জার্মানির জার্নাল ১

অনেকদিন আগে জার্মানি গিয়েছিলাম। ছিলামও মাস দেড়েক। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখছি জার্মানির জার্ণাল।

frankfurt-airport2
পৃথিবীর ব্যস্ত এয়ারপোর্ট গুলির অন্যতম ফ্রাঙ্কফুর্ট । আমরা যখন ওখানে পৌছালাম বাংলাদেশে তখন পড়ন্ত বিকেল আর ফ্রাঙ্কফুর্টে বুড়ো বাঘের মত শয়ে আছে শীতের দুপুর। তেজহীন সূর্যকে আগলে রেখেছে মেঘ, হঠাত দমকা বাতেসে কুয়াশা অথবা মেঘ সরে গেলে সূর্যের দেখা মেলে। আমাদের গন্তব্য মিঊনিখ এখান থেকে বিমানে ৪০ মিনিটের পথ। আমরা ১৪ জন বাংলাদেশি মিঊনিখ যাচ্ছি সিমেন্স ইন্সটিটিউটে ছয় সপ্তার ট্রেনিং এ। গতকাল দুপুর বারোটায় ঢাকা থেকে শুরু হয়েছে আমাদের যাত্রা। রাত কেটেছে দুবাইএর এয়ারপোর্ট হোটেলে। ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট এসেছি এমিরেটসে। ফ্রাঙ্কফুর্টে পাসপোর্ট কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে বেলা দেড়টা। তারপর এয়ারপোর্টে ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে তাও প্রায় এক ঘন্টা। এর মধ্যে কাজের কাজ হোয়েছে বিনিপয়সায় কফি খাওয়া আর ডলার ভাঙানো।নেদারলয়ান্ডের কিছু খুচরো গিল্ডারস দিয়েছিল এক আত্মীয়। সেটা কোন কাজে লাগল না।এখান থেকে Luftahnsaয় চেপে যেতে হবে মিউনিখ। Luftahnsa পৃথিবীর শীর্ষ স্থানীয় এয়ার লাইন গুলির একটি। ১৯৩০ সালে গঠিত হবার পর ক্রমশঃ বেড়েছে তাদের নেটওয়ারক।১৯৯৭ সালে জার্মান সরকার বেসরকারি খাতে ছেড়েদেয় Luftahnsa । বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশে Luftahnsa কিম্বা তার পার্টনারদের নেটওয়ারক বিস্তৃত।

পৌনে ৩টায় মিউনিখের উদ্দেশে বিমান ঊড়লো আকাশে। আমাদের ডোমেস্টিক রূটের এয়ারক্রাফটের মতই। এই ছোট্ট যাত্রায় আতিথেয়তাও কেবল কোমল পানীয়তেই সীমাবদ্ধ।

মিউন্নিখ এয়ারপোর্টে পৌছাতে পৌছাতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। দিন সেখানে ফ্রাঙ্কফুর্টের মত কুয়াশা কাতর নয়। শেষ বিকেলের রোদ ছুঁয়ে যাচ্ছে ফ্ল্যগহ্যাফেন মুনচেন (মিউনিখ এয়ারপোর্ট)
আমাদেরকে মিউনিখ এয়ারপোর্টে স্বাগতঃ জানালো হ্যারি ক্লোজ। পেশায় সিমেন্স কোম্পানীর বাস চালক। ইংরেজির দৌড় খুব বেশি নয় কিন্তু স্মার্টনেস অনায়াসে ইংরেজির ঘাটতি পুষিয়ে দেয়। বললো, ‘আমি আপনাদেরকে যিমেন্সের পক্ষ থেকে মুনচেনে স্বাগত জানাচ্ছি।আপনাদের লাগেজ গুলি চিনিয়ে দিলে আমরা হোটেলের দিকে রওনা হতে পারি’।
দুটি বিষয় জানা গেল, এক, ইংরেজি ‘এস’ এর জার্মান উচ্চারণ ‘য’ আর দুই, মিউনিখকে এরা মিউনিখ বলেনা। কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা  শেষ করে হ্যরির কাছে লাগেজ শপে দিতে দিতে সন্ধ্যা নেমে এল আমাদের অলক্ষ্যে। হ্যারি প্রায় একাই ১৪ জনের জিনিষ পত্তর তুলে ফেললো বাসে। একাধিক ফ্লাইওভার সড়ক আর রেল পথ মিঊনিখ বিমান বন্দরকে যুক্ত করেছে মূল শহরের সাথে। আমাদের বাস চলছিল কখনও দুইতলা কখনওবা তিন তলা ফ্লাই ওভার দিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহরের দূরত্ব ৩০ কি;মি;। হ্যারির কাছে জানলাম মিঊনিখের ব্যাভারিয়ান নাম মুনচেন। আমাদের গন্তব্য শহরের উপকন্ঠে সিলভার হরণ স্ট্রাসের হোটেল এপার্ট। হোটেলে পৌছালাম সারে পাঁচটায়। তার এক ঘন্টা আগে সূর্য ডুবে গেছে। এখানে নভেম্বরে সূর্য ডোবে সাড়ে চারটায়।
এপার্ট হোটেল ছোট কিন্তু সুন্দর। আমাদের জন্যে পাঁচতলায় ৭টি রুম বুক করা ছিল। মাঝ বয়সী এক মহিলা আমাদের রিসিভ করলেন হোটেলে। মিষ্টি হেসে ৭টি চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের মনে হয় ডিনার করা হয়নি। হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসতে পারো অথবা পিতযা খাবার জন্যে বাইরে যেতে পার। কাছেই একটা ইতালিয়ান বিস্ত্রো আছে’। মহিলার নাম এখন মনে নেই। প্যারিসের এক শহরতলিতে স্বামীর কাছে সন্তানদের রেখে তিনি চাকরী করতেন এই হোটেলে। তার মিষ্টি ব্যবাহারের কথা ভুলে যাওয়া সহজ নয়। মাঝে মাঝে বাইরে যাবার সময় তাঁর কাছে চাবি রেখে যেতাম। ফিরতে রাত হলে মনে হত তিনি আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করে আছেন বড় বোনের মত।

 

মিউনিখে থাকার খরচটাই সবচেয়ে বেশি। আমদের রুমগুলি আদতে ছিলো সিঙ্গেল । আমাদের পয়সা বাঁচানোর জন্যে সিমেন্সের অনুরোধে একটি ডিভানকে খাটে রুপান্তরিত করে ডাবল রুমের চেহারা দেওয়া হয়েছে। তারপরও দু’জনের জন্যে ব্যবস্থা খারাপ নয়। টিভি ফ্রিজের সাথে ছোট কিচেন কেবিনেটে ইলেক্ট্রিক ওভেনও ছিল রান্নার জন্যে। রুমে উঠে গোছগাছ করতে করতে পেটে ইঁদুর দৌড়তে লাগল।নিচ তলায় রেস্টুরেন্টের খবর আগেই পেয়েছিলাম। যাবার সাহস হল না। কারণ দুটি। ভাত পাবার সম্ভাবনা নেই, সঙ্গীদের অনেকেই ভাত ছাড়া অন্যকিছুকে রাতের খাবার হিসাবে ভাবতে পারে না। দেশ থেকে চাল, ডাল আলু ইত্যাদি নিয়ে আসা হয়েছে। এসবের দায়িত্বে ছিল আনোয়ার। ৪৫দিনের রসদ হিসেব করে এক একজনকে একেকটি জিনিষ বহনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। আমার ভাগে পড়েছিল ১০ কেজি চাল। ব্যগেই তুলিনি সে দ্রব্য। বলেছি, ‘মিউনিখে গিয়ে কিনে দেব’। দ্বিতীয়তঃ যে হোটেলে সিঙ্গেল রুমে প্রতি রাতের ভাড়া ১৫০ ইউরো সেখানে খাবার সস্তা হোতেই পারে না। শেষ পর্যন্ত ৭ জনকে নিয়ে বের হলাম খাবারের সন্ধানে।
সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় মিউনিখে। তার ওপর রোববার। দোকান খোলা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। অবশ্য দূর থেকে বোঝার উপায় নেই। দোকান বন্ধ থাকলেও আলো ঝলমল শো-কেস অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। হোটেলের আশেপাশে খোঁজা খুঁজির পর ইটালিয়ান পিতযার দোকান পাওয়া গেল একটা। দোকানে যাবার সময়ই ঘটলো এক বিপত্তি। সুনসান ফাঁকা রাস্তায় মোড় ঘুরতে গিয়ে একটি পিকাপ ভ্যান ঊলতে গেল হঠাত করেই। দু’এক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির। বিস্মিত হলাম। কারণ মিউনিখে আসার পর রাস্তায় পুলিশ দেখিনি। পরে জেনেছি আমাদের দেশের মত রাস্তায় ঘোরাঘুরির চেয়ে নির্দিষ্ট পোষ্টে বসে ডিউটি করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে জার্মান পুলিশ। ক্লোজ সার্কিট টিভিতে দুর্ঘটনাটি ঘটতে দেখে ছুটে এসেছে তারা।

শেষ পর্যন্ত যখন পিতযার দোকানে ঢুকছিই সেখানেও দরজা বন্ধ হয় হয় অবস্থা। একে ভিনদেশি, তারপর আবার ক্ষুধার্ত হয়তো এতেই মন গলল ম্যানেজারের। আমাদের যত্নের কোন ত্রুটি হলনা। তিন রকম পিযা বানায় তারা। পিযা পানে ৪ ইঊরো, পিযা মারগারিটা ৬ ইঊরো আর পিযা নেপোলি ৭ ইঊরো। সার্ভিস চার্জ আলাদা। মধ্যমের সাথে থাকা নিরাপদ। আমরা নিলাম মারগারিটা। খুব যে ভালো লাগল তা নয়, আমাদের অনেকেই তখন পর্যন্ত পিযার নামে চ্যাপ্টা পাউরুটির উপর গলানো টমাটো , ভাগ্যে থাকলে শসা আর মাংস লেপ্টে থাকা গোলাকার খাদ্য বস্তু খেতে অভ্যাস্ত।(পিযা হাট বাংলাদেশে এসে আমাদের পিযা চিনিয়েছে। এর আগে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে একটি পিযার দোকান ছিল যারা প্রায় সত্যিকারের পিযা বানাতো)। নতুন কাস্টমারদের খাতির করে সার্ভিস চার্জ নিলনা ইটালিয়ান ওয়েটার। মনটা ভরে গেল তার বদান্যতায়।
হোটেলে ফিরে দেখি চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়েছেন নজরুল সাহেব। মেনু ভাত আলু ভর্তা ডাল। সেদিন থেকে নজরুলের রুমই হল আমাদের কিচেন কাম ডাইনিং রুম (এহোটেলের প্রতিটি রুমেই রান্নার ব্যবস্থা আছে)। সে রাতে আর কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না। রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

১,৩০০ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “জার্মানির জার্নাল ১”

    • সাইদুল (৭৬-৮২)

      ভেবে দেখলাম গল্প, উপন্যাস লেখা অনেক খাটনির কাজ। যখন কোন চরিত্র নিয়ে চিন্তা করি আর কোন কিছু খেয়াল থাকে না। মেয়েরা প্রশ্ন করলে হ্যা, হু বলে চালাই। সে থেকে তারা আমার নাম দিয়েছে হু বাবা। তার চেয়ে ভ্রমণ কাহিনী লেখা সোজা। যা দেখেছি জাস্ট লিখে গেলেই হল।


      যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

      জবাব দিন
  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    জার্মানী আমার পছন্দের দেশ। চোখে দেখা হয়নি এখনো, তবে যাবার আশা আছে। জার্মানদের নিজ নিজ কাজে নিষ্ঠা আর পেশাগত দক্ষতা আমাকে মুগ্ধ করে। এমন একটি আগ্রহের দেশ সম্পর্কে লেখা এই জার্নাল তাই মন দিয়ে পড়লাম। গল্প বলার সাবলীল স্টাইল আমাকে মুগ্ধ করলো। পরবর্তী লেখাগুলোর জন্য মুখিয়ে রইলাম।

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ঢাকা থেকে ফ্রাংকফুর্ট পৌছুতে আপনার ক' ঘন্টা লেগেছিলো জানিনা । প্রথম তিন চার লাইনে আপনি লহমায় উড়িয়ে নিয়ে গেছেন আমাকে ।
    দিব্যি ট্যুর টিমের একজন হয়ে গেছি বলা যায় ।
    বিনে পয়সার ট্যুর শুরু করলাম । বদান্যতা আপনার । প'জ বাটনে অপেক্ষায় থাকলাম ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।