আমি একজন ক্যাডেট

ক্লাস সেভেনে থাকাকালীন ঘটনাটা বলি। কলেজ হাসপাতালে আমরা কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে আমার এক বন্ধুকে নিয়ে এলাম। বেচারার অবস্থা আজ বড়ই খারাপ। বেশ টানা কয়েকদিন ধরে আমাদের নভিসেস্‌ প্যারেডের প্র্যাকটিস চলছে। কড়া রোদের নিচে থাকতে থাকতে গায়ের রঙ তো কালো হয়েছেই তার সাথে সাথে আবার গেঞ্জিটা খুললে রোদে না পোড়া অংশটুকু আর একটা সাদা গেঞ্জির মতো লাগে। যাইহোক, আমার বন্ধুটা আজ সকালের প্যারেড প্র্যাকটিস শেষে বাথরুমে গোসলের জন্য লাইন রাখবে বলে দৌঁড়ে আসার সময় পিচের রাস্তায় পড়ে যায়। তার হাটুর বেশ কিছু মাংস উঠে গেছে। তাকে এখন বেডে শুইয়ে অবশ না করেই মেডিক্যাল স্টাফ তার পায়ে ড্রেসিং করে দিচ্ছে। আমি বেডের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছি। বেচারার পায়ের হাড়-মাংস দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আমাদের মেডিক্যাল অফিসার স্যার আসলেন। উনি এসে আমার বন্ধুর পাশে দাঁড়ালেন। বন্ধু আমার তার পায়ের যন্ত্রণায় কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। ওকে দেখে আমার খুবই খারাপ লাগছে। এমন সময় আমাদের মেডিক্যাল অফিসার স্যার তার গম্ভীর গলায় বললেন, এই ছেলে তুমি কান্নাকাটি করছো কেন? তুমি না একজন ক্যাডেট।

হ্যাঁ। আমি একজন ক্যাডেট। এটা অনেকটাই সুপারম্যানের মতো একটা ব্যাপারস্যাপার। আমি বাড়িতে এসে যখন দ্রুত ভাত খাই তখন আমার চাচাতো ভাই বলেন – ক্যাডেট ছেলেটা খাচ্ছে। আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে হাটাহাটি করি তখন আমার ক্লাসমেটরা আমাকে দেখিয়ে বলে, ক্যাডেট হাটছে। ভালোই লাগে আমার। আমি হাসি। মনে মনে। আমি একজন এক্স-ক্যাডেট তাই ভেবে। ক্যাডেট মানে যে কি, তা যদি আমি তাদেরকে বোঝাতে পারতাম তাহলে আমি ধন্য হতাম।

যাইহোক, সেই সময় আমাদের মেডিক্যাল অফিসার স্যার যেভাবে আমার ব্যথায়-যন্ত্রণায় কান্নারত বন্ধুটিকে বলেছিলেন যে, এই ছেলে তুমি কান্নাকাটি করছো কেন? তুমি না একজন ক্যাডেট। আমার মনে হয়েছে যে, স্যার আমার বন্ধুটাকে এই কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে একটা বিশাল শান্তনা দিয়েছেন। আমার বন্ধুটার কষ্ট দেখে নিশ্চয় স্যারের মনের ভেতরেও একটা কষ্ট হচ্ছিলো। ক্লাস সেভেনের মা-বাবার আদরের ছেলেটা আজ মনে হয় তার জীবনে এমন কষ্টের দিন প্রথম দেখছে। আর তাই স্যার আমার বন্ধুটাকে শান্তনা দেবার জন্য, এই অবস্থায় তার মনটাকে শক্ত করবার জন্য, আর কোন শান্তনা বাক্য খুঁজে না পেয়ে আমার বন্ধুটিকে মনে করিয়ে দিলেন যে, সে একজন ক্যাডেট। তাকে এভাবে কাঁদলে মোটেও চলবে না। তার মনটাকে পাথরের মতো শক্ত করতে হবে। আরও ভালভাবে বলা যায় যে, তাকে যে কোন পরিস্থিতিতেই স্বাভাবিক থাকতে হবে। জীবন-যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়বার বিষয়টা যেন কোন ক্যাডেট কেই মানায় না।

আমি একজন ক্যাডেট। আমি তাই যেকোন পরিস্থিতিতেই স্বাভাবিক থাকতে পারি। আমি আমার সিনিয়ার ভাইদের দেওয়া যেকোন ধরনের আদেশই স্বাভাবিক থেকে করেছি। জুতা পালিশ, টিপ বোতাম সেলাই, রুম ঝাড়ু, হাউস গার্ডেনে ফুলের গাছ লাগানো, সেই ফুল লুকিয়ে তোলা, কাঁঠাল ভাঙ্গা, রাতের অন্ধকারে সেই কাঁঠাল থেকে শুরু করে আম, পেয়ারা, জাম, জামরুল, কুল পাড়া। আমি টেবিলে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে টেবিল গোছানোর ব্যাপারে এক্সপার্ট। টেবিলে আমি অন্যের চোখ দেখেই বলে দিতে পারি যে, তার এখন কি লাগবে। আমি আমার ভুলের জন্য আমার বড় ভাইদের কাছে যে ঘন্টার পর ঘন্টা পানিশমেন্ট খেয়েছি তাও আমি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। পরে আমার পায়ে ব্যথার জন্য আমি যখন টয়লেটে যেয়ে ঠিকঠাক মতো বসতে পারতাম না তখনও আমি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। রাতের অন্ধকারে কলেজের বাইরে যাওয়া, কোন বড় ভাইয়ের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হয়ে তার সর্বনাশ করতে যাবার মিশনে যাওয়া, আর কোন আকাম করে বা চুরি করে কোন প্রকার ক্লু ছাড়াই নিখুঁতভাবে সফলতার সাথে ফিরে আসাটাও আমার কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আমি শুধুমাত্র ধরা পড়িনি এই আর কী। আমার নীতি ছিল, “যাই কর আর তাই কর না কেন ধরা পড়ো না”।

এমন সময় একদিন আমার জীবনে আমি আর একটা যুগান্তকারি ডায়ালগ শুনলাম। আমাদের হাউস মাস্টার স্যার এক হাউস অ্যাসেম্বেলিতে আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ক্যাডেটরা পারে না এমন কোন কাজ নেই আর করে না এমন কোন কাজ নেই। আমি মনে মনে হাসলাম। স্যারের কথা এঁকেবারেই একশো ভাগ সত্য ছিল। অবশ্য সেই সময় স্যার আমাদের হাউস ডিসিপ্লিন প্রসঙ্গে কথা বলার প্রেক্ষিতে এই কথাটা বলেছিলেন। আমরা ক্যাডেটরা যে আকাম-কুকাম করে ভেতরে ভেতরে আমাদের হাউসের ডিসিপ্লিনের বারোটা বাজাচ্ছি, সেটাই আসলে আমাদের স্যার আমাদেরকে বোঝাতে, এই কথাটা বলেছিলেন। আমি একসময় বুঝেছিলাম যে, আমাদের কলেজের কিছু স্যার, স্টাফ ও অন্যান্য কর্মচারীরা আমাদের কিছু দোষত্রুটি দেখেও না দেখার ভান করেন। আর আমাদের অজান্তেই সেগুলো রিপোর্ট করে আমাদের ব্যক্তিগত কলেজ ফাইলটাকে ভারী করে তোলেন। তার বিনিময়ে আমাদের উপর হঠাৎ করে আকাশ থেকে বড় ধরনের শাস্তির আদেশ আসে। তাই পরবর্তী জীবনে আমি আমার ব্যাপারে অনেক সাবধান হয়ে যাই। জীবনের প্রতিটি ধাপে পা ফেলবার সময় একবার পেছনে তাকাই। আর শত্রুর সাথেও ভালো ব্যবহার করি। সে বাড়িতে এলে তাকে বসতে বলি। দারোয়ান, বেয়ারা, মুচি, নাপিত, দর্জি সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করি। আমিও খুশি, তারাও খুশি। আমার ভুল হলে কিংবা আমি বিপদে পড়লে তারা আমার জন্য, আমাকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসে। আমার যেকোন প্রয়োজন তারা আগে মেটায়। আমার কথা মতো তারা কাজ করে। ভালো ব্যবহারে কী না হয় এই জগতে।

আমি একজন ক্যাডেট, তাই নাকি আমি অসামাজিক। আমার নাকি তাই পরিবারের প্রতি কোন টান নেই। মায়া-মোহাব্বত আমার নাকি কম। আমি নাকি মানুষকে ক্ষমা করতে পারি না। মানুষকে শাস্তি দেবার জন্য নাকি আমার হাত চুলকাই। আমি তাই কোন মেয়েকে ভালবাসতে পারি না। সেই মন আমার নাকি নেই। ক্যাডেট হয়ে তুমি আর্মিতে চান্স পাওনাই, তুমি কোন সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারো নাই, তুমি বেসরকারিতে পড়ছো। ক্যাডেট হয়ে তুমি বেকার, চাকরি পাচ্ছো না, বসে বসে খাচ্ছো। যদি কোন ভুল হয় তাহলে বলে, ক্যাডেট হয়ে তুমি এমন কাজ করতে পারলে, এমন কথা বলতে পারলে। তুমি তো দেখি মিয়া ক্যাডেট জাতির মান-সম্মানটাকে ডুবালে। তখন খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্যাডেট শব্দটা আমার জন্য একটা অভিশাপ। আমার জীবনে হয়তো, আমি ক্যাডেট না হলেই ভালো করতাম। আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ হতে চাই। কিন্তু, ঐ সুপারম্যান কতক্ষণ আর তার সামনে অন্যায় দেখে চুপচাপ বসে থাকবে। তাকে তো এই দারিদ্রসীমার নিচে বসতরত দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষগুলোকে বাঁচাতেই হবে। তাকে তো তার প্রিয়তমার জন্য একটা ভালো পরিবেশ সুনিশ্চিত করতেই হবে, যেখানে কিনা তার সন্তান হেসে খেলে বড় হতে পারবে। তাই আমি আবারও গর্জে উঠি। আমি এখন যে কোন পরিবেশ, পরিস্থিতিতেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে , নিজেকে খাপখাওয়ি নিতে সক্ষম। আমার আছে অভিজ্ঞতা, আমি সব ব্যথা-বেদনার অর্থ জানি, আমি মানুষ দেখলেই তাকে বুঝতে পারি। মানুষকে চিনতে পারি। তার দুর্বলতাকে ধরতে পারি। তাকে আবার ঠকাতেও পারি। তাকে নায়ক বানাতেও পারি। তার জীবনটাই আমি বদলে দিতে পারি। আমার কোন ভয় নেই। আমি পুকুরের মাঝখানের পদ্মফুলটাকে তুলে আনতে জানি। পদ্মকাঁটার ব্যথা-যন্ত্রণা আমার কাছে কিছুই না।

আমি একজন ক্যাডেট। আমি আমার সোনার দেশের সব জায়গাতেই আছি। আমার জন্য আমার দেশ আজ গর্বিত। আমাদের স্যার বলেছিলেন, আজকের হাউস কালকের দেশ। আর আমি মনে করি, আজকের বিশ্ব আমাদের এই বারোটা ক্যাডেট কলেজ। আমরা প্রশাসনে, আমরা শিক্ষায়, আমরা চিকিৎসায়, আমরা প্রযুক্তিতে, আবার আমরা আছি দুর্নীতি দমন করতে। এটা কোন দিল্লীকা লাড্ডু না, এটা কোন তামাশা না, এটা কোন স্বাভাবিক সহজ-সরল মানুষের জীবন না। এটা আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা কর্তৃক প্রদত্ত ক্যাডেট জীবন। আর আমি একজন ক্যাডেট। আমি একজন গর্বিত ক্যাডেট। আল্‌হামদুলিল্লাহ্‌।

তাই মনে মনে কবিতার ছন্দে বলি –
রবীন্দ্রনাথের তের-চৌদ্দ বছরের বালাই আমি এক_
যন্ত্রণায় আমার দিন যায়;
আর আমি বেড়ে হই,
সুকান্তের আঠারো বছর বয়সের তরুণ;
যাদের তাজা তাজা প্রাণে এক অসহ্য যন্ত্রণা।

দুঃসাহসী, প্রখর, তীব্রচঞ্চল প্রাণ আমার_
আমি জানি নাকো কাঁদা,
আমি মানি নাকো কোন বাধা,
আমি ভালবাসতে জানি;
আমি এক সুশিক্ষিত, বিবেকবান মানব সন্তান,
আমি একজন ক্যাডেট।

-সমাপ্ত-

৩,৩৪৪ বার দেখা হয়েছে

২৬ টি মন্তব্য : “আমি একজন ক্যাডেট”

  1. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)
    ক্যাডেটরা পারে না এমন কোন কাজ নেই আর করে না এমন কোন কাজ নেই।

    এক্কেরে হাছা কথা!!!


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  2. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    আর আমার বিশ্বাস ক্যাডেট কোনদিন বইয়া থাহে না
    কুনো জায়গায় চান্স না পাইলেও ওই পোলাও এমন শাইন করে যে বাকিরা চিন্তা করতেও টাইম নেয়
    আসলে ক্যাডেট দের কাছ থেকে মানুষের Expectation অনেক বেশি থাকে, কাজেই ক্ষুদ্র কোন ঘাটতি কেও অনেক বড় মনে হয়.........

    বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কোন দল এক ম্যাচ হারলেই তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়......... সবার মুখে Shame Shame আওয়াজ চলে আসে......... পাশাপাশি আফগানিস্তান কিংবা আয়ারল্যান্ড এর মত দল কোন ম্যাচ ফাইট দিতে পারলেই বাহবা পেয়ে যায়.........
    আশা করি বুঝতে পেরেছ যা বুঝাতে চেয়েছি......... 😀


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  3. অনিন্দ্য (২০০০-২০০৬)

    "আজকের হাউস কালকের দেশ । আর আমি মনে করি, আজকের বিশ্ব আমাদের এই বারোটা ক্যাডেট কলেজ । .......... আর আমি একজন ক্যাডেট। আমি একজন গর্বিত ক্যাডেট ।" অনেক ভালো লাগলো ভাই... :hatsoff: (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    লেখাটা ভাল লাগল। :clap:
    মানুষের এক্সপেক্টেশন অনুপ্রেরনা হতে পারে, আবার চাপও হতে পারে। নির্ভর করবে - তুমি কিভাবে সামলাও তার উপর... :-B

    কিছু মনে না করলে তোমাকে একটি কথা বলি। তোমার লেখায় পুরুষভেদে ক্রিয়ার রুপের কিছু সমস্যা আছে। তোমার লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি-

    ১। জীবন-যুদ্ধে ভেঙ্গে পড়বার বিষয়টা যেন কোন ক্যাডেট কেই মানা না।

    এটা 'মানায় না' হবে।

    ২। তাই পরবর্তী জীবনে আমি আমার ব্যাপারে অনেক সাবধান হয়ে যায়

    'যাই' হবে

    ৩। যন্ত্রণায় আমার দিন যা;

    'যায়' হবে

    ৪। আর আমি বেড়ে হয়

    'হই' হবে

    নিচের ছবিটা খেয়াল করে দেখো-

    পুরুষভেদে ক্রিয়ার রুপ

    ভাল থেকো। (সম্পাদিত)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।