জীবনের গল্প – ১

কয়েকদিন ধরে শুধু খারাপ খারাপ খবর পাচ্ছি। অমুক বন্ধু ছ্যাকা খেয়ে পাগল হয়ে গেছে, সারাদিন উলটা পালটা জিনিস খেয়ে পড়ে থাকে, বাসায় গ্যাঞ্জাম করে, তো অমুক কাজিন ফোন করে শুধু ঘ্যানঘ্যান করে যে বাসায় জেনে ফেলেছে,এখন সে আত্মহত্যা করে ফেলবে না মানলে। কয়েকজনের আবার পারিবারিক সমস্যা, বাবা মার মধ্যে সমস্যা, সেটাকে একটা ইস্যু করে সারাদিন বিষন্ন হয়ে বসে থাকে আর সন্ধ্যা হলেই শুকনো-ভেজা খোঁজার দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। আসলে পারিবারিক সমস্যা মানুষের জীবনে লেগেই থাকে। এমন কেউ নেই যে এর থেকে মুক্ত না। তাই বলে এটাকে একটা জীবনের ব্যার্থতা ধরে নিয়ে নিজের জীবন নিএ অহেতুক তামাশা করার কোন মানে হয় না।
আমার ব্যাক্তিগত জীবনে অনেক বন্ধু বান্ধবকে এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে দেখেছি। আবার এটাও দেখেছি যে তারা এটাকে নিজের জেদ হিসাবে কাজে লাগিয়ে আজ কতদুর পৌছে গেছে। তাদেরই কয়েকজনের কথা আজ বলার ইচ্ছা হল………
(এগুলোর কোনটাই মিথ্যা না, সবই সত্যি, আসলে শুধু এটা বোঝাতেই লেখা যে পরিস্থিতি কতটা খারাপ পর্যায়ে গিয়েও তারা আবার ফিরে এসেছে জীবনে।)

    অনিক

অনিকের মা’র যখন বিয়ের বয়স হল তখন অনেক জায়গা থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু করল। অনিকের নানা বেশ দেখে শুনে ২ জনকে পছন্দ করেছিলেন। এদের ২ জনই ফরেস্ট এ চাকরি করত। একজন ছিল খুলনাতে আর অন্যজনের পোস্টিং ছিল বরিশাল। শেষমেষ খুলনায় চাকরীরত সেই ভদ্রলোকের সাথেই অনিকের মা’র বিয়ে হয়। এর প্রায় ২ বছর পর তাদের সংসারে অনিকের জন্ম।
ফরেস্ট এর চাকরী এবং খুলনার পোস্টিং এর কারনেই সেই ভদ্রলোক কয়েকটি দুর্নীতি জনিত ঘটনায় জড়িয়ে পরেন। আর সেটা থেকে ছাড়া পেতে গিয়ে হারিয়ে বসেন প্রচুর টাকা পয়সা। আর তখনি অনিকের মা’র উপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন। অনিকের বয়স তখন ২ বছর। একদিন হঠাৎ করেই অনিকের বাবা অফিস থেকে এসে উম্মাদের মত আচরন করতে থাকে এবং অনিকের মাকে মারতে থাকে। এক পর্যায় যখন অনিকের মা বাসা থেকে কোন টাকা আনবে না বলে অস্বীকৃতি জানায় তখন অনিকের বাবা রান্নাঘর থেকে একটি দা নিয়ে অনিক ও তার মাকে মারতে উদ্দত হয়। অনিকের মা ২ বছরের অনিককে নিয়ে তখন অনেক কষ্টে বাসা থেকে পালাতে সক্ষম হয়। এরপর চলে আসে বরিশাল অনিকের নানা বাড়িতে।
অনিকের বাবা মাস খানেক পর “ভুল বুঝতে পেরেছি” এরকম একটি ভাব নিয়ে অনিকের নানার কাছে এসে ধর্না দেয়া শুরু করে। কিন্তু অনিকের নানা তাতে রাজি না হয়ে তাকে দিয়ে ডিভোর্স পেপার সই করিয়ে ছাড়েন। তার প্রায় এক মাসের মধ্যেই অনিকের মার জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব আসে। হাজির হন সেই ভদ্রলোক যিনি অনিকের মাকে বিয়ের জন্য পছন্দ করেছিলেন। এর মধ্যে তিনিও একটি বিয়ে করেছিলেন কিন্তু সেই মহিলা তাকে রেখে মেয়েকে নিয়ে অন্য এক লোকের সাথে ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে। অনিকের নানা অনিকের মা’র সম্মতি চাইলে অনিকের কথা ভেবেই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। এরপর অনিকের মা’র সাথে সেই ভদ্রলোকের বিয়ে হয়। অবুঝ অনিকের চোখের সামনে ঘটে যায় কিছু কঠিন বাস্তবতা।
অনিক যখন ৭ম শ্রেণীতে পড়ে তখন একদিন আবার অনিকের সত্যিকারের বাবা এসে হাজির হয়। অনিককে সে নিয়ে যেতে চায় তার কাছে। তাকে লোভ দেখায় যে তার এখন অঢেল সম্পত্তি। অনিক কে সে বাড়ী দিবে, গাড়ি দিবে ভাল স্কুলে পড়াবে। কিন্তু অনিক মাকে ছেড়ে যাবার কথা চিন্তা করে না। এরমধ্যেই অনিকের একটি ছোট্ট বোন হয়। অনিকের সত্যিকারের বাবাও আরেকটি বিয়ে করেছেন। সেই ঘরে তার একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে আছে। কিন্তু তারপরও সে অনিককে নিয়ে যাবার জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়ে যায়। অনিক শুধু মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়ে যায়।
পড়াশোনায় মেধাবি এই ছেলেটা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে পরার সময় পারিবারিক এই বিষয়টি হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনের অন্যতম একটি ক্ষতির কারন। যেই মেয়েটিকে সে ভালবাসত তার পারিবারিক মর্যাদা ও অর্থসম্পদ ছিল অঢেল। কিন্তু তারপরও মেয়েটির মধ্যে ভালবাসার কমতি ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে মেয়েটির পরিবার ঘটনাটি জেনে ফেলে। এবং মেয়েটিকে তার বাবা মা কঠিন ভাবে শাসন করে এবং এটাও শুনিয়ে দেয় যে ব্রোকেন ফ্যামিলিতে তারা কোনদিন মেয়ে দিবে না। মেয়েটির পরিবার অত্যন্ত কঠিন ভাবে মেয়েটিকে অনিকের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এই ঘটনাটি অনিকের মনে তার নিজের প্রতি এবং নিজের পরিবারের প্রতি তীব্র ঘৃনার জন্ম দেয়। অনিক পা বাড়ায় অন্ধকারের জগতে। প্রায়ই তাকে দেখা যেত সন্ধ্যার পর নেশায় বুদ হয়ে বসে আছে বাসার গলির মুখে চায়ের দোকানে। গাঁজা এবং ফেন্সিডিল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় সংগী। ধীরে ধীরে সে চলে যেতে থাকে আরও গভীর অন্ধকারে। অনিকের মা’র অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কিন্তু জীবনের এই নির্মম বাস্তবতার স্বীকার হয়ে যখন সে হারিয়ে বসেছিল প্রায় পুরো জীবনটাকে তখনই তার মনের গহীনে জমে থাকা ব্যাক্তি স্বকীয়তা তাকে নাড়া দেয়। ‘শুধু একটি মেয়ের জন্য সে আজকে তার জীবঙ্কে ঠেলে দেবে অবধারিত ধ্বংসের মুখে? যে তাকে না,তার পরিবারের জন্য তাকে চেড়ে দিল,যে অপরাধ সে করে নি তার জন্য সে কেন শাস্তি পাবে?’এই চিন্তাটা তার মাথার মধ্যে হঠাৎ করে ঘুরপাক খাওয়া শুরু করে। আবার উঠে দাঁড়ানোর জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। তার পাশে এসে দাঁড়ায় হাতে গোনা কিছু বন্ধুবান্ধব। যারা এই ছেলেটিকে সবসময় চোখে চোখে রাখত।
হাতে সময় খুব কম। যে মা তার জন্য এত কিছু করেছে, সেই মায়ের জন্য আবার ঘুরে দাঁড়ায় সে। ধীরে ধীরে পিছনে ফেলে আসে তার অন্ধকার জগতটাকে, একসময় উপলদ্ধি করে কতবড় ভুলই না সে করতে যাচ্ছিল।
আজ অনিক দেশের নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি নিয়ে লেখাপরা করছে। ওর রেজাল্টও সেরকম ভাল। সবার একরকমের ঈর্ষার পাত্র সে। মাঝে মাঝেই ওকে দেখে আমার হিংসা হয়। একটা মানুষ কিভাবে নিজেকে এতটা মটিভেট করে এরকম ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারে……????

৪,০৪৮ বার দেখা হয়েছে

৪৪ টি মন্তব্য : “জীবনের গল্প – ১”

  1. রহমান (৯২-৯৮)

    রেজওয়ান, লেখাটা ভাল হইছে :thumbup: । বাস্তব ঘটনা বলে আরো ভাল লাগল। আমাদের সমাজে যারা বিপথে চলে যাচ্ছে তারা সবাই যেন এই অনিকের মতো মটিভেট হয়ে আবারো আলোর জগতে ফিরে আসে সেই কামনা করছি।

    জবাব দিন
  2. সাইফ (৯৪-০০)

    প্রতিটি ক্যাডেট একেক্টা অমিত সম্ভাবনার দ্বার এর মতো।রেজওয়ান তোর এই লেখাটা সবুজের হলুদ ব্যাধিতে যারা আক্রান্ত তাদের জন্য ওষুধ হিসেবে কাজে দিবে আর অন্যদের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করবে..................... :clap:

    জবাব দিন
  3. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    রেজওয়ান ভাই জটিল হইছে :boss: :boss:
    আরো লিখেন আরো লিখেন :salute:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আইজক্যা আমার কুনু একটা প্রিবলেম হইতেছে। এই লেখাটাও চউক্ষু এড়াই গ্যাছে গ্যা।

    অনিকরে আমার সালাম দিও। আর কইও আমি কইছ "সাবাশ বেটা"


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    রেজওয়ান,
    সরি ফর লেট পার্টিসিপেশন।
    এটা আমি অফিসে বসে পড়েছিলাম। কিন্তু ওখানের কম্পিউটারে বাংলা লেখা খুব কষ্টকর বলে পরে লিখার জন্য তুলে রেখেছিলাম। তারপর কয়েক দফায় নানান হ্যাপা সামলাতে সামলাতে আর পেরে উঠিনি।

    তোমার লেখাটার ফ্যাক্টটা খুবই বাস্তব। আমি নিজেও এইরকম কয়েকটা ঘটনা জানি।
    মনে পড়ছে আইয়ুব বাচ্চুর গান: "ব্রোকেন ফ্যামিলি বয়....."।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুল হাসান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।