নিজ মানুষের পাল্টানোর কথা

আমার চাচাতো ভাই রুবেল ভালো প্লেন চালায়। প্লেন চালাতে যেয়ে ছেলেটা অনেক স্মার্ট হয়ে গেছে। এতো স্মার্ট যে আমার একমাত্র চাচী মানে রুবেলের মায়ের কাছে প্রায় গ্রামের অনেক মেয়ের বাবা আসেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এটা যদিও একটা খুশির বিষয় তবে আমার পক্ষে খুশি হওয়াটা সম্ভব হয় না। রুবেলের বাবা মারা যাবার পর থেকে আমার চাচী তার কথা বলবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। মেয়ের বাবা আমাদের বাড়িতে এসে রুবেলের বিয়ের কথা বললে চাচীর চোখ দিয়ে কেন জানি অশ্রু ঝরে। মেয়ের বাবা তা দেখে ভয় পেয়ে যায়। তবে আমি বুঝি ব্যাপারটা। এটা আসলে খুশির অশ্রু। ভালোবাসার অশ্রু। একমাত্র ছেলের প্রশংসা শুনে আমার চাচীর বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে।

রুবেল একজন অফিসার। সে আমাদের গ্রামের অনেক কেই চাকরি দিয়েছে। গ্রামের ছেলেরা শিক্ষিত হয়ে রুবেলের সাথে যোগাযোগ করে চাকরির জন্য। আমার পাড়াতো ভাই জসীমের চাকরি হয়েছে রুবেলের অফিসে। জসীম এখন আমাদের বাড়িতে এলে রুবেলকে নাম ধরে না ডেকে স্যার স্যার বলে ডাকে। আমি আর আমার চাচী এই বিষয়টি দেখে হাসাহাসি করি।

অনেকদিন পরের কথা —

আমি একজন দোকানদার। মুদির দোকান আমার। চাচীকে আজ তা প্রায় দু’মাস হয়ে গেলো গোরস্থানে কবর দিয়ে এসেছি। রুবেল ছেলেটা তার মায়ের মৃত্যুর পরদিন গাড়ি নিয়ে এসেছিল। তার বউয়ের নাকি শরীর খারাপ তাই বাড়িতে রেখে একা এসেছিল। কোনো কথা সে বলেনি আমার সাথে। কথা বলবার মুখ থাকলে তো বলবে।

জসীমের মুখে শোনা —

১,  রুবেল স্যার এতো স্মার্ট যে উনার প্রেমে বড়লোকের মাইয়ারা পাগল। মৌ নামের এক ম্যাডামকে উনার সাথে প্রায় দেখা যায়। তবে কেউ নিশ্চিত না যে আসলে উনাদের মধ্যে কোনো ব্যাপার আছে কি না।

২,  রুবেল স্যারের প্রোমোশন আটকে গেছে। উনার বিরুদ্ধে সিনিয়ার অফিসারদের সাথে বাজে ব্যবহারের রিপোর্ট ছিলো। আর ভাইবা বোর্ডে স্যার নাকি নিজের বাবার পরিচয় ঠিকভাবে দিতে পারেননি। রুবেল স্যারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, আপনার বাবা কি করেন ? স্যার বলেছিলেন, আমার বাবা মৃত। আবার প্রশ্ন করা হলো, আপনার বাবার পেশা কি ছিল ? উনি বলেছিলেন, আমার বাবার জমি দেখাশোনা করতেন। আবার প্রশ্ন করা হলো, আপনার বাবা কিভাবে জমি দেখাশোনা করতেন ? উনি বলেছিলেন, প্রতিদিন সকালে যেয়ে জমি দেখতেন। এবার প্রশ্ন করা হলো, আপনার বাবা সকালে কখন যেতেন এবং সাথে কি নিয়ে জমিতে যেতেন ? উনি বলেছিলেন, সকাল ছয়টায়। লাঙ্ল, বলদ আর টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে জমিতে যেতেন।

তারপর রুবেল স্যারকে ভাইবা বোর্ডে বসে থাকা অন্যান্য স্যাররা জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনার বাবা কী একজন কৃষক ? যিনি কিনা প্রতিদিন ভোর বেলায় লাঙল-বলদ নিয়ে মাঠে যেতেন জমি চাষ করতে ? রুবেল স্যার বললেন, জ্বী স্যার।

এরপর উনারা রুবেল স্যারকে বললেন, এই কথাটা তো প্রথমেই সহজভাবে বলা যেতো, তাই না ? মিস্টার রুবেল, আপনার তো গর্ববোধ করা উচিত যে আপনি একজন কৃষকের সন্তান হয়ে আজ আমাদের দেশের বিমান বাহিনীর একজন অফিসার। আর আপনি এই বিষয়টা বলতে এতো সংকোচ বোধ করছেন। আপনার জন্য আমরা দুঃখিত, মিস্টার রুবেল। এখন আপনি বাইরে যেতে পারেন।

দোকানে বসে বসে মানুষের মুখে আমার চাচাতো ভাই সম্পর্কে আরও নানান কথা শুনি। কষ্ট লাগে চাচীর জন্য। চাচার জন্য। তাদের একমাত্র সন্তান এই রুবেল। কতো স্বপ্ন তাকে নিয়ে। রুবেল আমার ভাই, শিক্ষিত ভাই। ও আসলেই শিক্ষিত। অশিক্ষিত না যে তার মায়ের ভালোবাসাকে অবহেলা করবে কিংবা ওর বাবার পরিচয়কে লুকোবে। ও একজন সাধারণ পরিবারের ছেলে। পুকুরে ঝাপ দিয়ে, কাঁদা মেখে, লাঙল টেনে সে বড় হয়েছে। ও আসলে জীবনের তাল-গোল হারিয়ে ফেলেছে। জীবনে ভালোবাসা দেয়া আর নেয়ার মতো যোগ্য মানুষ সে পায়নি বোধহয়। তবে জানি না কেনো সবাই ওকেই দোষ দেয়। হয় তো আমি ওকে আমার ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবাসি বিধায় ওর কোনো দোষ দেখি না।

-সমাপ্ত-

(কাল্পনিক মাত্র)  —— একটি সাকা পাগলামো প্রডাকশন।

 

১,০৪৯ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “নিজ মানুষের পাল্টানোর কথা”

  1. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    ও আসলে জীবনের তাল-গোল হারিয়ে ফেলেছে। জীবনে ভালোবাসা দেয়া আর নেয়ার মতো যোগ্য মানুষ সে পায়নি বোধহয়।
    :thumbup: :thumbup: :thumbup:


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    সকাল ছয়টায়। লাঙ্ল, বলদ আর টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে জমিতে যেতেন।

    :clap: :clap: :clap:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।