ফেরারী ২

ফেরারী

লিজা বারান্দায় দাড়িয়ে। বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে আজকেও আবীর আসবে কাক ভেজা হয়ে। আর ড্রাইভার আসবে ওর আগে এসে কাচুমাচু মুখে বলবে “স্যারকে নিষেধ করছি স্যার শোনে নাই।”অভ্যাসটা আবীরের অনেক পুরানো।তখন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছে খুব ঝড় আর বৃষ্টি বাইরে ও ভিজে এসে আমাকে বলল চল “বৃষ্টিতে ভিজি।”আমার খুব হাসি পেয়েছিল।কিন্তু আমি গিয়েছিলাম রিকশার হুড খুলে আমরা ভিজছিলাম কেন জানি আমার মনে হয়েছিল আবীর কাদছিল আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল।আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিধারা আর ওর চোখের জল হয়ত মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল আমি কিন্তু বুঝেছিলাম সেদিন।
আমরা চার বোন আর আমার মায়ের ছিল এটাই অজন্ম দোষ যে তার গর্ভে চারটি কন্যাসন্তান হয়েছিল।বাবা খুব ছোট্টবেলায় মারা যান আমার জন্মের কিছুদিন পরেই।আড়ালে আবডালে অনেকেই বলতে শুনেছি এই অপয়াই তো বাপটাকে খেল।আমার মাও হয়ত তাই বিশ্বাস করতেন আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে তাই একধরনের অপরাধবোধ নিয়ে।

আমার সাথে আবীরের পরিচয়টা একদম অলৌকিক ভাবে।আমি খুব কষ্ট করে ভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি চার-পাচটা টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ জোগাতাম।এরমধ্যে আবীরের বোনও ছিল।সেই সুত্রে আসা যাওয়ার পথে মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যেত।তবে কথা হয়নি কথনও।তবে আবীরকে নিয়ে ওদের বাসায় মাঝে মাঝে খুব হাঙ্গামা হত আমি বুঝতাম।আমার কথনো জানার ইচ্ছা হয়নি।ওর বোনের আবার কথা বলার রোগ ছিল কথা শুরু করলে আর থামতে চাইতনা।সেই বলল “জানেন আপু আমার ভাইয়াটা না খুব ভালো কিন্তু এক ডাইনীর পাল্লায় পরে”,আমি ধমক দিয়ে বললাম “পড়”।আসলে আমার জীবনটা তখন এত কঠিন ছিল এসব নিয়ে চিন্তা করার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ছিলনা।

এরপর আমার একটা স্কলারশীপ হল আর বাসার থেকে চাই বিয়ে দিয়ে দিতে।আর আমি গো ধরে থাকলাম আমি বাইরে যাবই।তবে চাচার কথা শুনে মনে হল যা করার আমারই করতে হবে।জমানো টাকা ছিল কিছু তাই দিয়ে IELTS এর রেজিষ্ট্রেশন করতে এসে দেখলাম কিছু টাকা কম হয়ে গেল তখন খুব কান্না পাচ্ছিল,হয়ত কেদেও ফেলেছিলাম।পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকল আমি ঘুরে দেখি আবীর আমি তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছলাম।”আপনি তমার টিচার না।
“আমি বললাম হ্যা।
“কি সবার মত দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য এসেছেন।”
আমি বললাম “আপনিও তো পালাতেই এসেছেন।”
দেখলাম একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গেল বলল আসলেই আমিও পালাতে চাই।আপনার তারিখ কবে?

সাধারণত আমি নিজের কথা কাউকে বলিনা আর প্রথম পরিচয়ে তো প্রশ্নই ওঠেনা
আমি বললাম “”এইতো সামনে।”
চট করে সে বলল “আপনি ভাল মিথ্যা বলতে পারেন না।”
আমি খুব অবাক হলাম তবুও সেটা লুকিয়ে বললাম “সব মেয়েকেই এভাবে বলেন নাকি।”
সে হেসে একটা খাম আমার হাতে ধরিয়ে প্রায় দৌড়ে পালাল।খুলে দেখি IELTS এর রেজিষ্ট্রেশন কার্ড।একবার ভেবেছিলাম ফিরিয়ে দিয়ে আসব আবার ভাবলাম আমার যে অবস্থা এগুলো বেশি না ভাবাই ভাল।তবে চিন্তা করলাম পরে ফেরত দিয়ে দেব টাকাটা।তারপর নানা ব্যস্ততাই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

আর হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম দেশ থেকে অনেক দূরে।আমার ভার্সিটির আর সবার মত উইকএন্ডে আমিও কাজ করতাম এক বাংলাদেশি ডাক্তারের চেম্বারে রিসিপসনিস্ট হিসেবে।আমার এখানে কাজ করতে ভাল লাগত কারণ ডাক্তার বাঙালি হবার কারণে অনেক
বাঙালি আসত তার কাছে আর নিজের দেশের মানুষ দেখলেও ভাল লাগত।আমি সাধারণত রোগীদের নাম আর আসার সময় গুলো লিখে রাখতাম।সেদিন খুব তুষার পড়ছে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বললেন আজকে আর আসবেন না এটা সবাইকে জানিয়ে দিতে।

সবাইকে আমি ফোন দিয়ে জানিয়ে দেবার আগেই এক রুগী এসে হাজির আমি তাকে বললাম আজ আর উনি রুগী দেখবেন না।তারাতো নাছোড়বান্দা বললেন ডাক্তারকে ফোন করে বলতে আবীর বাংলাদেশ থেকে।। আমার আজও বিশ্বাস হয়না আবীর নামটা শুনে কেন জানি আমার মনে হল ছুটে যেয়ে দেখে আসি ও আবীরই কিনা। তবে আমার যাওয়া হয়নি।ডাক্তারের কাছে ফোন দিতে উনি বললেন বাসার ঠিকানা দিয়ে পাঠিয়ে দিতে।ওরা ঠিকানা নিয়ে চলে গেল।পরেরদিন আমার একটা গূরৃত্বপূর্ণ পরীক্ষা ছিল কিন্তু আমি ঘুমাতে পারছিলাম শুধু চিন্তা হচ্ছিল ও কি আবীর ছিল।আমি খুব অবাক এটা আবীর হলেও কি আর না হলেই আমি এত চিন্তা করছি কেন।সকালে উঠে দ্রুত ভার্সিটিতে চলে গেলাম।আমি জানিনা ক্লাস শেষ করে নিজের অজান্তে কখন হসপিটালেন দিকে রওয়ানা হয়ে গেছি।রিসিপসনে এসে খোজ নিয়ে কেবিনের দিকে এগোচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম যদি আবীর হয় তাহলে কি হবে।আমি আমার নিজের কাজে আর চিন্তায় খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম এটা ভেবে এতদিন পরে এই অচেনা মানুষটার জন্য আমি এত চিন্তিত হচ্ছি কেন।হঠাৎ দেখি কখন যে কেবিনে চলে আসেছি।আবীরকে আমি দেখলাম বিছানায় শুয়ে। শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে।আমার চোথে জল চলে আসল।ওর মা আমাকে চিনতে পারলেন।আবীর তখন অজ্ঞান ছিল।আবীর একটা র্দূঘটনার পর প্রায় অনেকদিন ধরে কোমায়।

সেদিন হসপিটাল থেকে এসে খুব খারাপ লাগছিল,অস্থির লাগছিল কেন জানিনা।তবে আমার মনে হয় সেদিনের ঘটনার পরে আমার মনে তার জন্য একটা ভাল লাগা তৈরী হয়েছিল।আর আমাকে জীবনে কেউ বিপদে এমন করে সাহায্য করেনি।পরের দিন আমি আবার গেলাম।তমা মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গেছে ওর কাছে থেকে সব শুনলাম।অবাক হলাম আজকের যুগে আবীরের মত ছেলেরা সাধারণত এমন হয়না।ওর মত ছেলে ভালবেসে এমন পাগলামি করতে পারে আমার ধারণায় ছিলনা।

আমি এই মানুষটার জন্য প্রচন্ড ভালবাসা অনুভব করলাম। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম যে মানৃষটাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি হয়ত তার জানা হবেনা একটা অচেনা মেয়ে তাকে অজান্তেই ভালবেসে ফেলেছে।আবীরকে আমি ভালবাসতাম কারণ ভালবাসার ক্ষমতা সবার থাকেনা আর ওঠা আবীরের ছিল। আর সেই ভালবাসার কিছু অংশ পাবার লোভ আমাকে পেয়ে বসল।আর আমি তা পেয়েছি।

এর এক বছর পর আমি বাসর ঘরে বসে আছি, আমার খুব কান্না পাচ্ছিল আবীর আসল আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলেলাম। ও কোনদিন জানেনা আমি কেন কেদেছিলাম।আমি কেদেছিলাম কারণ আমি এমন একটা মানুষকে নিজের পাশে পেয়েছি যে আমাকে ভালবাসবে সারাজীবন ধরে।

তবে আমি বিয়ের এত গুলো বছর পরে জানি ওর মনের একটা জায়গায় আমার প্রবেশ নিষেধ।অহনা যেখানে নিভৃতে বসবাস করে।আমি সেই চেষ্টা করিও নি কথনো কারণ ওই সুপ্ত ভালবাসায় আমাকে পাগলের মত ভালবাসতে শিখিয়েছে নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছে।

মাঝে মাঝে ও মাঝ রাতে উঠে মানিব্যাগ খুলে হলুদ খামে থেকে কি বের করে আমি জানি।আমি ওকে দোষ দেইনা কাউকে ভালবাসলে এমনি ভালবাসা উচিৎ।আসলে ছেলেরা বোঝেনা স্ত্রী মায়ের জাত তাদের কাছ থেকে কিছু লুকানো যায়না।

কলিংবেল বাজল এসে গেছে লিজা তোয়ালে নিয়ে যায় কারণ আবীর ঠিক ভিজে এসেছে।

উৎসর্গ: কামরুল ভাই। উনি বলেছিলেন লিজাকে নিয়ে ফেরারী ২ লিখতে আসলে লিজার মনের কথা গুলো জানতে অনেক দেরি হল বলে লিখতে পারছিলাম না। এখন জানি।

১,৫২৬ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “ফেরারী ২”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    বাহ!
    ভাইয়া, কমা দাড়ি গুলো ঠিক জায়গায় বসেনি, কিছু জায়গায় লাইন ঠিকমত গঠিত হয়নি। এই ভুলগুলো ঠিক করে দিলে অতি চমৎকার গল্পটা সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে।
    লিজার চরিত্রটা খুবই পছন্দ হলো।

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)
    আসলে ছেলেরা বোঝেনা স্ত্রী মায়ের জাত তাদের কাছ থেকে কিছু লুকানো যায়না।

    এইটুক ছাড়া পুরা গল্পে প্লাস। পইড়া ভালো লাগছে। তবে থিমে গোলমাল আছে। "ম্যান ইজ জেলাস বাই নেচার" ..... জীবনানন্দের আকশলীনা পড় নাই???

    জবাব দিন
          • সামিয়া (৯৯-০৫)
            স্ত্রীরা মায়ের মত কইরা বুঝে না

            কারণ হাসব্যান্ডরা বাপের মত ফ্রী হইতে পারেনা। 😛 যেই মুহুর্তে আপনার স্ত্রী বুঝতে পারবে আপনি তার কাছে কিছুই লুকাচ্ছেন না, এমনকি টিন এইজে যেই মেয়েটাকে দেখে ক্রাশ খেয়ে ঠিক কি কি করসিলেন, সেইসব কথাও না...সেই মুহুর্ত থেকেই আপনার স্ত্রী ব্যবহারে আপনার মায়ের মতই হবে।
            সমস্যাটা হয়, ছেলেরা ভাবে এগুলা মেয়েদের বললে অহেতুক ক্যাচাল বাধবে। মেয়েরা হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে এই জিনিসটা তো সে আমাকে বলে নাই, ব্যস, ধুমধাম ধুমধাম, ডিশুম ডিশুম। সন্দেহ সন্দেহ। :gulli2:

            জবাব দিন
            • টিটো রহমান (৯৪-০০)

              স্যাম, বিষয়টা এত সহজ না মনে হয়......পড়া বইয়ে যেমন আগ্রহ কম তেমনি সব বলে দিলেও আগ্রহ কমে যায়.....কিছুদিন পরপর সম্পর্কে ও ধুমধাম ধুমধাম, ডিশুম ডিশুম দরকার আছে.....মেয়েদের চিন্তা ভাবনায় প্রচুর বৈপরিত্ব(এটা সম্ভবত এসেছে তাদের মা কিয়বা কপিরবােরর অন্যান্য মেয়েদের চেতনে বা অবচেতনে ফলো করে করে)
              একটা উদাহরণ দেই-আজকাল সব মেয়েই বন্ধুর মত বর খোঁজে। কিন্তু তােদর বাবাকে দেখেচে আজীবন মােয়র উপর স্বামীত্ব ফলাতে। কাজেই এই ব্যাপারটা তারা পছন্দ না করলেও দিন শেষে পুরুষের কাছ থেকে কিছু স্বামীত্ব/প্রভুত্ব(বিষেশত বর নির্বাচনের সময়) প্রত্যাশা করে নয়ত বন্দুর মথ্যেই সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। [বন্ধু বিয়ে করে আমি নিজে কিছিটা ভুক্তভোগী :bash: :bash: ;))]

              তবে ওসব অন্য ব্যাপার । আমিন বোধ হয় এটাই বোঝাতে চেয়েছে যে....মায়ের স্নেহ/ভালবাসা অন্ধ, কিন্তু স্ত্রীর স্নেহ/ভালবাসা অন্ধ নয়......

              জাস্ট একটা তথ্য(এখন পুরুষবাদী লেখা লিখছি তো :grr: :grr: :grr: ): আমেরিকান এক জরিপের ফল ....১০০বিবাহিত নারীর মধ্যে ৯০জনই আবার জীবন পেলে একই স্বামী চায়না...আর পুরুষদের ক্ষেত্রে এর সম্পূর্ণ বিপরীত


              আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

              জবাব দিন
            • রিয়াজ (৯৮-০৪)

              আমি সাদিয়ার সাথে একমত। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি স্ত্রীকে যদি নিজের সব কথা খুলে বলা যায় তাহলে তারা অনেক ভাল ব্যবহার করে যেইটা ছেলেদের কল্পনার বাইরে। সমস্যা হচ্ছে আমরা ছেলেরা সেইটা বুঝি না, তাই ভয়ে থাকি, নিজের জীবনের পুরনো গোপন কথা গুলি তাদের বলি না। পরে যখন তারা অন্য কোন ভাবে সেই গুলা জানতে পারে তখন পরিস্থিতি র নিয়ন্ত্রনে থাকে না। আমাদের উচিত আমাদের সঙ্গী কে সব কিছু খুলে বলে দেয়া। তা হলে সম্পরক টা আরও ভাল হয়।


              জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়

              জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাদিক (২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।