জীবনের গল্প – ৫

এইসব মানুষদের কথা এত অল্প করে লেখা যায় না। আর আমার কেন জানি মনে হয় এভাবে তাদের গল্প বলাও যায় না, তাদেরকে ছোট করা হয়। এরা হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে থাকা জ্বলন্ত উদাহরন। ভেঙ্গে পড়া মানুষ যে কিভাবে উঠে দাঁড়াতে পারে তা আমি এদের কাছ থেকেই শিখেছি। বন্ধু তোদের লাল সালাম…… :salute:

জীবনের গল্প – [১] [২] [৩] [৪]

ফাহিম

আমি যখন ক্লাস ৫ এ পড়ি তখন ফাহিমের মা মারা যান। প্রায় ৩/৪ মাস তিনি দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে যাওয়ায় প্রচুর যন্ত্রনা ভোগ করেন, তাকে ইন্ডিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে ফিরিয়ে আনার পড় শুরু হয় ডোনার খোঁজা। শেষে বহু খোঁজাখুঁজির পর একজন ডোনারও পাওয়া যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক হয়ত তাকে হায়াত দেন নি। কুরবানির ঈদের ৬ দিন পরে তার ফ্লাইট ছিল, ইন্ডিয়ার ব্যাঙ্গালোরের একটা হাসপাতালে অপারেশনের ডেট ও ফিক্স করা হয়েছিল, কিন্তু তার মাত্র তিন দিন আগে স্ট্রোক করে ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।

মায়ের চলে যাওয়ার সময় শুধু একবার মা বলে চিৎকার দিয়ে চুপ হয়ে যায় ফাহিম। এরপর তাকে আমি কখনও কাঁদতে দেখি নি। এমন কি যখন বরিশালে তাকে দাঁফন করা হয়েছে, তখন আমি ওকে শক্ত করে ধরে রেখে কাঁদছিলাম। কিন্তু ওর চোখ থেকে একফোটা পানি বের হতে দেখি নি। ছোট্ট বুকটা তখনই কেমন পাথরের মত হয়ে গিয়েছিল ওর।

ফাহিমের ভাসমান জীবনের শুরু এখান থেকেই। ওর বাবা পিরোজপুরের সরকারী একটা ব্যাঙ্ক এর কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ফাহিম কে নিয়ে যেতে চাইলে তার বড় খালা তাকে বাধা দেন, বলেন যে তিনি তাকে মানুষ করবেন। নিজের বোনের ছেলে তো নিজের ছেলের মতই। তাই তাকে তিনি নিয়ে গেলেন গাজীপুরে। ভালই কাটছিল প্রথম কয়েকমাস। কিন্তু প্রায় বছর না ঘুরতেই ফাহিমের যন্ত্রনায়(!) আর রাখতে পারলেন না তিনি। পাঠিয়ে দিলেন বরিশালে ফাহিমের নানা বাড়িতে। আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসল ফাহিম। এরপর ক্লাস ৮ পর্যন্ত আমাদের সাথেই ছিল।এরমধ্যেই (মা মারা যাবার দু বছর পর) একদিন খবর আসল যে ফাহিমের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করতে যাচ্ছেন।

ফাহিমকে এরপর নানা ভাবে খালা,মামারা নানুর বাসায় বুঝাত, দেখেছিস তোর বাপ বিয়ে করেছে, এখন যদি তোকে বাপের কাছে পাঠিয়ে দেই তাহলে বুঝবি সৎ মা কি জিনিস। নানা ভাবে ওর মধ্যে প্রথম থেকেই একটা চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, সৎ মা মানেই দজ্জাল টাইপের একটা মহিলা, ওর বাবাও আর আগের মত নেই, ও যদি ভাল ভাবে এখানে না থাকে তাহলে ওকে সেই নরকের মধ্যেই পাঠিয়ে দেয়া হবে।

ফাহিম যতক্ষন আমার সাথে থাকত বেশ ভালভাবেই কাটত, কিন্তু নানুবাড়িতে ঢোকা মাত্র তাকে শুনে যেতে হত নানা রকম যন্ত্রনা। মামা এবং নানু তাকে কন্ট্রোল করতে নাকি হিমিশিম খেত। মারপিট দিয়েও নাকি তাকে ঘরে রাখা যায় না। এমনি এক সময় আমি ক্যাডেট কলেজে চলে গেলাম। আর তারপর এক ছুটিতে এসে দেখলাম তার বাবা তাকে এসে পিরোজপুরে নিয়ে গেছেন। কিন্তু ততদিনে যে বাবা আর ছেলের মধ্যে ৩ বছরের একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে সেটা আর কেউ বুঝল না। নানুবাড়ীর লোকজন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঢাকা’র খালারও মনে হল যে ,না ওকে প্রথমেই বাবা’র কাছে পাঠানো উচিৎ ছিল।

প্রায় তিন বছর পর বাবার কাছে ফিরে গেল ফাহিম। ঘরে একজন সৎ মা। সে বেশ ভালভাবেই তাকে কাছে নিয়ে নিল। কিন্তু ফাহিম নিজেই তখন একটা দুরত্ব তৈরি করল সেই মহিলার সাথে। ক্লাস ৮ এর একটা ছেলের মাথায় যদি ওই বয়সে একটা ধারনা ঢুকিয়ে দেয়া হয় তাহলে সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। এরপর যা হবার, ফাহিম কোন ভাবে সেখানে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারল না। নিজের বাসায় এক রকমের বন্দী জীবন কাটাতে লাগল, নানা রকম কথা শুনে,চাপে থেকে, এমনকি বাবা’র কাছ থেকেও কোন রকম সহানুভুতি সে পায় নি। কারন বাবা’ও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, সে কোনভাবেই ওই মহিলার সাথে ভাল আচরন করছিল না। আস্তে আস্তে নিজের চারিদিকে একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়ে নিজের পৃথিবীটাকে আরও ছোট করে নিয়ে আসল।

বাসায় থাকা একসময় ওর জন্য দূর্বিষহ হয়ে পরেছিল। এরমাঝে প্রতিবেশী বাড়ির এক মেয়ের সাথে প্রেম করে নিজের উপর আরও বিপদ নিয়ে আসল। কোনরকমে এস.এস.সি শেষ করে আবার বরিশাল চলে আসল। নানু বাড়িতে উঠে আসল সে। কিন্তু তাকে নিতে আপত্তি দেখাল অনেকেই। তারপর এবার তার আশ্রয় মিলল ছোট খালার বাসায়। খালা সরকারি সিটি কলেজের টিচার ছিলেন, ফাহিমও সেই কলেজেই ভর্তি হল। তারপর ২ বছর আবার আমাদের মাঝে আবার ফিরে এল সে, অনেক পরিবর্তিত, নিজের ভিতর গুটিয়ে থাকে, হাসিখুশী নেই আগের মত, মানসিকতা অনেকটা অপরিপক্ক, ছেলেমানুষী কাজ কারবার। আসলে ততদিনে ও কিভাবে যেন মেনে নিয়েছে যে তার জীবন এভাবেই চলবে, ভেসে ভেসে……

ইন্টারে খারাপ করল সে, এবার শুরু হল খালার বাসাতেও যন্ত্রনা, কারন খালার ধারনা, সবাই ভাবছে যে তার অযত্নের কারনে সে খারাপ করেছে, সে এই দায়িত্ব আর নিতে পারবে না, তাই আবার তার ঠাঁই হল নানু বাড়ীতে। একটা বছর কাটাল সে, পরের বছর কোনমতে পরীক্ষা দিয়ে উতড়ে গেল। কিন্তু এরপর আবারও তার ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পরল। কারন বাবাও স্পষ্ট তাকে জানিয়ে দিল তিনি কিছু করতে পারবেন না। নানাবাড়ীতেও জায়গা হবে না। খালার বাসাতে তো না ই।

এগিয়ে এলেন ফাহিমের চাচা। তিনি চাচি সহ বিক্রমপুরে থাকেন। দুজনেই একটা কলেজের টিচার। সেখানে থেকেই তাকে ডিগ্রী পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন চাচা। ফাহিমও সব গুটিয়ে চলে এল। গত দু’বছর সে বিক্রমপুরেই ছিল, কিন্তু মাস দুয়েক আগে সে বরিশাল চলে এসেছিল, সেখানে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না, তাকে দেখে খুব খারাপই লাগল, জন্ডিস বাধিয়েছে, এবং খুব খারাপ ভাবেই…কিন্তু কে তার যত্ন নিবে? ১ মাস বরিশাল থেকে আবার ঢাকা চলে এল সে। কিন্তু এবার কারও বাসায় আর গেল না। নিজের ভাগ্য এখন নিজেই নির্ধারন করতে পথে বেড়িয়েছে………অনেক খোঁজাখুজি চলল। মোবাইলে পাওয়া যায় না। শেষমেষ একদিন ঢাকায় এক মামা’র বাসায় একদিন এসেছিল, ২ দিন থেকে চলে গেল সে, জানিয়ে গেল, সে এখন নিজের পথ নিজে করে নিবে, একটা পার্ট টাইম চাকরী খুঁজছে। এবং সেটা প্রায় পেয়েও গেছে। তার জন্য কাউকে চিন্তা করতে হবে না এখন। কারও বোঝা হয়ে আর না,অনেক তো হল। আপাতত এক বন্ধুর সাথে তার মেস এ আছে, তাকে না খুঁজলেও চলবে।

জীবনযুদ্ধের অর্ধেকপথ পারি দিয়েছে একজন পরাজিত মানুষ হিসেবে। আজ সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জীবনটাকে যে সঁপে দিয়েছিল ভাগ্যের হাতে, আজ সেই ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ার সংকল্প নিয়ে আবার লড়াই এ নেমেছে সে, আমার বন্ধু ফাহিম।

৩৬ টি মন্তব্য : “জীবনের গল্প – ৫”

  1. রকিব (০১-০৭)

    জীবনের গল্প যাদেরকে নিয়ে তাঁরা হারবেন না, তাঁরা হারতে পারেন না। ফাহিম ভাইয়ের জন্য একরাশ শুভ কামনা।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    সামান্য কিছু জিনিস সহজে না পাওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরি আমি এবং আমার মত অনেকেই। তোর এই গল্পগুলা পড়লে মনে হয় কতই না আরামে আছি।

    কেমন আছিস রেজু?

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রকিব (০১-০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।