একদিনের বাংলাদেশ

দিন তিনেক আগে রাত সাড়ে বারোটার সময় ফোর্ট স্টেশন থেকে বাসে উঠে দেখি শমী আহমেদের (রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ)  মত কেউ একজন বসা। থুতনির নিচে এক মুঠ দাড়ি গজানোয় তাকে দেখতে স্কুবি ডু’র শ্যাগির মত লাগছে। শমী ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ফেসবুকে দেখেছিলাম সে এলবার্টা চষে বেড়াচ্ছে। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, তুমি! কোথা থেকে? তোমার না এলবার্টায় থাকার কথা!

সে বলল, আমি আপনাকে বাসে উঠতে দেখেও চিনতে পারিনি। রাত সাড়ে বারোটায় আপনাকে এখানে আশা করিনি, তাই দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখিনি। আমি এলবার্টা থেকে ক’দিন হলো ফিরেছি।বাতেন ( সিলেট ক্যাডেট কলেজ) ভাই এর কাছে গাড়ি চালানো শিখতে গিয়েছিলাম। আপনি পিকনিকে যাচ্ছেন তো!

পিকনিকের কথা ভাসাভাসা শুনেছিলাম। আমি এখানে প্রায় সাড়ে চার মাস এসেছি। ক্যানাডা – বাংলাদেশ এসোসিয়েশন বলে একটি বাঙালিদের সংগঠন আছে। পিঠা উৎসবের সময় তাদের খাতায় নামও লিখিয়েছিলাম। অথচ তাদের অনুষ্ঠানের কোন খবর আমার কাছে আসেনা।একটু অভিমান হয়েছিলো, আগ বাড়িয়ে জিগ্যেস করতে যাইনি। শমীর কথায় সেই আগুনে কয়লা পড়লো। বললাম, ১৪ তারিখে আমার কাজ আছে, যাবোনা।

ক্রিসেন্ট লেক

ক্রিসেন্ট লেক

বাসায় এসে বঊ বাচ্চাদের জিগ্যেস করলাম, তারা প্রথম দিন কোন আগ্রহ দেখালো না। পরেরদিন বাতেনের টেক্সট পেয়ে যাবার জন্যে একটা তাগিদ অনুভব করলাম। অনেকের সাথে দেখা হবে।বললাম রওনা কখন? সে জানালো, যার যার মত চলেযাবে পোর্টেজ লা প্রেইরিতে, আইল্যান্ড পার্কে পিকনক। পিকনিকের চাঁদা খুব বেশি নয়। আমরা সেন্ট্রালি বাস ভাড়া করছিনা। তাহলে খরচ বেড়ে যাবে।
আমি বললাম আমি তো ড্রাইভিং টেস্টে ফেল!

আপনি চাইলে আপনার জন্যে রাইডের ব্যবস্থা করতে পারি। বাতেনের সতঃস্ফূর্ত উত্তর। বললাম, জানাবো।

আর জানাতে হলো না।নীতার বাবা  নুরুল ইসলাম খালু উদ্ধার করলেন সে বিড়ম্বনা থেকে। উনি বললেন আপনার গাড়ি আপনি চালাবেন, আমি আপনার সাথে থাকবো। উইনিপেগে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ ড্রাইভার পাশে বসলে লার্ণাররা গাড়ি চলাতে পারে।

পোর্টেজ লা প্রেইরির নাম শুনেছিলাম। উইনিপেগে যারা ক্রমাগত ড্রাইভিং টেস্টে ফেল করেন শুনেছি তারা পোর্টেজ লা প্রেইরিতে পরীক্ষা দিতে যান পাশের আশায়। পরীক্ষার কোন বিশেষত্ব নেই। মানুষ আর গাড়ির সংখ্যা কম হওয়ায় ভিড় ভাট্টা কম থাকে। পরীক্ষার্থিরা ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে পারে।

রাতে গুগলিয়ে দেখলাম কথা একেবারে মিথ্যে নয়। উইনিপেগ থেকে ৭৫ কিলো মিটার দূরের সাড়ে নয় বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে বারো হাজার। আমাদের যশোর শহর আয়তনে এর অর্ধেক হলেও তার জনসংখ্যা প্রায় ১৫ গুন বেশি।

শাপলা, কচুরি পানা

শাপলা, কচুরি পানা

কিলার্নির সোবীইজ গ্রোসারির সামনে থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা সকাল সাড়া আটটায়। আইল্যান্ড পার্কে পৌছাবার পর নাস্তা। তারপর অন্যান্য। বাঙালির আটটা এই বিদেশেও সাড়ে আটটার আগে বাজেনা (যদি অনুষ্ঠান শুধু বাঙালিদের হয়)। শেষ পর্যন্ত নয়টার একটু আগে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। সবচেয়ে সামনে কাজী ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে গাড়ি চালাচ্ছি আমি। শেষ মুহুর্তে নুরুল ইসলাম খালুকে তাঁর গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে হয়েছে ড্রাইভারের অভাবে। তার পেছনে অন্যান্য গাড়ি। কাফেলা খুব ছোট নয়।

ক্যানাডার রাস্তায় স্পিড লিমিট এক রকম নয়। রাস্তার অবস্থার উপর নির্ভর করে একেক সেগমেন্টে একেক রকম স্পিড। পেরিমিটার হাইওয়ে পার হয়েই স্পিড আশি কিলো মিটার। আরেকটু দূরে গিয়ে ১০০। আমার ২০০০ ডলারের ধ্যাদ্ধেড়ে গাড়ি সে ধকল নিতে পারবে কিনা জানিনা।কাজী ভাইকে বললাম ৮০ তে থাকি! উনি বললেন, ৮০ তে থাকবেন! হান্ড্রেডের আশেপাশে থাকেন।হ্যাতেরা অনেক জোরে চালায়।
আরও কিছুদূর যাবার পর ১১০ কিলোমিটারের সাইন। আমি জীবনে প্রথম ১০০ কিলো মিটারে গাড়ি চালিয়েছি পাঁচ মিনিট আগে।ভিতরে ভিতরে ঘেমে গেলেও এক্সিলেটরে চাপ বাড়িয়ে দিলাম। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে কোন ঝাঁকি ছাড়াই গাড়ি ১১০ ছাড়িয়ে চলতে থাকলো আমার পঙ্খীরাজ।

ইন্টারনেটে পড়েছিলাম পোর্টেজ লা প্রেইরি ম্যনিটোবার পুরনো শহর গুলির অন্যতম। সাস্কেচুয়ান আর অন্টারিওর দুই প্রাদেশিক বর্ডারের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিলো ১৭৩৮ সালে। পশমের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্যে সে বছর এসিনিবিওন নদীর উত্তর পাড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন পিয়েরে গলতিয়ের দ্য ভেন্স নামের এক ফরাসী অভিবাসী। তখন পর্যন্ত পোর্টেজ লা প্রেইরি ছিলো আদিবাসী ইন্ডিয়ান অধ্যুসিত অঞ্চল। পরের শতকে খ্রীস্টান যাযকদের আনাগোনা শুরু হয় এখানে। ১৮৮১ সালে ক্যানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হবার পর নদী, সড়ক আর রেল পথের সমন্বয়ে একটি চমৎকার যোগাযোগ কেন্দ্র হয়ে ওঠে শহরটি। পরে ক্যানাডিয়ান ন্যাশনাল রেলের অপারেশনও সম্প্রসারিত হয় এই শহরে।

কাজী ভাই বললেন, আমি আগেও কয়বার আয়সি। আপনি রয়্যাল রোড দিয়া ঢুইকা সোজা যাইবেন গা। হের পর আমি কমু তখন বামে যাইতে অইবো।

আমি জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোর্টেজ লা প্রেইরিতে এয়ার বেইস স্থাপিত হয়েছিলো। রানী এলিজাবেথ তখন সফরে এসেছিলেন। সেই থেকে শহরের প্রধান সড়কের নাম রয়্যাল রোড। সেই সব বলে আর কাজী ভাইয়ের কাছে বিদ্যা জাহির করতে গেলাম না। তিনি এমনিতেই আমার মত ড্রাইভিং টেস্ট ফেইল্ড্রাইভার নিয়ে পেরেশানিতে আছেন। বললেন তিন নম্বর রোড দিয়ে বায়ে ঢোকেন। বায়ে কিছু দূর চালাবার পর চমৎকার একটি সেতুর উপর দিয়ে আমরা আইল্যান্ড পার্কে ঢুকলাম। যে লেকের পাশে এই পার্ক সেটিকে আমি ইন্টারনেট থেকে চিনি। খ্রীস্টান ধর্ম প্রচার শুরু হবার পর এর নাম হয়েছে ক্রিসেন্ট লেক। তার আগে নাম ছিল স্লগ।

গাড়ির সারি

আমাদের আগে আরও কয়েকটি গাড়ি এসেছিলো, আমাদের পর এলো আরও বেশ ক’টি। সব মিলিয়ে ৫০টির মত গাড়ি আর সাড়ে তিনশ’ মানুষ। ক্যানাডায় আমি কখনও এত বাঙালি এক সঙ্গে দেখিনি। পার্কে সম্ভবত চারটি পিকনিক স্পট, প্রতিটি স্পটেই কোন না কোন দল আছে, তবে বাঙালিদের মত এত বড় দল কারো নেই। পার্কের এই জায়গাটুকু আয়োজক আর পার্টিসিপেন্টদের আন্তরিকতায় সত্যি সত্যিই একটুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছ।

এই পার্ক গড়ে উঠেছে ক্রিসেন্ট লেকের পশ্চিম পাড়ে। উনিশ শতকের শেষভাগে এখানেই অভিবাসীদের বসবাস শুরু হয়েছিলো। পপলার, এসপেন,বার্চ আর ম্যাপেল গাছের ছায়ায় সুন্দর পিকনিক স্পট আইল্যান্ড পার্ক। এর একদিকে আছে শিশুদের জন্য নানান রকম রাইড। লেকের পাড়ে ওয়াক ওয়ে। বসার জায়গা। লেকে নৌকা বাওয়া যায়, ওয়াটার স্পোর্টেরও আয়োজন আছে।তবে আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে লেকের বুকে ভেসে থাকা শাপলা ফুল। আর কচুরিপানা।

 

এসব দেখে ফিরে আসার পর বাচ্চাদের খেলাধুলা শুরু হলো। তার আগেই নাস্তা পর্ব শেষ হয়েছে। খেলাধুলার অনুষ্ঠানটি দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। দু’টি পর্বই ছিলো খুব মজার। প্রথমে ছোট ছেলেদের দৌড়, মেয়েদের দৌড়, শিশুদের চকোলেট দৌড়, মহিলাদের সুঁই সুতা দৌ্‌ড় মার্বেল দৌড়। ফাঁকে ফাঁকে হয়েছে ট্রেজার হান্টিং। চারটি লুকিয়ে রাখা কাজ খুঁজে বের করে পুরস্কার জিতে নিয়েছে পাঁচ জন। খুব পরিচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা। রাহিদুল ভাইএর নেতৃত্বে বয়সে তরুন বাঙালিদের একটি দল ছিলো চমৎকার এই আয়োজনে।

বল দেখা না গেলেও এটি আসলে ভলিবল খেলা

বল দেখা না গেলেও এটি আসলে ভলিবল খেলা

আমার দুই কন্যা, সারাহ, শ্রেয়া এবং উইন্ডমিল

আমার দুই কন্যা, সারাহ, শ্রেয়া এবং উইন্ডমিল

লাঞ্চের পর ছিলো বেশ কিছু মজার ইভেন্ট। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে ছেলে মেয়েদের কাছি টানাটানি। মেয়েরা যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে ওস্তাদ (থুক্কু) তা তারা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। দুই দুইবার ছেলেদের পরাজিত করে।

বাচ্চারা

বাচ্চারা

খাবারের মেনুও পছন্দ হয়েছিলো সকলের। বাতেনের পোলাও, কাবাব, রোস্ট, সালাদ চেটেপুটে খেয়েছে সবাই। তবে তার চেয়ে ভালো ছিলো শেষ বিকেলের চা – সিঙ্গাড়া । বলতেই হবে কাজী ভাইয়ের চায়ের হাত চমৎকার।

খেলা সাঙ্গ হতে হতে সুর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চমৎকার একটি দিনের স্মৃতি নিয়ে আমরা যখন ফিরে আসছি আমার বারবার মনে হচ্ছে পুরো একটা দিন বাংলাদেশে কাটিয়ে ফেরত যাচ্ছি উইনিপেগ।

২ টি মন্তব্য : “একদিনের বাংলাদেশ”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বাঙালির আটটা এই বিদেশেও সাড়ে আটটার আগে বাজেনা -- 🙂
    পার্কের এই জায়গাটুকু আয়োজক আর পার্টিসিপেন্টদের আন্তরিকতায় সত্যি সত্যিই একটুকরো বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে - ভাল লাগলো জেনে।
    চমৎকার, প্রাণবন্ত এ লেখাটা বেশ ভাল লাগলো। এর আগে কোনক্রমে হয়তো মিস করে গিয়েছিলাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।