গোলাপের রঙ (শেষ পর্ব)

গোলাপের রঙ ১
গোলাপের রঙ ২

একটানা কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন হাসান ভাই। বললেন, ‘দেখেনতো গল্প করতে করতে আসল কথাই বলা হয়নি। আপনারা খেয়ে এসেছিলেন?’ আমি বললাম আপনি ওয়েস্টার্ণ কালচারের লোক, আপনি তো সন্ধ্যায় খান ।
– তা, খাই। কিন্তু আজ আপনাদের সাথে খাবো ভেবেছিলাম।
– এখন খাবার পাওয়া যাবে কোথাও?

অন্য সবাই তখন গল্পের গভীরে ঢুকে গেছে। এরকম একটা সিচুয়েশনে এসে গল্প শেষ করা যায়? রুমন বলল, ‘খাওয়ার চিন্তা করে গল্পটা মাটি করা ঠিক হচ্ছে না হাসান ভাই। তারপর কী হল?’

একটি রহস্যময় হাসি দিলেন হাসান ভাই।‘এখন তো আর ট্রেন পাবেন না। আপনাদের ফেলে যাই কী করে বলেন তো, আমার এপার্টমেন্ট কাছেই। কিছু খাওয়া দাওয়াও করা দরকার’। গল্পের লোভেই হোক, আর খাবারের লোভেই হোক আমরা রাজী হয়ে গেলাম।রাত তখন প্রায় তিনটা বেজে গেছে । দুইটা ব্লক পেরিয়েই হাসান ভাইয়ের এপার্টমেন্ট।

মাঝবয়সী এ্ক রুক্ষ শুষ্ক জার্মান মহিলা দরজা খুলে বললেন, ‘শ্লামালাইকুম’। বিলাতি সুন্দরীদের চেহারায় আমরা যা কিছু আশা করি রঙ ছাড়া আর কোন কিছুই তার সাথে মেলে না। সাজগোজও সাধারন। আমাদের চোখে জিজ্ঞাসা দেখে হাসান ভাই বললেন, ‘মার্থা, ওর কথাই বলছিলাম’।এবার লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বাসায় ঢোকার ইশারা করতে করতে সেই মহিলা বললেন, ‘সরি নো বাংক্লা এন্ড ভেরি লিটল ইংলিশ’।

আমাদের লজ্জা করতে লাগলো। এই মহিলা আছেন জানলে আসতাম না। এত রাতে একজন গৃহিনীকে যন্ত্রনা দেবার কথা চিন্তা করে আমরা সপ্রতিভ হতে পারছিলাম না। হাসান ভাই বললেন, চিন্তার কিছু নেই, মার্থা বাঙালিদের চেনে। ও আমার সাথে ঢাকায়ও গিয়েছে আমার বড় মেয়ের বিয়ের সময়।
এবার আমাদের বিষ্মিত হবার পালা।

বলেন কী?
ভাবী কিছু বলেন নি?

সেকথার উত্তর না দিয়ে, হাসান ভাই বললেন, ও কী ভাবী নয়!

কথাটা এতক্ষণ আমার খেয়াল হয়নি। কী বলব ভাবছিলাম। হাসান ভাই বললেন, মার্থাই আপনাদেরকে নিয়ে আসতে বলেছে আগে আপনাদের খাবারের কথা বলিনি, কারণ তখন মার্থার কথা আপনারা জানতেন না।

দেশে গিয়ে সে বুঝেছে বাঙালি আতিথেয়তা কী জিনিষ!রান্না বান্নাও করেছে, না খাইয়ে যেতে দেবে না।আমাদের লিভিং রুমে বসিয়ে মার্থা সম্ভবত টেবিল ঠিক করতে গেল।

রুমন ফিরে এলো সেই পুরোনো কথায়, ‘আপনি কিন্তু গল্পটা শেষ করেননি’। হাসান ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘ও আচ্ছা, তারপর তো গল্প সংক্ষিপ্ত। শুক্রবার থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত ভীষণ অস্থিরতায় কাটলো আমার। কোন কাজে মন বসেনা। দুই দিনের মধ্যে কী করবো! আমার সপক্ষে কী প্রমান জোগাড় করবো? মন খারাপ করে কাজেও যাইনি। শনিবার রাতে ভোদকার বোতল কিনে এনেছিলাম একটা, আকন্ঠ গিলে বমি করে বেডরুম ভাসিয়ে দিলাম। এই দেশে কিন্তু এসব অকল্পনীয়। তুমি খাও ঠিক আছে, তাই বলে ভদ্রলোকের বেডরুম নষ্ট করবা! মার্থা এই দু’দিন আমার সাথে কথা বলেনি। রবিবার সকালে ওর ফ্লাইট, দুপুরে ঘুম ভেঙ্গে দেখি মার্থা বেডের পাশে বসে আছে, রুম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন । অবাক হয়ে বললাম, তুমি যাওনি! অভিমানে কথা বলল না সে।
আবার জিজ্ঞেস করলাম তুমি যাওনি? রেগে উঠে সে বলল, ডাম্বার্ট শ্লিঞ্জেল!তোকে এই অবস্থায় রেখে যাই কী করে?

– ডাম্বার্ট শ্লিঞ্জেল মানে?
– বোকা বান্দরের বাচ্চা।

হাসান ভাইএর কথায় আমরা হেসে উঠলাম সবাই। মার্থা এসে হাজির হল দরজায়। বাসায় ঢোকার সময় তাকে যেমন রুক্ষ লাগছিলো, গল্প শেষ হবার পর আর সে রকম লাগছে না । তিনি যখন বলল, ‘টেবিলে কাহবার’, অনেক কষ্টে উচ্চারণ করা সেই শব্দ দুটিও আমাদের পছন্দ হয়ে গেল। এনায়েত তার সামনেই বলতে লাগলো ‘কাহবার গুলি খুব মজাদার’। কামাল বলল ‘দেখতে একেবারে খারপ নয়’। ডাইনিং টেবিলে চারটি মাত্র চেয়ার। আমাদের চারজনকে বসতে দিয়ে হাসান ভাই আর মার্থা দাঁড়িয়ে বাঙালি মেহমানদারি করছিলেন। কামালের কথা হাসান ভাইয়ের কানে গিয়ে থাকবে, তিনি হাসতে হাসতে বললেন মার্থা বাংলা বলতে না পারলেও, বোঝে। কামালের বিব্রত চেহারা দেখে আরেকবার হাসির রোল উঠলো। গল্পও চলতে থাকলো একই সাথে।

হাসানভাইকে ফিসফিসয়ে বললাম, ‘সোফিয়ার কথা জানে?’
– না জানিয়ে উপায় আছে? আপনাদের তো বলা হয়নি, মার্থা আমার চেয়ে চার বছরের বড়। সোফিয়াকেতো ওই জুটিয়ে দিয়েছে। মার্থার সাথে সোফিয়ার দেখা মিউনিখের হফব্যানহফে মানে সেন্ট্রাল স্টেশনে, ও তখন রোম থেকে এসেছে চাকরি খুঁজতে। সে গল্প বলতে বলতে সকাল হয়ে যাবে। শুধু এই টুকু জেনে রাখেন সোফিয়া ওরই আবিষ্কার।

এনায়েত জানতে চাইলো হাসান ভাইএর বাচ্চা কাচ্চার কথা। হাসান ভাই বললেন, ও খুব বাচ্চা পছন্দ করে, অথচ দ্যাখেন আল্লাহ ওরে বাচ্চা দেয়নি।
আমার বড় মেয়ের বিয়ের কথা শুনে ঢাকায় গিয়েছিল।

– আপনি আপনার বাংলা দেশের বিয়ের কথা বলে দিয়েছেন?
– অনেক মাথা খাটিয়ে দেখেছি, বলে দেওয়াই ঠিক হয়েছে
– কিছু বলেনি?
– প্রথমে অনেক ক্ষেপে গিয়েছিলো। অনেক যন্ত্রনা করেছে। এখনও রেগে গেলে বলে ‘বিত্রুগ’, মানে ‘ঠগ’। কিন্তু যখন মেয়ের বিয়ের কথা শুনলো, নিজে থেকেই বলল, সে মেয়েটাকে দেখতে চায়, মেয়েটাকে কিছু দিতে চায়।

– বাংলাদেশে ঝামেলা হয়নি?
– প্রথমে হয়নি, ওরা জানতো আমার জার্মান বস গিয়েছে বাংলাদেশি বিয়ে দেখতে। পরে আমার বঊ বুঝে ফেলল
– তারপর?
সে কথার উত্তর না দিয়ে হাসান ভাই বললেন,ট্রেন আসার সময় হয়ে গিয়েছে চলেন আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি, আপনাদের তো ক্লাশ আছে সকালে!
মার্থার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময়, সে আও বিদারজেন না বলে বলল, খোদা হাফেজ।

বাংলাদেশে চলে আসার আগে হাসান ভাইকে ফোন করলাম। তিনি খুব আফসোস করলেন, কাজের চাপে দেখা করতে আসতে পারছেন না বলে। বললাম ভাবী কেমন আছে?
– তারা মনে হয় ভালোই আছে।
– মনে হয় কেন?
– মার্থার কথা সবাই জেনে গেছে, হুলুস্থুল ব্যাপার অশান্তিতে আছি।
– আমি তো ওনার কথাই জিগ্যেস করছি, আপনি সেদিন বললেন না উনি কী ভাবি নন?

কোন উত্তর পেলাম না মনে হলো শুনতে পাননি। বললাম, হ্যালো … হাসান ভাই বললেন, ‘শুনেছি’ কি বলবো ভাবছি
– মানে?
– বাংলাদেশ থেকে আমার বউ আল্টিমেটাম দিয়েছে, মেয়ের সংসারে নাকি অশান্তি হচ্ছে
– তারাও জানে?
– বলছে তো তাই।
আমি বললাম, কত মানুষেরই তো দুই বঊ থাকে, তাদের মেয়ের বিয়ে হয় না? হাসান ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, সেদিন আপনি ভিয়েতনামি মেয়েটাকে বলেছিলেন না, হোয়াই ডিড ইউ চুজ রেড?
– মজা করার জন্যে বলেছিলাম।

হাসান ভাই এর গলা শুনে মনে হল তিনি কাঁদছেন, ‘বললেন আমিতো মজা করতে পারছি না। প্রথম প্রথম শুধু এইদেশে টেকার জন্যে ওর সাথে প্রেমের ভান করতাম। এখন তো সেটা আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। এখন যদি মার্থার কাছ থেকে বিদায় নিতে হয় আমি কোন রঙের গোলাপ নিয়ে যাবো বলেন তো।

১,৮২৫ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “গোলাপের রঙ (শেষ পর্ব)”

  1. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    আপনার রচিত সংলাপগুলি পর্যবেক্ষণপ্রসূত ও যথাযথ। মুহূর্তেই বলিয়ে চরিত্রটিকে উন্মোচিত করে। যেমন,

    ‘সরি নো বাংক্লা এন্ড ভেরি লিটল ইংলিশ’।

    আর আপনি প্রতিটি মুহূর্তে চরিত্রগুলোর ভেতরে অনুভূতির যে পরিবর্তন ঘটছে, চলচ্চিত্রের ধাঁচে সেগুলো তুলে আনেন। ভালো লাগে। আজ প্রশংসা একটু বেশিই হয়ে গেল। তবু সেটা আপনার প্রাপ্য। 🙂


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
    • সাইদুল (৭৬-৮২)

      তোমার প্রশংসা পাওয়া সিসিবির সব ব্লগারের কাছেই অনেক বড় ব্যপার। আমার কাছে তো আরও বেশি।
      যখন বর্ণনায় এক ঘেয়েমি চলে আসে তখন সংলাপ দিয়ে এগিয়ে নেবার চেষ্টা করি, আর কিছু না।


      যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

      জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    শেষটায় বিষাদে ভরে উঠলো মনটা।
    আর এই কারনেই এটা একটা সার্থক গল্পের শর্ত পুরন করে ফেললো।
    অন্তত আমার কাছে।
    তার আগ পর্যন্ত উন্নতমানের দিনলিপি হিসাবেই এগুচ্ছিলো।

    দারুন একটা "গল্প" শুনলাম, সাইদুল ভাই।
    সিসিবিতে আপনার আগমনটা আসলেই
    শুভেচ্ছা ও স্বাগতম-এ পরিপুর্ন.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    নাহহ ! মন্তব্যটা পর্যন্ত লিখতে মন চাইছিলো না ।
    এতোটাই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো ।
    ছিলো মানে এখনো আছে ।
    জীবনের গল্পগুলো এমনই নানান রঙের বর্ণচ্ছটায় মিশে আছে যাপনের প্রতিটি দিনের সাথে,
    একটা থেকে দৃষ্টি সরে অন্যটায় না গেলে বোঝাই হয়ে ওঠে না আরো যে রঙ আছে ।
    আরো কতো কি যে আছে ।
    অনবদ্য গাঁথুনিতে আমাদের তুলে দিলেন অনন্য এক গল্প ।
    অনেক মুগ্ধতা ।

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    'গোলাপের রঙ' - এতক্ষণে যেন বুঝলাম শিরোনামটার নিগুঢ় অর্থ।
    মোস্তফা ঠিকই বলেছে, তোমার কলম যেন সেলুলয়েডের ফিতে।
    চমৎকার বললে খুব কমই বলা হবে।
    :hatsoff: :hatsoff:

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এমন টানটান নির্মেদ গল্প পড়ার পর কিছুই বলার থাকে না আসলে।
    চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া।
    পুরোটা টানা পড়তে তো দশমিনিটের বেশি লাগবেনা, কিন্তু তারপর বসা থেকে উঠতে তো ঘণ্টা পার হয়ে যাবে।
    :boss: :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।