যান্ত্রিক গোলযোগ আর নবীনত্বের মৃত্যু

হাসানের সাথে বেরিয়েছিলাম। বিকাল বেলা, আকাশ মেঘলা, হু হু বাতাস, ঝড় আসছে বলে। প্রথম চিন্তাটাই ছিল যান্ত্রিক। পকেটে মোবাইল আছে ভেজানো যাবে না। সাথে বাইক ছিল। ঝড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, ভিজে ঠাণ্ডা লাগতে পারত, এমনকি যেভাবে দুরে-অদূরে বাজ পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো; মাথায় বাজ পড়ার ভয় করাও অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ঐ যে বললাম! ১ম চিন্তা- পকেটের মোবাইল ভেজানো যাবে না।

ছেলে বেলা থেকেই আমাদের রাজশাহীর এই ৫-৬ জন মিলে যে ফ্রেন্ড সার্কেলটা আছে, সবাই বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসি। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত যখন ই বৃষ্টি হোক আমরা ঘর ছাড়া হয়ে যেতাম। কত বর্ষা এলো গেলো; আমরা বৃষ্টি ভেজা গায়ের কাপড় গায়েই শুকিয়েছি। ভেজা গায়ে বৃষ্টি যখন বেশি সময় ধরে চলত বা বৃষ্টির পর যখন বাতাস শুরু হত, কি এক অদ্ভুত কারণে সেই শীতের কাঁপুনিটা না আসলে বুঝি আমাদের বৃষ্টি ভেজার আনন্দ পুরো হতো না। ছেলে বেলা মানে বিশেষ করে টিন এজ বয়সটাতে কখনো ভাবতে হয়নি যে বৃষ্টি আসছে আশ্রয় নিতে হবে।

কিন্তু সময় পার হয়ে গেছে। নতুন প্রযুক্তির সময়। আমরা আধুনিক হয়ে গেছি। পকেটে মোবাইল, কাঁধে ল্যাপটপ নিয়ে ঘুড়ি। সেদিন হাসানের সাথে বেরিয়ে এমনই এক ঝড় বৃষ্টির মুহূর্তে আমরা কত বদলে যাচ্ছি সেই চিন্তাই আসল মাথাতে।

ঝড় আসতেই রাস্তার পাশের এক চা দোকান থেকে একটা পলিথিন নিয়ে মোবাইল এর বডিগার্ড হওয়ার বিনা মূল্যের চাকরি করা হয়ে গেলো আমাদের। যখন ঝড় এর সাথে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল আমাদের আশ্রয়টা বিশেষ সাহায্য করতে পারছিল না। পুরোপুরি ভিজে গিয়েছিলাম। এক অদ্ভুত আনন্দ এসেছিল মনে। খুব ভাল লাগছিল। সেই আনন্দ প্রকাশের জন্য আমার এই লেখা নয়। সেই আনন্দের মাঝে বুকের কোথায় যেন একটা চাপা দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ নিয়ে লেখা।

সেই দুঃখ ছিল, আমাদের আনন্দ গুলোকে বেশি রকমের জটিল করে ফেলার আক্ষেপ। এক সময় আমরা সাধারণ বৃষ্টিতে ভিজে যে অসাধারণ যে সুখ পেতাম, এখন সারাদিন কম্পিউটার, টিভির সামনে বসেও পাইনা। মেজাজ খারাপ করে বসে থাকি। কারণটা আরও হাস্যকর- বৃষ্টি হলে যে কারেন্ট চলে যায়! আমাদের সিনেমা-খেলা-টিভি প্রোগ্রাম মিস হয়ে যায়। এক সময় কিছু না ভেবেই বৃষ্টি হলে বাইরে বেরিয়ে পরতাম আর এখন আগে মোবাইল ভিজে যাবে তাই ভাবি। বিনা মূল্যের বৃষ্টি ভেজার অকৃত্রিম আনন্দ ছেড়ে আমরা এখন ভাবি ঘরে বসে মুভি দেখলেই পারতাম। আমরা যন্ত্র আবিষ্কার করে আমাদের কাজ কমাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু এই যন্ত্র যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই যান্ত্রিক গোলযোগের সৃষ্টি করছে আমাদের কোন আপত্তি নেই।

“জয়যাত্রা”র অগ্রপথিক “নবীন” হয়ে আমরা এমন কিছু অর্জন করেছি যে; দুরন্ত পথিকের “প্রবীণ” এর বেশ স্বেচ্ছায় ধারণ করেছি। আমরা তাও এটা অনুভব করতে পারছি যে কি থেকে কি হয়েছি, কি পেতে কি মিস করছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো হয়ত এটাও জানবে না যে, বৃষ্টিতে ভেজার কি আনন্দ। বুঝবে না বৃষ্টি ভেজা দিনে সব কিছু তুচ্ছ করে রাস্তায় রাস্তায় বৃষ্টিতে ভিজে ঘুরে বেরানর আনন্দ। বিশুদ্ধ বৃষ্টির পানি শরীরে নির্দ্বিধায় বরণ করে নেয়ার সুখএন

আমরা তো তাও নবীন থেকে প্রবীণ হচ্ছি, কিন্তু আগামী প্রজন্মকে দিয়ে যাচ্ছি দুনিয়াময় প্রবীণত্ব। যত যন্ত্রের আবিষ্কার তত যান্ত্রিক গোলযোগ আর নবীনত্বের মৃত্যু।

৬৯৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “যান্ত্রিক গোলযোগ আর নবীনত্বের মৃত্যু”

মওন্তব্য করুন : নাজমুল (০২-০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।