সেলুকাস এবং ……..

প্রবল করতালিতে ভেসে যাচ্ছে রংপুর ক্যাডেট কলেজের অডিটরিয়াম। সময়টা আন্ত ক্যাডেট কলেজ সাহিত্য/সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা ২০০৪ । বাংলা একক অভিনয় চলছে, মাত্র শেষ হল ঝিনাইদহ এর প্রতিযোগীর পর্ব। দর্শক সারির সবাই মুগ্ধ। এত করতালি আগের বারের ৪/৫ টাতেও পরে নি। স্বতস্ফুর্ত ভাবে তালি পরেই চলেছে। বিমোহিত হয়ে গেছে সবাই এই ক্যাডেট এর অভিনয় আর সংলাপ বলা দেখে। একে একে সবার পালাই শেষ হল। শুরু হল রেজাল্ট এর জন্য অপেক্ষা, যারা নিয়মিত পয়েন্ট এর হিসাব রাখছিলেন, তারা অনেকেই ঝিনাইদহ কে প্রথম ধরে নিয়েই হিসেব কষছেন। কিন্তু সবাইকেই অবাক করে দিয়ে ৭ম এ ঘোষিত হল ঝিনাইদহ এর প্রতিযোগীর নাম।

লাঞ্চ শেষ করে ক্যাডেটদের বিশেষ গ্রুপটা টয়লেট এ যথারীতি হাজির। ৩ তলার ব্লকটা দেয়া হয়েছিল বরিশাল আর ঝিনাইদহ কে। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল একজনকে কেন্দ্র করেই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আসরের মধ্যমনি আর কেউ নয়, ঝিনাইদহ এর সেই প্রতিযোগী। একেরপর এক সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছে, সবাই তাকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে, আর তাদের মধ্যে অনেকেই ঝিনাইদহ এর না। এক সময় বেচারা একটু ইমোশনালই হয়ে গেল। কয়েকফোঁটা পানিও বোধহয় পড়ল। সেই থেকে তার সাথে আমার পরিচয়।

এরপরের বাকি দিনগুলোতে আমাদের মাতিয়ে রেখেছিল ও একাই। বড় বেশী পাগলাটে ছিল ও। হাসাতো না যতটুকু, নিজে হাসত তার চেয়ে বেশী। আর গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকলে একটা বাথরুম যে সেই ব্যাক্তি দখল করে আছে তা বোঝা যেত অনায়াসেই, যেভাবে চিৎকার করে গান গেয়ে জানান দিত না… :guitar:

এল.এম শেষ করে কলেজে চলে আসলাম। মাঝখানে কেটে গেল প্রায় এক বছর। পাগলার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, হঠাৎ ছুটির মাঝে একদিন বরিশালের রাস্তায় তার দেখা। দেখতেই লাফ দিয়ে রিকশা দিয়ে নেমে জড়িয়ে ধরল। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে সে এতটাই উচ্ছাসিত ছিল যে আমিই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। জানতে পারলাম তার মা এখানে চাকরী করেন তাই ঘুরতে আসা। তারপর বেশ কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আবার বিদায়।

এরপর বেশ বড়সড় একটা গ্যাপ। তার সাথে আবার দেখা ডিফেন্স গাইডের নিচে, ডিব্বায়। এবং যথারীতি সেই অপরিবর্তিত রূপ। নাহ, ঠিক অপরিবর্তিত বললে ভুল হবে, ড্রেস আপে ব্যাপক পরিবর্তন। থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট, ডিজুস টি শার্ট, কেডস, ক্যাপ আর কি কি জানি… ,পুরাই ইয়ো… B-)

আবার সেই কলেজের মত পরিস্থিতি, ডিব্বার নিচে চা সিগারেট আর আড্ডাবাজী , গান। দারুন মাস্তিতে থাকত আর আমাদেরকেও রাখত। শুধু মাঝেমাঝে একটু বিপদে ফেলে দিত এই যাহ। ডিব্বায় আমাদের আড্ডাবাজীর মুল একটা উৎসই ছিল এখানকার কোচিং এ আগত ষোড়শীরা। একদিন একজনকে দেখে একটু বেশীই ভাল লেগে গেল আমার, তখন কুমিল্লার জিহাদ আবার আমাদের সাথে প্রায়ই থাকত। সে আবার নিজেকে লাভ গুরু টাইপ করার চেষ্টায় মত্ত। তাই ওরেই গিয়ে বললাম, “দোস্ত এই মেয়েটাকে তিন তলায় দেখলাম তখন, মনে হয় ডিফেন্স গাইডেই ভর্তি হবে, ভালই লাগছে মামা, দেখ না একটু….” জিহাদও বীরদর্পে এগিয়ে গেল, আর আমরা একটু পাশে থেকেই দেখতে লাগলাম ব্যাপারটা। জিহাদ বেশ বড়সড় একটা গল্পই ফেঁদে বসল, বিবিএ এর জন্য কোচিং নিয়ে একটা ব্যাচ করবে, সেখানে আরও কিছু স্টুডেন্ট দরকার …ইত্যাদি ইত্যাদি… আমি বেশ আশা নিয়ে বসে আছি, হঠাৎ দেখি কোত্থেকে পাগলা এসে পাশে বসল। আমাকে জিজ্ঞাসা করল , “কিরে দোস্ত কি হইতেসে ওইখানে ?” আমি বেশ সরল গলাতেই বললাম যে জিহাদ গেসে আমার জন্য একটা মাইয়ার কাছে। “আররে এইটা কোন ব্যাপার হল” বলেই লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর জিহাদের কাছে গিয়ে বলল, “এই জিহাদ সর !!! এক্সকিউজ মি আপু, আপনার নাম ?…আচ্ছা দেখুন আপু জিহাদ এতক্ষন যা বলছে তা আসলে ফালতু, বুঝলেন আপু ? আসলে ঘটনা হল গিয়ে ওই যে ছেলেটা দেখছেন ওখানে বসে আছে, তার আপনাকে ভাল লেগেছে, ফ্রেন্ডশীপ করবেন ??” :bash:

“হোয়াট ননসেন্স”এক উত্তরেই আমার প্রথম প্রচেষ্টার বারটা ছাড়িয়ে চৌদ্দটা বাজিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেল সেই মেয়ে….আমি আর জিহাদ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, আর হারমীটা এসে আমাকে বলল, “ব্যাপার না দোস্ত, আজকাল সব স্ট্রেটকাট বুঝলি, নে একটা সিগারেট খা” ~x(

যথারীতি একদিন আই.এস.এস.বি’র ডেট পড়ল, গাট্টি বোচকা নিয়ে রওয়ানা দিলাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে। মাথায় চিন্তা একটাই, প্রথম ধাপটা উৎড়াইতে পারলে হয়। একে একে সবই উৎড়ে গেলাম…..কয়েকজন বন্ধুকে বিমর্ষ নয়নে বিদায় নিতেও দেখলাম। এরপর অবশিষ্ট ৩ দিনের জন্য গ্রুপ ভাগ করে দেয়া হচ্ছিল যখন তখন যারপরনাই অবাক হলাম নিজেকে পাগলা’র গ্রুপে আবিস্কার করে, সাথে ছিল আমাদের উকিল শার্লীও। নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে কাটতে লাগল দিন’কটা। এখানেও সেই একি অবস্থা বন্ধুবরেষুর। গান, মাস্তি আর জোকস করে সারাখন মাতিয়ে রাখত আমাদের। এমনকি আমাদের গ্রুপ এর একজন সাইকোলজিস্টকেও গান গেয়ে শুনিয়েছিল (মাতিয়েছিল কিনা কে জানে :grr: )। গ্রুপ এসেসমেন্টে তাকে আমি এক নম্বরে রেখেছিলাম বিনা বিচারে (স্যরি শার্লী, তুই ২ এ ছিলি 😛 )। আসার পর ও আমাকে বলেছিল, “দোস্ত, তোকে এক নম্বর দিয়েছি, আমি না পাইলে কিছু না, তোর এইটা পাওয়া দরকার।”

কয়েকদিন এর বন্ধুত্বে অনেক কিছুই আমরা শেয়ার করেছিলাম, হয়ত সে কারনেই এটা বলেছিল…..শেষের দিন রেজাল্টের জন্য অধীর আগ্রহে আমরা একই সাথে অপেক্ষা করছিলাম। ও একটু বেশীই অস্থির ছিল, সারাক্ষন পায়চারী করছিলা আর বলছিল, “দেখিস দোস্ত, আমার হবে না,অমুক খানে গ্যাড়াইছি, তমুক খানে ধরা খাইছি” কিন্তু তারপরও সেই চিন্তা মাথায় নিয়েও আমাদের সাথে হাসি তামাশা চলছেই। এর কিছুক্ষন পর ওর ডাক পড়ল ওর, গেল আর কিছুক্ষন পর ফিরেও আসল, হাতে ছিল একটা লাল কার্ড……এসেই একটা হাসি দিয়ে বলল, “দেখছিস,বলছিলাম না দোস্ত আমার হবে না” তারপর কতক্ষন ভালই পাগলামি করল সে, রেড কার্ডটা টাইপিনের সাথে বাজিয়ে আমাদের সামনে অনেকক্ষন জোকস করল, চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছিল, অথচ মুখে ধরেছিল হাসি।

জানি না কেন, কিন্তু সত্যি মনে হচ্ছিল আমার বদলে যদি গ্রীন কার্ডটা এই ছেলেটাকে দিয়ে দেয়া যেত তাহলে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকবে না……কিন্তু বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় বিধাতা আমাদেরকে দেন নি। এরপর আমরা আবার ছিটকে গেলাম দুদিকে….কয়েকদিন ওকে দেখলাম ডিফেন্স গাইডের নিচে….একটু অন্যরকম, বিষন্নমনা…আর্মির জন্য অনেকটাই হয়ত ডেসপারেট ছিল,তাই…..। তার কয়েকদিন পর আর দেখাও পেলাম না।

বি.এম.এ চলে গেলাম…ঝিনাইদহ এর ছেলেদের মুখে শুনলাম ও ইংল্যান্ড চলে গেছে, ভাবলাম হয়ত এটাই ওর জন্য ভাল হল (তখন আমাদের অবস্থা ভাষায় বর্ননা করার মত না)। প্রায় মনে পড়লেও ভাবতাম ও হয়ত ভুলেই গেছে, একসময় আমার স্মৃতিতেও হয়ত ধুলো পরে গেল। একদিন ছুটিতে বাসায় বসে মোবাইলে একটা কল পেলাম, অচেনা নম্বর…ফোন ধরার সাথে সাথেই ও পাশ থেকে ভড়াট গলা, “রেজওয়ান বলছেন ? আমাকে চিনবেন না….অমুক তমুক” অনেকক্ষন ধরে গ্যাজানোর পর বলল, “কিরে দোস্ত, কেমন আছিস ? আমারে চিনছস? আমি……” এরকম সারপ্রাইজিং কল আমি আমার লাইফে পাই নি। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আমার এই বন্ধুটি কষ্ট করে আমার নম্বর জোগার করে আমাকে ফোন দিয়েছে……আমি এতটা বিষ্মিত হয়েছিলাম তা আর বলার না….

এরপর থেকে প্রায়ই আমাদের ফোনে আলাপ হয়, ইদানিং নেট এর বদৌলতে আবার সেই পুরানো দিনের মতই কাছে চলে এসেছে এত দূর থেকেও……মাঝে একবার দেশেও এল, কিন্তু কপাল মন্দ হওয়ায় দেখা মিলল না, ইংল্যান্ডে ফেরত চলে গেল। কথাবার্তা মাঝে একটু কমেও গেল, বেচারা নাকি খুব ব্যাস্ত আর কষ্টে থাকে। অবশ্য শনি আর রবিবারে ছুটির দিনগুলোতে মাঝে মধ্যে ক্যাম দিয়া দেখাইত কি হারামীগিরিটা করে….মাঝে মাঝে আমাকে খোঁচাও দিত, চাকরী বাকরী নিয়ে। আর নিজের জীবন নিয়ে খালি আলতু ফালতু বকবক…একদিন ওর গান টান গাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করায় বলল গানটান শুরু করেছে বেশ আয়োজন করে, দু একটা ভিডিও দেখলাম ইউটিউবে, তাও প্রায় ৭/৮ মাস আগের কথা। একটা এলবামে কিছুটা কাজও করল…কিন্তু একক ভাবে শুরু করার প্ল্যান আমাকে বলেছিল অনেকদিন আগে যার কোন আপডেট আর পাচ্ছিলাম না।

গত কয়েকদিন ধরেই তার ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখছিলাম যে, “workin on ma 2nd/3rd/4th track…..” এভাবেই চলল কয়েকদিন। অবশেষে ২/৩ দিন আগে তার পোস্ট করা লিঙ্কে গিয়ে খুঁজে পেলাম তার করা গানগুলো……

অনেকগুলো গান করে ফেলেছে, এলবাম এখনও রিলিজ পায় নি, তবে রেডিও গুলোতে নাকি চলে এসেছে, সানা ভাইয়ের এ.বি.সি তেও নাকি বাজছে…..চমৎকার কয়েকটা ট্র্যাক, সবচেয়ে ভাল লেগেছে আমার কাছে এই সেলুকাস গানটা

আর অন্যান্য গানগুলোও অসাধারন লেগেছে….বিশেষ করে বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয় নিয়ে এই গানটা

আরও দুইটা দিলাম………শুনে দেখতে পারেন….

ওহহো…এতক্ষনে এই পাগলা বন্ধুবরেষুর নামটাই তো বলা হল না… 😛
অবশ্য অর্ধেক লোক এর মধ্যেই টের পেয়ে গেছেন মনে হয় (বৃক্ষ বইলা কথা) :duel:

তৌফিক আহমেদ ( ঝিনাইদহ ১৯৯৯-২০০৫)

তৌফিক আহমেদ ( ঝিনাইদহ ১৯৯৯-২০০৫)


এই পোস্টটা তোর জন্য…… :salute:
ভাল থাকিস, খুব ভাল… :hug:

আর দেশে আইলে এইবার এট লিস্ট অটোগ্রাফটা দিয়া যাইস…… 😡

৫,৮৯৮ বার দেখা হয়েছে

৫০ টি মন্তব্য : “সেলুকাস এবং ……..”

  1. রকিব (০১-০৭)

    সেলুকাসটা দারুণ হয়েছে। তৌফিক ভাই পাথ্রায়, সবুজ বৃক্ষ পাথ্রায়।

    রেজুদা দারুণ লিখেছেন। :boss:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    তৌফিককে নিয়ে আমার স্মৃতির অনেকটাই মনে হয় আইএসএসবির। মাত্র ৪ দিনে মানুষের মনে এতটা দাগ কাটা মনে হয় শুধু তৌফিকের পক্ষেই সম্ভব। আইএসএসবিতে ওর উপস্থিত বক্তৃতা এখনও মনে পড়ে।

    জবাব দিন
    • ওর মত জলি পোলা অনেক কমই দেখছি
      একবার ওকে আমি সর্প হতে পালাবার পথ কইরা দিয়েছিলাম।ওইদিন ধরা খাইলে সেদিনই তাঁর অশনি সঙ্কেত বেজে উঠতো।:D বেচারা বড়ই ফাঁপড়ে পড়েছিল।

      জবাব দিন
  3. সালাম সবাইকে, অনেক অনেক অনেক বেশি ভাললাগসে পুস্ততা পরে, অনেকদিন পর আবার পুরান ডিনের কিছু বাসি কাবাব ঝলসে উঠলো, 😀
    সিনিঅর ভাইদের অনেক ধন্নবাদ,পিচ্ছি ভাইদের আদর,,,আর দস্তদের কি আর বলব,,,তোরা ছিলিশ,তোরা আছিস,জানি তোরাই থাকবি,,,,,বন্ধু,,,, 🙂
    আমার জন্নে দুআ করবেন,,,আমি এই প্রথম বাংলাএ লিখলাম,,,

    31st e আমার album আসছে ইন্সাল্লাহ,,,,,,miss u yall..

    জবাব দিন
  4. Towfique 36th

    সালাম... সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। নতুন এক্তা খবর দিতে চাই। আমার দুইটা ইংরেজি গান বের হচ্ছে under - Right Track Records (UNIVERSAL MUSIC, operation UK)। এই বছরে। সবার দোয়া চাই।আমার আলবাম রাজত্বের বিদ্রোহী ও নাগরদোলা নামের গান দুটার ইংরেজি ভারসান বের হচ্ছে। সাথে নতুন মিউজিক ভিডিও।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।