ট্যানজির গল্প

ম্যানিটোবা ইউনিভার্সিটিতে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলাম।ক্যালেন্ডারে ফাগুন এসে গেছে । মনে এবং বনে আসেনি। তুষার গলা শেষ হয়ে চকচকে সুর্য উঠেছে। সেই সূর্য সিনেমার পর্দায় দেখা সূর্যের মত। আলো আছে উত্তাপ নেই। আর যাকে দেখতে পাচ্ছিনা, সেই বাতাস কোথা থেকে এসে যে গা কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে বোঝাও যাচ্ছেনা। বাসস্টপের সামনে ঘাসে মধ্যে জুবুথুবু হয়ে বসে থাকা এক জোড়া বুনো হাঁস আর আমি ছাড়া আশে পাশে আর কোন প্রাণি নেই। হংস যুগলের ছবি তুলতে গিয়ে ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি ছোট্ট হলুদ ফুলের সাথে দেখা হয়ে গেলো। প্রথমে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ফুল গুলিকে ঘাসের উপর ফেলে গিয়েছে। পরে বুঝলাম ঘাসের নিচের দিকে তার ডাল পালার বিস্তার। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ঘাসের উপর তার লাজুক উপস্থিতিকে মনে হচ্ছে সবুজ ব্লেজারে সোনার বোতামের মত।
কাল আবার তাদের দেখা পেলাম চ্যন্সেলার ড্রাইভের একটা স্কুলের কাছে ঝাকে ঝাকে ফুটে আছে। আগের মত সলাজ উপ্সথিতি নয়, চারপাশ মাতিয়ে রেখেছে তাদের প্রগল্পভতা। ফুলের নাম জানার জন্যে দু’য়েক জনের দ্বারস্থ হলাম, তারা অবাক হয়ে বলল, এত নামি দামি ফুল থাকতে তুমি এই অখ্যাত বুনো ফুলের নাম জানতে চাইছো কেন?

পরে ইন্টারনটে জেনেছি এই ফুলের নাম সম্ভবত ট্যানজি। চেহারায় আমাদের হলুদ মল্লিকার সাথে মিল আছে। একটা সুঘ্রাণও আছে, খানিকটা কর্পুরের গন্ধের মত। মল্লিকার ঘ্রাণও অনেকটা সেরকমই। ট্যানজি ইউরোপেরই মেয়ে, অনেকে ইউরেশিয়ারও বলে্ন। গ্রীস, ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড সহ অনেক এলাকাতেই বসন্ত ও গ্রীস্মে ঝাকে ঝাকে ফোটে ট্যানজি। এস্টার গোত্রেই এই ফুলের প্রজাতি কম নয়। কিছু কিছু তো দুই তিন ফুটও লম্বা হয়। আমার চেনা ট্যানজি লম্বায় বড় জোর কুড়ি সেন্টি মিটার। পাতা কতকটা শেয়াল কাঁটা গাছের পাতার মত তবে অত লম্বা চওড়া নয়, কাঁটাও নেই।

ট্যানজিকে একসময় খুব উপকারি ফুল হিসাবে গণ্য করা হত। সম্ভবত গ্রীকরা প্রথম এই ফুলের চাষ শুরু করেছিলো চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্যে। হজমের সমস্যা, জ্বর আর কৃমির প্রতিশেধক হিসাবে ব্যাবহার করা হত ট্যানজি পাতা। ষোড়শ শতকে ইউরোপের ডালের সাথে ট্যানজি পাতা ব্যাবহার প্রচলিত হয় কৃমিরোগীর পথ্য হিসেবে। তবে পুডিং আর ওমলেটেরে ফ্লেভার বাড়াতেও ট্যানজি ব্যবহৃত হত।
আইরিশ রুপকথায় আছে ট্যানজি পাতার সাথে লবন পানি মিশিয়ে গসল করলে জয়েন্টের ব্যথা কমে। ত্বকের পরিচর্যায়ও ট্যানজি ব্যবহৃত হয়। আমেরিকান ফার্মাকোপিয়া লিস্টে ট্যানজি আছে জ্বর, ঠাণ্ডা লাগা আর জন্ডিসের প্রতিশেধক হিসাবে।
ট্যানজির আরও অনেক রকম ব্যবহার আছে। ট্যানজির গন্ধ অনেক পোকামাকড় সহ্য করতে পারেনা। প্রাকৃতিক কীট নাশক হিসাবে ট্যানজি ব্যবহার হতে পারে। অন্য ফসলের সাথে ট্যানজির চাষ করলে, ক্ষতিকারক পোকামাকড়ের হাত থেকে ট্যানজি ফসলকে বাঁচাতে পারে।

এতকিছুর পরও নামি ফুল হিসেবে ট্যানজির সমাদর নেই। ট্যানজির চাষ চোখে পড়েনা। সুকান্ত ভট্টাচার্যের লাইন মনে পড়ে যায়, আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,

 

T1

যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।

৪,৫৮৪ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “ট্যানজির গল্প”

  1. কাজী সাদিক (৮৪-৯০)

    আমাদের এখানে ড্যান্ডেলিয়ন আগাছা গোত্রভুক্ত! একবার লনে ঢুকলে ছাড়ানো মুশকিল। কিন্তু সবুজের মধ্যে হলুদ দেখতে কত সুন্দর লাগে।

    কয়েক দিন পরেই ওদেরকে একদম অন্য রূপে দেখতে পাবেন।

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ট্যানজি হোক আর ড্যান্ডেলিয়নই হোক, দেখতে ভালো লেগেছে, আর তার ওষধি গুণের কথা জেনেও ভালো লেগেছে।
    লেখার শুরু আর শেষটাও চমৎকার।
    মাহমুদুল ঠিকই বলেছে, এ জগতে কত কিছুই অজানা!

    জবাব দিন
  3. বাংলাদেশে এই গোত্রিয় ঠিক এমন না, এটি গুলগাল। চৈত্রের শেষের দিকে মাঠের কোণে পড়ে থাকে। সূর্যোদয়ে বেশ লাগে সত্যি। বাট যাকে চিনি,তার রূপ লম্বাটে। যদি সম্ভব হয় আমি ছবি দেবার চেষ্টা করবো পরে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাজী সাদিক (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।