ফেরারী

আবীরের একসময় নিজের জন্য অফুরন্ত সময় ছিল।তখন বিকেলে বুড়িগঙ্গার তীরে বেনসনের প্যাকেট নিয়ে বসে যেত। রাত নিঝুম হওয়া
পর্যন্ত চলত সিগারেটে অগ্নি সংযোগ।কখনো বা খালি পায়ে হাটাহাটি করত সংসদের সামনের রাস্তার,কৃষ্ণচূড়ার ফুল ঝরা লাল গালিচায়।তখন জীবনের স্বাদটা সত্যিই অন্যরকম ছিল।এখন আর নিজের করে সময় বের করা হয়ে ওঠেনা।সারাদিন অফিস তারপর সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে করেত মধ্যরাত
তারপর পরের দিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়া।আবীর একটু পাশ ফিরে শোয়.পুরোন অভ্যাস মত হাতঘড়ি দেখে।রেডিয়ামের জ্বলজ্বলে কাটাটা জানিয়ে দেয় রাত পৌনে চারটা।পুরো বাসা নিঃস্তব্ধ।পাশের বস্তিতে একটা বাচ্চা কেদে ওঠে।ঢাকার অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে।আবাসিক এলাকায় রঙহীন বাসা আজকাল দেখা যায়না বললেই চলে।কিন্তু এই বস্তিগুলো আর তার ভিতরের মানুষগুলোর জীবন সংগ্রাম একই রকম আছে,আদিম অকৃত্রিম।
লিজা ঘুমিয়ে আছে।আবীর বেড সাইডের ল্যাম্প জ্বালিয়ে গ্লাসে রাখা পানি খায়।আজকাল বড় নস্টালজিক হয়ে পড়েছি ভাবে মনে মনে।
শুধু পুরোন কথা মনে পড়ে,বয়সটাতো আর কম হলনা।রাহাতের ঘর থেকে শব্দ আসে।ছেলেটা কি জেগে আছে এখনো। এত রাতে কি করে?
মোবাইলে কথা বলে নাকি?এটা ভেবে মনে মনে হাসে আবীর সবাইকে নিজের মত ভাবা ঠিক না।লাইটা অফ করে আবার শুয়ে পড়ে আবীর।
লিজা অভ্যাসমতো জড়িয়ে ধরে।সবকিছু পরিবর্তরন হয়ে গেছে কিন্তু লিজার অভ্যাস গুলো আগেরই মত আছে।এখনো সে পুরোন দিনের মত
বায়না ধরে চল কোথাও ঘুরে আসি।আবীর বার বার বলে ছেলে বড় হয়েছে না।
ওকে ফেলে এভাবে ঘুরাঘুরি কি ঠিক বল।লিজা কপট রাগ দেখিয়ে বলে,ওতো বড় হয়েছে ও বোঝে।আবীর বলে বোঝে বলেইতো সম্যসা।
হঠাৎ কেন জানি আবীরের বিয়ের প্রথম রাতের কথা মনে পড়ে।বিয়ে করার কোন ইচ্ছায় ছিল না।ব্যাচেলর জীবনের স্বাধীনতাটা
পুরোপুরি পেয়ে বসেছিল নিজেকে।অবশেষে মায়ের জেদাজেদিতে বিয়ের লাড্ডু খেতেই হল।বাসর ঘরে ঢুকতেই চমকে উঠে আমার দিকে
তাকাল লিজা,ওর চোখ দেখে মনে হল হরিণের খাচায় ঢুকল কোন ক্ষুর্ধাত হায়েনা।পাশে বসতেই আবীরকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না।মেয়েটার জন্য সেদিন খুব মায়া লেগেছিল আবীরের।সে রাতে লিজার কান্না থামাতে অনেক কষ্ট হয়েছিল।পরে অবশ্য কোনদিন সে স্বীকার করেনা এ কথা যে সেদিন রাতে নাকি সে কেদেছিল।
অহনাও কাদতে চেয়েছিল বাসর রাতে।আমার অহনা।বয়সটা অনেক হল নিজের বলে আর কিছুই নেই।
শুধু নিজের বলতে বয়ে গেছে অহনা আর ওর হাজারো স্মৃতি।অহনা পানি খুব ভয় পেত।যখনই আমরা নৌকায় ঘুরতে বের হতাম আমাকে ভয়ে জড়িয়ে রাখত।আমিও জড়িয়ে রাখতাম।প্রচন্ড ভালবাসা অনুভব করতাম অহনার জন্য।আবীর লিজার মুখের দিকে তাকায়,অন্ধকারে লিজার অবয়বটা আবছা বোঝা যায়।
অহনার জন্য যে প্রচন্ড ভালবাসা ছিল এতগুলো বছর পরে হাজারো চেষ্টা করে তার খানিকটাও জমা করতে পারিনি লিজার জন্য।
এটা ভাবতেই আবীরের বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে।
লিজা যখন মা হল আবীরেরে খুব ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে হোক,যার নাম রাখবে অহনা।তা আর হলনা ওদের ঘরে আসলো রাহাত।আবীরের মা বলে ছেলে হয়েছে শুনে আবীরের মুখ নাকি কালো হয়ে গিয়েছিল।রাহাতকে আবীর খুব ভালবাসে সবার থেকে বেশি।আচ্ছা আমার মত কি অহনাও চেয়েছিল
ওর ছেলের নাম বাখবে আবীর।আবীর ভাবে অহনা কি এখনো ওকে ঘৃণা করে।খুব ইচ্ছা করে তার অহনার মুখোমুখি হতে।
অনেকবার চেষ্টাও করেছে আবীর আবার ফিরে এসেছে।আবীর বিছানা ছাড়ে.ঘড়িতে পাচটা বাজে আজ আর ঘুম হবে না ভাবে আবীর।
প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে।মানিব্যাগের লুকানো পকেট থেকে পুরোন একটা খাম বের কের।জীবনের ত্রিশটা বছর যক্ষের
ধনের মত লুকিয়ে রেখেছ এই জিনিষ গুলো সে।না না কোন দামী কিছু না।টিস্যু পেপারে মোড়ানো কিছু চুল।
টিস্যু পোপারে লিপিস্টিকের দাগ,একটু বির্বণ কিন্তু মলিন না আবীরের কাছে।প্রথম যেদিন অহনা ওকে চুমু দিয়েছিল ।
আবীরের মুখ শার্টতো লিপিস্টিকে মাখামাখি।অহনা নিজের ব্যাগ থেকে টিস্যু পেপার বের কের মুখ থেকে দাগ মুছে দিয়েছিল।
আবীর আজো এগুলো খুব যত্নে রেখে দিয়েছে।আগে মাঝে মাঝে বের কের দেখত।এখন আর সময় হয়ে ওঠেনা।
আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে,লিজা এখুনি ঘুম থেকে উঠে পড়বে।ওর আবার তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস।ভোরের আবছা আলোয়
আবীর দেখে লিজাকে।একটা সময় ছিল অহনা ছাড়া জীবনে অন্য কেউ থাকবে ভাবতে পারতাম না।আজ অহনা কত দূরে।
দেখা হয়না একযুগ বা তারও বেশি সময়।দেখা নেই বললে ভুল হবে ।অহনার স্মৃতি থেকে নিজেক বাচিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি,ভাবে আবীর।
আবীরের চোখের কোনাটা ভিজে ওঠে।দ্রুত হাতে চোখটা মুছে বাথরুমের দিকে হাঁটে আবীর।অফিস যেতে হবে।

আবীর ফেরারী। জীবনের স্মৃতির চাতক পাখি গুলো তাকে খুঁজে ফেরে।আমাদের মাঝে হাজারো আবীর লুকিয়ে আছে।
স্বাধীন জীবনে তারা ফেরারী।

২,৯৯৬ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “ফেরারী”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    পোলায় দেখি পুরা হিপোক্রেট... এই যখন খারাপ অবস্থা তখন বিয়ে করার কি দরকার ছিল... শুধু শুধু লিজার সাথে সারাজীবন ধরে হিপোক্রেসি করে যাচ্ছে... :thumbdown: :thumbdown:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. আবীর রে কইষা মাইনাস

    :thumbdown: :thumbdown: :thumbdown: :thumbdown:

    বদের বদ... এখনও বলে প্যাকেট থেইক্কা টিস্যু বের করে... 😡

    সাদিক রে !! তোর মতিগতি খারাপ। অহনা রে নিয়া আর বাড়িস না কয়া দিলাম 😛 😛
    যা গেছে তা তো গেছেই ;;; ;;; ;;;

    জবাব দিন
  3. গল্পটা ভালো। আমিও কয়েকটা লেখছিলাম, যখন তোমার মত স্টেজে আছিলাম। 😛

    ব্যাপার নাহ, কিছুদিন এই রকম গল্প লিখো, তারপর ঠিক হয়া যাবে সব। তারপর পইড়া নিজেই হাসবা। 😛

    জবাব দিন
  4. রিয়াজ (৯৮-০৪)

    লিজা কে তার ভাল বাসা থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হচ্ছে না। লিজার ভালবাসার প্রতিদান যদি নাই দিতে পারবেন তা হলে বিয়ে করলেন কেন??? আবীরের মতো ছেলে কে আই পছন্দ করি না।
    মানুষ কে তার অতীত কে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে। অতীত কে আকড়ে ধরে কী লাভ। এতে শুধু কষ্টই বাড়বে। অনাগত মধুর ভবিষ্যতের পথেই হওয়া উচিত আমাদের নিরন্তর পথ চলা


    জানি সত্য নয়,শুধু কল্পনায়...ইচ্ছের ঘুড়ি আমরা ওড়াই...স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তারি অপেক্ষায়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।