জীবনের গল্প – ২

জীবনের গল্প – [ ১ ]

    জর্জ

আমার খুব কাছের বন্ধুদের মধ্যে জর্জ একজন। সবসময় হসি খুশী থাকে, দেখলে বোঝার উপায় নেই কতবড় ভার তার বুকের উপড় চেপে বসে আছে। ওকে যখন থেকে দেখেছি তখন থেকেই ভাবতাম এই ছেলেটার মত হাসি খুশী আর মাস্তিবাজ যদি হতে পারতাম তাহলে কত মজাই না হত। কখনওই ভাবি নি ওর মনের মধ্যে কত কষ্ট লুকিয়ে আছে। একদিন ওর এক ফুপাত ভাই এর মুখে শুনলাম ওর ইতিহাস।

জর্জের ৫ বছর বয়সে বাবা মারা যান। ওর বাবা বরিশালের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর তারা আর্থিক দিক দিয়ে ভেঙ্গে পরে। কিছুদিন পরেই জর্জের মা ওকে ওর দাদুর বাড়িতে রেখে চলে গিয়ে একজন ভদ্রলোককে বিয়ে করেন। জর্জ মানুষ হতে থাকে তার দাদির কাছে। এর প্রায় দুই বছর পর জর্জের মা জর্জকে নিতে আসে তার কাছে। কিন্তু জর্জের দাদি তাকে জোর করেই নিজের কাছে রেখে দেয়। পরে জর্জের মা’র জোড়াজুড়ি দেখে তাকে পাঠিএ দেন মালায়শিয়া তে।
জর্জ প্রায় সাত বছর মালায়শিয়াতে তার চাচার কাছে থেকে দেশে ফিরে আসে। ততদিনে সে অনেক বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। বাংলাদেশে ফিরে দাদির কাছেই আবার বসবাস শুরু করে। কিন্তু আবার হাজির হয় জর্জের মা আর শুরু হয় টানাপোড়েন। জর্জকে আবার পাঠিয়ে দেয়া হয় ঢাকায় তার ফুপুর কাছে, প্রায় ৩ বছর সেখানে থেকে আবার বারিশাল ফিরে আসে সে। কিন্তু ততদিনে সে অনেক সময় পার করে ফেলেছে। বাস্তবতার টানাপোড়েন আর পারিবারিক যুদ্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পরে তার নিজের জীবন, অনিশ্চিত হয়ে পরে তারই ব্যাক্তিগত ভবিষ্যত। কিন্তু তারপরও নিজের জেদের বশেই হাল ছাড়ে না সে, চালিয়ে যায় তার পড়ালেখা, তার মিউজিক, তার ফ্যাশন প্রোগ্রাম…। শুধু মাঝে মাঝে বিশেষ বিশেষ সময়ে দেখতাম ওর আনমনা ভাব, যখন সবাই মিলে হঠাৎ করে চলে যেতাম কোন বন্ধুর বাসায়, আঙ্কেল আর আন্টির সাথে চুটিয়ে গল্প আর জম্পেশ খানাদানার পর আড্ডা মারতাম, কিংবা ঈদের সময়…বুঝতাম না কেন হঠাৎ হঠাৎ ও সব পানিখোরদের দলে যোগ দিত। কিন্তু এটা ছিল একান্তই সাময়িক, কারন অন্য ৮/১০ টা ছেলের মত ও এই ব্যাপারটাকে নিজের দুর্বলতা হিসেবে নেয় নি। নিজের এই ভাসমান জীবনই হয়ত ওকে অনুপ্রেরনা জোগাত কিছু একটা করে দেখাবার, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। সেই জীবনীশক্তি নিয়েই এখনও ও যুদ্ধ করে যাচ্ছে।
কি একটা জীবন…পরিবার, ভালবাসা, বাবা, মা কোন কিছুই পায় নি ছেলেটা, নিয়তির নির্মম নিষ্ঠুর পরিহাসে ভেসে বেরিয়েছে এখান থেকে ওখানে। কিন্তু হাল ছাড়ে নি সে। ওর এক ফুপু আছে আমেরিকাতে থাকে, প্রায়ই জর্জকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান তিনি। কিন্তু জর্জ রাজি হয় না। অন্যের উপর ভর করে সে আর চলতে চায় না। পরগাছার মত বাচার চেয়ে স্বাধীন ভাবে নিজের জীবন গড়ার যুদ্ধে সে হার মানতে রাজী নয়।
এখনও ঢাকা গেলে ওর সাথে দেখা করি সবার আগে। একটা মিডিয়া ফার্মে কাজ নিয়েছে সে। গেলেই এটা সেটা খাওয়ানোর জন্য ব্যতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে…জোর গলায় বলার চেষ্টা করি আরে দোস্ত চাকরি করি,আমাকে দে না বিলটা দিতে। হাসি হাসি মুখ করে বরাবরের মত একটাই উত্তর…’আমি কি ঘাস কাটি ?’ আমি অবাক হয়ে চেয়ে থাকি, আর মনে মনে বলি ‘তুই আরও বড় হ জর্জ…’

৩,১৪৭ বার দেখা হয়েছে

৪২ টি মন্তব্য : “জীবনের গল্প – ২”

  1. রকিব (০১-০৭)

    :hatsoff: :hatsoff: তাদের প্রতি, যারা জর্জ ভাইয়ের মতো দুঃসময়ের টানাপোড়নে আত্মসমর্পণ না করে মাথা উচিয়ে দাড়িয়ে আছেন। উনারাই তো আমাদের মতো চারাগাছগুলার প্রেরনা :salute: :salute:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    রেজওয়ান,
    ধন্যবাদ জীবন থেকে নেয়া কিছু ঘুড়ে দাড়ানোর গল্প শেয়ার করার জন্য...
    জর্জের প্রতি আমার :salute:
    তোমার লেখা দেখে আমিও অণুপ্রানিত হলাম এক লড়াকুর গল্প শোনানোর জন্য। আর সেই লড়াকু আমাদেরই একজন ক্যাডেট ভাই...

    জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    রেজওয়ান পুলাটা আমারে এম এস এনে যেই সব স্বরচিত ছড়া পাঠায়(ছিঃ কি অশ্লীল সব ছড়া) সেইগুলা পইড়া কোন শালা বুঝবো যে এর ভিতরে এমন সংবেদনশীল একটা মন আছে!!

    সাবাশ রেজওয়ান,সাবাস জর্জ!

    জবাব দিন
    • রেজওয়ান (৯৯-০৫)
      রেজওয়ান পুলাটা আমারে এম এস এনে যেই সব স্বরচিত ছড়া পাঠায়(ছিঃ কি অশ্লীল সব ছড়া)

      😮 😮 😮 😮 আমি !!!!!! কবে ?????? আপনেই না আমারে কি সব অশ্লীল কথা দিয়া বাক্য রচনা কইরা জমা দিতে কন... 😛 😛 😛 😛
      আর অহন আমি খারাপ x-( x-( x-( ফাস কইরা দিমু কিন্তু... :grr: :grr: :grr:

      জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    রেজওয়ান,

    এই লেখাটা পড়ে আমার যেই ভালো লাগা ফিলিংসটা হচ্ছে সেটা তোমাকে নিয়ে, তোমার প্রকাশ করার অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে। তোমার লেখাটা একেবারে হৃদয়ের গহীন প্রদেশে পৌঁছে কড়া নেড়েছে। এক ফাঁকে এও ভাবলাম তোমার বয়সই বা কত??? কিভাবে পার এমন করে লিখতে????

    আহসান ভাইয়ের মতোন আমারও কিছু একটা মনে পড়ি পড়ি করছে..........কিন্তু জানি না সেই গল্প এইরকম জীবন যুদ্ধে অসীম সাহসী সৈনিকদের মতোন হবে কিনা। জর্জের জন্য হাজারটা লাল গোলাপের শুভেচ্ছা।

    **** আমার কৌতুহলটা কতটা উপাদেয় হবে বুঝতে পারছি না, কিন্তু জানতে মন চাচ্ছে খুব। জর্জ তার মা'র সাথে গেল না কেন? মায়ের অভাবটা পূরণ হতো অন্তত।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
    • রেজওয়ান (৯৯-০৫)

      যখন ওর মা ওকে ফেলে রেখে চলে যান তখন ওর বয়স ছিল তখন ৭ বছর। সেই জেদ থেকেই ওর দাদি ওকে যেতে দেন নি পরবর্তীতে। আর বড় হবার পর ও নিজের জেদেই আর মা'র দিকে পা বাড়ায় নি।
      আপনার লেখাটাও তাড়াতাড়ি দিয়ে ফেলেন...আপনি যে লেখাই দিন না সেটাই তো হেভি জমে যায় :hatsoff: :hatsoff: :hatsoff:

      জবাব দিন
  5. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আমার প্রকাশও সায়েদের মত। তুমি একটা আসাধারন কাজ করছ, এভাবে বন্ধুদের গল্প শেয়ার করে। অভিনন্দন তোমাকে।

    কেউ যদি দাড়াতে চায়, কে তাকে আটকাতে পারে, জর্জকে স্যালুট।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  6. সামিয়া (৯৯-০৫)

    এই লেখাগুলা অসাধারণ, আমি আসলে গুছায় বলতে পারি না, কিন্তু খুব খুব ভালো লাগে সেই মানুষগুলোকে, যারা বাজে সময় কে পেছনে ফেলে চলতে পারে। সবাইকে :salute:

    জবাব দিন
  7. রহমান (৯২-৯৮)

    রেজওয়ান,
    কংগ্রেটস্‌ ফর প্রমোশন :clap: 🙂
    আগের মতো এই লেখাটাও খুব ভাল লাগল :thumbup: । সংগ্রামী মানুষের জীবন কাহিনী শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। আমার বাবার জীবনটাও অত্যন্ত সংগ্রামী। জীবনের গল্প-৩ এর অপেক্ষায় রইলাম

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেজওয়ান (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।