গোলাপের রঙ ২

গোলাপের রঙ ১

হাসান ভাই এর গল্প দিয়েই শুরু হল আসর। মাগুরায় জন্ম আমদের মেজবানের। সর্বহারাদের দলে ঢুকেছিলেন সাম্যের রাজনীতিতে অনুপ্রাণীত হয়ে। এর পরের জীবনের কালো অধ্যায় আর মনে করতে চান না। এই ক্লেদাক্ত জীবনকে পিছনে ফেলার চেষ্টাতেই টাকা পয়সা ধার করে এরশাদের আমলে দেশ ছেড়েছেন। প্রথমে ইরাক, তুরস্ক হয়ে গ্রিস, তার পরে ইটালি হয়ে সুইজার ল্যান্ড, আর সব শেষে পায়ে হেটে জার্মানি।
অবিশ্বাস্য লাগছিল তার গল্প। লোরেন বাঊ চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘ ভোদকা খেয়েছেন? আমার নেতিবাচক উত্তর শুনে বললেন, ‘ নির্জলা ভোদকা ঘাষের উপর ঢেলে দিলে ঘাষ হলুদ হয়ে যায়। সেই বিষ খাবার প্রতিযোগিতায়ও আমাকে নামতে হয়েছে শুধু টিকে থকার জন্যে’।
এনায়েতের চোখ কপালে ঊঠতে দেখে বললেন “সুইজারল্যান্ডে পৌছানোর কিছুদিন পর টাকা ফুরিয়ে গেল।চাকরি নেই, ওয়ার্ক পারমিট নেই এমন কি পাসপোর্ট পর্যন্ত নেই। সেই সময় দেখি সুইজারল্যান্ডের এক গ্রামে ভোদকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। পুরো আয়োজন খোলামাঠে, শীতের সময়তো দেখেছেন এখানে কেমন বাতাস থাকে, সেই হাড় কাঁপানো শীতে শুধু ভোদকার কারণে মানুষ টিকে যাচ্ছে”। তর সইছিল না এনায়েতের বলল “আসল কথা বলেন”। হাসান ভাই গায়ে মাখলেন না।

মনে হচ্ছে তিনি আমাদের মাঝে নেই। লোরেন বাউএর গ্লাসে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছেন যেন অভ্যাসের বসে। দৃষ্টি আমাদের ছাড়িয়ে অন্য কোন খানে। পোডিয়ামের মিউজিক তাঁকে স্পর্শ করছে কি করছে না, বোঝা যাচ্ছে না। “ আমার পকেটে তখন কয়েকটা মাত্র ক্রোনার। আমি নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, কখন যেন হাজির হয়ে গেলাম আসরে। প্রতিযোগিতা জমে উঠেছে । সব চেয়ে বেশি যে খেতে পারবে তার জন্যে পুরষ্কার ৫০০ ক্রোনার। আমি বসে গেলাম। নির্জলা ভোদকা। প্রতি চুমুকে পুড়ে যাচ্ছে পাকস্থলী। কিন্তু আমার ফেরার উপায় নেই। ৫০০ ক্রোনার তখন আমার কাছে অনেক। অন্যরা খাচ্ছে মজা করে আমি পুড়ছি বাধ্য হয়ে। একে একে বিদায় হচ্ছে এক এক জন। আমি বসে বসে গলায় ঢালছি তরল আগুন”।

– তারপর?
রুমনের প্রশ্নে, হাসান ভাই এর গলা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে এল, “পরদিন নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাস্পাতালের বিছানায়” মৃদু হাসলেন তিনি, “বালিশের নীচে ৫০০ ক্রোনার”।
– জার্মানিতে এলেন কবে?
– সে আর এক গল্প । লুকিয়ে চুরিয়ে আর কত পারা যায়, বলেন? একটা হোটেলে কাজ পেলাম বাসন ধোয়ার। ইটালিয়ান মালিক, জানতো আমার কাগজ পত্র নেই, তাও কাজ দিল, ওদেরও লাভ আছে, ইল্লিগ্যালদের কম পয়সায় খাটান যায়। মাস কয়েক কাজ করেছিলাম, তারপর ছাঁটাই। ট্রেনে মিউনিখের বর্ডার পর্যন্ত এসে পায়ে হেটে বর্ডার পেরিয়ে চলে এলাম।
– এত সোজা?
হাসলেন হাসান ভাই। ‘মোটেও সোজা নয়। এখানে এসে পুলিশ ধরলো, পাসপোর্ট চাইল, কিছুই দেখাতে পারলাম না। কোর্টে চালান করে দিল। সেখান থেকে ঊদ্ধার করল ওয়াইএমসিএ’।
অবাক হলাম আমি, ওয়াইএমসিএ কেন?

– যীশুর চ্যালা ওরা। অসহায়দের আইনী সহায়তা দেয়, বিনিময়ে বাইবেল পড়া শিখতে হয়, ওরা জার্মান ভাষাও শেখায়। আমাকে কোর্টে নেবার পর আমি রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলাম। বললাম, বাংলাদেশে আমার জীবনের নিরাপত্তা নেই। আমি আন্ডার গ্রাউন্ড পলিটিক্স করতাম আমার নামে মিথ্যা খুনের মামলা আছে।
বিচারক সব শুনে হেসে ঊড়িয়ে দিতে চাইলেন। বললেন,তোমার নামে এরকম মামলা থাকলে তোমাকে ঢাকার এয়ারপোর্টেই এরেস্ট করার কথা। এই গল্পে ভুলছি না। তোমাকে দেশে ফিরে যেতে হবে’।
জাজের কথায় পড়ে গেলাম মহা ফাঁপরে। দেশে ফেরা যাবে না। আগে খুনের মামলা না থাকলেও এবার হবে। যাদের টাকা ধার করে এসেছি, টাকা শোধ না দিতে পারলে তারাই জেলে দেবে। ভাবলাম শেষ চেষ্টা করে দেখবো নাকি একবার? বললাম মহামান্য বিচারক জার্মান পুলিশের সুনাম সারা বিশ্বে।
বিচারক আন মুভড।
বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ জার্মান পুলিশের সুনাম করার জন্যে কিন্তু তোমাকে ফিরে যেতে হবে’।
বললাম, ‘এই জার্মান পুলিশের কড়াকড়ির মধ্যেও আমি যে ভাবে মিউনিখে পৌচেছি, ঠিক একই ভাবে আমি ঢাকা এয়ার পোর্ট পেরিয়েছি। আমার জীবন সত্যিই হুমকির মুখে। আমাকে জেলে পাঠান কিন্তু বাংলাদেশে পাঠাবেন না’।
নড়ে চড়ে বসলেন জাজ। অনেকক্ষণ তাঁকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, “তিন মাসের মধ্য তোমার বক্তব্যের সমর্থনে প্রমান চাই”।
আমার ঠাই হল ওয়াইএমসিএ হোস্টেলে। ঠাঁই তো মিললো কিন্ত ঘুম হারাম হয়ে গেল। প্রমান পাব কই?
হোস্টেলের একজন বুদ্ধি দিল, ‘জার্মানিতে বিয়ে করে ফেল, থাকতে পারবা। শুরু করলাম বউ খোঁজা’।
এখানে থাকতে টুকটাক কাজের চেষ্টা করেছি। মারসিডিজ বেঞ্জ কোম্পানীতে শ্রমিকের চাকরী পেলাম। তাও অস্থায়ী। কাজ করতাম বয়লারের মত একটা জায়গায়। লোহা পুড়িয়ে, পিটিয়ে বিভিন্ন শেপ দেওয়া হয় সেখানে। দোজখের আগুণের তাপ কেমন হবে জানিনা। তবে জীবন থাকতে আর মারসিডিজ বেঞ্জের ওই জায়গায় যেন চাকরী করতে না হয়। গরমে মাথা ধরে যেত। ঘামের চোটে পানি শুণ্য হয়ে যেত শরীর। সন্ধ্যায় গিয়ে বসতাম কোন পাবে। বউ যদি পাওয়া যায়!
একদিন দেখি এক টেবিলে একা বসে মদ খাচ্ছে একটি মেয়ে, বয়স তিরিশের আগে পরে। চেহারা তেমন ভালো নয়। দেখবেন জার্মান মেয়েরা একটু রুক্ষ ধরণের হয়। এই মেয়েটাও অনেকটা সেরকমই। তবে আমার কাছে সেটি সেই মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মেয়েটি প্রায় ঘন্টা দুই বসেছিল একা। মদ খাচ্ছিল কাঁদতে কাঁদতে। আমি সাহস করে পাশে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ সঙ্গ দিলাম তাঁকে।এক কথায় দু’কথায় জিজ্ঞাসা করলাম তার কান্নার কারণ। প্রথমেতো বলেই না। শেষে বলল তাঁর বয় ফ্রেন্ড তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। পরদিন আবার দেখা মেয়েটির সাথে । একই জায়গায় । একই অবস্থায় । আমার কাছে মনে হল এটিই মোক্ষম সময় । বললাম, তোরও যেমন কষ্ট আমিও তেমনই একা। চল আমরা বন্ধু হই। সে খুব একটা আমলে নিল না আমার কথা। এক সময় বলল, ‘বাঙালিরা বন্ধুত্ব করে এদেশে টিকে থাকার জন্যে। তোর মতলব আমি বুঝে গেছি’।
তৃতীয় দিন মনে হয় মায়া হল তার।
আমাকে বাসায় নিয়ে গেল সে।আড়াই মাস খুব সেবা যত্ন করলাম তার।
মেয়েটির বয়ফ্রেন্ডের শোক কাটেইনা। প্রতিদিন মদ গিলে এসে বমি টমি করে একাকার। আমি সেই বমি ধুই। ঘরদোর পরিষ্কার করি।আড়াই মাস পরে একদিন তার মন ভাল হল।
আমাকে বলল, ‘না মানুষ্ টা তুই খারাপ নোস । চল আমরা বিয়ে করে ফেলি। দেশে বউ টউ নেই তো ! আমাকে ছেড়ে পালাবি না তো?’
আমি সব কিছুতে শুধু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি সে ছাড়া আমার কেঊ নেই, কিছু নেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হল বিচারকের বেঁধে দেওয়া তিন মাস শেষ হবার আগের রবি বারে। শুক্রবারে সে হঠাত বলে বসলো, ‘তোকে বিয়ে করা ঠিক হবে না। আমি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি’।

অসমাপ্ত

১৩ টি মন্তব্য : “গোলাপের রঙ ২”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ভাবছিলাম । এমনটাই ।
    ঝলমলে বাতির কাছে এলেই দেখা মিলবে ফার্ণেসের উত্তাপ ।
    তাতে গলে যাবে স্বপ্নের শরীর ।
    আর সেই তাপদগ্ধ স্বেদবিন্দু থেকে জন্ম নেবে জীবন মথিত দ্রাক্ষা ।

    - আরো আরো উদ্গ্রীব অপেক্ষমান হলাম ।

    জবাব দিন
  2. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এক্কেরে জমজমাট গল্প।
    আর এমন জায়গায় ছাড়লেন, পুরাই হিন্দি সিরিয়ালের লাহান!!! 😀 😀 😀
    বাকি কমেন্ট ১ নং পর্বে ...


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  3. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

    আপনার গল্প পড়ে মনে হয় না গল্প পড়ছি। মনে হয়, আপনি বলে যাচ্ছেন--আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি! আর আমাদের চোখের সামনে ঝকঝকে পরিষ্কার সব ছবি ভেসে উঠছে। আমোদ আছে, আছে নাটকীয়তা, আর আছে অতৃপ্তির তৃপ্তি!


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আহ! জমে উঠেছে।
    আর আপনার মধ্যে আছে তুখোড় সিরিয়ালপ্রণেতার নির্মমতা। ঠিক জায়গায় রুখে দিয়ে পাঠককে খেপিয়ে দ্যান।
    সাথে না থেকে সে যাবে কই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।