মা

সাড়ে বারো বছর বয়স থেকে আমি ঘর ছাড়া। ১৯৭৬ সালের আগষ্ট মাসে সেই যে ক্যাডেট কলেজে ঢুকলাম তারপর থেকে ছুটি ছাটায় বাড়ি যাই গেস্টের মত। দুর্জনেরা বলে এতে বাড়ির সাথে নাড়ির সম্পর্ক কমে যায়। আমি ব্যাপারটাকে সেভাবে দেখিনা। ক্যাডেট কলেজ বারো বছরের একটা ছেলেকে উপরে উপরে শক্ত হতে শেখায়।বন্ধুরা হয়ে যায় ভাইয়ের মত। ক্যাডেট কলেজের ঘেরাটোপ থেকে বাইরে এসে আড়মোড়া ভাংতে সময় লাগে।মানুষ ভুল বোঝে। আমার মনে আছে, ঝিনাইদয় বাস থেকে নেমে রিক্সা করে কলেজে যাবার সময় দূর থেকে একাডেমিক ব্লকের গম্বুজটা দেখার সাথে সাথেই মন খারাপ হয়ে যেত। অবশ্য কলেজে পৌছাবার পর বন্ধুদের সাথে মিলে মিশে সব ঠিক ঠাক হয়ে যেত। তবে সারাটার্ম (প্রায় তিন মাস) ধরে ভাবতাম ছুটিতে বাসায় ফিরে কি কি করবো। বাসায় গেলে তার প্রায় কিছুই করা হতো না।

বাসা থেকে আসার সময় ছোট খাটো কারণে মায়ের সাথে ঝগড়া হতো। আসলে মন এত খারাপ থাকতো তখন কেউ একটু আদর করলেই চোখে পানি চলে আসতো। আমি তখন বড় হয়ে উঠছি।চোখের পানি কেউ দেখে ফেলা বিশাল লজ্জার ব্যাপার। বাড়ি থেকে বের হবার সময় মায়ের সাথে দেখা করতে চাইতাম না। মন খারাপের ভয়ে।এবার ঈদে যশোর গিয়ে সেই একই রকম ফিলিং হলো।

ঈদের পর টিকেটের ঝক্কি অনেক। আমি ঈদে বাড়ি গেলে প্রথম দিনই ফেরার টিকেট কিনে ফেলি।আমার হাতে টিকেট দেখে মা বললেন, এই রকম বাড়ি আসার দরকার কী। কোন কথা না বলে ঘরে চলে গেলাম। আমার ঘরটা, আড়াই তলায়। ঘরের সামনে এক চিলতে ব্যলকনির মত। সেখান থেকে দোতলার ব্যালকনির কথা বার্তা শোনা যায়। শুনি আমার ছোট মেয়ে বলছে, ‘দাদ দাদ তোমার ছেলেটা কেমন দ্যাখো, ঢাকায় থাকলে মাকে দেখতে যাবো দেখতে যাবো বলে আর যশোরে এসে তোমার পাশে বসেও না। নিজের ঘরে চলে যায়’।
মা বললেন, আমার সাথে কথা বলার জন্যে তোকে তো রেখে গেলো, তুই আমার ছেলের বদনাম করবি না। নাতনি বলল, দাদ দাদ আমরা চলে গেলে তোমার আমাদের কথা মনে পড়েনা? তুমি আমাদের সাথে ঢাকায় আসো না কেন। মা কি বললেন শুনতে পেলাম না। একটু পর শুনি তিনি বলছেন,
– তোরা চলে যাবার পর আমি কান খাড়া করে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি।
– কেন?
– বাবুয়ার চায়ের দোকানে একটা ছেলে প্রায়ই এসে তোর বাবার গলায় কথা বলে।আমার মনে হয় আমার ছেলেটা এলো নাকি?ওকে দেখার জন্যে আমি বাবুয়ার দোকানে উঁকি ঝুকি দেই।

নিজের অজান্তেই বিষাদে ভরে উঠলো মন। চোখে পানি চলে এলো। বড় মেয়ে কখন পেছেনে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাই নি। সে বলল, বাবা তোমার কী দাদ দাদের কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে?
আমি বললাম নারে, অফিস খুলে যাবে, তোমাদের স্কুল খোলা। সে আমার কাছে আরও সরে এসে আমার হাত ধরে বলল, মায়ের কাছে মিথ্যা বলতে হয় না। তুমি না বলো আমি তোমার ছোট্ট মা !

১০ টি মন্তব্য : “মা”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    আমিও আমার মায়ের আজন্ম প্রবাসী কন্যা, ভাইয়া! ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার জন্য সেই যে ঘর ছেড়ে এসেছিলাম আর আমাদের সেই সাদা বাড়িতে ফেরা হয়নি। দোতলায় বড় জানালা ঘেরা আমার শোবার ঘর অথবা ছাদে বোনের বাগানে আমি চিরকালের অতিথি হয়ে গেলাম, জানো! ছুটিতে বাড়ি গেলে শাসনের বদলে উপচে পরা ভালবাসাই পেয়েছি বাবা-মা, ভাই বোন এমনকি আত্মীয় স্বজনদের থেকে। খাবারে রুচি ছিলনা মোটে তবুও দুধের সর থেকে শুরু করে কাবাব, পরোটা খাওয়ানোর জন্য মা কত কসরতই না করতেন।

    ছুটি শেষে কলেজে যাবার সময়ে চোখে অশ্রু থাকতো না একবিন্দুও কিন্তু নিশ্বাস নিতে কী যে কষ্ট হতো!

    জবাব দিন
  2. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    খুবই হৃদয়স্পর্শী লেখা।
    ছুটি শেষে কলেজে যাবার দিনে মা কতকিছু খাওয়াতে চাইতেন, ঢোক গিলতে বড় কষ্ট হতো। আবার কলেজে এসে সবকিছু ঠিক হয়ে যেত।
    "তুমি না বলো আমি তোমার ছোট্ট মা" - আমার মেয়ে নেই, তাই এই স্বর্গীয় অনুভূতি থেকে বঞ্চিত।

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ভীষণ হৃদয়স্পর্শী । ভীষণ ।
    আমি যদিও বাবার প্রচন্ড কড়া শাসন থেকে পালাতে মরিয়া হয়ে ক্যাডেট কলেজে গিয়েছিলাম ।
    তবু ... মা ... আর তিন প্রজন্মের সন্ধি ... লেখার শৈলীতে বুক ভারী করে দিলো খুউব ...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।