ছাতা কাহিনী

আমার বড় আপু আমাকে খুব ভালবাসে। আমি তার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। ছোট ভাই হবার মজাই আলাদা। অনেক মজার মজার খাবার খাওয়া যায়। বোন চাকুরী করে, তাই অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার পাওয়া যায়। আমার মতে, বাবা-মার আদরের থেকেও বোনের আদর অনেক বেশী। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, বড়বোন থাকলে গৃহশিক্ষক থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আগে মা যখন সকালে রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, তখন আমার বোন আমাকে স্কুলে পাঠাবার জন্য প্রস্তুত করতো। ব্রাশে পেস্ট লাগানো, চুল আচঁড়ানো, জুতার ফিতা বাঁধা, স্কুলের ব্যাগ গোছানো সবই আপু করতো।

মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কলেজে পড়ালেখার জন্য আমাকে বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসতে হয়। কলেজের হোস্টেলে সিটের সংকট থাকায় বাবা আমাকে কলেজের পাশের এক ছাত্রাবাসে তুলে দিয়ে যান। ছাত্রাবাসের খাবারের অসাধারণ নতুন স্বাদ আর কলেজের মোটা মোটা বিজ্ঞান বইয়ের লেখাপড়াগুলো আমাকে মানুষ করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। বাড়ি থেকে বের হয়ে জগৎটা ছিলো একেবারেই অপরিচিত। ব্যাপারটা যেন সাঁতার না-জানা ছেলেকে পুকুরের মাঝখানে ফেলে দিয়ে সাঁতার শেখানো। সেবার বৃষ্টিও হয়েছিল প্রচুর। আমার মনে অনেক জোর থাকলেও শরীরে হাড়-চামড়া ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

সময়টা ছিল বর্ষাকাল। আর কিছুদিন পরেই প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা শুরু হবে। তাই টেবিল-চেয়ারে বসে পড়ালেখা করছিলাম। এমন সময় শফিক এসে বলল, এই অন্তু তোর একটা পার্সেল এসেছে। দরজায় পিয়ন দাঁড়িয়ে আছে, তোকে ডাকছে। আমি পড়া ফেলে উঠে দরজায় গিয়ে পিয়নের খাতায় নাম লিখে প্যাকেটটা নিলাম। তার সাথে একটা চিঠিও ছিল। ঘরে এসে চিঠিটা আগে খুললাম। তাতে লেখা ছিল-

ভাইয়া,

আমার অনেক অনেক আদর ও ভালবাসা নিও। আশাকরি তুমি ভালো আছ। আমরা সবাই ভালো আছি। একটা খুশির খবর আছে। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষিকা হিসাবে আমার চাকুরিটা হয়ে গেছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা চলে এসেছে। সামনের এক তারিখ থেকে আমি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে ডিউটি শুরু করব। বাসার সবাই অনেক খুশি। তুমি থাকলে আমার আরও ভালো লাগতো। তোমার জন্য একটা উপহার পাঠালাম। আশাকরি তোমার এটা ভালো লাগবে।

তুমি বাড়ি কবে আসবে ? এবার বাড়ি এলে আমরা অনেক মজা করবো। নিজের শরীরের যত্ন নিও। ভালো মতো লেখাপড়া করো।

ইতি

তোমার বপু।

চিঠিটা পড়ে আনন্দে আমার অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো। আমি এখন একজন ম্যাডামের ভাই। ভাবতেই ভালো লাগছে। হঠাৎ মনে পড়লো, ও’ একটা উপহার। প্যাকেটটা খুলে দেখি, একটা ছাতা। চমৎকার সুন্দর একটা ছাতা। বর্ষাকালে আমার কাছে যে ছাতা নেই, সেটা আর কারো মনে থাকুক না থাকুক আমার বোনের ঠিকই মনে আছে। ছাতাটা সোনালী রঙের। দেখেই বোঝা যায়, বেশ দামী। ছাতাটার হাতলের সাথে একটা কালো রঙের ফিতা লাগানো আছে। ফিতাটার সাহায্যে আমি ছাতাটা আমার ঘরের দেয়ালে পেরেক দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছি।

কলেজে যাবার সময় আমি ছাতাটা সঙ্গে করে নিয়ে যাই। ছাতাটা আমাকে রোদ-বিষ্টি থেকে বাঁচাই। বিছানায় শুয়ে-শুয়ে আমি ছাতাটার দিকে তাকিয়ে আমার বোনের কথা ভাবি। ভাবি যে, আমাকে সে কত ভালোবাসে। আমি তার একমাত্র ছোটভাই। আমি বড় হয়ে যখন চাকুরি করব, তখন আমার বোনকেও আমি আমার বেতনের টাকা দিয়ে অনেক অনেক উপহার কিনে দেবো।

কলেজের সেইসব দিনগুলোতে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শফিক। পড়ালেখা থেকে শুরু করে খেলাধূলো, চলাফেরা করা সবটাই তার সাথে হতো। একদিন বিষ্টির দিনে সকালে শফিক আমার কাছে এসে ছাতাটা চেয়ে নিয়ে যায়। অন্য কেউ ছাতাটা চাইলে আমি বলতাম, আমি একটু পর বাইরে যাবো তাই আমার ছাতাটা লাগবে। কিন্তু শফিক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়াতে আমি তাকে ছাতাটা দেই। কাজ শেষ করে বিকালে শফিক ছাতাটা নিয়ে ভালোই-ভালোই ফিরে এলো। আমি টেবিল-চেয়ারে বসে পড়ছিলাম। শফিক আমার বিছানায় বসে বলল, “ছাতাটা অনেক মজবুত। এতো ঝড়-বিষ্টির মধ্যে এলাম, ছাতাটার কিছুই হয়নি। এটার দাম কত হয়েছে রে”?

আমি বললাম, “চারশো টাকা। এটা আমার বোন আমাকে দিয়েছে”।

শফিক বলল, “বাইরে খুব জোরে বাতাস হচ্ছিলো। ভাবলাম ছাতাটা উল্টে যাবে। তা যায়নি। খুব ভালো ছাতাটা”।

এই কথা বলতে-বলতে শফিক তার হাতের আঙুলটা ছাতাটার হাতলে লাগানো কালো ফিতাটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ছাতাটা বন-বন করে ঘুরাতে শুরু করলো। আমি তাকে থামতে বলতে যাব এমন সময় হঠাৎ কালো ফিতাটা ছিঁড়ে মুহূর্তের মধ্যে ছাতাটা উড়ে এসে আমার কপালে লেগে টেবিলের ওপর পড়ল। আমি ছাতাটা ধরলাম। আমার ডান গাল বয়ে আমার খাতার উপরে বেশ কয়েক ফোটা রক্ত পড়লো। শফিক হতভম্ব হয়ে রইল।

বেশি না, তিন তিনটে সেলাইয়ের দাগ আমার ডান কপালে আছে। এখন আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে যখন ছাতাটার দিকে তাকাই তখন প্রথমে আমার বোনের কথা মনে হয়। আর আমার দৃষ্টি যখন সেই ছেঁড়া ফিতাটার দিকে যায়, তখন আমার মনে পড়ে, আমার বন্ধু শফিকের কথা। যাকে আমি তার সাহায্যের জন্য আমার প্রিয় ছাতাটা দিয়েছিলাম। এর বিনিময়ে সে আমার ছাতার ফিতাটা ছিঁড়ে ফেলেছে। সে আমার ভালো বন্ধু হওয়ায় আমি তাকে ছাতাটা দেবার সময় “ছাতাটা আমার লাগবে” এমন কোনো কথা বলতে পারিনি। আর সে তো ইচ্ছা করে ফিতাটা ছেঁড়েনি, আর আমার মাথাও ফাটায়নি।

তবুও, মন মানে না। এখন আমি তাকে অপরাধী বলে মনে করি। যতই তার অনিচ্ছায় ঘটনাটি ঘটে থাকুক না কেন, সে আমার ছাতাটাতে একটা খুঁত তৈরী করেছে। আমার বোনের দেয়া উপহারটি সে নষ্ট করেছে।  আমি তাকে কীভাবে ক্ষমা করব। সে দোষী। উহ! কী বোকা আমার বন্ধু। তার ফিতা ধরে ঘুরানো মোটেও উচিত হয়নি। সে সাবধান হতে পারত। আসলে সে একটা অপদার্থ। নাহ্, আজকে সে আমার মনটাই খারাপ করে দিল।

 

-সমাপ্ত-

 

 

১,০৩১ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “ছাতা কাহিনী”

মওন্তব্য করুন : মোঃ সাদাত কামাল [০১-০৭]

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।