আমার বন্ধু লুবনা

কলেজে থাকাকালীন সময়ে আমি কখনই লুবনার প্রিয় বন্ধু ছিলাম না। লুবনা বরং আমাকে মারতো সময় সুযোগ পেলে। মার্চ পাস্ট করে একাডেমিক ব্লকে যাচ্ছি তো লুবনা আমার অক্সফোরড শু খুলে দিলো লাথি মেরে। সাইডে বসে জুতো পরছি, ও এমন একটা লুক দিল যে মনে হতো দেখিস একদিন আমিও… সেই একদিন কখনোই আসে নাই ক্যাডেট কলেজে থাকাকালীন সময়ে। অনেক কারিগরী করে দুই ইঞ্চির একটা বিনুনি করলাম চুলে, লুবনা আমার কষ্টকল্প চুলের ফ্যাশনের বারোটা বাজিয়ে দি্লো মুহূর্তেই। বাজ পাখীর মত কোথা থেকে এসে খুলে দিল ববি পিন আর বাহারী রিবন।

গতবছর ঢাকায় লুবনা এলো এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে, সাথে ওর চাইতেও বিচ্ছু দুই বাচ্চা। এক হাতে বুকে জড়িয়ে অন্য হাতে ধরিয়ে দিলো দেশী জামা কাপড়ের বিশাল এক প্যাকেট… এতোদিন পর দেশে ফিরছি, কী না কি জামা কাপড় পরবো তাই আগেই সব কিনে নিয়ে এসেছে। সাথে রান্না করা খাবারও হট পটে।

খুব নিরীহ ভাল একটা মানুষের মুখচ্ছবি তার, নখের এতটুকু ব্যাবহার না করে সুনিপুণ ভাবে সে আমাকে চিমটি দিয়ে হাতের মাংস থেতলে দিতো সামান্য কারনে! সেই থেঁতলানো হাত নীল হয়ে থাকতো মাস ধরে। সবার হয়তো বাড়ী থেকে চিঠি এসেছে বুধবারের মেইলে, আমি কেবল মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি মেইল না পেয়ে। লুবনা তার খাকি শার্টের নিচে লকারে রেখে দিয়েছে আমার মেইল। দিনের শেষে তিন মিনিটের একটা শাওয়ারে গেছি, সবার অগোচরে বাথরুমের আলোটা নিভিয়ে ও পড়তে বসেছে ভাল মানুষের মত মুখ করে।

পালমোনারি এমবোলিসমে ডায়াগনোসড হয়ে মরতে বসেছিলাম বছর কয় আগে। খবর শুনে লুবনা আমার জন্য ওমরাহ্‌ করতে গেলো সৌদি আরবে, সাথে ওর ছয় মাসের মেয়ে অপ্সরাআর মহা বান্দর ছেলে। লুবনা খোদার কাছে আমার রোগ মুক্তি চাইতে আন্ডাবাচ্চা নিয়ে চলে গেল কারো কথা না শুনে। লুবনা আমার জন্য রোজা রাখলো, লুবনা নামাজে কান্না করলো কুড়ি বছর আগের আধা ভোলা এক শত্রুর জন্য।

ছুটির দিনে গার্ডেনিং করা আমাদের বাধ্যতামূলক ছিল। বাগান করা শেষে লুবনা দুটো কিলবিলে পোকা বা একটা কেঁচো এনে নিয়ম করে আমার বালিশের কভারের ভেতরে রেখে দিতো। চুলে তেল দেই নাই এই জন্মে, তেল দেখলেই আমার গা শিরশিরে অনুভুতি অথচ আমার উস্কুমুস্কু চুল ওর দুই চোখের বিষ। মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতে যখন ঘুমিয়ে পরেছি, লুবনা সবার অগোচরে আমার চুলে কদুর তেল লেপটে দিয়েছে আর আমি কাঁপতে কাঁপতে আর কাঁদতে কাঁদতে গোসল করেছি ওকে শাপ শাপান্ত করে।

এক জন্ম প্রবাসে থাকার পরও ঈদ এলে আমার মন উচাটন হয় দেশের কথা মনে করে। লুবনা আমাদের জন্য একটা একটা করে কাপড় কেনে হাজার মাইল দূরে বসে, অনেক যত্নে মেইল করে নিজে। পাখী জামা পরবে নাকি তারা? আর তুই কাঞ্চিভরম শাড়ী?? লন খুব চলছে দেশে এখন, পাঠাবো কি বাজুবন্দ আর কাঁচের চুড়ি, নাকের ফুল? ওর কোন কথাই আমার কানে যায় না, একদা মার খেয়ে নীল হওয়া শরীরে আমি হাত বুলিয়ে ওর ভালবাসা অনুভব করতে চেষ্টা করি শুধু।

ঢাকায় লুবনার বাড়ী যখন পৌঁছুলাম টেবিলে তখন সুতো রাখবার মত জায়গাও অবশিষ্ট নাই। আন্টি আর লুবনা মিলে তিন জন্মের খানা খাইয়ে দিল সারাদিনে। কচুর লতি আর চিংড়ি ভর্তা, কাচ্চি বিরিয়ানি আর শামি কাবাব, সর্ষে ইলিশ তো মাছের মুড়ো, আলু ভর্তা তো মুগ ডাল, লইট্টা শুটকি তো কাচকি মাছের চর্চরী … কী খাই নাই একদিনে। কত রকমের যে মিষ্টি বানিয়েছে ও, পিঠা পুলি, পায়েশ, নারকোল নাড়ু, কি ছিলোনা তাই ভাবি।

ঢাকার এবড়ো থেবড়ো পথে তিন ইঞ্চি স্টিলেটো পরে হাঁটতে হাঁটতে আমি যখন ক্লান্ত লুবনা তখন তার ইয়া বড় ব্যাগ থেকে চটি জুতো বের করে বলেছে, এইটা পর গাধা, ফ্যাশন তো অনেকই হইল! ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে লালচে মুখে পানির ঝাপটা দিয়েছে সে তার আম্রিকার শত্রুটিকে।

আমার মেধাবী ডাক্তার বন্ধু লুবনা শারমিন যখন ব্রেস্ট ক্যান্সারে ডায়াগনোসড হলো গত বছরের শুরুতে তখন অনেকদিন পর সেজদায় কেঁদে উপরওয়ালা কে ডেকে বললাম, হোয়াই আস এগেইন, খোদা?

হাজার মাইল দূরে থাকি আমি, বন্ধুর সুখে বা শোকে, জরা ও ব্যাধিতে হাত ছুঁয়ে বলতে পারি নাই কখনো, ওরে আমি আছি তোর পাশেই! কিন্তু আমি জানি, আমার প্রানের বন্ধুটিও জানে, বুকের ধুকপুকুনির মতোই আমরা আছি এক আত্মায় আর দুই শরীরে!

LUBNA
৫,৫২২ বার দেখা হয়েছে

৪৮ টি মন্তব্য : “আমার বন্ধু লুবনা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    পুরান দুই নাম্বারি করলাম। পরথম! :awesome: :awesome: :awesome: এইবার পড়তে যাই লেখাটা!


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    মনটা ভাল হয়ে গেল লেখাটা পড়ে। লুবনা আপা কোথায়? কমেন্ট করেন না কেন?! 😀 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  3. ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।লজ্জাও পাচ্ছি।ইস আগে যদি জানতাম যে তুই আমাকে নিয়ে লিখবি তাহলে কলেজে এতো জালাতন করতাম না।তখন যা করেছি তাই ভেবে এখন লজ্জা পাচ্ছি।তুই চিরকালই এতো সরল থেকেই গেলি।তোর এই সরলতাই আমাদের পছন্দ।এতো সুনদর লেখা পড়ে আমার দুই চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বইছে। 😡

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এরকম বন্ধু পাওয়া রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার।

    আপনাদের দুজনকেই শ্রদ্ধা :boss: :boss: :boss:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আপা,
    ক্যাডেট কলেজে গিয়ে ঠিকই এই রকম বন্ধু পেয়েছি বলেই দিনমান দৌড়ের উপর থেকেও মনে হয় জীবনটা কি সুন্দর!


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  6. সাজেদ (২০০৪-২০১০)

    প্রথম বারের মত উদ্ধৃতি ব্যবহার করে কি বিপদেই না পড়েছি 🙁
    অসাধারণ লাগল আপু। আরও লেখা পড়তে চাই। :boss:
    আর যত গুলো খাবারের নাম বল্লেন সব গুলোই তো favorite....... খিদে পেয়ে গেল তো 😛
    কে এখন খাওয়াবে এত কিছু???????? :((


    "মরনের বীথিকায় জীবনের উচ্ছ্বাস,

    জীবনের যাতনায় মৃত্যুর মাধুরী"

    জবাব দিন
  7. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ক্যাডেট কলেজে পড়ার কারনে এমন কিছু বন্ধু পেয়েছি যাদের সাথে শত দুঃখ-কষ্ট-বাধা-বিপত্তিও হাসতে হাসতে মোকাবেলা করা যায়। আমি তো মনে করি এক সাথে কয়েকজন থাকলে আমরা মৃত্যুকেও হাসিমুখে বরণ করে নিতে পারব। B-)

    দুই আপা'স, তোমাদের এই বন্ধুত্ব চির অটুক থাকুক। :clap:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  8. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আপনার বন্ধু ভাগ্য ভালো। যে কেউ ঈর্ষা করবে।
    যদিও আমি করছি না।
    শুভেচ্ছা আপনাদের দুজনকে।

    আমি বন্ধু হীন।
    অবশ্য অখুশি নই।
    কারণ এই আমার বেশ লাগে। B-)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        সবার বন্ধু থাকে।
        আমার নেই।
        এই না থাকাটাও অন্যরকম ব্যাপার।
        আমার কিন্তু ভালোই লাগে।
        কিংবা এও বলা যায় আমার বন্ধু-আত্মীয় কেউ নেই।
        এইখানে কিশোর কুমারের গান হতে পারে, আমি একা, বড়ো একা।
        যদিও কিশোর কুমারের গানে বিষাদ রয়েছে।
        আমার গানে থাকবে না।
        হয়তো আমি আলাদা, স্বাভাবিক নই।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
        • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

          "হয়তো আমি আলাদা, স্বাভাবিক নই" - তাই যদি সত্য হয়, তবে তো কাউন্সেলিং দরকার। না, আমি কোন মানসিক ডাক্তার টাক্তারের কথা বলছি না। যে তোমাকে ভালোভাবে জানে, চেনে, এমন নিকট কাউরো কাছে নিজেকে একটু উন্মীলন করে দেখতে পারো, রাজীব। তুমি যেভাবে বলেছো, তাতে একটু ব্যথিত বোধ করেছি বলেই কথাগুলো বললাম।

          জবাব দিন
          • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

            ভাই ধন্যবাদ।
            বয়স ১৮ থেকে ২৫ হলে মানসিক ডাক্তারের প্রসঙ্গ আসলে মাইন্ড করতাম। ৩৮ এ এসে সে সুযোগ নেই।

            আমিও বন্ধু বা তথাকথিত বন্ধুদের সাথে হুল্লোড় করি। আড্ডা য় যা যা করা হয় তাই করি।
            আমি লোক হাসাতে পারি। আড্ডা জমাতে পারি।
            ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুবাদে ঘনিষ্ট কিছু বন্ধু ও আছে।

            হয়তো আমি আরো গভীর কিছু র কথা বলছি। নিশ্চিত নই।
            যেহেতু নিজে রুমি লেভেল এর নই তাই শামস এর কথাও বলতে পারছি না।

            এমন না যে লোকজনের সাথে যোগাযোগ নেই।
            ফেবু তে সচল।
            যেই আওয়াজ দেয়, উত্তর দেই।
            নিজে থেকে কারো সাথে যোগাযোগ করি না।
            কারো সাথেই না।


            এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

            জবাব দিন
  9. আহমদ (৮৮-৯৪)

    বন্ধুত্ব টিকে থাকুক সবসময়। ভালোবাসা-মায়া-মমতায়। সবাই ভাল থাকুক।
    লেখাটা বেশ ইমোশনাল। সবাই ইমোশন প্রকাশ করতে পারে না। আপনি পেরেছেন।
    হাত খুলে লিখে যান। আমরাও পড়তে থাকি।


    চ্যারিটি বিগিনস এট হোম

    জবাব দিন
  10. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    খুব সুন্দর ঝড়ঝড়ে লেখা আপা, মনটাই ভালো হয়ে গেলো। এমন বন্ধু পাওয়াও ভাগ্যের ব্যপার, আপনার এখন লেখা খইয়ের মত ফুটছে, দয়া করে লিখতে থাকুন। পরে একটা সময় আসে যখন অনেক চিন্তা করেও কিছু লেখা যায় না। 🙁


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  11. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এই লিখাটা কেন যেন পড়া হয় নাই। আজ পেলাম সিসিবি ম্যাগাজিনের এডিটরিয়াল বোর্ডের মেম্বার হিসাবে।
    শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ কাদলাম।
    অনেক দিন ধরে বেশ কিছু কান্না জমে গিয়েছিল। এটাতে এসে সেটা বাধ ভাঙ্গলো।
    এখন হালকা লাগছে।

    তোমাকে ধন্যবাদ হালকা হবার এই সুযোগটা করে দেবার জন্য।


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিনা

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।