব বুকিং এর ব্যবস্থা করে দেয়। নবম দিনে ট্রেনিং শেষ করেই Orlando চলে আসা, আর এখন আমি এখানে।
৫ পাতার কাগজপত্র গুলো নিয়ে কিছুদুর পড়লাম। কিসের যেন সব ইনস্যুরেন্স এর কথা বার্তা লেখা আছে। একটু পর পর আমার সাইন চেয়েছে। একটু আগে অন্যান্য দের দেখছিলাম কি কি সব লিখেই যাচ্ছে। এখন বুঝলাম তারা শুধু সাইনই করছিলো। আইনি ব্যাপার স্যাপার এমনিতেই মাথায় আসে না তার উপর আবার বিদেশী আইন; পড়ার কষ্ট না করে সাইন করা শুরু করলাম। বেঁচে থাকলে তো হইসেই আর না হলেও এই সাইনে কোন লাভ তো আসবে না।
সাইন শেষ কেও নিতে আসছে না । তাই আমি উঠে এগিয়ে গেলাম ফাইলটা জমা দিতে। ক্রিস কে না পেয়ে আর একজন মহিলা ছিলেন ডেস্কে তাকে জমা দিতেই তিনি বললেন, “11 or 15 ?”
কি বলে! আমি তো সাজেশন চেয়েছিলাম। কিন্ত ক্রিস তো নেই। আমি বললাম “ how much for 15 and how much for 11?”
“199$ &168$, do you want video with you? Its 159$ for ultimate and 99$ for normal.”
“যে কোন কিছুই তো হতে পারে। অঘটন ঘটলে একটু উপর থেকে মরি”; এই কথা আগেই একবার মনে হয়েছিল। এখন সাথে যোগ হল আল্টিমেট ভিডিও থাকলেও তো খারাপ হয়না। যা আছে ভাগ্যে!
“Me 15000 ft with ultimate video Mam” বলে ফেলে বুঝি বাঁচলাম, আর কোন ডিসিশন নেয়া লাগবে না ।
“Take this card, your no is 16 here. Give this card to the diver when your no is called on mike. Now go inside the airport, Have a nice experience”.
ধন্যবাদ জানিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে সামনে এগুলাম। একটা দরজার সামনে বোর্ড এ কাস্টমার লিখা। ভেতরে ঢুকে দেখি বাইরে চলে এসছি, ঠিক বাইরে নয়। রানওয়ে র পাশে ডাইভিং হ্যাঙ্গার।

পুরো দৃশ্যটাই নতুন আমার কাছে। এক পাশে অনেক জায়গা জুড়ে ১০ জন এর মত লোক প্যারাসুট ভাঁজ করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। এত আস্তে আস্তে ভাঁজ করছে আমি অবাকই হলাম। এত আস্তে তো আমি ভাঁজ খুলে যাওয়া আমার নতুন শার্ট, যেটা কিনা কোন পার্টিতে পড়তে হবে রাতে সেটাও করিনা। পড়ে জেনেছিলাম, যারা ভাঁজ করছিলো তারাই ডাইভার। নিজের ভাঁজ করা প্যারাসুট এই জাম্প দিতে হবে তাই খুব যত্নের সাথে ভাঁজ করে তারা। একটু ভুল যে নিজের শেষ ভুল হয়ে দাঁড়াবে। হাঙ্গার এর বাইরের দিকে কিছু মানুষ গ্যালারির মত কিছু চেয়ারে বসে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম সব দর্শক, মানে যারা এডভেঞ্চার এর নেশায় টাকা খরচ করতে এসছে তাদের পরিবার অথবা বন্ধুবান্ধব আর কি। কি করব বুঝতে না পেরে ঐখানেই গিয়ে বসলাম। পাশে রানওয়ে তে একটা প্লেন দাঁড়িয়ে আছে। পড়ে অনেকবার ভেবেছি প্লেন এর মডেল নাম্বার বা কোন কিছু কেন জেনে নেইনি ভাল করে। আসলে প্রয়োজনের বাইরের কিছু জানার প্রতি উদাসীনতা টা প্রায় ই ভোগায়।

“Sakib right? I was looking for you the whole time” ক্রিস এর পরিচিত গলা শুনে সচেতন হলাম।
“oh hi, feelings mutual” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কেননা এত জনের মাঝে শুধু তার সাথেই কোন কথোপকথন হয়েছে আমার। এর মধ্যে প্রায় ১ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। মাইকে ১৬ নাম্বার এর ডাক এগিয়ে গিয়েছিলাম। নিক নামের এক ভদ্রলোক অনেক কিছু ব্রিফ করেছে। বলেছে আমাদের জাম্প থার্ড ফ্লাইটে। তাই এখন বাকিদের সাথে চুপচাপ বসে আছি গ্যালারিতে। এর মধ্যে আমার ভাইকে কল দিয়েছিলাম। তাকে জাম্প এর কথা আগেই বলেছিলাম। বাসার আর কাউকে জানানোর ইচ্ছা করেনি, কেননা অনেক না করবে। আমার যমজ ভাই লাবিব, তাই এডভেঞ্চার এর বিষয়ে আমাদের দুজনেরই একই উচ্ছাস। লাবিব খুব এক্সাইটেড ছিল। ওকে দোয়া করতে বলে দুই ফ্রেন্ড কেও কল করেছিলাম। ব্যাটারা শুধু বলেছিল “মরিসনা”।
“So you are visiting here, isn’t it? I saw you are from Bangladesh.” ক্রিস পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।
“Yap, you know about Bangladesh”
“Yes, very little, I just heard people around there has to marry the one girl they date!”
এত নিস্পাপ ভাবে জিজ্ঞেস করল, তুচ্ছতার কিছু পেলাম না তাই হাসি দিয়ে বললাম, “Not like that but kinda. You heard only this!”
“Sorry, don’t be offended please. Actually we have our branch in Nepal only, don’t know much about that side. So what do you do there?”
আমি আর্মির কথা বলতেই অবাক হয়ে সে বাকিদের উদ্দেশ্য করে জোরে বলে উঠল যে আমি বাংলাদেশ আর্মিতে আছি, এখানে জাম্প করতে এসছি। একটা গুঞ্জন দেখলাম আমার মত যারা জাম্পার আর তাদের পরিচিত দের মধ্যে। ক্রিস এলমেলো কিছু কথা বার্তা বলে চলে গেলো। কিন্তু আমার শুরু হল ব্যস্ত সময়। হোক অন্য দেশের, সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি আমেরিকানদের অনেক শ্রদ্ধা। এর আগেও দেখেছি এই কয়দিনে। এখানেও ব্যতিক্রম হলনা। অনেকেই বেশ ইন্টারেস্ট নিয়ে কথা বলতে আসলো। হাজার ধরনের প্রশ্ন। আমার অনেকের মাঝে একা থাকার সময় বুঝি শেষ হল অবশেষে। ভালই লাগছিল। টের পেলাম নার্ভাস ভাবটা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। যারা প্রথম বার এর মত জাম্প দিতে এসছে সবার সাথে পরিচিত হলাম। এর মধ্যে একটা পুরো ফ্যামিলিই ছিল যেখানে দুই যমজ ভাইয়ের জন্মদিন পালন করতে তারা সবাই জাম্প দিতে এসছে। সবারই সাথে ফ্রেন্ড কিম্বা ফ্যামিলি আছে দেখতে এসছে। আর একটা মেয়ের সাথে কথা হল আমার বয়সীই হবে। আগেই দেখেছিলাম যে ওর সাথে শুধু কেও ছিলোনা। বাড়িতে কেও রাজি হবে না বলে একা একাই চলে এসছে। একই ফ্লাইটে আমরা। প্রথম দুই ফ্লাইটের জাম্প দেখতে দেখতে বাকি টাইম Charlotte এর সাথেই কথা বলে কাটিয়ে দিলাম। জাম্প শেষে বেঁচে থাকার সেলিব্রেট ও করেছিলাম একসাথে যেহেতু আর কেও ছিল না আমাদের কারো সাথে। নিক এর ডাক শুনে বুঝলাম সময় আগত।
বেল্টটা টাইট করে আগে শেখানো কিছু হ্যান্ড সিগনাল দেখালো নিক। আমরা ৫ জন জাম্প দিব এই ফ্লাইটে। সাথে আমাদের জাম্প মাস্টার আর যারা ভিডিও চেয়েছে তাদের ক্যামেরাম্যান। প্লেন চালু অবস্থাতেই আছে। আমরা লাইন ধরে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলাম প্লেন এর দিকে। অন্যান্য দের মত আমাদের কেও দর্শক রা চিৎকার করে আর শিশ দিয়ে বিদায় জানালো। অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছি। তাকিয়ে দেখলাম হাতের লোম গুলো দাঁড়িয়ে গেছে। অবশেষে একটা ইচ্ছা পুরন হতে চলেছে।
“কোন বিপদ হবে কে জানে? আরে বিপদের কি আছে, বাকিরা তো দিলই দেখলাম। জাম্প শেষ করে ভিডিওটা দেখতে হবে কেমন এসছে, আম্মুকে একটা ফোন দিলেও হত, ধুর ইন্টারভিউটা রিটেক করতে গিয়ে শর্ট হয়ে গেছে, ভিডিওটার শুরুটা ভাল হবে না, আবহাওয়া ভাল না বলছিল ঠিক থাকবত! বিয়ে করে আস্লেই পারতাম, যদি মারা যাই! প্যারাসুট যদি না খুলে? অত উপর থেকে পরতে কেমন ব্যথা লাগতে পারে! আচ্ছা না খুল্লেও তো পাশের সমুদ্রেও তো পরতে পারি, সাতার তো জানিই। এখানে নাকি হাঙ্গর আছে পানিতে!”
পাইলট এর বাড়িয়ে দেয়া হাতে একটা হাইফাইভ দিয়ে এই সব হাজার ধরনের উল্টা পাল্টা কথা ভাবতে ভাবতে প্লেন এর সিড়ি বেয়ে উঠলাম। আমার সিটটা সবার সামনে। আমিই যে প্রথম জাম্পার…

প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। মনে হল কে যেন গলা দিয়ে বরফ ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। প্লেন এর চারদিক তাকিয়ে দেখলাম। পাশে নিক এর সাথে চখাচখি হতেই একটা থাম্বস আপ দেখাল। আমি হাসি দিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম। প্রথমবার যারা জাম্প করতে যাচ্ছে তাদের মধ্যে দেখি আমার অবস্থাই ভাল। একদম পিছনে এক মহিলা, সেই যমজ ভাইদের মা । বুকে ক্রস এর পর ক্রস টেনে যাচ্ছেন, বুঝলাম খ্রিস্টান। সামনে আর এক লোক আমার বয়সীই হবে কিন্তু অল্প বয়সেই চুল পড়ে গেছে; আর এখন মনে হচ্ছে কেও যেন স্ট্র বসিয়ে তার মুখের সব রক্ত খেয়ে ফেলেছে। সামনে একজন কালো করে দেখতে ছেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। ওর পা কাঁপছে আর হাটুর উপর অনবরত তুবুরি বাজিয়ে চলেছে। আমার ঠিক পিছনেই Charlotte চোখ বন্ধ করে আছে। আমাকে বলছিল প্লেন রানিং অবস্থায় থাকলে নাকি ভয় পায়। আমার হাসি পেল আমি আর কি ভয় পাব, প্লেন এ চরলাম ই ৪ না ৫ বারের মত। বাকি যারা জাম্প মাষ্টার আর ক্যামেরাম্যান রা আছে তারা নিতান্তই স্বাভাবিক। প্লেন অলরেডি চলা শুরু করেছে, প্রচুর শব্দ হচ্ছে। কিন্তু কান ফাটা শব্দের মদ্ধেও যেন অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।

আয়াতুল কুরসি পড়লাম, যা আমি সব কাজের আগেই পড়ার চেস্টা করি। Charlotte ডেকে ইশারায় বেস্ট অফ লাক জানালো। প্লেনের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম প্লেন অলরেডি টেক অফ করেছে। সামনে ছোট দরজার পাশেই দুইটা লাইট, একটা গ্রিন আর একটা রেড। রেডটা জ্বলে আছে এখন। নিক বলেছিল যে সবুজ বাত্তি জ্বলার মানে হল আমাদের জাম্প এর সময় হয়েছে।
জানালা দিয়ে নিচের এয়ারপোর্ট, সাথে পাশের বাড়িঘর গুলো ছোট হয়ে আসতে দেখলাম। দুরের NASA র বিল্ডিং টা দেখা যাচ্ছে। সাথে সাথেই তিন দিকের সীমাহীন সমুদ্র। কিছু পরেই সমুদ্র আর টিটাসভিল শহরের চিহ্ন মুছে আমরা মেঘের উপরে চলে আসলাম। এ এক আরেক দুনিয়া। আমরা যেন কোন স্তর ভেদ করে সাদা এক পৃথিবীতে চলে এসছি যেখানে আমাদের প্লেনটা ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। মনটা হাল্কা হয়ে এলো। মাথা থেকে যেন একরাশ চিন্তা মুছে গেলো। এই মেঘের রাশিমালা ভেদ করেই একটু পর নিচে যাব। টেনশন ছেড়ে বুঝি এক্সাইটমেন্ট ভর করল আমাকে। মনে হল এভাবেই আরও কিছুক্ষন উড়ি। কারন জাম্প দিলেই তো খুব জলদি নিচে চলে যাব। এন্দ্রালিন রাশ না কি যেন বলে এটাকে, আমি যখন তার তুঙ্গে, নিক এর হাতের গুঁতোয় সামনে তাকিয়ে দেখি সবুজ বাতি জ্বলে গেছে। প্লেনের দরজাটা খুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
আমার ক্যামেরাম্যান জাম্পার, নাম হজ দরজার সামনে গিয়ে আমাকে ইশারা করতে আমি এগিয়ে যেতে থাকলাম দজার দিকে, সাথে নিক। প্রবল বাতাসের ঝাঁপটা লাগতেই, হঠাত করে কে যেন আমার হৃৎপিণ্ডটাকে হাত মুঠো করে চেপে ধরল। “I am gonna jump now, from 15000 ft :o”। এর আগে জাম্প করেছিলাম হেলিকপ্টার থেকে ৫০ না কত ফিট থেকে যেন ভুলে গেছি তাও পিছন ফিরে দড়ি ছিল সাথে। আর এখন প্লেন এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি কোন দড়ি নেই, আমার আর নিকের সাথে একটা প্যারাসুট আর নিচে সীমাহীন মেঘ, শুধু সাদা আর সাদা। বিশ্বাসই হচ্ছিল না নিচের সাদা যা দেখা যাচ্ছে তার সাথে বারি খেতে হবে না ভেদ করে চলে যাব নিচে। এর আগে অনেকের কাছে শুনে ছিলাম যে জাম্প দিতে গিয়ে নাকি প্রথমবার বেশিরভাগই নাকি পিছিয়ে আশে জাম্প দিতে চায় না। তখনি ঠিক করেছিলাম কোনদিন যদি সুযোগ আসে আমি একটুর জন্যাও পিছপা হব না। সেই প্রতিজ্ঞা রাখতেই বুঝি, নিক এর সিগনাল পাওয়া মাত্রই সামনের দিকে গা ভাসিয়ে দিলাম।

প্রথম কয় সেকেন্ড কি হল হুশ ছিল না মনে হয়। পাশে ক্যামেরা হাতে হজ এর কথায় ওর দিকে তাকালাম “ Enjoy Buddy”
হাসতে চেয়েছিলাম কিন্তু প্রবল বাতাসে হাসিটা কেমন হল বুঝলাম না। চারপাশ তাকিয়ে দেখলাম। আমরা তিনজন ছাড়া আর কিছু নেই সবই মেঘে ঘেরা আর আমরা নিচের দিকে ছুটে চলেছি। ছুটে চলা বললে ভুল হবে যেন “we are flying in the sky”। হজ এর সাথে চোখাচোখি হতেই দুজন গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়ে উঠলাম। না চিৎকারটা ভয়ের ছিল না, ছিল সীমাহীন আনন্দের। নিক ইশারা করল ওর হাতের ছোট ক্যামেরার দিকে তাকাতে। আমি আর একটা উল্লাস ভরা চিৎকার দিয়ে উঠলাম। অদ্ভুত অনুভূতি। মেঘ গুলো ঘেঁসে নিচে নামছি আর কেমন যেন শীতলতায় হাত যেন জমে যাচ্ছে। মেঘ পার হতেই আমার ঠিক আগের মত স্বাভাবিক। হজ একটু দূরে চলে গিয়েছিল আবার আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল। স্কাই ডাইভারদের ভিডিও গুলোতে যেভাবে দেখেছি হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে নামে ঠিক সেভাবেই কিছুদুর নামলাম। হজ ইশারা করল ওর পা ধরে ডিকবাজি খাওয়াতে, তাইই করলাম। অভাবনীয় দক্ষতায় ডিকবাজি খেয়ে কিছু দূর চলে গিয়ে আবার এসে আমার হাত ধরল। একটু আগের ভয় যে কোথায় উড়াল দিয়েছে আল্লাহ জানেন। অন্যদের কি হয় জানিনা আমি ঐ কটি মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ দের এক জনই ছিলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি মেঘ কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। নিচের পৃথিবী টাকে ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে। ঐ দ্রুত চলে যেতে থাকা সময়ের মধ্যেই অদ্ভুত হাহাকার বেরিয়ে এলো আমার মন থেকে “ ঈশ!! শেষ হয়ে যাচ্ছে, চলে আসছি প্রায়।
হজ এর দিকে তাকালাম। ও একটা স্যালুট দেখিয়ে আমার হাতটা ছেড়ে দিল। নিক এর ইশারায় প্যারাসুট খোলার রিং ধরে হ্যাঁচকা টান দিলাম। এক প্যারাসুট এর সাথে আমি আর নিক যেন থেমে গেলাম মাঝ আকাশে। প্যারাসুট না খোলার অঘটন এর কথা মনেই ছিল না। আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। হজ আস্তে আস্তে নিচে কোথায় হারিয়ে গেলো। ও আরও পরে প্যরাসুট খুলবে। বলে রাখি ক্যামেরাম্যানরা আরও দক্ষ ডাইভার। নিচে থেকে দেখেছিলাম যে ওরা কত স্পীডে গিয়ে প্যারাসুট এর রিং টান দিয়ে মাটির এক দের গজ আগে গিয়ে স্থির হয়ে যায় আর আস্তে করে পা মাটিতে রাখে। দেখার মত দৃশ্য।
“How are you feeling?” প্যারাসুট স্বাভাবিক হতেই নিক এর গলা শুনলাম উপর থেকে।
“Awesome” বলে যত জোরে চিৎকার করে উঠেছিলাম মাত্র এক শ্রোতার সামনে, এখন পর্যন্ত মনে হয় এত জোরে চিৎকার করিনি।
“What’s the one thing you want now?”
“To go back and jump again” বলতেই নিক হেসে উঠল। “I wanted the same thing, right at this moment on my first jump buddy. Enjoy the country view”
একটু সময় যেতেই বুঝলাম প্যরাসুট খোলার পর আমরা মোটেও ধীর হয়ে যাইনি। ডাইভ এর স্পীড এত বেশি ছিল যে বুঝতেই পারিনি প্রথমে। নিচে পুরো NASA র এরিয়াটা পুরোটা দেখা যাচ্ছে। নিচের ভূখণ্ড ধীরে ধীরে বড় হতে চলেছে। একবার মনে হল গ্যালিলিও না সক্রেটিস কাকে যেন মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল; ঐ সময়ের কাওকে এই খান থেকে পৃথিবীটাকে দেখাতে পারলে বুঝি ওর আর ফাঁসি হত না। পৃথিবী যে সত্যি গোল। নিকের কথায় প্যারাসুট এর ডান রিংটা টেনে ধরতেই আমাদের নিচে নামার গতি বেড়ে গেলো। বাতাস কেটে নিচে নামার শো শো শব্দ হচ্ছিল। ঠিক যেমন কাগজের প্লেন এর মাপকাঠি ঠিক মত না হলে ঘুরতে ঘুরতে নামে সেভাবেই নামছিলাম আমরা। এত গতি ছিল যে একবার মনে হল প্যারাসুট খুলে পড়ে যাচ্ছি নাকি। হাত ছেড়ে দিয়ে আবার স্লো হয়ে গেলাম। একবার উপরে তাকিয়ে প্যারাসুট টাকে দেখলাম। সাথে অনেক দূরে উপরে আমার পরের জাম্পার দেরও দেখা যাচ্ছিল। যতক্ষনে নিচে তাকিয়েছি আমাদের ল্যান্ডমার্ক এয়ারফিল্ড এর চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
“Thanks man, It was great” নিক কে বলতেই ও বলল “My pleasure, man”
2008_10200491884086618_410175055_n
530757_10200491882686583_1671688310_n
যেখান থেকে উড়েছিলাম প্লেন এ করে, সেই ভুমির দিকে এগিয়ে চলেছি। অথচ এই মাটি এখন আমার কাছে অবাঞ্ছিত। চাইছি আরও কিছুক্ষন উড়তে। সাদা মেঘের উপরের দুনিয়াটাকে আরও একবার উড়ন্ত অবস্থায় নিচে নামতে নামতে দেখতে। সীমাহীনতা কে আর একবার গিয়ে উপলব্ধি করতে। চাই মেঘের মধ্যে দিয়ে নেমে আসার শীতলতাকে অনুভব করতে। আর একবার নিজেকে সবচেয়ে সুখি ভাবতে; কিন্তু হায়! পৃথিবীটা যে এগিয়ে আসছে আমার দিকে নিষ্ঠুর হয়ে।
বেশ কয়েকশ মিটার উপর থেকে দেখলাম নিচে হজ দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আমাদের দিকে। নিক আমাকে ল্যান্ড করার সিস্টেম সম্পর্কে কিছু বলতে বলতেই মাটিতে পা রাখলাম একটি অভূতপূর্ব, অভাবনীয়, Unbelievable এডভেঞ্চার শেষে। নিচে নেমেই প্যারাসুট খোলার দৌড়। তারপর হজ আর নিক এর সাথে হাইফাইভ। এর মধ্যে বাকি জাম্পার রা নেমে যাওয়ার পর তাদের সাথে আনন্দ, যাদুর ঝাপ্পি আর উল্লাস।
হ্যাঙ্গার এর দিকে আসতে আসতে নিক কে বললাম,
“One jump can’t make anyone satisfied man. I wanna jump some more, can’t help it”
“ Of course not, that’s how I started. Came to jump for fun with friends for the first time & you see now its thousands.” আবেগপূর্ণ পরিতৃপ্তির ভাষায় বলল নিক।

এই ছিল আমার প্রথম স্কাই ডাইভিং এর অভিজ্ঞতা, কিন্তু অনুভূতি যা ছিল তা অবর্ণনীয়। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নিক এর সাথে কথা শেষে হ্যাঙ্গার এ ফিরতে ফিরতে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল বার বার। ভাই, বন্ধু বা কেও যদি এখন সাথে থাকতো! এমন কেও যার সাথে সেই মুহূর্তের অবর্ণনীয় আনন্দটাকে পরিপূর্ণ ভাবে শেয়ার করতে পারতাম। সুখময় দীর্ঘশ্বাস…।

১১ টি মন্তব্য : “জাম্প (Jump)”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    উফ চরম লাগলো! চরম! জাম্প করার অভিজ্ঞতা লিখে বোঝানো সম্ভব না কিন্তু পড়ে ঠিকই চারপাশের পরিবেশ ও আবহাওয়ার আমেজ পেলাম! :hatsoff:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদুল (২০০০-০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।