একটা উজার করে দেওয়া গাছের গল্প

সে অনেকদিন আগের কথা। এক বনে এক গাছ ছিল। গাছটির কাছে রোজ একটা ছোট্ট ছেলে খেলা করতে আসত। প্রতিদিন সেই ছেলেটি গাছের সব পাতা একত্র করত আর তা দিয়ে সে তার মাথার মুকুট বানাত। গাছটাকে ঘিরে সে প্রতিদিন মনের আনন্দে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করে বেড়াত। গাছটির ডাল বেয়ে বেয়ে উঠে আপেল পেড়ে খেত। ডালগূলোতে ঝুলে দোল খেত। গাছের গুড়ি জড়িয়ে ধরে কানে কানে কি কি সব যেন কথাও বলত। গাছটির পাশে যে বড় পাথরটি ছিল, তার আড়ালে ছোট্ট ছেলেটি লুকিয়ে থাকত আর গাছটি কিভাবে কিভাবে যেন তার পাতাভরা ডাল নুয়ে নুয়ে ছেলেটিকে খুঁজে নিত ঠিকই। ক্লান্ত হলে পরে ছেলেটি গাছের নিচেই শুয়ে পড়ত আর গাছটি ছায়া বিছিয়ে দিত। ছেলেটি প্রতিদিন আসত গাছটির কাছে। আর গাছটি মনে বড়ই সুখ পেত।

এভাবে দিন গড়িয়ে রাত আসল, রাত শেষে দিন, মাস শেষে বছর। ছেলেটি ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। ছেলেটি এখন আগের চাইতে গাছের কাছে আনাগোনা কমিয়ে দিয়েছে। গাছটির এখন প্রায়ই একলা লাগে।

বেশ কিছুদিন পর আবার ছেলেটি আসল গাছটির কাছে। ততদিনে সে কিশোর। গাছটি খুব খুশী হল।
“আসো বাছা, আমার চারিধারে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুড়ি বেয়ে উপরে উঠে আপেল খাও, আমার ডালে ঝুলে দোল খাও।”
“আমার এখন খেলতে ভালো লাগে না।”
“কি করলে তোমার ভালো লাগবে বাছা?”
“আমার এখন অনেক কিছু কেনার প্রয়োজন, আর তার জন্য চাই টাকা। আছে তোমার কাছে টাকা?”
“না, আমার কাছে তো টাকা নেই। কিন্তু আমার আপেলগুলো নিয়ে তুমি বাজারে বিক্রি করলে টাকা পেতে পারো, বাছা।”
কিশোরটি তখন সেই গাছের সবগুলো আপেল পেড়ে নিয়ে চলে গেল। খুশী হল গাছটি। গাছটি আবার অনেক দিনের জন্য একা হয়ে গেল।

অনেক দিন পর আবার ছেলেটি এল গাছের কাছে। এখন সে টগবগে যুবক। তাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গাছটি বলল,
“আসো বাছা, আমার চারিধারে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুড়ি বেয়ে উপরে উঠে আপেল খাও, আমার ডালে ঝুলে দোল খাও।”
“না, এখন আমি অনেক বড় হয়ে গিয়েছি, কি করে উঠব?”
“তবে তোমার কি ভালো লাগে, বাছা?”
“আমার এখন একটা ঘর বানাতে হবে। বিয়ে করে বউ নিয়ে সেই ঘরে উঠব। তোমার কাছে তো ঘর নেই।”
“বাছা, আমার কাছে তো ঘর নেই, এই জঙ্গলই আমার ঘর। কিন্তু আমার ডালপালাগুলো দিয়ে তুমি তোমার ঘর বানাতে পারবে। তুমি আমার ডালগুলো কেটে নিয়ে যাও।”
যুবকটি তার বাসা বানানোর জন্য গাছটির সব ডাল কেটে নিয়ে চলে গেল। খুশী হল গাছটি। আবারও অনেক দিনের জন্য একলা হয়ে রইল সে।

তারও আরো অনেক, অনেক দিন পরের কথা। ছেলেটি আসল গাছটির কাছে। বয়স অনেক বেড়ে গেছে, বৃদ্ধের কাছাকাছি সে এখন প্রায়। এতোদিন পর তাকে দেখে আনন্দের আতিশায্যে কথাই বলতে পারছিল না গাছটি। কেবল বলল,
“আসো বাছা, আমার চারিধারে দৌড়ে বেড়াও, আমার গুড়ি বেয়ে উপরে উঠে আপেল খাও, আমার ডালে ঝুলে দোল খাও।”
“আমি এখন বৃদ্ধ প্রায়, এবং আমার মনে অনেক কষ্ট।”
“তবে তোমাকে আমি কিভাবে খুশী করতে পারি, বল বাছা?”
“আমার একটা নৌকা দরকার যা দিয়ে আমি অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে চাই। আছে তোমার কাছে নৌকা?”
“আমার কাছে তো নৌকা নেই, কিন্তু আমার এই গুড়িটা আছে যা দিয়ে তুমি নৌকা বানিয়ে নিতে পার, বাছা। এ নিয়ে যাও এবং খুশী থাক।”
বয়স্ক লোকটি তখন নৌকা বানাবার জন্য গাছটির গুড়ি কেটে নিয়ে চলে গেল। গাছটি খুশী হল কিন্তু সব খুশী সেই ছেলেটিকেই দিয়ে দিল। আবারও সে অনেকদিনের জন্য, অনেক অনেক দিনের জন্য একলা হয়ে রইল।

অনেক, অনেক, অনেক দিন পর থুড়থুড়ে বুড়োর বেশে এসে দাড়ালো সেই ছেলেটি। গাছের গুড়িটি তাকে দেখে বলল,
“তোমাকে দেবার মত আমার কাছে কিছুই নেই। আমার আপেল গুলো নেই তোমাকে খেতে দেবার জন্য, বাছা।”
“আমার দাঁতও প্রায় একটিও নেই। আমি কি করে আপেল খাব?”
“আমার ডালপালাও নেই যাতে করে আমি তোমাকে দোল খাওয়াব।”
“তোমার ডালে ঝুলে দোল খাবার জন্য আমি এখন বৃদ্ধ অতি।”
“আমার গুড়িও আজ নেই যেটি বেয়ে বেয়ে তুমি উপরে উঠতে পার।”
“আমার শরীরে সেই শক্তিটুকু অবশিষ্ঠ নেই আজ।”
“বাছা আমার, আমি খুবই দুঃক্ষিত। তোমাকে দেবার জন্য কিছু একটা দিতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু আজ আমি নিঃস্ব, আমি কেবলই একটা মরা গাছের শেকড়।”
“দুডন্ড শান্তিতে বসার জায়গা ছাড়া আমার আসলে এখন আর কিছুই দরকার নেই, আমি খুবই ক্লান্ত।”
যতটুকু সম্ভব সামান্য মাথা বেড়িয়ে থাকা গাছটি নড়েচড়ে সোজা হবার চেষ্টা করল। বলল,
“তবে বাছা আমার, একটা পুরানো গাছের কাটা গুড়ি বসার জন্য ভালো জায়গা। তুমি আরাম করে বস।”

ছেলেটি গাছটিতে আরাম করে শান্তি নিয়ে বসল এবং তার হাড়ানো সুখ খুঁজে পেল।

(ডিস্ক্লেইমারঃ শেল সিলভারস্টেইন রচিত “দ্যা গিভিং ট্রি” বইটির কথা গুলো বাংলায় লেখার চেষ্টা করেছি।)

২,১৯৮ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “একটা উজার করে দেওয়া গাছের গল্প”

  1. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    ২য় ইটা......


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন
  2. আমিনুল (২০০০-২০০৬)

    ৩য় ইটা!!!'দ্যা গিভিং ট্রি'র কাহিনীটা আগেই পড়েছিলাম মা নিয়ে কোন একটা লেখায়।আমাদের মায়েরা কেন যেন এমনই হয়।যতবারই এই কাহিনীর কথা পড়ি নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়।
    অসাধারণভাবে কাহিনীটা প্রেজেন্ট করার জন্য ::salute::
    প্রিয়তে নিয়ে নিলাম। 😀

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ও এটা দেখি গাছের গল্প... আমি ভাবছিলাম গাছের গল্প...


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • সাবিহা জিতু (১৯৯৩-১৯৯৯)

      ফয়েজ ভাই, আমি মা ছেলেকে চোখ দেয়ার গল্প জানি না, তবে অন্য আরেকটা গল্প শুনেছিলাম, কিছুটা এমন- প্রেমিকার অনুরোধে মায়ের কলিজা কেটে প্রেমিকার কাছে নিয়ে যাবার পথে পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে যাবার পথে মায়ের কলিজাটা বলে উঠল, "আস্তে যা বাবা, ব্যাথা পাবি তো!" চোখের গল্পটা বলেন তো!


      You cannot hangout with negative people and expect a positive life.

      জবাব দিন
      • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

        ছোট একটা ছেলের মনে বড় কস্ট কারন তার মার একটা চোখ নাই। শৈশবে সে মাকে দেখে ভয় পেত, মায়ের কাছে যেতে চাইত না, কৈশোরে তার মাকে বন্ধুদের কাছ থেকে আড়ালে রাখত, পরিচয় দিত না, এরপরে এডাল্ট হবার পরে মাকে ছেড়ে চলে যায়, অনেক কস্ট করে পয়সা কামায়, বিয়ে করে, বউ-বাচ্চা সংসার, কিন্তু কাউকেই সে তাঁর মায়ের কথা বলেনা, সবাই জানে তার মা নেই, অনেক দিন পরে তাঁর মা দেখা করতে আসলে সে বাসায় ঢুকতে দেয় না, কারও সংগে পরিচয় করিয়েও দেয় না, এরপরে সে একটা চিঠি পায়, সেখানে তার মা তাকে ডিটেইল বলে কেন তাঁর চোখ নেই, সেই চিঠি পড়ে সে গ্রামে যায়, মায়ের কাছে মাফ চাইতে, গিয়ে দেখে তাঁর মা মরে গেছে।

        এই হচ্ছে গল্প, চিঠিতে কি লিখা ছিল বললাম না, কুইজ দিলাম, দেখি বলতে পার কিনা? 🙂


        পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

        জবাব দিন
  4. আমীন (০১-০৭)

    আপনি তো মাত্র একটা গাছের কথা বললেন,কিন্তু এরকম হাজার হাজার গাছ আছে যারা অবিরত আমাদের সুখ দিয়ে যাচ্ছে তাদের কথা বলবেন কিভাবে?
    আমি গল্প টা আগে থেকেই যানতাম কিন্তু বাংলায় পড়তে গিয়ে কেমন জানি বেশি খারাপ লাগল!
    এরকম মন খারাপ করা গল্প দেয়ার জন্য আপনারে মাইনাস দিব কিনা ভাবতেছি!! :thumbup:

    কিছুদিন আগে বাংলালিঙ্ক ফ্রী এস.এম.এস চলাকালীন সময়ে একটা ম্যাসেজ পেয়েছিলাম।আপনার “আস্তে যা বাবা, ব্যাথা পাবি তো!” দেখে সেটার কথা মনে পড়ে গেল।আমি আবার সেটাকে গল্পে দাড় করিয়েছি তখনই।যাই পোস্ট করে আসি।

    জবাব দিন
  5. বেশ ছোটবেলায় গল্পটা পড়া হয়েছিল। আমার অবশ্য ছোটবেলায় রূপকথা আর ভূতের গল্পের প্রতি ভয়াবহ ঝোঁক ছিল। রাক্ষস-খোক্ষস, দুই বাংলার ভূতের গল্প এদের নিয়েই ছোটবেলাটা মন্দ ছিল না।
    অফটপিকঃ আপু, ট্যাগে ঝকক দিলে ভালো হতো 😛

    জবাব দিন
  6. আছিব (২০০০-২০০৬)

    আমি পেরথমেই ভাবছিলাম ইহা ঝকক র কারও জন্মদিনের পোস্ট কিনা 🙁
    যাউজ্ঞা...জিতুপ্পিকে ধন্যবাদ মনে নাড়া দেয়া লেখা উপস্থাপনের জন্য...যদিও সব লেখাই ইরাম জোস হয় :boss:

    জবাব দিন
  7. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    গল্পটা খুবই খুবই মন খারাপ করা। এই গল্পটা যতবারই পড়ি শত ঝড়ের মাজএও সন্তানকে আগলে রাখা সন্তানের জন্য সর্বস্ব উজার করে দেয়া একজন জননীকেই দেখই।
    এই রকম পোস্ট দিয়া মন খারাপ করানোর জন্য জিতুপিকে মাইনাস।
    পোস্টে প্লাস।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আছিব (২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।