আল্পসের চূড়ায়

ইউরোপের দিনগুলি দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। জার্মানিতে এসেছি SCHENGENERS STAATEN ভিসা নিয়ে। কাজেই দেশ ভ্রমণের অবারিত সুযোগ। ভাড়াও তেমন কিছু নয়। ইউরো ট্রেনে ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া ঘুরে আসা যায়। কিন্তু যাই যাই করে কোথাও যাওয়া হয়নি। অভিজ্ঞতা বলতে মিউনিখের গোটা দশেক জাদুঘর, ইংলিশ পার্ক, বিপণী কেন্দ্র, Olympia Zentrum আর U Bahn (পাতাল রেল)। সময়টা এমন যে রাস্তায় বেরুনো কঠিন। দিনের পর দিন ডিমের খোসার মত আকাশ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর তীব্র শীতের হাওয়া অনভ্যস্ত বাঙালি শরীরে আদৌ সুখপ্রদ নয়। জার্মানিতে আসার পর থেকেই শুনে আসছি ‘ খুবই খারাপ সময় এসেছ। শীতের সময় কেঊ ইউরোপে আসে? এলেই যদি তো মাস খানেক আগে এলে না কেন? আন্তত Oktoberfest টা ধরতে পারতে’। খোঁজ নিয়ে জানা গেল Oktoberfest হচ্ছে ফোকলোর উতসব। ফোকলোর চর্চার সাথে সাথে বয়ে যায় বিয়ারের বন্যা। মিউনিখ শহরে কয়েক হাজার বিয়ার গার্ডেন আছে। অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে সেখানে মদের মচ্ছব লাগে। সুরায় আসক্তি নেই। কাজেই বিষয়টি খুব বেশি আলোড়িত করল না। মাঝখানে বলে রাখি জার্মানির ব্যভারিয়া প্রদেশের রাজধানি মিউনিখ। যে তিনটি জিনিষের জন্যে এ শহরের বিশ্ব জোড়া খ্যাতি তার একটি বিয়ার অন্য দুটি হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স আর মোটরগাড়ি। তবে আমি এ খ্যাতির আরও তিনটি কারন খুঁজে পেয়েছি। এক । বরিস বেকার দুই। বেকেন বাওয়ার, তিন। স্টেট বিবিওলিথিক (বিশ্বের দশম বৃহত্তম লাইব্রেরী)।
একদিন ক্লাশের ফাঁকে আমার শিক্ষক Dr Reinherd Ernst বললেন, “জার্মানীর শীতটাও খারাপ না। আল্পসে তুষার জমতে শুরু করেছে। এক উইক এন্ডে ঘুরে আসতে পারো’। জীবনে তুষারপাত দেখিনি। Reinherd এর কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো গোটা সপ্তাহ। আল্পসের নাম প্রথমে শুনি ছোটবেলার ইতিহাসের ক্লাশে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কার্থেজের সেনাপতি হ্যানিবল আল্পস অতিক্রম করেছিলেন গোটা বাহিনী নিয়ে। ১১১৬ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এই পর্বতমালা ফ্রান্স থেকে ইটালি পর্যন্ত বিস্তৃত। আল্পসের কথা মনে হলে Helvetia’র ডাকটিকেটে আঁকা বরফে ছাওয়া পাহাড়ের ছবি চোখে ভাসে। ঠিক করলাম, আল্পস দেখতে যাব ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। Reinherd বললেন, Byerisehes Fernshen চ্যানেলে আল্পসের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানায়। বের হবার আগে টিভিতে আবহাওয়ার খবরটা দেখে নিও। মেঘলা আবহাওয়ায় না যাওয়াই ভাল, রোদ ঝলমলে দিনে বরফের গায়ে আলোর ঝিলিকই আল্পসের আসল সৌন্দর্য।”

যাত্রা শুরু।
মিউনিখ থেকে আল্পসের পাদদেশে পৌছানোর সহজতম উপায় হচ্ছে ট্রেন। মিউনিখ শহরে মোট চার ধরনের ট্রেন চলে। ICE বা ইন্টার সিটি এক্সপ্রেস সবচেয়ে দ্রুতগামী। আন্তঃ দেশীয় যোগাযোগের জন্যে এ ট্রেনের খ্যাতি ইউরোপ জুড়ে। আন্তঃ মহানগর ভ্রমণের জন্যে রয়েছে ইউরো ট্রেন। U bahn দ্রুতগামী হলেও মিউনিখ শহরের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। আর S bahn ততটা দ্রুত না হলেও পুরো জার্মানিতে সস্তায় ভ্রমণের সবচেয়ে উপযোগী বাহন। সপ্তাহান্তে বিশেষ ছাড়ে টিকেট পাওয়া যায়। মাত্র ৪০ ইঊরোর একটি উইক এন্ড টিকিটে পাঁচ জন যাত্রী শুক্রবার বিকেল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত জার্মানির ভেতরে যে কোন গন্তব্যে যাওয়া আসা করতে পারে। আমাদের যেতে হবে S bahnএ গারমিস- পার্টেন কিচেন রুটে।

ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ঘুম থেকে উঠতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। জানালার ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে মিহি আলো ছুয়েছে দরজার চৌকাঠ। আবহাওয়া বার্তা না দেখেই বলে দেওয়া যায়, আজ রৌদ্রজ্জ্বল দিন। আজ আমাদের দিন।
দ্রুত তৈরি হয়ে সকাল ন’টায় পাতাল রেলে Hauptbahnhof পৌছলাম আমরা দশজন। মিউনিখ শহরের প্রধান স্টেশন Hauptbahnhof, এখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতি তিন মিনিটে একটি করে ট্রেন ছাড়ে। ICE, EURO, U bahn এবং S bahn সব ট্রেনেরই কেন্দ্রীয় স্টেশন Hauptbahnhof এখানে নয়টায় পৌছেও সাড়ে নয়টার ট্রেন ধরতে পারলাম না। তার প্রধান কারণ স্টেশনের বিশালত্ব এবং ডয়েচেবানের (জার্মান রেলয়ে) সময়ানুবর্তিতা। জার্মানিতে সাড়ে ন’টার ট্রেন সাড়ে ন’টায়ই ছাড়ে। গারমিস পার্টেন কিচেনের ট্রেন ছাড়ে ২৭ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে। সেখনে পৌছাতে পৌছাতে নয়টা একত্রিশ বেজে গেল। কাজেই পরবর্তী ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। এটা ছাড়বে সাড়ে দশটায়।
ট্রেনের অভিজ্ঞতা।
ট্রেনে উঠতে গিয়ে এক মজার কান্ড। উইকএন্ড টিকিট শুধুমাত্র ২য় শ্রেণীতে ভ্রমনের জন্যে। দরজায় ২য় শ্রেণীর চিহ্ন আছে ঠিকই, ভিতরের অবস্থা আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীকে হার মানায়। এত পরিপাটি যে মনে হয় ভুল কামরায় উঠে পড়েছি। এদেশে বিনা টিকেটে কিম্বা ভুল টিকেটে রেল ভ্রমণ বড় মাওএর অপরাধ। ধরা পড়লে ৬০ ইউরো জরিমানা। এদের কাছে টাকার অংকটা বড় না হলেও, পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়া মানে অশেষ হ্যাপা। কামরায় আগে থেকেই এক মহিলা যাত্রী বসে ছিলেন চোখের সামনে গল্পের বই মেলে। জার্মানিতে এটি অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। ট্রেন, বাস, ট্রাম সব জায়গাতেই এদের সঙ্গী বই। বাসের দরজায় বই, ট্রামের ভেতরে বই, ট্রেনের জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কেউ তারও সঙ্গী বই। কত টুকু পড়া হয় জানি না। তবে নিজেকে গুটিয়ে রাখা যায়। সহযাত্রী মহিলাকে টিকেটটা দেখালাম ঠিক আছে কিনা জানার জন্যে। উনি যা বললেন, তার সরল অর্থ হচ্ছে “আমি ইংরেজি জানিনা”। সুতরাং টিকেট টেকারের অপেক্ষায় বসে রইলাম পকেটে ৬০ ইউরো আলাদা করে। বেশিক্ষণ উৎকণ্ঠায় কাটাতে হল না। দু–একটা স্টেশন পরে টিটিসি এসে টিকিট দেখে গেল। আমরা নিশ্চিত হলাম।
জার্মানির এই ধীর গতির S bahn আমাদের আন্তঃনগর ট্রেনের চেয়ে দ্রুত ছোটে। Passing স্টেশন ছাড়াতেই হঠাত করে প্রকৃতি যেন আমাদের কাছাকাছি চলে এল। বুঝলাম শহর ছাড়িয়েছি। এদিকে জনবসতি বেশ হালকা। ইংরেজি সিনেমায় দেখা গ্রামের মত। ছড়ানো ছিটানো দু- একটা ঘর। মাঝে মাঝে ফা্রের কিম্বা ঝাউ বনের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন।

সূর্য তখনও মাথার উপর ওঠেনি। ট্রেনের ডান পাশে লম্বা ছায়াটি দ্রুত এগিয়ে চলেছে আমাদের সাথে। অনেক দিন পর একটা ঝক ঝকে নীল আকাশ দেখছি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অবশ্য মেঘলা দিনের কথা বলা হয়েছিল। গাইয়েরবাওয়েন নামের এক স্টেশনে যেয়ে ট্রেন বদলে আর এক ট্রেনে যেতে হবে গারমিস। বার বার বাইরে তাকিয়ে স্টেশনের নাম পড়তে গিয়ে অনেক কিছুই দেখা হচ্ছে না। এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি Tutzing. মিউনিখের বিখ্যাত স্ট্র্যানবারগ হ্রদের তীর ঘেঁষা পরিচ্ছন্ন কাউন্টি শহর। প্রকৃতি ব্যাভারিয়াকে সমুদ্র দেয়নি। তার বদলে যে অপার সৌন্দর্য দিয়েছে, তা তুলনাহীন। এই হ্রদের গাঢ় নীল পানি, হ্রদের বুকে ঝুঁকে পড়া মেঘ আর বিশাল উপত্যাকা একে করে তুলেছে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। শোনা যায় জার্মানির স্বপ্নবিলাসী রাজা দ্বিতীয় লুডউইগ এই হ্রদে আত্মবিসর্জন দিয়ে ছিলেন। সুন্দরের খোঁজে না সৌন্দর্য সুধা পান করতে তা অবশ্য জানা যায়নি।
Tutzing থেকেই আল্পস পর্বতের চূড়ায় জমে থাকা বরফ দেখা যাচ্ছিল। জমাট বরফে সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে রুপের ছটা। পাহাড়ের নিচ দিকে রোদ যেখনে তেমন প্রখর নয়, বরফ যেন সেখানে বিছিয়ে আছে রূপালী চাদীররের মত, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। রাস্তার ঘোরপ্যাঁচের জন্যে পাহাড়কে মনে হচ্ছে কখনো কাছে, কখনো বা দূরে। ঠিক ১ ঘণ্টা ২১ মিনিট পর ট্রেন পৌছালো গারমিসে।
আল্পসের পাদদেশে গ্র্যানিঊ এলাকার এক উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র গারমিস পার্টেনকিচেন। সমতলে আমাদের শেষ স্টেশন। ট্রেন থামতেই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা সবাই। ঠাণ্ডা এখানে মিঊনিখের চেয়ে বেশি। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি, সাথে ঠান্ডা বাতাস। আকাশের নীলচে ভাবটা নেই। আবহাওয়া বার্তা ফলতে শুরু করেছে। আল্পসের চূড়া দূরে হলেও মনে হচ্ছে বরফ ছুঁয়ে বাতাস ছূটে আসছে প্ল্যাটফর্মে। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার অভিযান এখান থেকেই শুরু।
Bayern Zugpitz Bahn এর একটা অফিস আছে গারমিস পার্টেনকিচেনে। তার সামনে থেকেই কগহুইল ট্রেন, কেবল কার আর চেয়ার লিফট ছেড়ে যায় ঘন্টায় ঘন্টায়। সবচেয়ে উঁচু চুড়ায় যাবার জন্যে ভাড়া জনপ্রতি ৪৭ ইঊরো।কগহুইল ট্রেন আমি আগে কখনও দেখিনি। বরফে ছাওয়া রেল সড়কে চলার উপযোগী এই ট্রেনের চাকা থাকে লাইনের মাঝ বরাবর এবং মাত্র একটি।চাকার দুপাশে থাকে বরফ সরানোর কিছু একটা । এক চাকার এই ট্রেন মৃদু মন্দ ঝাকুনি দিয়ে বরফ সরাতে সরাতে এগিয়ে চলে। কগ হুইল ট্রেন প্রথমে যাবে ঈব সী। সেখান থেকে আবার কগহুইল ট্রেন কিম্বা কেবলকারে যুগপিতয, সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৯৬৪ মিটার উঁচুতে জার্মানির সরব্বোচ্চ চুড়া। তবে আল্পসের সবচেয়ে উচু চুড়ার নাম মাউন্ট ব্ল্যাঙ্ক। ফ্রান্স – ইটালি সীমান্তে এই চুড়ার উচ্চতা ৪ হাজার ৮০৭ মিটার। শীত আর উচ্চতার কারণে আমাদের দলে ভাঙ্গন শুরু হল। পাঁচজন মিউনিখে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। রয়ে গেলাম আলম, রকিব, আনোয়ার, নজরুল আর আমি। এদিকে আমার জামা কাপড়ের যে অবস্থা, তাতে যুগপিতয এর অনেক আগেই আমার বরফ হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। খালেদ এগিয়ে এল বিপদে। মিঊনিখ ফিরে যাবার আগে তার জ্যাকেটটা দিয়ে গেল আমাকে। খালেদের জ্যকেট গায়ে তৈরি হলাম।
টিকেট কাটতে গিয়ে জানলাম ট্রেন ছাড়তে তখনও ৪০ মিনিট বাকি। এই সুযোগে গারমিস দেখতে বের হওয়া গেল। সরকারি হিসাবে গারমিস পার্টেনকিচেনকে গ্রাম বলা হলেও প্রকৃত পক্ষে ছোট্ট একটি ট্যুরিষ্ট শহর গারমিস। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। শহরের মাঝ বরাবর মসৃন পিচঢালা পথ, দু’পাশে শপিং সেন্টার, সুন্দর ফোয়ারা আর পেছনে বিশাল আল্পস।জার্মানিতে ছুটির দিনে দোকান পাট বন্ধ থাকে, তার ব্যতিক্রম নয় নির্জন এ শহরও।আলমের ক্যামেরাটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ করেই। ছবির মতো এই শহরের ছবি তুলতে না পেরে তারও মনটা গেল খারাপ হয়ে।
ঈবসীর পথে
বারোটার একটু আগে বা পরে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। খুব বেশি যাত্রী নেই ট্রেনে। সামনের দিকে কম বয়সী কয়েকজন ভারতীয় তরুণ-তরুণী ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। উজ্জ্বল কমলা আর হলুদ রঙের স্কী পোশাক পরা কিছু জার্মান। আর আমরা। এই প্রথম দেখলাম জার্মানরা পথ চলছে বই ছাড়া। গোমড়া মুখের পরিবর্তে প্রাণবন্ত একদল মানুষ। প্রথমবারের মতো দেখলাম জার্মানদের প্রগল্ভতা। হয়তো স্কী’র উজ্জ্বল পোশাকই রং ধরিয়েছে এদের মনে। আল্পস যতই কাছে আসতে থাকলো, তার চেহারা ততই বদলে যেতে থাকলো আমাদের চোখে। ট্রেনের জানালা থেকে বরফে ছাওয়া দু-একটা ঝাউ আর বারচ গাছ নজরে এলো ছোট বেলায় দেখা বইয়ের ছবির মতো। গারমিসের নিকটবর্তী কয়েকটি স্কী স্পটে নেমে গেল কিছু যাত্রী। কেবল-কারেও যাওয়া যায় এসব জায়গায়। সবচেয়ে কাছের চূড়াটি মাত্র ১৬৫ মিটার দূরে। তার পর একের পর এক মোট ১৬/১৭টি স্পট। আমরা যাব উচ্চতম চূড়ায় আকাশ ছুঁতে।
কগহুইল ট্রেন চলে ধীর লয়ে একটু দুলুনির মধ্যে দিয়ে। ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে প্রকৃতি। রেল লাইনের কাছেই সুন্দর সুন্দর কাঠের বাড়ি। দূরে ভেজা রাস্তা, পাহাড়ের গায়ে ঝোপ হয়ে থাকা গুল্ম, নিচে নুয়েপড়া লতা এবং বৃষ্টিস্নাত গাছপালার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ ঝলকানি দেওয়া ছিটেফোঁটা আলো দেখতে দেখতে ২৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম ঈব সী।
পাহাড় চূড়ায়
কি করতে হবে বুঝতে পারছি না। একজন জার্মান ভদ্রলোক পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, ‘কেবল-কারে যেতে চাইলে রাস্তা পার হয়ে কেবল-কার স্টেশনে চলে যাও।’ কে একজন বলল, ‘একেই বলে বাণিজ্য। একটা ইংরেজি শব্দ যাদের মুখ দিয়ে বের হতে চায় না, ব্যবসার কারণে তারাও কত ভালো ইংরেজি বলে।’ কেবল-কারের জন্যে বেশিক্ষণ দেরি করতে হলো না। ঈব সী থেকে ঘণ্টায় ১২ হাজার যাত্রী উঠা-নামা করে পাহাড়ের বিভিন্ন চূড়ায়।
এক ট্রিপে ৯০ জন যাত্রী। কেবল-কারে সবাইকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। ভারসাম্য রক্ষার জন্যে বাসের রডের মতো রডও রয়েছে কেবল-কারের ভেতরে। চূড়ায় ওঠার জন্যে কগ হুইল ট্রেনসহ ৩৮টি বাহন আছে ঈব সীতে। বেশ কিছু ভিনদেশী যাত্রীর সাথে কেবল-কারে চড়লাম আমরা ৫ বাঙালি।
একটু একটু করে উঠছে কেবল-কার আর কানের উপর চাপ বাড়ছে। তবে ঈব সী’র রূপের ঝলক তাক লাগিয়ে দিচ্ছে আমাদের। ব্যভারিয়ার সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক হ্রদ ঈব সী। যুগপিতয’র নিচদিকে পাহাড়ি উপত্যকায় অবিশ্বাস্য সুন্দর এই হ্রদ। পাহাড়ের বরফগলা পানি মিশেছে এই হ্রদে। আকাশের নীল, তুষারের শুভ্রতা, আর সবুজের ঘেরাটোপে সৌন্দর্যের এক নতুন সংজ্ঞা ঈব সী। মিনিট কয়েক দেখা দিয়েই সূর্য আবার হারিয়ে গেল ঘন কুয়াশায়। আমরা ততক্ষণে মেঘের রাজ্যে ঢুকেছি। নিচে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে এক আধবার ভেসে উঠছে ঈব সী, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে পরক্ষণেই। যেন এক মায়াবী জগত। কেবল-কারের নিচে সরাসরি তাকাতে বুকের জোর লাগে। দুর্বল হৃদয়ের মানুষদের এই বাহনে ওঠা নিষেধ।
পাহাড়ের গাছ লম্বা হয় জানতাম, এখানে মনে হলো যতটুকু কল্পনা করতে পারি তার চেয়ে দীর্ঘ এসব গাছ। মেঘ, কুয়াশা আর গাছের ফাঁক দিয়ে আবছা দেখাচ্ছে বরফ ঢাকা রাস্তা। হঠাৎ যদি বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়? কেউ একজন বলল, ‘ভয় নেই, গত ৫০ বছরে জার্মানিতে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়নি এক মিনিটের জন্যেও।’ ঈব সী থেকে প্রায় দেড় হাজার মিটার উঁচুতে যুগপিৎয তার মধ্যে এক হাজার মিটার একেবারে খাড়া। ১০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। কেবল-কারের দরজা খুলে বেরুতেই তীব্র ঠান্ডা হাওয়া চাবুক মারল চোখেমুখে। দ্রুত ঢুকে গেলাম যুগপিৎয কেবল-কার স্টেশনে। মেঘের উপর এক অবাক স্থাপনা এই কেবল-কার স্টেশন। চারদিকে মেঘের আস্তরণ আর পায়ের নিচে মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এ জায়গার নাম দেওয়া যায় ‘মেঘ চাতাল’।
যুগপিৎযে আছে আশ্চর্য এক আর্ট গ্যালারি। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৯৬৪ মিটার উচ্চতায় ৪৫০ বর্গমিটারের এ গ্যালারিতে প্রকৃতির সাথে চারুকলার অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে। বছরে দু’বার এখানে সমকালীন শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়। স্টেফান বাস্কেনল, টনিক্র্যাগত, ফ্রাস্কো মারলোর মতো শিল্পীরা চলে আসেন প্রকৃতির কাছাকাছি। আর এই উচ্চতায় প্রকৃতির সাথে মানুষের সৃষ্টিশীলতার পার্থক্যটা মূর্ত হয়ে ওঠে। জয়ী হয় অবশ্যই আল্পস। আর্ট গ্যালারির পাশাপাশি স্যুভেনির শপগুলোও কম আকর্ষণীয় নয়। তবে সবচেয়ে মন কাড়ে সামিট রেস্তোরাঁ।
প্রায় ৩০০০ মিটার উচ্চতায় কাচ ঘেরা এক কাপ কফি হাতে রোদ বরফের হুটোপুটি, পায়ের নিচে উড়ে যাওয়া মেঘ, কুয়াশা ও মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠা বন, দূরে ঘন নীল ঈব সী আর সবুজ গাছে ছাওয়া গ্রাম দেখার আনন্দ ভুলবার মতো নয়। অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স আর জার্মানির সীমান্ত এখানে মিলেমিশে একাকার। ইচ্ছে হলে ওয়াকিং ট্রেইল ধরে ঘুরে আসা যায় অস্ট্রিয়ার টিরল থেকে। তবে স্কী এ পাহাড়ের চূড়ায় নয়। এখান থেকে দেড়শ’ ফুট নিচে, আলপিতয মালভূমিতে।
যুগপিতয শৃঙ্গ থেকে আবার কেবল-কারে উঠলাম। এবার গন্তব্য ‘আল্পিতয’, ১৯২৬ সাল থেকে স্কী’র জন্যে জগত বিখ্যাত। ২ হাজার ৮০০ মিটার উঁচু এই মালভূমিতে স্কী এরিয়া ছাড়াও আছে রেস্টুরেন্ট, মুভি শো, ওয়াকিং ট্রেইল আর গির্জা। আগের মতোই কেবল-কারের বাইরে বের হবার সাথে সাথে বাতাসের ঝাপটা ছুঁয়ে গেল সমস্ত শরীর। কনকনে শীত আর উদ্দাম হাওয়ার চাবুকে হাড় নড়ে যাবার আবস্থা। তীব্র শীত ও বাতাসে তীক্ষ্ণ ছুরির মতো শরীরে বিঁধছে তুষার কণা। কেবল-কার স্টেশনের মুখেই একটা ফাস্ট ফুডের দোকান; শোন আলপিন। উচ্চস্বরে ইংরেজি গান বাজছে সেখানে। জার্মান তরুণ-তরুণী ইংরেজি গানের ভক্ত। ডিস্কো আর নাইট ক্লাব ছাড়া এই প্রথম প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে গান শুনলাম জার্মানিতে। এতে শব্দ দূষণ হচ্ছিল কিনা জানি না। তবে আমার মনে হচ্ছিল পাহাড়ের উত্তাপ বাড়ছে। তারই মধ্যে বরফে ডিগবাজি খেতে লাগলো প্রথমে রকিব, পরে আনোয়ার। নতুন পরিবেশে আড়ষ্ট হয়ে পড়ি আমি। হঠাৎ একটা তুষারের দলা আমার গায়ে ছুঁড়ে দিল কেউ। আড়ষ্টতা কেটে গেল নিমিশেই। হাতের দস্তানা খুলে এক তাল তুষার ছুড়ে দিলাম অন্যদের দিকে। প্রথমে মনে হলো হাতের আঙুলগুলো আমার নয়। জমে গেছে। তাপমাত্রা এখানে শূন্যের নিচে দুই ডিগ্রি। একটু পরে সব স্বাভাবিক মনে হতে লাগলো। জীবনে প্রথম অনুভব করলাম আর্মি বুট বা বুট ডিএমএস খুবই উপকারী জুতো। বলতে গেলে বরফ, স্কী, অভিযাত্রী, তুষারÑ এগুলোর সাথে মিশে গেলাম সবাই।
এখানকার সম্পূর্ণ এলাকা স্কীর উপযোগী নয়। কোথাও কোথাও তুষার ধস নামে হঠাৎ করে। এসব এলাকায় আগে থেকে সতর্কবাণী লেখা আছে। স্কী এরিয়া ঠিক রাখার জন্য ২০টি বরফ সমান করা গাড়ি ‘স্নো ক্যাট’ আর ৫০ জন কর্মী নিয়োজিত আছে। কয়েকটি স্পটে সারা বছর স্কী চলে। গ্রীষ্মকালে কৃত্রিম বরফে ঢেকে দেওয়া হয় স্কী স্পটগুলো। এসবের জন্য সারা বছর পানি জমিয়ে রাখা হয় নিকটবর্তী হিমেল রাইখ রিজারভারে। আল্পিতয ওয়াকিং ট্রেইল ধরে এগিয়ে যেতে যেতে দেখি কোথাও কোথাও বরফ জমে কঠিন হয়েছে। গ্লেসিয়ারের মতো। পড়েও গেলাম একবার। এক জায়গায় শুকনো মাটি কিংবা পাথরের চাঁই পাওয়া গেল। তুমুল আবেগাক্রান্ত আলম জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকাতে ঢুকাতে বলল, ‘আল্পসের উচ্চতা কমিয়ে দিলাম কয়েক মিলি মিটার’।
স্লেজ ধরনের একটা বাহন পাওয়া গেল হঠাৎ করেই। একদল ভারতীয় আর দু’জন পশ্চিম ইউরোপীয় তরুণী ব্যবহার করছিল বাহনটি। তাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আমরাও একটু মজা করলাম। কাঠ বা চামড়ার আসনের মতো এ বাহনের সামনের দিকে দড়ি থাকে গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। পাহাড়ের উঁচুতে বসে দড়ি টান দিলে চলা শুরু হয়। দড়ি টেনে গতি বাড়ানো যায়। আর থামাতে হয় পা দিয়ে।
আল্পিতয-এর বাড়তি আকর্ষণ ছোট্ট একটি গির্জা। আমাদের দেশের পাহাড় চূড়ায় মাঝে মাঝে যেমন নিভৃত কোনো মন্দির দেখা যায়, অনেকটা সেরকম। পাথরের গির্জা। স্কী’র লাল, নীল, কমলা আর হলুদ পোশাককে দিনের আল্পস থেকে আলাদা করার উপায় নেই। দূর থেকে তুষারবৃত আল্পসে মৌন ধ্যানী কোনো ঋষি ভাবতে ইচ্ছে করে। কাছে এলে মনে হয় ঋষির ধ্যান ভাঙাতেই যেন স্কী’র পোশাকে এসেছে উচ্ছ্বল তারুণ্য।
বেলা তিনটার দিকে সূর্যের তেজ কমতে শুরু করল। আমাদের তখনও দেখা হয়নি অনেক কিছুই। তবু অন্ধকার হবার আগেই ঘরে ফেরার তাড়া। ফিরতি কেবল-কারে উঠলাম একটু পরে। এক জাপানি পরিবারের সাথে পরিচয় হলো। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে তারাও খুব খুশি। কর্মসূত্রে বাংলাদেশ দেখেছে এই দম্পতি। সবুজ বাংলাদেশের স্মৃতি সযত্নে লালিত তাদের অন্তরে। জার্মানির সর্বোচ্চ চূড়ায় পাঁচ বাংলাদেশীর পদচিহ্ন রেখে ফিরে এলাম ৪টার দিকে। ঘন কুয়াশায় তখন ঈব সী’র নীল পানি আর স্পষ্ট নয়। চারদিকে শীতের তীব্রতা বাড়ছে। আর ক্রমশ ঘনায়মান আঁধারের মাঝেও মাথায় বরফ নিয়ে জ্বলজ্বল করছে আল্পস।

Ebsee

Ebsee

কেবল কারে

কেবল কারে

স্লেজ?

স্লেজ?

১১ টি মন্তব্য : “আল্পসের চূড়ায়”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এইবার "সাইদুল ভাই-এর" গদ্য পাঠের তৃষ্ণা মিটেছে।
    ছবির মত সব কিছু শুধু যে দেখাই হলো, তাই না, একটা সময় শীতটাও অনুভব করতে পারছিলাম।

    কিন্তু এটা দ্বিতীয় পাতায় কেন?
    প্রথম পাতায় দেখেছি বলে তো মনে হলো না।

    এডিটে ঢুকে ডেইটটা একটু চেঞ্জ করে দেবেন কি? (সম্পাদিত)


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন লেখক মঈনুস সুলতান। তিনি ভ্রমন বিষয়ক লেখালেখিতে বলতে গেলে সবার উর্ধ্বে। সাইদুল ভাইয়ের লেখাতে তার ছোয়া পাচ্ছি। মনে হচ্ছে আমি নিজেই যেন প্রতিটি অংশ ঘুরে দেখছি। তবে লেখাটি দুই তিন খন্ডে দিলে আরো ভাল লাগতো। বেশি আকর্শণ থাকতো। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : পারভেজ (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।