জীবন তবুও অম্লান – (ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা-৪)


[আগের আধ্যায় – ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা]
[আগের আধ্যায় – অজানা যাত্রা – ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা-২]
[আগের আধ্যায় – নববর্ষ ‘৭১ – ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা-৩]

প্রায় এক মাস কেটে গেল আমাদের চট্টগ্রামের প্রত্যান্ত গ্রাম চরণ দ্বীপে বসবাস। এর মধ্যে আমাদের সাথে কোন আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের যোগাযোগ হয়নি। তারা কোথায়, কে কেমন আছে তাও জানিনা। গ্রামের জীবন মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল এতো দিন। এক দিন গুজব শোনা গেল – পাকি আর্মি নাকি আমাদের গ্রামের দিকে ছুটে আসছে। গ্রামের অনেকেই গ্রাম ছেড়ে দূরতম গ্রামে পলায়ন করলো। আমাদের আশ্রয়দাতারা আমাদেরকেও পালাবার উপদেশ দিলেন। তারা আবশ্য ঠিক করলেন আরও অপেক্ষা করে দেখতে। আমরাও রয়ে গেলাম তাদের সাথে সাথে।

রহমান সাহেব বিগত ইলেকশনের সময়ের কিছু পোষ্টার নিয়ে এলেন। এগুলি ছিল ওই এলাকার পরাজিত মুসলিম লীগের ক্যান্ডিডেটের পোষ্টার। বাড়ীর ঘরের দেওয়ালে এগুলি লাগাতে রহমান সাহেবকে সাহায্য করলাম। যদি পাকি আর্মি আসে তবে তারা দেখবে যে এ বাড়ীটি মুসলিম লীগের প্রার্থীকে সমার্থন করেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে নয়। পরে জানলাম এ গ্রামের অনেক বাড়ীতেই এই পোষ্টার লাগানো হয়েছে। এই মুসলিম লীগের প্রার্থী বিগত নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেছিল। আমি ভাবছিলাম, যদি পাকি আর্মি এসে ঘরে ঘরে এই পেষ্টার দেখে, তবে কি তাদের মনে এই প্রশ্ন জাগবে না যে এত অধিক সমর্থন থাকতেও কেন এই প্রার্থী নির্বাচনে জিততে পারেনি? তবে এত বুদ্ধিই যদি পাকিদের থাকতো, তবে কি তারা এই ভাবে পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে পারতো?

শেষ পর্যন্ত আমাদের আশংকা অমূলক প্রমানিত হলো এবং কোন আর্মি এ্যাকশন এই গ্রামে হলো না। তবে আমরা বিভিন্ন স্থান থেকে নানা রকম আর্মি এ্যাকশন ও অত্যাচারের কাহিনী শুনতে থাকলাম। আমরা শুনলাম যে এখন প্রতিটি গ্রামে পাকিস্তানপন্থী আনসার বাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন হচ্ছে এবং তারা খুঁজে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে কারা শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। খোঁজ পেলে তাদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য দ্রবাদি জোর করে নিয়ে নিচ্ছে। শুধু পাকি আর্মি নয়, এই সব নতুন সৃষ্ট বাহিনীর হাতে অকথ্য অত্যাচার, রেপ ও হত্যার খবর আসতে শুরু করলো। চরণ দ্বীপ যদিও পূর্ব বাংলার ৬৪,০০০ গ্রামের মধ্যে অত্যান্ত অখ্যাত এক প্রত্যান্ত গ্রাম, তবে কি নিশ্চয়তা আছে যে এই গ্রামেও একদিন এই সব অত্যাচার শুরু হবে না?

পিংকু এসে জানালো তাকে যে ১০০ টাকা দিয়েছিলাম তার থেকে মাত্র ২০ টাকা অবশিষ্ট আছে। মাত্র ৮০ টাকা দিয়ে সে ষে সম্পূর্ণ মাস চালাতে পেরেছে, তাতেই অবাক হলাম আমি। ঠিক করলাম, পরের দিন আমি চট্টগ্রাম শহরে বুকে সাহস বেঁধে যাবার চেষ্টা করবো। যখন আমার এই সিদ্ধান্তের কথা পিংকুকে জানালাম তখন দেখলাম, যদিও সে বুঝেছিল যে এটাই যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত এবং সে কিছু না বলে মেনে নিলো – তবে তার চোখে স্পষ্ট দেখলাম আমাকে যেন কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না।

পরের দিন আমাদের অবশিষ্ট টাকা ভাগ করে পিংকুর সাথে ১০ টাকা রেখে দিয়ে বাকী ১০ টাকা নিয়ে আমার বহু পরিচিত চট্টগ্রাম শহরের পথে এবারের অপরিচিত যাত্রা শুরু করলাম। রহমান সাহেব ও আরও কয়েক জন আমার সাথে নদীর ঘাট পর্যন্ত এসে আমাকে নৌকায় উঠিয়ে দিলেন। নৌকায় আরও কিছু লোক ছিল যারা নদীর ওপারে যাচ্ছিল। তবে দেখা গেল এ গ্রাম থেকে আমিই প্রথম সাহস করে চট্টগ্রাম শহর পানে যাচ্ছি।

নৌকা কালুরঘাট ব্রিজ থেকে একটু দূরে আমাদেরকে নামিয়ে দিল যেহেতু ঠিক ব্রিজের মুখে পাকি আর্মি তখন চেক পোষ্ট বসিয়েছে। আমি অন্যদের সাথে প্রায় আধা মাইল হাটলাম মেইন রাস্তায় পৌঁছাতে। দেখলাম, রাস্তায় একটি শহরমূখী বাস তখন দাঁড়িয়ে আছে। বাসে উঠে দেখলাম শুধু সামান্য কয়েকজন লোক সেখানে বসে আছে। শুধু যাদের নেহাতই যাত্রা করা দরকার তারাই আছে সেখানে। যখন বাস যাত্রা শুরু করলো, আমি রাস্তার দুই পাশে তাকিয়ে যেন কিছুই চিনতে পারলাম না। রাস্তার দু’ধারে যে সব দোকান-পাটি ও বাড়ী-ঘর ছিল, সেগুলি সবই পুড়ে গেছে। খুব কম লোককে দেখলাম রাস্তার পাশ দিয়ে হাটতে। অথচ মাত্র এক মাস আগে এই রাস্তার দুই পাশ মানুষজনে গিজগিজ করতো।

চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছাবার আগে আর একটা চেক পয়েন্টে থামতে হলো। এক পাকি সৈনিক রাইফেল কাধে নিয়ে বাসের মধ্যে ঢুকলো। বাসের কন্ডাক্টার আগেই সবাইকে শিখিয়েছিল কি করতে হবে চেকিংয়ের সময়। সে বিশেষ করে বলে দিয়েছিল চেকিংয়ের সময় আমরা যেন অন্য দিকে না তাকিয়ে থাকি এবং চোখাচোখি দৃষ্টি থেকে যেন চোখ সড়িয়ে না নিই। প্রশ্ন করলে যেন তখনি উত্তর দিই। ভিতরে ভিতরে আমার যতেষ্ট টেনশন ছিল, যেহেতু আমি শুনেছিলাম যে আমার বয়সী ছেলেদেরকেই সাধারণত ধরা হচ্ছে ইন্টেরোগেশনের জন্যে। পিংকু বলে দিয়েছিল যেন যাত্রার সারাটা সময় আমি মনে মনে ‘কুলহু আল্লাহ’ পড়তে থাকি এবং আমি তাই করতে থাকলাম এবং খুব কষ্ট করে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম যাতে আমার টেনশন বাইরে প্রকাশ না পায়। সৈনিকটা আমাদেরকে ছেড়ে দিল।

বাস থামার পর আমি হেটে জুবিলী রোডে অবস্থিত পি,আই,এ, টিকিট বুকিং অফিসে এলাম। জানলাম যে যে কোন সময় টিকিট কেনা যাবে তবে এখান থেকে কোন নির্দিষ্ট বুকিং দেওয়া হচ্ছে না। শুধু এয়ার পোর্টে যাবার পর জানাবে ফ্লাইটে সীট হবে কিনা। কাছেই আমার বন্ধু মোখলেস-মাহবুবাদের বাড়ী। মাহবুবাকে আমি তার বিয়ের অনেক আগে থেকে চিনি। তার বড় আপার স্বামী ছিলেন চট্টগ্রামের এস,পি শামসুল হক। আমাকে বিশেষ পছন্দ করতেন তিনি। শুনলাম হক সাহেবের কোন খোঁজ তখনও পাওয়া যাচ্ছেনা। মাহবুবাকে চিনতে প্রথমে কষ্ট হচ্ছিল। মাত্র এক মাসে এত রোগা হয়ে গেছে মনে হচ্ছিল অন্য কেউ। মানসিক ভাবে মনে হলে সে খুবই মুষড়ে পরেছে। আমি কোথায় আছি বা কেমন আছি তা জানতেও চাইল না। অথচ এই বাড়ীতে আমি রাত কাটিয়েছি, খেয়েছি এবং পিংকুকে নিয়ে বিয়ের পর চট্টগ্রাম পৌছালে এরাই আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোটে ছুটে গিয়েছিল।

ক্যাডেট কলেজের বন্ধু মেজবাহ গ্রিন্ন্ডলেজ ব্যাংকে কাজ করতো। সৌভাগ্যক্রমে ব্যাংকে যেয়ে পেলাম তাকে। তার কাছ থেকে ২৫০ টাকা ধার চেয়ে নিলাম। সেও টাকা দেবার পর আমার সাথে বেশী কথা বলার আগ্রহ দেখাল না। সবাইকে মনে হল যেন কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। ইতিমধ্যে দুপুর হয়ে গেছে। আমি ঠিক করলাম দুপুরের খাবার কিনে পয়সা আর সময় নষ্ট না করে তখনি ফিরে যেতে। বাস ষ্টেশন পর্যন্ত হেটে এসে কালুরঘাটের বাসে উঠে বসলাম।

আমি যখন নদীর ধারে পৌছালাম তখন বিকাল প্রায় ৩টা বাজে। অথচ মনে হলো কোন ক্ষিধা নেই। টেনশনে আমার ক্ষুধা যেন লোপ পেয়ে গেছে। আমি জানলাম আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এখানেই ঘন্টা দুয়েক আগে পাকি আর্মি এক তরুনকে এনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে। পাশের পুকুরে ফেলে দেওয়া তরুনের মৃতদেহ তখনো সমাহিত করা হয়নি। তখনও পরে আছে সেটা সেখানে।

নিঃশব্দে নদী পাড় হলাম। আমাকে দেখে দুশ্চিন্তামুক্ত হল পিংকু। আমি তার চোখে শুখনো কান্নার দাগ দেখলাম। আমি অনুভব করলাম মাত্র এক মাসের মধ্যে সে আমাকে কতটা ভালবাসতে এবং আমার উপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। আল্লাহকে ধন্যবাদ দিলাম এ পর্যন্ত আমাদেরকে রক্ষা করার জন্যে।

আমি যা দেখে শুনে এলাম তাতে মনে হল গ্রাম আর আগের মত নিরাপদ থাকছে না। পিংকুর সাথে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলাম যে আমরা বরং ঝুকি নিয়ে চট্টগ্রাম এবং সম্ভব হলে ঢাকা যাবার চেষ্টা করবো। এক দিন পরেই আমাদের যাত্রার দিন ঠিক করলাম। আলি আকবরও চাইলো ঝুকি নিয়ে কুমিল্লায় তার দেশের বাড়ীতে যেতে। যাতায়াত বাবদ ৬০ টাকা চাইল আমার কাছে। আমার ধার করা ২৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা দিয়ে দিলাম তাকে। আমার কাছ থেকে তার তখনো দুই মাসের মাইনে পাওনা আছে।

আমাদের আশ্রয়দাতা পরিবারের কাছ থেকে যখন বিদায় নিলাম তখন দেখি সবারই চোখ ছলছল করছে। পিংকু এই পরিবারে যতেষ্ট প্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাড়ীর ছোট ছেলে মেয়েরা তার পাশ ছাড়তে চাইছিল না। সবার সামনেই অনিশ্চিত ভবিষ্যত। কেউই জানিনা কোন সিদ্ধান্তটি সঠিক। ফলে কেউই সাহস করে আমাদেরকে যেতে দিতে বা থাকতে বলতে পারলো না। আমরা সবাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ভাগ্যের হাতে সপে দিলাম নিজেদেরকে।

ছোট একটি সুটকেস ছাড়া সাথে নেবার তেমন কিছু ছিল না। ধার করা লুঙ্গি দু’টি ফেরত দিলাম আলি আকবরকে। সে আমাদের সাথে থাকলো নদী পার হওয়া পর্ষন্ত। নদী পার হবার পর একটা অটোরিক্সা পেয়ে গেলাম এবং বাসে যাবার বদলে সেটাতেই চড়ে বসলাম। সমস্ত যাত্রা পথে আমরা সব সময় খুব উৎকন্ঠায় কাটালাম, তবে সৈভাগ্যক্রমে কোন অঘটনের মুখামুখি হতে হল না। আমরা সোজা পি,আই,এ অফিসে এসে ঢাকার দু’টি ওপেন টিকেট কাটলাম। তারা আমাদেরকে পি,আই,এর বাসে চেপে এয়ার পোর্ট পর্যন্ত যেতে অনুমতি দিল। পিংকুর মনে নিশ্চয় অনেক স্মৃতি জেগে উঠছিল। আমার মনেও। আমরা আমাদের সঞ্চিত অনেক কিছুই পিছনে ছেড়ে যাচ্ছি। আমাদের গাড়ী, পিংকুর অধিকাংশ শাড়ী ও পোষাক, তার বিয়ের গহনার অর্ধেক, আমার কয়েক প্রস্থ স্যুট, বিয়েতে পাওয়া অনেক উপহার, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তবে আমরা কেউই ওসব নিয়ে ভাবছিলাম না। আমরা শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম যেন আমরা নিরাপদে ঢাকা পৌছাতে পারি।

এয়ার পোর্টে পৌছে আমরা চেক-ইন কাউন্টারে হাজিরা দিলাম। তেমন ভিড় দেখলাম না, তবু আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বললো এবং ওয়েটিং লিষ্টে আমাদের নাম ঢুকিয়ে রাখলো। আমাদের পরিচিত কোন গ্রাউন্ড স্টাফ দেখলাম না। শুধু অবাঙ্গালী বিহারী স্টাফদের দেখলাম সেখানে। অন্যদের কথা জিজ্ঞাসা করতেও ভয় পেলাম আমরা। সমস্ত পরিবেশ কেমন যেন গা ছমছম করার মত।

যা আমি পিংকুকে বলিনি তা হচ্ছে, আমি এর আগে শুনে এসেছি যে এয়ার পোর্টে তরুন বয়সের যুবক-যুবতীদেরকে যাত্রা থেকে বাধা দিয়ে মিলিটারীদের হাতে সপে দেওয়া হচ্ছে। যুবকদেরকে মুক্তি সন্দেহে এবং যুবতীদেরকে পাকি আর্মির মনরঞ্জনের জন্যে। ভীড় না থাকা সত্বেও যখন এই বিহারী সুপারভাইজার আমাদেরকে বোর্ডিং পাস না দিয়ে ওয়েটিং লিষ্টে নাম ঢুকিয়ে রাখলো, তখন আমার দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেলো। তবু কেন জানি, ভিতর থেকে একটা মনের জোর অনুভব করছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত সব কিছু ভাল ভাবেই কাটবে।

যথন ঢাকা থেকে প্লেন এসে নামলো এবং একে একে প্যাসেনজার ও ক্রু বিমান থেকে নামা শুরু করলো, পিংকু আবিস্কার করলো যে তার পরিচিত ক্যাপ্টেন জিয়া এই বিমানের ক্যাপ্টেন। পিংকুকে ওয়েটিং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখে ক্যাপ্টেন জিয়া বেরিয়ে এসে জানতে চাইলো। তাকে জানালাম যে আমরা এখনো ওয়েটিং লিষ্টে এবং আমরা ঢাকা যেতে চাই। ক্যাপ্টেন জিয়া সুপারভাইজারকে ডেকে আমাদেরকে বোর্ডিং পাস দিতে বললো।

যখন অন্য যাত্রীরা বিমানে চড়া আরম্ভ করে দিয়েছে তখনই বোর্ডিং পাস হাতে পেলাম আমরা। তখনও আমদের লাগেজ চেক হওয়া বাকী। ক্যাপ্টেন জিয়া তার কো-পাইলটকে প্লেন স্টার্ট করতে পাঠিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো আমাদের ল্যাগেজ চেক শেষ না হওয়া পর্যন্ত। যাত্রীদের মধ্যে আমরাই সব শেষে। পিংকু তার সাথের গহনাগুলি একটি খালি ওভালটিনের কৌটার মধ্যে ভরে রেখেছিল। চেকিংয়ের সময় কৌটা খুলে গহনাগুলির উপর চোখ পড়ল তাদের। ক্যাপ্টেন জিয়া তখনও কাছিকাছি দাঁড়িয়ে আমাদের উপর নজর রাখছে। তাই দেখে সুপারভাইজার ভাল মানুষ সাজার অভিনয় করে পিংকুকে বললো কৌটা থেকে বের করে গহনা গুলি নিরাপদে রাখার জন্যে তার হাত ব্যাগে রাখতে। আমরা যখন বিমানের সিড়িতে উঠছি, শুধু তখন ক্যাপ্টেন জিয়া বিমানের দিকে রওয়ানা হল। ততক্ষণে তার কো-পাইলট বিমানের ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিয়েছে এবং প্রপেলার ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। বিমানের ভিতর প্রবেশ করার পর দেখলাম প্লেনের অর্ধেকও ভর্তি না। আমি বুঝলাম কতটা বড় সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে এসেছি আমরা। প্লেন যখন আকাশে, তখন ক্যাপ্টেন জিয়া একবার ক্যাবিনের মধ্যে এলো পিছনে টয়লেটে যাবার পথে। সে তাকিয়ে আমাদেরকে দেখল, কিন্তু কোন কথা বলল না। আমার মনে হলো সে যেন দেখে গেল আমরা ঠিক মত আছি কিনা। বাকি প্যাসেঞ্জারের মধ্যে হয়তো সিকিউরিটির লোক বসে ছিল, জিয়া শুধু শুধু আমাদেরকে আরও বিপদের মধ্যে ফেলতে চাইনি।

ঢাকা তেজগাঁ এয়ার পোর্ট মনে হল যেন ঠিক আগের মতই আছে। একটা বিরাট দুঃশ্চিন্তা যেন দূর হল যখন এয়ার পোর্ট বিল্ডিং থেকে বের হয়ে একটা রিক্সায় উঠে বসলাম আমরা। পায়ের কাছে সুটকেসটা রেখে তার পাশে চাপাচাপি করে বসলাম আমরা। যারা ২৫শে মার্চ ঢাকায় ছিল তাদের কাছে হয়তো মনে হতে পারে ঢাকার চেহারা বদলে গেছে, কিন্তু চরণ দ্বীপে এক মাস কাটিয়ে এসে আমাদের চোখে মনে হল ঢাকা যেন ঠিক আগের মতই আছে। আমরা আবার স্বভাবিক ভাবে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করলাম।

কাছেই কাঠাল বাগানে আমার সেজ আপা থাকতেন। তার বাড়ীতেই উঠবো ঠিক করলাম। রিক্সা যখন কাঠান বাগানের গলিতে প্রবেশ করলো, মনে হল চারিপাশে যেন শান্ত এক পরিবেশ বিরাজ করছে। আমাদেরকে দেখতে পেয়ে খুবই খুশী হলেন সেজ আপা। জড়িয়ে ধরলেন আমাদের দু’জনকে। আমি দেখলাম তার দু’চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরে পড়ছে। তিনি আমাকে খুবই ভালবাসতেন। ঢাকাতে তখন বসন্ত কাল। লাল কৃষ্ঞচূড়ায় ছেয়ে গেছে সমস্ত শহর। কোকিলের ডাক শুনলাম। মনে হলো আমরা যেন নতুন জীবন ফিরে পেয়েছি।

Krishnachura

পরিশিষ্ট

[ চট্টগ্রামের এস, পি শামসুল হককে পাকি আর্মি ধরে নিয়ে অনেক অত্যাচারের পরে হত্যা করে। তার মৃতদেহ কখনো উদ্ধার করা যায়নি।

মোখলেস-মাহবুবা দু’জনেই এখন মৃত। উত্তরা মটরের মালিক ছিল মোখলেস।

স্বাধীনতার পর আলী আকবরকে খুজে বের করি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চাকরীরত অবস্থায়। তার পাওনা মিটিয়ে দিতে পেরে দায়মুক্ত হই।

মেজবাহকে টাকা ফেরত দিতে যেয়ে দেখি ২৫০ টাকার কথা মনে নেই তার। ব্যাংকের খুব সিনিয়ার আফিসার সে তখন। এখন সে লন্ডনে থাকে, টেলিফোনে মাঝে মাঝে কথা হয়।

আমার সেজ আপা, সাহিত্যিকা সাদেকা শফিউল্লাহ, ক’য়েক বছর হল মারা গেছেন। শিশু একাডেমীর পরিচালিকা ছিলেন তিনি।

সিরিয়াসলি কখনো ক্যাপ্টেন জিয়াকে খোজ করে আমাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্যে কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাইনি। জানি না ক্যাপ্টেন জিয়া এখন বেচে আছেন কিনা। ১৯৭৪ সালে জেনেভা যাবার পথে প্লেন স্বল্প সময়ের জন্যে করাচীতে থেমেছিলো। এয়ার পোর্টে নেমে পেসাব করে এসেছি। মনে তখনো প্রচন্ড পাকি ঘৃনা।

চট্টগ্রামে নানা কাজে বহুবার যেতে হয়েছে । ব্যস্ততার কারণে কখনও আর সময় করে উঠতে পারিনি আবার চরণ দ্বীপে যেয়ে রহমান সাহেব বা তার বড় ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসতে। হাজার হলেও তো আমি একজন বাংগালী – অকৃতজ্ঞের জাত।]

৫,৮১০ বার দেখা হয়েছে

৪৩ টি মন্তব্য : “জীবন তবুও অম্লান – (ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা-৪)”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    সাইফুদ্দাহার ভাই,
    আপনার লেখা গভীর আগ্রহের সাথে পড়ছি...

    এই সিরিজ তো চলবেই, সময় পেলে 'শহীদ লিপি' নিয়েও লিখবেন...
    দাবী না-অধিকারের কথা জানায়ে গেলাম... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    এক নিঃশ্বাসে পড়লাম। অসাধারণ বললেও কম হবে। সাইফ ভাই একটা অনুরোধ আপনার কাছে, প্রয়োজন পড়লে সময় নিন আর "ভিন্ন জানালা দিয়ে দেখা" লেখাটা চালিয়ে যান। আপনার আক্ষেপ করে বলা কথাটা খুবই অর্থপূর্ন মনে হলো আজকের বাংলাদেশে -

    হাজার হলেও তো আমি একজন বাংগালী - অকৃতজ্ঞের জাত।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
    • সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

      'পাবনা ৭৬৩' কি শুনতে 'কচুপাতা' থেকে ভাল হলো? তোমার নামটা কি ভাই (দরকার হলে আলাদা ভাবে ই-মেলে জানিও)।
      আপাতত 'ভিন্ন জানালা' এখানেই বন্ধ থাক। পরে সময় হলে অন্য জানালা খোলা যাবে।

      "হাজার হলেও তো আমি একজন বাংগালী – অকৃতজ্ঞের জাত" - তোমার মতো সবাই কি ঠিক বুঝবে আমার এই আক্ষেপের কারণ?

      জবাব দিন
  3. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    তবে এত বুদ্ধিই যদি পাকিদের থাকতো, তবে কি তারা এই ভাবে পাকিস্তানকে ভাঙ্গতে পারতো?
    =)) =)) =)) =)) =)) পাকিদের আহাম্মকি নিয়ে আসলে নতুন কিছু বলার নেই। পুরো জাতি ধরে একটা দেশের মানুষ(একবাল আহমেদ এবং এরকম মাইক্রোস্কপিক সংখ্যক কয়েকজন বাদে) যে আহাম্মক আর বদমায়েশ হতে পারে এইটা পাকিদের না দেখলে নিশ্বাস করা যায়না।রেসিস্ট কমেন্টের জন্যে দুঃখিত-কিন্তু এদের বর্ত্মান জেনারেশনের সাথে মিশেও আমার এদের সম্পর্কে ধারণার খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

    জবাব দিন
  4. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)

    অসাধারন সাইফুদ্দাহার ভাই। একেবারে ছুয়ে যাওয়া একটা লেখা। মনে মনে আশা করছিলাম আপনার আর ভাবীর ছবি বোধহয় দেবেন একটা। যাহোক, আপনার আরো লেখার অপেক্ষাতে থাকলাম।

    জবাব দিন
  5. হাফিজ (১৯৯১-১৯৯৭)

    বাই দ্যা ওয়ে সাইফ ভাই, স্বপ্নচারী মন্দ বলে নাই; আপনাদের ওই সময়কার কোন ছবি থাকলে, তা শেয়ার করতে পারেন।

    "হাজার হলেও তো আমি একজন বাংগালী – অকৃতজ্ঞের জাত।" জীবনে অনেকের কাছে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেয়ে এসেছি। ঠিকমতো ধন্যবাদ টাও বলা হয়ে উঠেনি অনেক ক্ষেত্রেই।

    জবাব দিন
  6. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    শুধু মাত্র একজনের সংগে দেখা না করতে যাওয়াটা অকৃতজ্ঞতা বলে মানতে বাধছে, অকৃতজ্ঞ হবেন তখন, যখন তার প্রয়োজনে সে আপনার কাছে আসলো, আর আপনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন, কারন তার তখন দাবী থাকবে আপনার উপরে।

    এবার চিটাগাং আসলে আওয়াজ দিবেন ভাইয়া, দুজনে মিলে চরণ দ্বীপে ঘুরে আসা যাবে। অথবা লোকেশন বলে দিলে আমি নিজেই ঘুরে আসলাম, তারা কেমন আছে দেখে আসলাম। অবশ্য এতে আপনার দায়মুক্তি পুরোপুরি হবে না।

    শহীদ লিপির ইতিহাস জানতে চাচ্ছি আপনার কাছে, সেই সাথে যদি সম্ভব হয় প্যাটেন্ট ইস্যু নিয়ে আপনার মতামত।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  7. আহমদ (৮৮-৯৪)

    :boss: অসাধারন লেখা ভাইয়া। সকালেই পড়েছিলাম। কিন্তু ক্লাশের তাড়া থাকায় মন্তব্য করতে পারিনি।

    সত্তরের দশকের ছবিটা দেখে খুবই মজা পেয়েছি। আমার স্ত্রী বলেছে ছবিটাতে আপনাদেরকে সিনেমার চরিত্রের মত লাগছে। 😉


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  8. জিনাত (২০০২-২০০৮)

    সবসময়ের জন্য আগ্রহ নিয়ে পড়তে পারি এমনভাবে আপনি লিখেন ভাইয়া ।আর পড়ার পর মনে হয় ,আমাদের নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব আরো বেড়ে গেলো ।
    অফ টপিক : ছবিটা একদম সেইরকম ভাইয়া ।

    জবাব দিন
  9. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আতঙ্কের অভিজ্ঞতা সাইফ ভাই। ১৯৭১ সালে দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবার এরকম অসংখ্য বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। আজকের প্রজন্মের কাছে এসব এখন আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। আপনার বর্ণনা, ভাষায় ৪০ বছর আগের ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে আমাদের মনে ধরা পড়েছে। এই লেখা আমাদের নিয়ে যায় একাত্তুরের ভয়াল দিনগুলোতে।

    ওই সময়ের দুটো অভিজ্ঞতা আমার মনে পড়ে। বাবা যেহেতু এজি-তে চাকরি করতেন, '৭১-এর মাঝামাঝি আর শেষদিকে গ্রাম থেকে সম্ভবত দুবার ঢাকা এসেছিলেন। তবে থাকেননি। আবার ফিরে গেছেন গ্রামে। আমরা তার জন্য রূদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করতাম ওই কয়টা দিন।

    আরেকটা ঘটনা; পাকি সেনারা আসছে এই উড়ো খবর পেয়ে আমরা গ্রাম ছেড়ে কয়েক গ্রাম দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সেখানে একটা কুকুর আমাকে বেশ ভালোই আঁচড় দেয়। কামড়ায়নি। কিন্তু বাড়ির সবার সিদ্ধান্ত, নিরাপত্তার জন্য আমাকে ইনজেকশন নিতেই হবে। কিন্তু ওষুধ পাবে কোথায়? আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৭ মাইল হাটা দূরত্বে মানিকনগর লঞ্চঘাট। সেখানে একটা দোকানে ওই ওষুধ পাওয়া যায়। কিন্তু হাটে আবার পাকিস্তানি বাহিনী ঘাটি করে বসে আছে। ষেশষ পর্যন্ত আমার বয়সী দাদা, যিনি আবার আওয়ামী লীগ নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন; তিনি শেষ পর্যন্ত গেলেন। আমরা বাড়িতে সবাই দম বন্ধ করে অপেক্ষায় আছি কখন দাদা ফিরে আসেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ভালোয় ভালোয় ফিরলেন। আর আমাকে নাভির চারপাশে ১৪টা ইনজেকশন নিতে হল!!


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • সাইফ শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

      লাবলু,

      আমি তোমার ৭১-এর আভিজ্ঞতার লেখা গুলি পড়েছি। এক বালকের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের আভিজ্ঞতা খুবই ভাল লেগেছে। যদি পারা যায় তা হলে ঐ সময়ে যারা বয়স্ক - বিশেষ করে যারা তাদের যৌবনে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান পাবার স্বপ্নে বিভোর ছিল - তাদের কথা, তাদের চিন্তা ভাবনা জানতে ইচ্ছা করে। তাদের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের রূপ কেমন ছিল।

      জবাব দিন
  10. শ্রদ্ধাষ্পদেষু,
    আমার একটি সাম্প্রতিক লেখায় আপনার কিছু কথা উল্লেখ করেছি আপনার অনুমতি ছাড়া (যোগাযোগের প্রচেষ্টা ছিল, কিন্তু ইমেইল ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারিনি)।
    ভালো থাকবেন।

    জবাব দিন
  11. খুব ভালো লাগলো আপনার লেখটা পড়ে. অন্যরকম একটা অজানাক জানতে পারলাম যেটা আমার জানাটা দরকার ছিল.সাধীনতা সম্পর্কে আমি যা জানি এবং যা এখন জানতে পারলাম তা দিএ এতটুকু বলতে চাই omar N.Bradlery এর ভাষায় :
    Wars can be prevented just as surely as they can be provoked...and we who failed to prevent them,must share the guilt for the dead.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইফুদ্দাহার শহীদ (১৯৬১-১৯৬৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।