একটি ক্রিকেট ব্যাটের আত্মকাহিনী

আমি একটি ক্রিকেট ব্যাট, কালের আবর্তনে জীবনের ৩য় বর্ষে পা রেখেছি। শুনতে কম মনে হলেও মানুষের হিসেবে আমি বৃদ্ধ, বলতে গেলে মৃতপ্রায়। জীবনের শেষ মুহুর্তে খেলার স্থান ছেড়ে একটি রুমের কোনায় আমার অবস্থান। শুনেছি মৃত্যুর পূর্বে পুরা জীবনটা মানুষের সামনে ভেসে উঠে। যদিও মানুষ নই কিন্তু আমার পুরা জীবনটাকে আমি আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, তাহলে কি আমার মত্যু আসন্ন? হয়ত তাই।

ক্রিকেট ব্যাট বলাতে আপনারা আসলে যা ভাবছেন, তা আমি নই। ব্যাট প্রস্তুতকারী কোন নামী কারখানা বা কোন দক্ষ্য কারীগরের সূনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় আমি তৈরি হইনি, আমার গায়ে নেই কোন নামী দামি ব্র্যান্ডের স্টিকার, শচীন টেন্ডুলকার বা ব্রায়ান লারার মত বিশ্বখ্যাত খেলোয়াড়ের হাতের ছোঁয়া পাবার সৌভাগ্যও আমার হয়নি। কারন, আমি হচ্ছি ক্যাডেট কলেজের রুম ক্রিকেট খেলার ব্যাট।

বর্তমানে ক্রিকেট ব্যাট হলেও জন্ম থেকেই আমি তা ছিলাম না। মূলত আমার জন্ম সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন একটি ছোট কারপেন্টার শপে। একটি টেবিলের পা দানী হিসেবে আমাকে তৈরি করা হয়। জন্মের সময় আমি বেশ চকচক করছিলাম, গায়ে ছিল বার্নিশের কড়া গন্ধ। এক সুন্দর বিকেলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় শাহ্‌জালাল (রঃ) হাউসের ৩৪ নং রুমে, একজন ক্যাডেটের পড়ার টেবিল হিসেবে আমার আশ্রয়দাতা টেবিলটির স্থান হয়।

বেশ সুখেই দিন কাটছিল। যদিও প্রতিনিয়ত ক্যাডেটদের পায়ের ধূলা খেতে হত কিন্তু আমি গর্ববোধ করতাম যে তাদের জ্ঞান লাভের সহায়ক আমি অন্তত হতে পারছি। এসময় হঠাৎ একদিন আমার পাশে কতিপয় ক্যাডেটের সমাগম লক্ষ করলাম, তাদের উত্তেজিত কন্ঠ থেকে “চওড়া”, “শক্ত” ইত্যাদি বিশেষণ ভেসে আসছিল। এমন সময় দেখি তারা আমার টেবিলটিকে উল্টিয়ে আমার গায়ে সজোরে লাথি মারা শুরু করেছে। বুঝতে পারছিলাম না কি অপরাধ করেছি যার জন্য এমন নির্মম নির্যাতন তারা আমাকে করছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমার আশ্রয়দাতা টেবিল থেকে আলাদা হয়ে গেলাম, এরপর দেখি একজন হাতুড়ি বাটাল নিয়ে এগিয়ে আসছে…. শুনতে পেলাম- “দোস্ত এগুলা ওয়ার্কশপ থেইকা মাইরা আনসি, জোস একটা ব্যাট হইব”। আমার নিয়তি পরিষ্কার ভাবে বুঝে গেলাম। পরবর্তী ৩ ঘন্টা আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালান হল, মনে হচ্ছিল গায়ের চামড়া খুলে নিচ্ছে। চোখ থাকলে পানি দিয়ে পুরো রুম ভাসিয়ে দিতাম। নির্যাতন শেষ হলে দেখি তারা আমাকে হাত বদল করছে আর বেশ প্রশংসা করছে। এর মধ্যেই দেখি একজন আমার উপরের অংশে যেটি এখন চিকন গোলাকার আকৃতি ধারন করেছে, সেখানে রাবারের মত কি যেন একটা পরিয়ে দিল। এভাবেই ব্যাট হিসেবে আমি পুনর্জন্ম লাভ করলাম।

আমার পরবর্তী জীবন অত্যন্ত ঘটনাপূর্ণ ও রোমাঞ্চকর, এবং তা আমি আগের চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করছিলাম। রুমে, হাউসের করিডরে, কমনরুমে কিংবা ক্যান্টিনের সামনে আমাকে নিয়ে ক্যাডেটদের বিজয় গাঁথা আমকে উচ্ছ্বসিত করত। সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরির পর আমাকে নিয়ে তাদের উল্লাস কখনই ভুলবার নয়। কিন্তু সময় পুরাটাই যে সহজ ছিল তা নয়। মাঝে মাঝেই হানাদার হাউস টিউটর, হাউস মাষ্স্টার কিংবা হাউস বেয়ারা আমাকে মমতাময়ী ক্যাডেটদের কাছ থেকে কেড়ে নিত, বদ্ধ করে রাখত হাউস ষ্টোরে কিংবা হাউস অফিসে। কিন্তু ক্যাডেটরাই বা কম কিসে? অসীম সাহস বুকে নিয়ে রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পরত তারা ব্যাট উদ্ধার অভিযানে, মুক্ত করে আনত আমাকে বন্দিদশা থেকে। কিন্তু এমন কিছু সময় আসত যখন কষ্টে বুকটা ভরে যেত। প্রায়ই ক্যাডেটরা ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাকে ব্যবহার করত জুনিয়রদের প্রহার করার কাজে। হাউস মাষ্টারের কাছে ধরা খাওয়ার পর মাঝে মাঝে তিনি আমাকে দিয়েই তাদের শাস্তি দিতেন, তাদের কচি কন্ঠের আর্তনাদ আমার বুকে হাহাকার সৃষ্টি করত, কিন্তু প্রতিবাদ করার ভাষা কিংবা মুখ কোনটাই আমার ছিলনা।

এভাবে ঘড়ির কাঁটার সাথে সময় গড়িয়ে চলল, এক ব্যাচ থেকে আরেক ব্যাচে আমাকে হস্তান্তর করা হল, কিন্ত সময়ের সাথে তার ছাপও আমার গায়ে লাগছিল, খেলায় নৈপূণ্যে অবনতি আর ক্যাডেটদের কথা থেকে বুঝতে পারছিলাম আমার সময় প্রায় শেষ। এমনই একদিন এক ক্যাডেট আমাকে ময়লার ডাষ্টবিনে ফেলে দিল। তাকে বলতে শুনলাম নতুন ব্যাট নাকি চলে এসেছে যার “ষ্ট্রোক” আমার থেকে বেশী। কিছুটা মন খারাপ হল। বিদায় হবে জানতাম, কিন্তু এভাবে হবে আশা করিনি। কিছুক্ষন পর দেখি হাউস বেয়ারা আমাকে ডাষ্টবিন থেকে তুলে হাউস অফিসের কোনায় রেখে দিল। রাতে আমাকে ইঙ্গিত করে তাকে বলতে শুনলাম,- “ভাঙ্গা খাটটা কালকে ঐ কাঠটা দিয়ে জোড়া লাগাব।”

এরপর থেকেই রুমের কোনায় পরে আছি। মনকে আশ্বস্ত করছি যে মৃত্যু হলেও ক্যাডেটের উপকারেই ব্যবহৃত হব, ব্যাট হিসেবে যেমন তাদের আনন্দ দিয়েছি তেমনি হয়ত কোন একজনের সুখনিদ্রায় সহায়ক হব। ভয় পাচ্ছিনা, কারন মৃত্যুতো আমার আগেও একবার হয়েছে।

সকাল হয়ে গেছে, দেখি বেয়ারা আমার দিকে এগিয়ে আসছে, মৃত্যু নিশ্চিত, কিন্তু আমিও প্রস্তুত আছি, কারন এটাইতো শেষ নয়, বরং শুরু। নতুন জীবনের শুরু।

১০,১৩০ বার দেখা হয়েছে

৯৭ টি মন্তব্য : “একটি ক্রিকেট ব্যাটের আত্মকাহিনী”

  1. ইফতেখার (১৯৮৪-১৯৯০)

    ৮-৯ এ রুমের ভিতরে সক্সের বলই চলতো, আর ব্যাটের পুনর্জন্ম বেডের পাটাটন থেকে। তোমরা কি রুমেই টেপ দেয়া টেনিস বল পিটাইটা নাকি? টিউবলাইট আর জানালার কাঁচ ভাঙ্গে নাই? মাঝেমধ্যেই টিউবলাইট জোগাড়ে (ইহা নিশ্চই চুরি নয়?) যাইতে হইতো। আহারে, সেই দিনগুলা!

    জবাব দিন
    • কলেজ ক্যান্টিনের পিছে সব ফিউজ লাইট গুলা জমা রাখত। কমনরুমের টিউব লাইট ভাঙলে ওইখান থেকে ফিউজ লাইট আইনা লাগায়া ভাল মানুষের মত হাউজ বেয়ারার কাছে রিপোর্ট, কাশেম ভাই, কমন রুমের লাইট ফিউজ হয়া গেছে। :grr: :grr: :grr:

      জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    এর মধ্যেই দেখি একজন আমার উপরের অংশে যেটি এখন চিকন গোলাকার আকৃতি ধারন করেছে, সেখানে রাবারের মত কি যেন একটা পরিয়ে দিল।

    :khekz: :khekz: :khekz:


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮) বলেছেনঃ
    মার্চ ৫, ২০০৯ @ ১০:৩৮ অপরাহ্ন edit

    এর মধ্যেই দেখি একজন আমার উপরের অংশে যেটি এখন চিকন গোলাকার আকৃতি ধারন করেছে, সেখানে রাবারের মত কি যেন একটা পরিয়ে দিল।

    :khekz: :khekz: :khekz:
    --------------------------

    ইয়ে মানে, আমারো মনে হইছিল। 😀 😀 😀

    জবাব দিন
  4. আশহাব (২০০২-০৮)
    এর মধ্যেই দেখি একজন আমার উপরের অংশে যেটি এখন চিকন গোলাকার আকৃতি ধারন করেছে, সেখানে রাবারের মত কি যেন একটা পরিয়ে দিল।

    দোস্ত, পুরা মাক্ষি হইসেরে, চালায়া যা...
    :khekz: :khekz: :khekz:


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন
  5. জিহাদ (৯৯-০৫)

    ব্যাপক। খুব্বালা হৈসে 😀

    চালায় যাও সপাটে।

    এর মধ্যেই দেখি একজন আমার উপরের অংশে যেটি এখন চিকন গোলাকার আকৃতি ধারন করেছে, সেখানে রাবারের মত কি যেন একটা পরিয়ে দিল।

    :khekz: :khekz:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  6. নাসির (৯৮-০৪)

    চমৎকার!!সাজি্দকে আমার ভালোই মনে আছে মনে হয়। পোলাপান কত্ত বড় হইয়্যা গেসে!!
    ক্লাস সেভেন এ থা্কতে ১০২নং রুম এর এক দোস্ত প্রায়ই সিনিয়র ভাইয়ের ধুয়ে শুকাতে দেয়া মোজা চুরি করে বল বানাতো। মোজার আনলিমিটেড স্টক।
    হায়রে সেদিন :dreamy: :dreamy:

    জবাব দিন
  7. তাসনিম (২০০২-২০০৮)
    বর্তমানে ক্রিকেট ব্যাট হলেও জন্ম থেকেই আমি তা ছিলাম না। মূলত আমার জন্ম সিলেট ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন একটি ছোট কারপেন্টার শপে। একটি টেবিলের পা দানী হিসেবে আমাকে তৈরি করা হয়।

    হাহাহাহা...কোপাইসস
    :boss:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তুহিন (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।