হ্যালো ব্যবসা

অগ্রহায়ণ মাস যাইতেছে, তথাপিও শীতের দেখা মিলিতেছে না। আসি আসি বলিয়াও শীত জাঁকিয়া বসিতে পারিতেছে না কেন, তাহা নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তিত হইয়া মন আকু পাকু করিয়া উঠিলেও ইহার রহস্য ভেদ করিতে পারিতেছেনা। আমার এই ভোঁতা মস্তিষ্ক কোন কারণ না পাইয়া শেষে দোষটা দিয়া বসিতেছে ঐ নন্দঘোষ অভাগা বাঙ্গালীর উপর। বাঙ্গালীর সংখ্যা যেইভাবে এই ভূখণ্ডে বাড়িতেছে তাহাতে অদূর ভবিষ্যতে শুধু শীত কেন, বর্ষাকালও যে বাংলাদেশের বুক থেকে হারিয়া যাইয়া শুধু গ্রীষ্মের জন্য জায়গা করিয়া দিবে তাহা ভাবিবার মত বিষয় হইয়া দাঁড়ায়াইছে। ফি বছর কাটিয়া যাইতেছে তাহার সাথে বাংলাদেশেও শীতের তীব্রতা কমিয়া আসিতেছে বইকি, কিন্তু দুনিয়ার মানুষের অস্থিরতা দিন দিন বাড়িয়া যাইতেছে। বাঙ্গালীর অস্থিরতা ত অনেক আগেই বাড়িয়া “অস্থির স্কেলের” বাহিরে চলিয়া গিয়াছে, শীতকালের কিঞ্চিৎ বেশী সময় অবস্থান যে কিছুটা হইলেও এই অস্থিরতা “অস্থির স্কেলের” ভিতেরে আসিয়া পড়িত, তাহা কেন জানি বারবার মনে আসিতেছে ভাবিয়া পাইতেছিনা।

অস্থিরতা বৃদ্ধির প্রভাব আমার এই ক্ষুদ্র মনের মধ্যেও যে ব্যাপক ভাবে পড়িতেছে তাহা বেশ হলফ করিয়া বুঝিয়া উঠিয়াছি। মনটা যে কি পরিমাণ অস্থির হইয়া পড়িয়াছে তাহা টেলিভিশনের সামনে একবার বসিলে বুঝিতে পারি। কোন ভাবে যদি বাড়ির অন্যান্যদের হইতে রিমোট নামক যন্ত্রটা একবার হস্তলব্ধ হইয়া যায়, তাহার পড়ে সেইটাকে শুধু আঙ্গুলের পেষণে অস্থির বানাইতে ইচ্ছা করে। কোন চ্যানেলেই মন স্থির থাকিতে চাহেনা। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই ৫০ খানা চ্যানেল ঘুরিয়া বেড়াইলো কিন্তু কোথাও মনপাখি স্বচ্ছন্দ বোধ করিয়া উঠিলনা। অনুষ্ঠান দেখিবার বদলে চ্যানেল পরিবর্তনেই অস্থির এই মন বিনোদন খুঁজিয়া পাইতেছে। এইভাবেই সময় যাইতেছিল। কয়েকদিন আগের কথা। টিভির চ্যানেল অস্থির ভাবে ঘুরাইতে ঘুরাইতে হঠাৎ “হ্যালো ব্যবসা” শব্দটি কর্ণকুহরে প্রবেশ করিবা মাত্রই রিমোটের জাম্প বাটন পেষণ ক্ষান্ত করিয়া কাঙ্খিত চ্যানেলে মন-চোখ স্থির করিবার চেষ্টা চালাইলাম। মনে মনে ভাবিলাম তিন মাস ধরিয়া বেকার জীবন কাঁটাইতেছি, এইবার হয়ত একটা নতুন ফন্দি-ফিকির করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিবার ব্যবস্থা করিতে পারিব। কিন্তু চ্যানেলে যাইয়া দেখি আফসানা মিমি আপা নাটক ছাড়িয়া সঞ্চালকের ভূমিকায় অবস্থান গ্রহণ করিয়াছেন। অনুষ্ঠানে মিমি আপা ছাড়াও একজন পুলিশ কর্মকর্তা, একজন রিপোর্টার আর একজন প্রাক্তন “হ্যালো ব্যবসায়ী” পর্দার আড়ালে থাকিয়া অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করিতেছে। পুলিশের উপস্থিতি আমাকে হতদ্যম করিয়া ফেলিল। পুলিশ যেহেতু উপস্থিত হইয়াছে, গণ্ডগোল নিশ্চয় থাকিবে, তাই রিজিকের চিন্তা বাদ দিইয়া, তাহারা সবাই মিলিয়া কি বলিতে চাহিতেছে তাহা বুঝিবার জন্য মন সংযোগ করিলাম।

নাম অনুসন্ধান বাদ দিইয়া অনুষ্ঠানটি মাঝ হইতে দেখিতে লাগিলাম এবং শেষ করিয়া বুঝিলাম, মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলার তিনটি গ্রামের লোকজন মিলিয়া দেশে “হ্যালো ব্যবসা” নামক একটি নতুন বিজনেস কনসেপ্ট দাঁড় করাইয়া ফেলিয়াছে এবং তাহাদের দেখাদেখি আরো লোকজন তাহাদেরই দেখানো পথে বিনা পুঁজিতেই ব্যবসা করিয়া লাভের জলে সাঁতার কাটিতেছে। ইহা “চোটপাট ব্যবসা” নামেও ব্যাপক সুনাম কুঁড়াইয়াছে। এই ব্যবসাটির ধরণ নতুন না হইলেও নামকরণ যে নতুন আর অভিনব তাহা যে কেহই বলিয়া দিবে। এই সকল ব্যবসায়ীরা নাকি বিভিন্ন ভাবে নিরীহ মানুষ জনের টেলিফোন নম্বর জোগাড় যন্ত্র করিয়া ফোনে বিভিন্ন কুখ্যাত সন্ত্রাসীর নাম ভাঙ্গিয়া, ঢাকা ও অন্যান্য শহরের মানুষের কাছ হইতে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করিয়া বিভিন্ন পরিমাণের টাকা হাতাইয়া লইতেছে। রিপোর্টারের বক্তব্য এবং পরবর্তীতে এই অধমের অর্ন্তজালে অনুসন্ধানের মাধ্যমে বুঝিতে পারিলাম, আমি হয়ত বোকার রাজ্যে বসবাস করিতেছি নয়ত লোকচক্ষুর অন্তরালে যাইয়া বন জংগলে সন্ন্যাসীর জীবন ধারণ করিয়াছি। তাহা না হইলে জুলাই মাসে এই “হ্যালো ব্যবসা” নিয়ে “প্রথম আলো” পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল তাহা কেন এই অভাগার দৃষ্টিতে পড়িল না? তাহার একটি কারণ হয়ত হইবে, সেই সময় আমার বাংলাদেশ হইতে দশ হাজার মাইল দূরের প্রবাস জীবন।

যাহা হউক এই “হ্যালো ব্যবসা” নিয়া জানিতে গিইয়া নিজেকে যারপরনাই বেকুব ভাবিতে কুণ্ঠিত বোধ করিলাম না। সাধারণ গ্রাম্য বাঙ্গালীর মাথায় কত বুদ্ধি গিজগিজ করিতে পারে তাহা যদি বিজাতীয় পশ্চিমা সভ্যতার লোকজন জানিত, তাহা হইলে বাঙ্গালীকে আর বিশ্ব দরবারে মাথা নত করিয়া চলিতে হইত না। আসিতে যাইতে তাহারাও কয়েক বার বড় বড় দেশের বড় বড় গড ফাদারদের সালাম পাইত। এই “হ্যালো ব্যবসা” করিয়া লুন্দি নামক গ্রামের সকলেই নিজ নিজ বাড়িতে পাকা ঘর তুলিয়াছে। প্রায় ১০ বছর ধরিয়া নাকি এই ব্যবসা চালু রহিয়াছে কিন্তু কিছুদিন আগে ইহা লইয়া পত্র-পত্রিকা এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী দৌড়-ঝাঁপ করিতেছে। কুম্ভকর্ণ বাঙ্গালী হইতে এর চেয়ে আর কিই বা বেশী আশা করা যাইতে পারে? যেইখানে আমাদের ভাইয়েরা মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলোতে বছরের পর বছর কাজ করিয়া কোন রকমে টিকিয়া থাকিতেছ, সেইখানে মাদারীপুরের কতিপয় গ্রামের লোকজন কয়েকটি ফোন কল করিয়াই রাতারাতি নিজ নিজ ঘরে সুখের ঢেউ তুলিতেছে। পত্রিকা মারফত জানিতে পারিয়াছিলাম যে, মোবাইল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের টেলি সার্ভিস দিইয়া দেশে-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করিয়াছে। দেশ-বিদেশের বড় বড় তস্করেরা এই ধরনের “হ্যালো ব্যবসায়ীদের” খোঁজ পাইলে উহাদেরকেও পুরষ্কারে ভূষিত করিয়া গর্বিত হইত তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। আমাদের দেশের মার্কেটিং এখনো সেই অবস্থানে যাইতে পারে নাই দেখিয়া এবং এই বাটপারদের পুরষ্কার হইতে বঞ্চিত হইতে দেখিয়া মনে বড় যাতনা বোধ করিতেছি।

অবাক করার মত বিষয়, ঐ সকল গ্রামের প্রায় ৮০ শতাংশ লোকের জীবন ধারণের মাধ্যম হইল এই বিখ্যাত “হ্যালো ব্যবসা”। আগে শুনিতাম এক গ্রামে এক কি দুজন চোর-বাটপার থাকে এখন দেখিতে পাইতেছি ঐসকল গ্রামের সব লোকই এই তস্কর শ্রেণী ভুক্ত। এমনকি তাহারা স্কুলের কক্ষ ব্যবহার করিয়া মানুষকে ভয়-ভীতি দেখাইয়া বেড়াইতেছে। বিদ্যালয়ে বিদ্যার বদলে বাটপারি শিখানো হইতেছে। ধন্য লুন্দি গ্রামের সচেতন ভাই ও বোনেরা। শুধু কি তাই? বাবা-ছেলে মিলে এই ব্যবসায় জড়িত হইয়া বংশের মুখও অনেক বাটপার উজ্জল করিতেছে। আগে শুনিতাম চোরও নাকি চাহিতনা তাহার ছেলে চৌর্য বৃত্তি করুক। এখন দিন বদলাইয়াছে। বাবাও চাহিয়া বেড়ায় তাহার ছেলে চোর-বাটপার হইয়া সমাজে টিকিয়া থাকুক। বাপকা বেটা সিপাহীকে ঘোড়ার আবশ্যকতা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম। আবার সেই বাবা তাহার ছেলের নাম সংবাদ পত্রে প্রকাশ করিয়া দিবার পর,সেই রিপোর্টারের সাথে যোগাযোগ করিয়া তাহার ছেলের নাম কাটিয়া দিবার অনুরোধই শুধু করে নাই, রিপোর্টারের মোবাইলে ৫০০ টাকা ফ্লেক্সি লোড করিয়া দিতে চাহিয়াছিল। সৎ সাংবাদিক তাহার সেই ঘুষের ডাকে সারা দিবার প্রয়োজন বোধ করে নাই। সবচেয়ে খারাপ লাগিল তাহারা নাকি পত্র-পত্রিকায় যেই সব অসহায় লোকজন সাহায্যের আবেদন চাহিয়া বিজ্ঞাপন দিয়াছে, তাহাদের সাথেও যোগাযোগ করিয়া প্রতারণার মাধ্যমে নিজেদেরকে বিভিন্ন এনজিও বা সাহায্য সংস্থার লোকজন দাবি করিয়া রেজিস্ট্রেশনের নাম করিয়া ৫-১০ হাজার টাকা হাতাইয়া লইতে কুণ্ঠা বোধ করিতেছে না। চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী বলেও ত কথা শুনিয়াছি, “হ্যালো ব্যবসায়ীদের” থেকে কুণ্ঠা বোধ আশা করা হইবে সুদূর পরাহত। কোথাও পড়িয়াছিলাম পাতালের সাত স্তরের কথা। অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল এবং পাতাল। আমাদের সমাজে কারও অধঃপতন হইলে নীতিবান লোকজন বলিয়া বেড়ায় রসাতলে গিয়াছে অর্থাৎ ষষ্ঠ স্তরে গিয়ে পড়ার কথা বলা হইয়াছে, পাতালে নয়। কিন্তু এই মানুষ নামের “হ্যালো ব্যবসায়ী” সারমেয়দের স্থান পাতালেও হবেনা বলিতে আমার দ্বিধা করিতেছে না।

আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এদের অনেককেই ধরিতে পারিলেও তাহারা এখন দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার কাছে গিয়া এই “হ্যালো ব্যবসা” সচল রাখিয়াছে। মাঝে মাঝে সীমান্তের ওপারে গিয়া আত্মগোপন করিয়া থাকিতেছে আবার কিছুদিন পরে নিজ এলাকায় আসিয়া সুনামের সাথে থাকিয়া এই ব্যবসা চালাইয়া যাইতেছে। সারা দেশেই তাহাদের নেটওয়ার্ক ছড়াইয়া গিয়াছে। যদিও মিমি আপার সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত পুলিশের ভদ্রলোক দর্শকদেরকে সান্ত্বনা দিয়া বলিয়াছিলেন, এইরকম কাহারো সহিত বাটপারি হইলে সাথে সাথে নিকটস্থ পুলিশ কিংবা র্যা ব এর অফিসে জানাইবার জন্য, কোন রকম জিডি ছাড়াই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এইসব বাটপারদের বাহিনীকে ধরিতে অভিযান চালাইবে তথাপিও এই অধম বলিতেছে, সাধু সাবধান!

১,২০৫ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “হ্যালো ব্যবসা”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    শর্টকাটে অবৈধ পথে টাকা কামানোর নিত্য নতুন ব্যবসা আবিষ্কারে আমরা বরাবরই অতুলনীয় ।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।