পাহাড়ের কান্না

ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছিলাম, হিল ট্র্যাক্টস থেকে, রাতের বাসে, বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। ভোররাতের দিকে বাস থামল এলেঙ্গা। নেমে গেলাম, আমাকে এখান থেকে বাস চেঞ্জ করতে হবে। সমস্যা হল সকালের আগে আর বাস নেই। অগত্যা এক চায়ের দোকানে বসে গেলাম। চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে টেবিলে বসলাম, খানিক পরে এক ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘বসতে পারি?’
-শিয়োর।
চা খেতে বললে বললেন , ‘আমি অর্ডার দিয়েই এসেছি’। এক কথায় দুকথায় জানতে চাইলেন, আর্মিতে আছি কিনা। খুবই স্বাভাবিক প্রশ্ন। আমাকে দেখেই লোকজন কিভাবে জানি টের পেয়ে যায়। তবে আমারও মনে হচ্ছিল উনিও খুব সম্ভবত কোনকালে আর্মিতে ছিলেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, হ্যাঁ ছিলাম। তারপর পরিচয় হল। মজার ব্যাপার, আমার পোস্টিং যেখানে, সেখানে এক সময় ছিলেন তিনি। খুবই সদালাপী অফিসার। আমি নিশ্চিত, উনাকে উনার ইউনিটের সৈনিকরা সবাই খুব পছন্দ করত। এক সময় জানতে চাইলেন বাস তো সকালে, একটা গল্প হয়ে যাবে কিনা, ভূতের গল্প। আমি যদিও ভূত বিশ্বাস করিনা, তবু গল্পে ক্ষতি কি? ভাবলাম বেশতো, হোকনা। আমি নিজেও গল্প বলতে বা শুনতে বেশ পছন্দই করি। উনার পরিচয়টা আর দিচ্ছিনা। তাঁর নিজের ভাষাতেই শোনা যাক।
‘উনিশশো নব্বই সালের মাঝামাঝি, পার্বত্য শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা ঝিমিয়ে পড়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে তখন ভয়াবহ অবস্থা। ক্যাম্পেও তখন জীবন ঝুঁকির মুখে। রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে শোনা যায় ফায়ারিং হচ্ছে। মাঝে মাঝে শান্তিবাহিনী ক্যাম্পেও আক্রমন করে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। মাঝে মাঝে দেখা যায় রাতের আঁধারে দূরে কোন এক গ্রাম দাউ দাউ করে জ্বলছে। তখন মাত্র বিএমএ থেকে পাস আউট করে বের হয়েছি, তরতাজা সেকেন্ড লেফটেনেন্ট। পোস্টিং হল হিল এ। আমার মন খারাপ। এখনকার মত তখনতো আর সেল ফোন ছিলনা। দুর্গম ছিল বেশিরভাগ ক্যাম্প। হেঁটে যেতে হত, দুতিন দিন লাগত। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও। আর বাড়িতে চিঠি পাঠাতে বেগ পেতে হত ভীষণ।
কিন্তু আমি এসে রীতিমত হতচকিত হয়ে গেলাম। এতো রীতিমত ভূস্বর্গ! কে বলবে এখানে এত হানাহানি চলছে? ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে কিছুদিন পরেই ক্যাম্পে চলে গেলাম। অপারেশনাল কার্যক্রমের পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখি করে, বইপত্র পড়ে আর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সময় কাটে। সামনে আমার কোর্স, তার প্রিপারেশনও চলছিল। ভালই চলছিল দিনকাল। রাতের বেলা মাঝে মাঝে রেডিওতে আমার এক কোর্সমেটের সাথে কথা বলতাম। মনে হচ্ছিল জীবনটা ভালইতো। এর মাঝে পুরো হিল গরম হয়ে গেল। হিলে একজায়গায় পরিস্থিতি খারাপ হলে সবজায়গায়ই তার প্রভাব পড়ে। রেড এল্যার্ট চলছে। আমাদের ঘুম নেই। কেমন একটা ক্রোধ মেশানো আতংক কাজ করছে সবার মধ্যে। স্বাভাবিক, পরিবার পরিজন থেকে দূরে এমন দুর্গম এলাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকলে ব্যাটল ফ্যাটিগ এক সময় চলে আসেই। আমার মধ্যেও এসেছিল। মাঝে মাঝেই তখন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত, দুঃস্বপ্ন দেখতাম। কখনো শুনতাম আসলেই ফায়ারিং হচ্ছে, দুঃস্বপ্ন না। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তবে আমার সৈনিকদের বুঝতে দিতামনা আমার মাঝে ফ্যাটিগ চলে এসেছে। ওরা টের পেলে আরো ঘাবড়ে যাবে।’
এটুকু বলে তিনি থামলেন। আবার চা হবে কিনা জিগ্যেস করলাম। বললেন ক্ষতি কি? আমি চা নিয়ে এসে বসলাম। বাইরে তখনও ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। আমরা দুজন ছাড়া দোকানে কেউ নেই। দোকানী আমদের চা দিয়ে আবারো ঝিমুচ্ছে। চা শেষ করে আবার তিনি গল্প শুরু করলেন।
‘তো যা বলছিলাম, এরকম পরিস্থিতিতে একদিন দিনের বেলা পেট্রল করে এসে খুব ক্লান্ত লাগছে। সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল হঠাত করেই। কিসের শব্দ যেন হচ্ছে। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার রুমের চারপাশে হাঁটছে। আমার ভুতের ভয় ছিলনা। জিগ্যেস করলাম কে? কোন সাড়া নেই। বের হয়ে দেখি কেউ নেই আশে পাশে। টর্চ নিয়ে বের হলাম। ডিউটি পোস্টে গিয়ে দেখি সবাই ঠিকঠাক মতই ডিউটি করছে। ক্যাম্পের চারপাশে চারটা ডিউটি পোস্ট, বাইরে থেকে কারো আসার কোন সুযোগ নেই। মনের ভুল ভেবে আমি আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে উঠে হাস্যকর লাগল। ধুর, কিছুদিন হল বেশি টেনশন করছি। পড়াশোনায়ও বেশি মনোযোগ নেই, অথচ কিছুদিন পরেই আমার কোর্স। কিন্তু আমার প্রায়ই এরকম হতে লাগল। রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, নাহয় মনে হয় কেউ একজন ডাকছে। একটু একটু ভয়ও মনের ভেতরে তখন ঢুকতে শুরু করেছে। কিছু একটা বিহিত না করলেই না।
এর মাঝে একদিন কথায় কথায় আনসার যারা পুরানো এখানে আছে, তাদের জিগ্যেস করলাম এই ক্যাম্পে কখনো এজাতীয় কিছু শুনেছে কিনা। তারা বলল না, এমন কিছু তারা কখনো শোনেনি। আমাকে জিগ্যেস করল, স্যার আপনি কি নিশির ডাক শোনেন নাকি? আমি হেসেই উড়িয়ে দিলাম। ধুর, এমনি জানতে চাইলাম। কেমন নির্জন জায়গা দেখনা? আমি ভুত প্রেত, অশরীরী কোন কিছুতেই বিশ্বাস করিনা।
এভাবেই চলছিল। এর মাঝে একদিন একটা ইনফর্মেশন পেলাম। কোন এক বাড়িতে শান্তিবাহিনির দুই সদস্য অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে আছে। ক্যাম্পে বলে দিলাম রাতের বেলা অপারেশন এ যাব। আমার রানারকে বললাম, তিনটার দিকে ডেকে দিতে। রাতে শফিক আমাকে ডেকে দিল, বলল স্যার সবাই রেডি আছে, আপনি আসেন। আমি রেডি হয়ে বাইরে এসে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আগেই ব্রিফিং করা ছিল। আমি মাথা গুনে দেখলাম সবাই আছে। বললাম, চল তাহলে। বৃষ্টি পড়ছিল। কিছু দেখা যায়না। অপারেশনের জন্য একেবারে আদর্শ আবহাওয়া। সবাইকে দিনের বেলা বুঝিয়েছি কীভাবে কী হবে। কন্টিনজেন্সি ঠিক করে নিয়েছি। তারপরেও মনের মধ্যে খুত খুত করছিল। ক্যাম্প থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাইডকে জিগ্যেস করলাম ঠিক মত পথ চিনে এগোচ্ছ তো? বলল ঠিক যায়গামত পৌঁছে দেব স্যার কোন চিন্তা করবেননা। বলেই কেমন করে যেন হেসে উঠল। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। কন্ঠ কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে! আমিতো সবাইকেই চিনি। তাহলে?
তখন আমরা একটা জঙ্গলের মধ্যে। বললাম, তুমি কে? বলে স্যার আমি জব্বার, কেন চিনেন নাই? বলে আবার হা হা করে হেসে উঠল। হাসবে কেন? হাসির তো কিছু হয়নি, তাছাড়া আমার সাথে কথা বলার সময় তো কারো অকারণে হাসার কথা না? আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। পেছন থেকে বলল স্যার দাঁড়িয়ে পরলেন যে? কেমন নাকি নাকি গলা। খুনখুনে একটা শব্দ! আমি ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। রেইনকোটের হুডের ভেতরে যেখানে মুখ থাকার কথা সেখানে একটা মানুষের খুলি!’
-তারপর?
-তারপরে আরকিছু মনে নেই।
এটুকু বলেই তিনি চুপ মেরে গেলেন। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম মনে নেই মানে? অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন? তিনি কেমন একটা বিষণ্ণ হাসি দিলেন। বললেন, বাস এসে গেছে, এবার যাওয়ার সময় হল। বলেই উঠে গেলেন। আমার রাগ উঠে গেল, এরকম বানোয়াট একটা গল্প বলে, তারপরে আবার শেষ না করেই চলে যাবেন? ভাবলাম বাসে গিয়ে ধরব। আমি ব্যাগ নিয়ে বাসে উঠে দেখি তিনি কোথাও নেই! অবাক ব্যাপার, তিনি কি এই বাসে যাবেন না? ততক্ষনে বাস চলতে শুরু করেছে।
ছুটির পুরো সময়টা কেমন অশান্তিতে কাটল। মা বললেন কি হয়েছে তোর? এমন আনমনা থাকিস কেন? ছোট বোন তো প্রচার করেই দিল, আমি নাকি কার কাছে ছ্যাকা খেয়েছি। ছুটি শেষে আমি ইউনিটে ফিরে গিয়ে খোঁজ খবর করলাম, হাজার হোক তিনি এখানেই পোস্টেড ছিলেন। প্রায় বৃদ্ধ এক আনসার সদস্য পাওয়া গেল, যিনি সে সময় এখানে ছিলেন। বললেন যে, নব্বই সালে এখানে এক অফিসার নিখোঁজ হন। অপারেশনে যাবার কথা ছিল সে রাতে। কিন্তু রাতে তাকে ডাকতে গিয়ে দেখা যায় তিনি রুমে নেই। অনেক খোঁজখবর করার পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় এক জঙ্গলে। কিভাবে ওখানে গেলেন, কেন গেলেন, কেনই বা মারা গেলেন কিছুই জানা যায়নি। বললাম, এত বড় ঘটনা কেউ জানেনা? বললেন, তখন লোকজন ভয় পেতে পারে ভেবে চেপে যাওয়া হয়ে ছিল। লাশ বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সবাই ভুলে যাবার চেষ্টা করে। তাছাড়া পরিস্থিতি তখন অনেক খারাপ ছিল স্যার। প্রায়ই এখানে সৈনিক, অফিসার মারা যেতেন।
আমি একদিন লং রেঞ্জ পেট্রলে বের হয়েছি, সেই আনসার সদস্য সাথে আছেন। হঠাত বললেন, স্যার এই জঙ্গলে উনার লাশটা পাওয়া যায়। আমি বললাম, পিসি সাহেব আমাকে দেখান তো ঠিক কোথায় পাওয়া গিয়েছিল মৃতদেহটা। ওখানে গিয়ে দেখি জায়গাটা কেমন একটু উঁচু।
পরের কাহিনী আরেকটু চাঞ্চল্যকর। আমার সন্দেহ হওয়াতে জায়গাটা খুঁড়ে দেখা হয়। ওখানে কবর দেয়া আঠারোটা নরকঙ্কাল পাওয়া যায়। আশির দশকে এই এলাকায় এক মর্মান্তিক গনহত্যা হয়েছিল। অনেক লোক তখন নিখোঁজ হয়েছিল। জানিনা এরা এদের কেউ কিনা। তবে এরকম গণকবর এখানে আরও আছে, কোনটার অস্তিত্ব মানুষ জানে, কোনটার জানেনা। তবে প্রায়ই এইসব পাহাড় বা জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাবার সময় পাহাড়ি গানের বিষণ্ণ সুর ভেসে আসে। মনে হয় পাহাড়ের কান্না ভেসে আসছে।

(গল্পে ব্যাবহৃত সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক বলে দাবি করবনা, কারো সাথে মিলে যেতেই পারে!)

১৯ টি মন্তব্য : “পাহাড়ের কান্না”

  1. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    :clap: :clap: :clap: :clap:

    তুমি এতো কম লেখো কেন, ভাইয়া? ব্যস্ততার অজুহাত দিওনা হে!

    একটানে পড়ে গেলাম তোমার গীতিময় গদ্য। আরো পড়বার তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিলে তুমি।

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    সাদী,
    ভৌতিক গল্প বলেই কি না জানিনা প্রথমে চোখে পড়ে কাকতাল। তোমার ব্যাচ দেখি ৩১ --- এফসিসিতে আমরা যে ব্যাচের। ক্যাডেট নাম্বার টা এক অঙ্ক কম হলেই খুব বলা যেতো মিল-অমিল নিয়ে।

    ভূতের গল্প লেখা হলে, আগেভাগেই ভূতের গল্প ঘোষণা দেয়া হয়ে গেলে আরো বাড়তি কিছু থাকতে হয়ে ভৌতিক আবহকে ছাড়িয়ে । সেটা পেলাম গল্পের শেষে এসে। সূক্ষ্মভাবে । ভালো লাগলো । পাহাড়ে গণহত্যার কথা --- কান্নার কথা, তাকে উন্মোচনের গল্প আরেকজন হারিয়ে যাওয়া অফিসারের বিবেক (বা আত্মা) -এর দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে। এত সুন্দর! এত ম্যাচিওর!
    বাড়তি মেদ নেই। রাজনৈতিক অবস্থান নেই তবু মানবিকতা হারিয়ে যায়নি । ভূতের প্রসঙ্গ খুবই অনুমেয়ভাবে এসেছে --- ফোকাসটি ওখানেই থেকেছে তবু। একটা ভুতের গল্প হিসেবেও সুন্দর কিন্তু সাধারণ। আমাদের জাতিগত ইতিহাসের পাঠ হিসেবে? অ-অ-সাধারণ (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    বেশ মজা পেয়েছিলাম এই গল্পটা পড়ে। মনে হচ্ছিল একদম বাস্তব ঘটনা। অদ্ভুত সুন্দর লেখার হাত তোমার।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. মহিউদ্দিন (২০০২-২০০৮)

    সাদী, তুইতো বেশ লিখিস রে! ঘন ঘন লিখ। আমার মনে হলো ছোটবেলার রহস্যপত্রিকায় হারিয়ে গেছি। তোকে একটা ফোন দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। গল্প শুনাবি। অসাধারণ। :clap:


    Prisoner of Own Mind

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শেখ সাদী (০৬-১২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।