কেন প্রয়োজন ভিন্নপাঠ?

দারিদ্র্য নিরসনসংক্রান্ত যে-কোনো বৈশ্বিক সম্মেলনে আফ্রিকার প্রসঙ্গ উঠতে বাধ্য। কিন্তু আফ্রিকা কি সত্যিই দরিদ্র ও যুদ্ধ-কবলিত নাকি তাকে দরিদ্র করে রাখা হয়েছে? গুণীজন কহিবেন, উহারা দরিদ্র না হইলে ধনী দেশগুলো অকাতরে হাজার হাজার কোটি ডলার সাহায্য বা সহজ শর্তে ঋণ দিতেছে কেন?

নরওয়েজিয়ান স্কুল অব ইকোনমিকস পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ধনী দেশ কর্তৃক দরিদ্র দেশকে সাহায্য প্রদানের প্রচলিত এ ধারণার মধ্যে রয়েছে শুভঙ্করের মস্ত ফাঁকি। ধনী দেশগুলো প্রতি ১ ডলার অর্থ সাহায্যের বিপরীতে গ্রহীতা দেশের কাছ থেকে প্রায় ২৪ ডলার আদায় করে নেয় মাথায় হাত বুলিয়ে বা গলায় গামছা পেঁচিয়ে। ২০১২ সালে আফ্রিকায় আর্থিক সাহায্য ও ঋণের নেট ইনফ্লো ছিল ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার, আর আউটফ্লো ৩.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ঋণের সুদ, কনসালটেন্সি ফি, ট্রেড মিসইনভয়েসিং (এই জালিয়াতিটি করে প্রধানত বহুজাতিক কোম্পানিগুলো) ও ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থিত করস্বর্গে অর্থ পাচারের মাধ্যমে এই কাজটি নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হয়। (১)

এছাড়াও প্রতিবছর ২৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কাঠ, বন্যপ্রাণী অবৈধভাবে পাচার হয় আফ্রিকা থেকে ধনী দেশগুলিতে। আদতে আফ্রিকা মোটেই দরিদ্র নয়। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার পরও এই মহাদেশের মানুষের ভাগ্য বদলায় না, কারণ তেল-খনিজ-গ্যাস রপ্তানি থেকে অর্জিত অর্থের সিংহভাগ হাতিয়ে নেয় বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। (২) রাজার হস্ত এভাবেই সুকৌশলে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি করে। তারপর কাঙালকে অল্প কিছু পয়সা ভিক্ষা দিয়ে চোর থেকে সে দানবীর বনে যায়। ডারউইন খুব সম্ভবত এই বহুরুপী গিরগিটিদের কথা মাথায় রেখেই তার তত্ত্বটি দিয়েছিলেন।

২.
বৈদেশিক সাহায্য প্রদানের নামে শোষণের আধুনিকতম এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে উন্নয়নশীল দেশের মানুষ। এগুলো সম্পর্কে তাদেরকে অন্ধকারে রাখার জন্যে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার (যাঁতা)কলে শিক্ষিত (পড়ুন:মাড়াই) করা হয় যাতে শিক্ষাঙ্গনের চৌকাঠ পেরোনোর পর অনুসন্ধিৎসা স্পৃহা বলে তাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। গৎবাঁধা পাঠ্যপুস্তক ও ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষাকাঠামো তাকে মোটেই নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস জোগায় না।

ছোট্ট উদাহরণ দিই। আমাদের স্কুলের ইতিহাস বইয়ে লর্ড ডালহৌসী কর্তৃক রেলগাড়ি চালুর কথা থাকে, কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার বিবরণ থাকে না। তেতাল্লিশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে লেখা থাকে, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে কৃত্রিম সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ মানুষকে দিশেহারা করে তোলে। (৩)

দিশেহারা? ৪০ লক্ষ মতান্তরে অর্ধ কোটি মানুষের প্রাণহানিকে কীভাবে কেবল দিশেহারা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, তা পণ্ডিতপ্রবররাই বলতে পারবেন! আর দুর্ভিক্ষটি যদি কৃত্রিম সৃষ্টই হয়, এজন্যে কে দায়ী তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নাই। পাঠক বলবেন, এত বিস্তারিত জানার দরকার কী বাপু?

দরকার আছে। আমার পূর্বপুরুষ কার হাতে কেন কীভাবে যুগের পর যুগ শোষিত হয়েছে, তা না জানলে মুখোশ পাল্টে পুরনো শকুন নতুনরূপে আবার হাজির হবে শরীরের অবশিষ্ট রক্ত চুষতে। একইভাবে নিজের ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল অতীত না জানলে কখনো আত্মসচেতন হওয়া যায় না। অবচেতন মনে গভীর হীনম্মন্যতার বোঝা বহন করে বেড়াতে হয় আজীবন। উদাহরণ দিয়ে খোলাসা করি ব্যাপারটা।

হালফ্যাশনের গ্যাজেট আর দুনিয়ার যাবতীয় ফুটবল লীগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আমার সপ্রতিভ বন্ধুদের দেখেছি, বাংলাদেশে ঘুরতে আসা শ্বেতাঙ্গ অতিথিদের সামনে নিজের দেশের প্রসঙ্গ উঠলে বরাবরই মিইয়ে যেতে। এহেন পদলেহী আচরণে আমি বিস্মিত হই। মনে হয়, আমাদেরও যে নিজস্ব ঐতিহ্য আছে, সাংস্কৃতিক সম্পদ আছে সেগুলো ওরা কেন বিদেশিদের কাছে তুলে ধরছে না? আমি বলতে শুরু করলে বাকিরা বরং বিব্রত বোধ করে। এ রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছি বহুদিন ধরে।

পরে মনে হলো, অধিকাংশ বঙ্গসন্তানের ইতিহাস জ্ঞানের শেষ সীমান্ত ১৭৫৭ সাল। এর আগে যেন কিচ্ছু নেই। সোমপুর বিহার, জগদ্দল বিহার, নালন্দা বিহার তো দূরে থাক; সে কখনো এটাই শোনে নি যে, ১৭৫৭ সালে লন্ডনের চেয়ে ঢের শানশওকতপূর্ণ ছিল বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ এবং ইংরেজ কর্তৃক দুশতাব্দিব্যাপী লুন্ঠনের আগে বাংলা ছিল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী অঞ্চল। পাঠ্যবইয়ে সে পড়ে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। অথচ, সেই প্রাচীনকাল থেকে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার বিশাল জাহাজ-নৌকা নির্মাণ ও বস্ত্রশিল্পে বিশ্বব্যাপী বাংলার শ্রেষ্ঠত্বের কীর্তিগাথা সে কখনো স্কুলে শেখে না।

তাই যে শিশুটি কেবল বাংলার দারিদ্র্যের কথা পড়েছে, ইংরেজের হাতে বেধড়ক মার খাওয়ার ইতিহাস পড়ে বেড়ে উঠেছে, তার পক্ষে ধনী দেশের কোনো তরুণ বা তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে স্বদেশকে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তার সেই মনোবলই থাকে না। সে চাপিয়ে দেয়া, জোর করে গিলতে বাধ্য করা ইতিহাস শেখে। চর্বিত-চর্বণ করে। উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের স্বাধীন চোখ দিয়ে না দেখে বরং পশ্চিমা ঐতিহাসিকদের চোখেই পৃথিবীকে দেখতে শেখে।

বছর দুয়েক আগে মোঙ্গল সেনানায়ক চেঙ্গিস খানকে নিয়ে একটা নিবন্ধ লিখেছিলাম। সেটা পড়ে কেউ কেউ সাঁড়াশি দিয়ে আমাকে চেপে ধরল যে, কেন আমি যুক্তিতর্কের জাল বিছিয়ে চেঙ্গিস খানকে মহান বা নিরপরাধ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি। চেঙ্গিস খান মোটেই নিরপরাধ বা ধোয়া তুলসী পাতা নন। তবে ইউরোপীয় বা আরব ইতিহাসবিদরা তাকে যেভাবে বর্বর হিসেবে বর্ণনা করে, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো? চেঙ্গিস খানের হাতে যারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে, তারা যে ইতিহাস রচনার সময় তার প্রতি সুবিচার করবে না সেটাই তো স্বাভাবিক।

এক্ষেত্রে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদের একটা কথা প্রাসঙ্গিক হবে-

We live in a Eurocentric world. … What we hear and what we think are largely influenced by the perceptions and thinking of the Europeans. Yet, we, non-Europeans, know very little about these people who play such an overwhelming role in every aspect of our lives. What we do know about them is what they tell us about themselves. Naturally, try as they might to be impartial, what they tell about themselves is biased. They cannot help but see themselves in the light they would like others to see them. (৪)

মনে আছে, নবম শ্রেণিতে থাকার সময় ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক লাপিয়েরের লেখা ফ্রিডম এ্যান্ড মিডনাইট পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। গান্ধী-নেহরু-জিন্নাহ-বল্লবভাইকে ছাপিয়ে বইটির প্রধান চরিত্র লর্ড মাউন্টব্যাটেন। বইটি পড়লে মনে হবে, আহা! যেন দেবদূত এক। কঠিন প্রতিকূলতার মুখেও যথাসম্ভব নিরপেক্ষভাবে দেশভাগের মতো জটিল কাজটি সমাধা করতে তিনি উদয়াস্ত ব্যস্ত। আবার দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গা নিরসনেও কী ক্লান্তিহীন পরিশ্রম তার!

অথচ, ইতিহাস খুঁড়ে দেখা যাচ্ছে দেশভাগের কাজটি করা হয়েছিল বড্ড তড়িঘড়ি করে। তাতে মোটেও নিরপেক্ষতা ছিল না। র্যা ডক্লিফের চূড়ান্ত নকশার সাথে কংগ্রেসের প্রস্তাবিত পরিকল্পনার অনেক মিল; কেউ কেউ এমনকি এও বলতে চান যে, কংগ্রেস যা চেয়েছে, র্যা ডক্লিফ তা-ই দিয়েছেন। (৫) আর ১৯৪৭ সালের আগে-পরে সঙ্ঘটিত কয়েকটি দাঙ্গার পেছনে বড়লাটের সায় ছিল। যাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতবর্ষ ভাগ করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর তার ‘সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খানের লেখা The History of Pakistan Army বই থেকে উদ্ধৃত করেছেন –

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের এবং তার পূর্বের দাঙ্গার বিস্তৃত প্রস্তুতির সমস্ত খবর ‘ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট’ ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের কাছে পেশ করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বড়লাট মাউন্টব্যাটেন এবং পাঞ্জাবের গভর্নর জেঙ্কিনস দাঙ্গা রোধ করার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেন নি। (৬)

তাই কে বীর হিসেবে পূজিত হবে আর কে খলনায়ক হিসেবে নিন্দিত, তা নির্ধারণে সত্যের চেয়েও বেশি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইতিহাসবিদের কলম আর একালে মিডিয়ার জোর। যেমন, স্টালিন জীবৎকালে পেয়েছিলেন বীরের সম্মান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়াকে রক্ষা করেছিলেন জার্মানির হাত থেকে। তার মৃত্যুর পর জানা গেল জার্মানির সাথে যুদ্ধে যেখানে দু-কোটি রাশিয়ান প্রাণ হারিয়েছে, সেখানে স্টালিনের হাতে তিন কোটি সোভিয়েত নাগরিকের ভবলীলা সংবরণ হয়েছে।

৩.
বিজয়ী ও প্রভাবশালীর হাতে রচিত মিথ্যাশ্রয়ী ইতিহাস কতটা শক্তিশালী হতে পারে তার আরেকটি প্রমাণ দিই। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিল। অসীম সাহস ও দূরদর্শী পরিকল্পনার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন নাৎসি জার্মানির কবল থেকে ব্রিটেন (ও পশ্চিম ইউরোপকে) উদ্ধার করার দুঃসাধ্য প্রচেষ্টায়। তাই ইংরেজরা তো বটেই ইউরোপিয়নরাও গভীর শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করে। আজো অব্দি তার তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। ২০০২ সালে পরিচালিত এক জরিপে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন হিসেবে তাকেই নির্বাচিত করে ইংরেজরা। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু অ-ইংরেজ ও অ-শ্বেতাঙ্গদেরও কি চার্চিলকে মাথায় তুলে উদ্বাহু হয়ে নাচতে থাকা উচিত?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ষাট লক্ষ ইহুদী হত্যার দায়ে হিটলার নিন্দিত ঘৃণিত অভিযুক্ত। কতশত বই লেখা হলো, হৃদয়স্পর্শী চলচ্চিত্র নির্মিত হলো। অথচ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কথা বলতে বেমালুম ভুলে যান ইতিহাসবিদরা। ভারতবর্ষের বাইরে এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কথা কেউ জানেই না। মানবসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অন্তত চল্লিশ লক্ষ মানুষ ধুঁকে ধুঁকে মারা গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘটা এত বড় একটা ঘটনা সবার চোখ কোনো কারণ ছাড়াই এড়িয়ে গেল? নাকি পরিকল্পিতভাবে মুছে দেয়া হয়েছে ব্রিটিশরাজের ইতিহাস ও চার্চিল মশাইয়ের জীবনী ঝকঝকে করার জন্যে?

কেননা, এই দুর্ভিক্ষ খাদ্যাভাবের কারণে হয় নি, it was manufactured by racist policy of British government. অস্ট্রেলিয়ান জীববিজ্ঞানী ড. গিডন পোলিয়া তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের নেপথ্যে চার্চিলের নেতৃত্বাধীন ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছেন,

“The loss of rice from Burma and ineffective government controls on hoarding and profiteering led inevitably to enormous price rises. Thus it can be estimated that the price of rice in Dacca (East Bengal) increased about four-fold in the period from March to October 1943. Bengalis having to purchase food (e.g landless laborers) suffered immensely. Thus, it is estimated that about 30 percent of one particular laborer class died in the famine. The Bengal famine was a man-made holocaust. The British brought an unsympathetic and ruthless economic agenda to India.” (৭)

অনাহারে মুমূর্ষু লক্ষ লক্ষ বাঙালির জন্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়েক জাহাজ ভর্তি গম নিয়ে আসার কথা ছিল। সেটাও চার্চিলের আদেশে বাংলার বদলে গ্রীস ও যুগোস্লাভিয়ায় পাঠানো হয়। চার্চিলের মন্তব্য ছিল, দুর্ভিক্ষের জন্যে ভারতীয়রা নিজেরাই দায়ী। তারা খরগোশের মতো এত বাচ্চা বিয়োয় কেন? (৮) এই হৃদয়হীন আচরণ ও চল্লিশ লক্ষ বাঙালি হত্যার দায়ে চার্চিলকেও কি হিটলারের মতো ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড় করানো উচিত নয়? অথচ, চার্চিলের শেষকৃত্যে সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়করা হামলে পড়েছিলেন।

নির্মিত ইতিহাস পাঠ করে এ প্রজন্মের বঙ্গসন্তানরা বেড়ে উঠি চার্চিলকে ইতিহাসের মহানায়ক জেনে। ২০০ বছরের শোষণের ইতিহাস ভুলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের জার্সি পড়ে টিভির সামনে নির্ঘুম রাত কাটাই। প্রিয় দলের পরাজয়ে মাতম শুরু করি কিংবা বিজয়ে বিশাল স্ট্যাটাস দিয়ে প্রমাণ করি, হাঁ আমি মেকলে-র সন্তান বটে। চামড়া সাদা না হলে কী হবে, চিন্তাচেতনায় আদি অকৃত্রিম ইংরেজের তল্পিবাহক। দু-চোখ ভরা স্বপ্ন একদিন পাড়ি জমাব প্রভুদের দেশে। হোক না দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে, তাতে কী!
ইঙ্গ-বঙ্গ তুখোড় তার্কিকরা বলবেন, আরে এ তো বিশ্বায়নের যুগ। এখন কি আর স্বদেশ-বিদেশ এসব ধারণা খাটে? নিজেকে গড়ো, যেখানে তোমার মেধার বিকাশ হয়, নিরাপদ জীবন পাবে সে-দেশেই যাও। (আমার এক বন্ধু ঠিক এই যুক্তিটাই দিয়েছিলেন আমাকে)

তাদের উদ্দেশ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সত্তরের দশকে বলে গেছেন, “এ যুগের মানুষ আন্তর্জাতিক হোক- এ প্রত্যাশা তো আমরা সকলেই করি। কিন্তু স্বদেশের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সেই আন্তর্জাতিকতার বৃত্ত রচনা করতে হয়, কেন্দ্রচ্যুত মানুষের ঠাঁই নাই কোথাও।” (৯)

তথ্যসূত্র:
১. Aid in reverse: how poor countries develop rich countries, দ্য গার্ডিয়ান, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭
২. Honest Accounts 2017: How the world profits from Africa’s wealth, গ্লোবাল জাস্টিস নাউ, মে ২০১৭
৩. বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, নবম-দশম শ্রেণি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, পৃঃ ১২৬
৪. Doctor in The House, মাহাথির মোহাম্মদ, এমপিএইচ গ্রুপ পাব্লিশিং, ২০১১, পৃঃ ৩৮৯
৫. The spoils of Partition, জয়া চ্যাটার্জী, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৭, পৃঃ ৫৯-৬০
৬. সাম্প্রদায়িকতা, বদরুদ্দীন উমর মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৬৬, পৃঃ ৩৪
৭. BENGAL FAMINE: Things We Forgot to Remember, BROADCAST ON BBC4 on January 7, 2008
৮. Not his finest hour: The dark side of Winston Churchill, retrieved from www.independent.co.uk, ২৭ অক্টোবর ২০১০
৯. সেরা রম্যরচনা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০০৬

৬,৮৩৫ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “কেন প্রয়োজন ভিন্নপাঠ?”

  1. মোহাম্মদ ওবায়েদুল্লাহ খান ওয়াহেদী

    দারুন লেখা।একটানেই পড়ে ফেললাম ।মাঝেমাঝে দেশের ইদানীং অবস্থা এবং নাগরিক চেতনা হতাশ করে তোলে এই ভেবে যে সব বুঝি হারিয়ে যাচ্ছে। এমন লেখা সব হতাশা ঝড়ে নতুন স্বপ্ন দেখায় - আমার মত হয়তো অনেকের , জাতির , দেশের , দেশের মানুষের। আমাদের সব ছেলেরা যে নেশায় বুঁদ হয়ে নেয় - ভাবতে অহং জাগে।

    ওবায়েদুল্লাহ
    ঝকক

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      ভাইয়া, রূঢ় শোনাবে হয়তো। তবু বলি। ইতিহাস-সমাজ-চারপাশের জীবন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক-বিতর্ক করেছি ক্যাডেট কলেজে। অপ্রাপ্ত বয়সে আমার মতোই অপ্রাপ্ত বয়স্ক সহপাঠী-সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে এসব প্রসঙ্গে কথা বলার মতো আগ্রহী মানুষ তেমন পাই নি আর। Odd Man out !

      লেখাটি যে আপনার ভালো লেগেছে, জেনে অনুপ্রাণিত হলাম। 🙂

      জবাব দিন
  2. 'অনাহারে মুমূর্ষু লক্ষ লক্ষ বাঙালির জন্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে কয়েক জাহাজ ভর্তি গম নিয়ে আসার কথা ছিল। সেটাও চার্চিলের আদেশে বাংলার বদলে গ্রীস ও যুগোস্লাভিয়ায় পাঠানো হয়। চার্চিলের মন্তব্য ছিল, দুর্ভিক্ষের জন্যে ভারতীয়রা নিজেরাই দায়ী। তারা খরগোশের মতো এত বাচ্চা বিয়োয় কেন?'
    মানবিক নেতৃত্বের সংকটে ভুগছে পৃথিবী!

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    প্রথমে পড়লাম। তারপর লগ ইন করলাম শুধুমাত্র এইটুকু বলার জন্য- 'ধন্যবাদ!' দারুণ লেগেছে প্রবন্ধটি, উপস্থাপনা, বিষয়বস্তু, আর্গুমেন্ট, সবকিছু। এমন আরও আরও লেখা পেলে সিসিবি'তে আবার আনাগোনা বেড়ে যাবে 🙂


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      ভাইয়া, শেকড়ের সন্ধানে-১ প্রকাশের পর থেকেই অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আপনার লেখার জন্যে অপেক্ষা করি। কয়েকবার ভেবেছিও যোগাযোগ করি। কিন্তু কোনো সুলুক সন্ধানের কোনো সুরাহা করতে পারি নি।
      লেখাটি পড়ে আপনার ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ 🙂

      জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    গত এক বছর কোন কিছুই তেমন করা হয়নি- পড়া, লেখাও।

    আরও বেশি বেশি করে লিখো। এইসব বিষয় জানার এবং আলাপ করার দরকার আছে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।