গোলাপের রঙ ১

হাসান ভাইকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি খুশি হননি। তাঁর নিমন্ত্রণেই আমাদের মুঞ্চেনার ফ্রিহিইটে আসা। আমাদের রিসিভ করতে তিনি ষ্টেশনেও এসেছেন অথচ আমাদের সাথে দেখা হবার পর থেকেই তাঁর মুখে রাজ্যের অন্ধকার। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী রুমন। সে বললো, ‘হাসান ভাই এর মন খারাপ নাকি? সে কথার উত্তর না দিয়ে হাসান ভাই বললেন আপনাদের সার্ট-টাই পরে আসতে বলেছিলাম না!’
মনে পড়লো হাসান ভাই বলেছিলেন, ‘টিশার্ট টার্ট সাধারণ মানুষ পরে। আপনারা কিন্তু ভাই সার্ট, টাই পরে আসবেন। আমার দেশি বন্ধু বলে কথা। এ ম্যান ইজ নোওন বাই দ্য কম্পানী হে কিপস’। কথাটা সিরিয়াসলি নেওয়া হয়নি। হাসান ভাই এটাকে দেখছেন প্রেস্টিজ ইস্যু হিসাবে। পরিবেশ হালকা করার জন্যে বললাম আপনিই তো বলেছেন মুঞ্চেনার ফ্রিহিইট মানে ফ্রিডম অব মিউনিখ। এখানে এসে একটু পোষাক আশাকের স্বাধীনতাও পাব না? ঝলমলিয়ে হেসে উঠলেন হাসান ভাই, কালো স্যুট পরা প্রায় শ্যমলা হাসান ভাইএর দাঁত গুলি ঝিকমিকিয়ে উঠল। ‘আপনার সাথে পারি না, কিসের সাথে কী ! কথা ঠিক । ১৯৪৫এ নাতসী বিরোধীএকটি দল এখানে দুটি রেডিও স্টেশন দখল করে মুক্ত মিউনিখ ঘোষণা করেছিল। তাদের স্মরণেই ফেলিটজ প্লাটজের নাম বদলে রাখা হয় মুঞ্চেনার ফ্রিহিইট। পোষাকের কথা কেন বলে ছিলাম একটু পরে বুঝবেন’ বলতে বলতে আমাদের নিয়ে ওয়াগনারস্ট্রাসের দিকে রওনা দিলেন।
হাসান ভাইকে প্রথম দেখি টিটোর বাসায় । একটু দেরিতে এসেছিলেন, টিটোদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় হাসান ভাই । চাকরিতেও যে একটু, সেটি বোঝানোর একটা প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা ছিলো তার আচরণে। বললেন,
– স্টাডসের চাকরি,হাই অফিসিয়ালরা যাবার আগেতো বের হতে পারিনা।পুলিশ কমিশনারের গুরুত্বপূর্ণ একটি ডকুমেন্ট নিয়ে শেষ বেলায়……
টিটো বলল, স্টাডস মানে হচ্ছে মিউনিখ সিটি কর্পোরেশন।
হাসান ভাইকে প্রথম দিকে একটু রাশভারি মনে হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আমাদের বন্ধু হয়ে গেলেন । পোড় খাওয়া লোক, অনেক ঘাটের জল ঘেটে মিউনিখে থিতু হয়েছেন প্রায় ১২ বছর। নাটকীয়তায় ভরা তাঁর জীবন, কথাও বলেন নাটকের সংলাপের মত। এক সময় আন্ডার গ্রাউন্ড রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সর্বহারাদের হয়ে বেশ কয়েকটি অপারেশনেও অংশ নিয়েছেন। এখন মুঞ্চেন স্টাডসে কাজ করেন সপ্তায় ৫দিন, আর দুই দিন গোলাপ ফুল বেচেন মুঞ্চেনার ফ্রেইহিটের নামকরা ডিস্কো পোডিয়ামে।

টিটোর বাসায় পরিচয়ের দিনেই তিনি আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন তার দ্বিতীয় কর্মস্থলে।
ওয়াগনারস্ট্রাসে খুব দূরে নয়। তবে হেটে যেতে একটু সময় লাগল ক্রিসমাসের মেলার কারণে। অনেক কাল আগে থেকেই প্রতি ডিসেম্বরে হস্ত শিল্পের মেলা বসে এই স্টেশনের বাইরের চত্বরে।
হাসান ভাই পোডিয়ামে সবার পরিচিত সম্ভবতঃ তার চমৎকার ব্যবহার আর ব্যক্তিত্বের কারণে। প্রথমে তিনি আমাদের নিয় গেলেন জ্যাকেট খুলে রাখতে । সেখানে যেয়ে তাঁর মন খারাপের কারণ আরও বিষদ ভাবে বোঝা গেল। বললেন, ‘জ্যাকেট পরে আসবে সাধারণ …… মানে ডিক, হ্যারি টাইপের লোকজন আমার বন্ধুরা আসবে স্যুট পরে। বুঝলেন না আভিযাত্যের একটা ব্যাপার আছে না!’ হাসান ভাই এর কথা শুনে এনায়েত বলল,
– ঠিক আছে আপনাকে আর ভাবতে হবে না, আমরা চলে যাচ্ছি’।
এনায়েতের কথায় বিব্রত হয়ে পড়লেন আমাদের মেজবান। বললেন, ‘ভাইরে আমার কাছে আভিযাত্যের চেয়ে বন্ধুত্ব অনেক দামি। আসেন ভিতরে যাই’।

পোডিয়ামে বেশ কয়েকটি রুম আছে। একটি মঞ্চ আছে হল রুমে। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে কোন না কোন নাম করা ব্যান্ড পারফরম করে। হালের বিখ্যাত জার্মান ব্যান্ড মুঞ্চেনার ফ্রেইহিইটের জন্মও এখানে। আমরা গিয়ে বসলাম স্টেজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। হাসান ভাই বললেন, ‘কি খাবেন? জার্মানির সবচেয়ে ভাল বিয়ার লরেনবাউ। এছাড়া সাউথ আফ্রিকার ক্যাসেল আছে, যদি শক্ত ধরণের কিছু নিতে চান তাও আছে’। তিনি কি খাবেন আমি জানতে চাইলাম। এরই মধ্যে এক লাস্যময়ী তরুণি হাতে কয়েক রঙের গোলাপ নিয়ে হাজির হল আমাদের সামনে। টেবিলে গোলাপ রেখে প্রথমেই সে জড়িয়ে ধরলো হাসান ভাই কে। হাসান ভাই পিঠ চাপড়ে দিল তার। পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের সাথে। ইটালির মেয়ে সোফিয়া, ইংরেজি তেমন জানে না। মাস ছয়েক এসেছে মিউনিখে। হাসানের সাথে পরিচয় পোডিয়ামেই। বললাম,
– মেয়েতো আপনার হাটুর বয়সী।
– আমি তো সেটা বলেও মেয়েটাকে খসাতে পারছি না।
– আপনাকে দেখে তো খারাপ লোক মনে হয় না। বিয়েওতো করেছেন শুনেছি।
হাসান ভাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। “ ভাইরে বিদেশে কত কী যে করতে হয়, আমি তো সারাদিন মাথা খাটাই বলতে পারেন মাথা খাটয়েই টিকে আছি”।
আমার অবাক হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে বললেন, ‘মেয়েটাকে কাজ দিয়ে ছিলাম, তার অসহায় অবস্থা দেখে। কিন্তু গতিক দেখে মনে হচ্ছে সে আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাকে সব সময়ই বলি তোর বয়সী একটা মেয়ে আছে আমার দেশে। মেয়েটা তবুও আমার সাথে লেপ্টে থাকে। আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি ওর নিরাপত্তার জন্যেই সে এটা করে। অন্যরা মনে করে আমার ফিয়াঁসে, তাই ডিস্টার্ব করে না’।

আমাদের মুখোমুখি একজোড়া ছেলে মেয়ে বসেছিল আরেকটি টেবিলে । ছেলেটিকে চেনা লাগছিল। পরে মনে হল একদিন তাকে আমাদের রুম পরিষ্কার করতে দেখেছি । ইরাকি কুর্দি । মিউনিখে এসেছে ভাগ্যান্বেষণে । সোফিয়া গোলাপ নিয়ে হাজির ওদের কাছে। হাসান ভাই বললেন, ‘সব গোলাপ এক নয়। আমার মনে হয় ওরা নেবে লাল গোলাপ। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সত্যিই লাল গোলাপ নিল তারা । আমার বিস্ময় দেখে মৃদু হাসলো সোফিয়া। কাছে এসে বললো, ‘হোয়াইট মিন ইউ আর জাসত নোন, ইয়েলো সেজ ইউ আর গুড ফ্রেন্দস বাত নো ডিনার টুগেথার। উইথ রেড ইউ ক্যান কল ইউর ফ্রেন্দ ফর দিনার এন্ড হ্যাভ ফান’।

ইরাকি ছেলেটিকে রেখে মেয়েটি উঠে এল আমাদের টেবিলে। বলল ইরাকিই ছেলেটির কথা সে বুঝতে পারছে না। কারণ ইরাকি ছেলেটি জারমান বুঝলেও ইংরেজি বোঝেনা। আর মেয়েটি বোঝে না জার্মান। বললাম, দেন হোয়াই ডিড য়ু চুজ রেড রোজ?
মৃদু হাসি ছাড়া আর কোন ঊত্তর পাওয়া গেলনা।
এক্ষেত্রে হাসান ভাইই ভরসা। জার্মান আর ইংরেজি দুইই তার দখলে। তিনি উঠে গেলেন মেয়েটির সাথে। হাসান ভাই ফিরে আসার পর জানা গেল মেয়েটির নাম কিম চাও। ভিয়েতনাম থেকে এসেছে ভাগ্য ফেরাতে। ইরাকির সাথে পরিচয় হয়েছে ট্রেনে।এর মধ্যে লাল গোলাপ পর্যন্ত পৌছে গেছে ভাষা না জেনেই।

গল্পে গল্পে রাত তখন একটা ছাড়িয়েছে, আমার সঙ্গী সাথিদের কেউ কেউ দুই এক পাক নেচেও এসেছেন। মাঝে মাঝে সোফিয়া অথবা হাসান ভাই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছেন। সোফিয়া থাকায় হাসান ভাই এর ব্যবসা জমে উঠেছে। তিনশো গোলাপের প্রায় সবই শেষ। পড়ে থাকা কয়েকটি সাদা গোলাপের একটি নিলাম আমি সোফিয়ার জন্যে। খিলখিলয়ে হাসতে হাসতে সে বলল “হাসান উইল বি এংরি”। আমি বললাম “না,হি মে বিকাম জেলাস”। ড্যান্স ফ্লোরে তখন বাজনা দ্রুত থেকে দ্রুত তর হচ্ছে। হাসান ভাই আমার পাশে বসলেন একটি লোরেন বাউ নিয়ে। চোখে মুখে ক্লান্তি, অবসন্নতা। বললাম কেমন আছেন হাসান ভাই? বুদ্ধিমান লোক তিনি বললেন টিকে আছি, শুধু মাথা খাটিয়ে টিকে আছি। কী কষ্ট যে করতে হয়েছে, বলে বোঝানো যাবে না। ততক্ষণে নাচের ফ্লোর থেকে ফিরে এসেছে অন্যরাও।হোটেলে ফেরার জন্যে রেডি হতে দেখে হাসান ভাই বললেন, ট্রেন তো সব বন্ধ হয়ে গেছে, ভোর চারটার আগে ফেরার ট্রেন নেই। তারচেয়ে বসেন গল্প করি।

অসমাপ্ত

১৪ টি মন্তব্য : “গোলাপের রঙ ১”

    • সাইদুল (৭৬-৮২)

      গোলাপের রঙ আমার পছন্দের গল্প গুলির মধ্যে একটি ( নিজের লেখা আবার পছন্দ!, কী তালেবর লেখক হয়ে গেছে ব্যাটা)
      সাথে থেকো, গল্পটা এরকম থাকবেনা। আজ দ্বিতীয় পর্ব দিয়ে দিচ্ছি।


      যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

      জবাব দিন
  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    প্রবাসে যারা দীর্ঘদিন ধরে নানা ঝড়-ঝঞ্জা মোকাবেলা করে টিকে আছেন- তারা প্রত্যেকেই মনে হয় একজন বীর যোদ্ধার মতন!
    এরকম আরও অনেক অনেক গল্প পড়তে চাই, সাইদুল ভাই! 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দূর থেকে সব বনই ঘণ । কাছে গেলে বোঝা যায় গাছ মোটে কয়টা ।
    মানুষের যুদ্ধে যুথবদ্ধ জীবনের সত্যি রঙটুকু টের পাওয়া যায় না কেছে না গেলে ।
    দূর থেকে সবার জীবনই যেনো সেলুলয়েডের মতোন রঙ্গীন।
    কান্নার সরোবরের বাঁধাই তীরে বসে মানুষ যে অনাবিল যাপে জীবন হেসে খেলে ।

    সুন্দর উঠে আসছে সেই সব জীবনের কথকতা । মনে হচ্ছে এমনটাই।
    পরের পর্বে যাই ...

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আ হা, কী ভালোই না লাগলো শুরুটা।
    আপনি যে একজন গুরু লেখক তা ক্রমশঃ প্রকাশ পাচ্ছে।
    দ্বিতীয় পর্বে কাল যাবো।
    এ গল্পের শেষ না দেখে ছাড়ছিনা।

    জবাব দিন
  4. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    সাইদুল ভাইয়ের গল্প মানেই হলো পড়া শুরু করলে, একদমে পুরোটা পড়ে শেষ করতে হবে।
    আর এই কারনেই অনেক সময়ই চোখে পড়লেও শুরু করাটা পিছিয়ে যায়।
    এই গল্পটা প্রথম যখন চোখে পড়লো, তখন দৌড়ের উপরে ছিলাম।
    ভাবলাম, সুস্থির হয়েই না হয় পড়বোখন।
    সেই সুস্থির হতে হতে দিন গড়িয়ে গেল। যখন নিয়ে বসলাম, ততক্ষনে দ্বিতীয় পর্ব এসে গেছে।
    ভালই হলো, একদমে দুইটা পর্ব পড়া হয়ে গেল।

    এইরকম গতিময় লিখা পড়ার মজাই আসলে আলাদা।
    ক্যামনে যে লিখেন, ভাবি।
    টেকনিকটার উপরে একটু তালিম নিতে হবে.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "এর মধ্যে লাল গোলাপ পর্যন্ত পৌছে গেছে ভাষা না জেনেই।" - একটা ছোট্ট কথা দিয়ে যে কতকিছু বলা যায়! তুমিই পারো সেটা সদর্পে বলে যেতে।
    গল্প পরিবেশনার ব্যাপারে তোমার পরিমিতিবোধও ঈর্ষণীয়। গল্প হঠাৎ থেমে যায় না, সুন্দরভাবে ব্রেক কষে থামে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।