বিস্মৃত নক্ষত্রের আলোয়

কবিগুরু যে বছর জন্মগ্রহণ করেন সে বছরই খুলনার রাড়ুলি গ্রামের জমিদার বংশে জন্ম হয় আরেক মনীষীর। তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ‘প্রাণে প্রাণে মুখরিত হন রবীন্দ্রনাথ। তিনি থেকে যান কেমন যেন অজ্ঞাত অন্ধকারে।’ (১) অথচ, আচার্য পি সি রায় ভারতবর্ষে রসায়নের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রথম সার্থক চরিত্র। ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি ও ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি গঠনের উদ্যোগ নিয়ে এই উপমহাদেশে আধুনিক রসায়নচর্চাকে তিনি শক্ত বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। একাধারে রসায়নবিদ, ইতিহাসবিদ, সফল শিল্পোদ্যোক্তা, সমাজকর্মী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক-এরূপ নানাবিধ পরিচয়ের মিশেলে তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির ইতিহাসে আশ্চর্যরকমের ব্যতিক্রমী এক ব্যক্তিত্ব।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

তাঁর পুরো জীবনটাই কেটেছে পরাধীন ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এদেশীয় মানুষেরা একধরনের মানসিক দৈন্যতায় ভুগতেন। শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা যে সবদিক দিয়েই ‘কালা আদমি’-দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ- এটা তাদের মগজে পাকাপোক্তভাবে গেঁথে গিয়েছিল। অবশ্য পূর্বপুরুষদের খামোখা একতরফা তিরস্কার করাটা বড়ই বেইনসাফি হবে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়েছে ৭০ বছর আগে। অথচ মনোজাগতিক দাসত্ব আজো কি দূর হয়েছে আমাদের? শার্টের কলার উঁচিয়ে ফট ফট করে ইংরেজি (কিংবা বাংলিশ) বলতে পারলে তবেই না হ্যাজাকবাতির মতো দাঁত কেলিয়ে উঁকি দেয় স্মার্টনেস ! এখনো বহুলোক আছেন যারা স্বদেশী ঠাকুরকে লাথি মেরে বিদেশি কুকুরের পায়ে উবু হয়ে ঢিপ দিতে একপায়ে খাঁড়া। বলাই বাহুল্য, ব্রিটিশদের দমনপীড়ন ও শোষণের স্বর্ণযুগ উনবিংশ শতাব্দীতে বেশিরভাগ ভারতীয় বিনা বাক্যব্যয়ে ইংরেজদের ঔদ্ধত্য মেনে নিত।

গুটিকয়েক যে-সব ব্যক্তি আপন ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে আত্মসম্মান বিকিয়ে দেন নি তাদের অন্যতম প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তাঁর শিষ্য মেঘনাদ সাহার স্মৃতিকথন থেকে জানা যায়-

স্যার পি.সি. রায় একবার পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু রসায়ন সম্পর্কে বক্তৃতা দেবার জন্য নিমন্ত্রিত হন। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য থেকে আহরণ করে তিনি দুই খণ্ডে তাঁর সুবৃহৎ ‘হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস’ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থ তাঁর রসায়ন শাস্ত্রে ও প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে সুগভীর পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক। … লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বক্তৃতা সভায় স্থানীয় কলেজের একজন অল্পবয়স্ক ইংরাজি অধ্যাপকও ছিলেন। তিনি তখন সবে ভারতবর্ষ এসেছেন। এখানকার সভ্যতায় বা হালচালে বিশেষ আকৃষ্ট হননি। স্যার পি.সি. রায় প্রাচীন হিন্দুদের রাসায়নিক প্রক্রিয়া ও সেই যুগের প্রভূত যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে ছবি এঁকে ব্যাখ্যা করছিলেন। কতকগুলি মাটির ভাণ্ডের ছবি, যার নীচে জ্বাল দিয়ে ঊর্ধ্বপাতন প্রক্রিয়া দ্বারা (Sublimation) মকরধ্বজ ইত্যাদি তৈরী করা হয়। ইংরাজ যুবকটি তাচ্ছিল্যভরে নাক সিটকাচ্ছিলেন এবং হাসি সম্বরণ করতে পারছিলেন না। আচার্যদেব তা লক্ষ্য করে বিরক্ত হয়ে উঠলেন। যন্ত্রপাতির ব্যাখ্যা শেষ করে হাতে এক ঢেলা মকরধ্বজ নিলেন। মকরধ্বজ হল রিসাব্লাইমড (Resublimed) মারকিউরিক সালফাইড। মকরধ্বজের ঢেলা হাতে নিয়ে তিনি বললেন-‘ বন্ধুগণ, আজ হতে দু‘হাজার বছর পূর্বে সেকেলে যন্ত্রপাতির সাহায্যে ভারতবাসীরা এই অপূর্ব ঔষধ প্রস্তুত করে মানবের কল্যাণার্থে ব্যবহার করেছেন, রোগে শান্তি দিয়েছেন- এখনকার উন্নততর যন্ত্রপাতির সাহায্যেও এর চেয়ে বিশুদ্ধ Resublimed mercuric sulphide তৈরী হয়নি। হিন্দুরা সামান্য মাটির ভাণ্ডে এরূপ বিশুদ্ধ রাসায়নিক দ্রব্য তৈরী করেছিলেন কোন সময়ে- প্রায় হাজার বৎসর পূর্বে, যখন আমার ঐ বন্ধুটির (ইংরাজ যুবকটিকে দেখিয়ে) পূর্বপুরুষেরা পশুচর্মে লজ্জা নিবারণ করতেন এবং বন্য ফল খেয়ে জীবনধারণ করতেন। এই কথা বলা মাত্র ভারতীয় শ্রোতারা করতালি দিয়ে উঠল। তরুণ ইংরাজ অধ্যাপক যুবকটি লজ্জায় লাল হয়ে সবেগে ঘর থেকে ছুটে পালালেন। (আচার্য স্মৃতি)

নাকউঁচু ইংরেজদের তুলনায় বাঙালির মেধা যে কোনো অংশে কম নয়, তা বিলেতে পড়ার সুবাদে প্রফুল্লচন্দ্র রায় খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে। কৃতিত্বের সাথে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করার তিন বছর পর ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। উচুঁমানের ডক্টরাল থিসিসের স্বীকৃতিস্বরূপ সে-বছর তাঁকেই প্রদান করা হয় বিখ্যাত ‘হোপ পুরস্কার’। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কেমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হন তিনি। এত যোগ্যতা থাকলে কী হবে, দেশে ফিরে এক বছর বেকার থাকতে হয় তাঁকে। শিক্ষা বিভাগের ইম্পিরিয়াল ক্যাডারে তাঁকে নিতে অস্বীকার করে ঘড়েল ইংরেজ সরকার। অগত্যা সমান যোগ্যতাসম্পন্ন ব্রিটিশ অধ্যাপকদের অর্ধেক বেতনে প্রেসিডেন্সী কলেজে যোগ দেন প্রফুল্লচন্দ্র রায় ।

দীর্ঘ ত্রিশ বছর অধ্যাপনার পর ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। যোগ দেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক স্থাপিত বিজ্ঞান কলেজে। ১৯২২ সালে বয়স ৬০ পূর্ণ হওয়ায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায় অবসর গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কলেজ সিনেটের অনুরোধে সেবারের মতো তিনি অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেন। তবে শর্ত জুড়ে দেন। ১৯২২ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে তাঁর প্রাপ্য বেতনের পুরো অর্থ ব্যয় করতে হবে রসায়ন গবেষণার কাজে। ১৯৩৭ সালে এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লক্ষ টাকা। এই অর্থ দিয়ে বিজ্ঞান কলেজে সৃষ্টি করা হয় দুটি নতুন ‘লেকচারার’ পদ।

আচার্যের শিষ্য ও সহকর্মীরা অবশ্য তাঁর এই উদার আচরণে অভ্যস্ত ছিলেন। অধ্যাপক হিসেবে মাইনে ও বিভিন্ন ভাতা এবং বেঙ্গল কেমিক্যালের ডিরেক্টর হিসেবে পাওয়া বেতন– সবমিলিয়ে তাঁর উপার্জন বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু, এর প্রায় পুরোটাই তিনি ব্যয় করতেন দরিদ্র ছাত্রদের কল্যাণে ও সেবামূলক কাজে। তাঁর ছাত্র বিখ্যাত রসায়নবিদ প্রিয়দারঞ্জন রায়ের জবানিতে রয়েছে- অর্থ ও ক্ষমতার প্রতি তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসিন। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর মোটা ধুতিচাদর ও জামা ছিল প্রফুল্লচন্দ্রর পোশাক। অ্যাসিড পড়ে সেগুলি যেত আবার স্থানে স্থানে ছিদ্র হয়ে। তিনি ছিলেন সাধারণের লোক এবং সাধারণ দুঃখদৈন্যকে বরণ করে নিয়েছিলেন আপন দুঃখদৈন্য হিসাবে। ছোট বড়, ধনী দরিদ্র, পরিচিত সবার কাছেই তিনি ছিলেন অবারিত দ্বার। নামের বদনাম কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারে নী।

কতটা মানবদরদী ও নিজের ন্যূনতম প্রয়োজনের প্রতিও উদাসীন ছিলেন তা আরো পরিষ্কার হবে এই ঘটনা থেকে-
আচার্যদেব থাকতেন বিজ্ঞান কলেজেরই দোতলার একটি ঘরে। তার পাশের ঘরে থাকত কয়েকজন ছাত্র। আচার্য কলা খেতে ভালোবাসতেন। যে ছাত্রটির ওপরে বাজারঘাট করার দায়িত্ব ছিল, সে প্রতিদিন তাঁর জন্যে এক পয়সা দিয়ে দুটি কলা কিনে আনত। একদিন বাজারে গিয়ে সে দেখে বেশ বড়সড় কলা পাওয়া যাচ্ছে। দাম একটু বেশি। প্রতি কলা এক পয়সা। সে ২ পয়সা দিয়ে ২টি কলা কিনল। ভাবল আচার্য নিশ্চয় খুশি হবেন। পি সি রায় কিন্তু দাম শুনেই উত্তেজিত হয়ে গেলেন। অথচ, সেদিন বিকেলেই আশ্রমের জন্যে সাহায্য চাইতে যখন একজন এলো, তিনি নির্দেশ দিলেন তার পেনশন ফান্ডে জমা ২৭৩০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা যেন লোকটিকে দান করা হয়। সকল পার্থিব সম্পদ এভাবে বিলিয়ে গেছেন বলেই বাংলার মানুষ ভালবেসে ‘আচার্য’ উপাধি দেয় তাঁকে। পি সি রায়ের এই বদান্যতার কথা অজানা ছিল না বাংলার বাইরেও। তাঁর সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে পাঠানো চিঠিতে মহাত্মা গান্ধী লিখেছিলেন-

It took my breath away when I heard that out of his princely salary he kept only a few rupees for himself and the rest he devoted to public uses and particularly for helping poor students.

পরবর্তীতে খ্যাতিমান হয়েছেন এমন অনেকে ছাত্রজীবনে পি সি রায়ের অর্থানুকূল্য লাভ করেছেন। ছাত্ররাই ছিল তাঁর আপনজন। তাঁর প্রিয় ছাত্রদের তালিকাটিও দেখবার মতো। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, রাসবিহারী দাস, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, নীলরতন ধর প্রমুখ। প্রেসিডেন্সী কলেজে তাঁর বিদায়ী সংবর্ধনায় তিনি বলেন-
`যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার কার্যকাল শেষ হইবার সময় আমি কি মূল্যবান সম্পত্তি সঞ্চয় করিয়াছি, তাহা হইলে প্রাচীনকালের কর্নেলিয়ার কোথায় আমার ছাত্রদিগকে দেখাইয়া আমি উত্তর দিব- এঁরাই আমার রত্ন।`

তবে তিনি নিতান্ত সমাজবিমুখ নিভৃতচারী পণ্ডিত কিংবা বিজ্ঞানী ছিলেন না। ইংরেজ গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় তাঁর নাম ছিল- ‘বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী।’ কুখ্যাত রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তিনি কলকাতার টাউন হলে দেয়া ভাষণে বলেন- ‘দেশের জন্য প্রয়োজন হলে বিজ্ঞানীকে টেস্টটিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে।’ এই আহ্বানের প্রয়োগ নিজের জীবনেই করেছেন তিনি।

১৯২১ সালে খুলনার দুর্ভিক্ষে, ১৯২২ ও ১৯৩৭ সালে উত্তরবঙ্গের বন্যার সময় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় সংগঠক হিসেবে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি। তাই ১৯৪৪ সালের ১৭ জুন, তাঁর মৃত্যুর পরদিন দৈনিক ‘যুগান্তর’-এর সম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল-
… যেখানে দুর্ভিক্ষ, যেখানে বন্যা, মহামারী, দুর্যোগ-দুর্বিপাক, সেখানেই এই মহাপুরুষকে দেখা গিয়াছে নামের জন্য নয়, বক্তৃতা দিয়ে আসর-মাত করিবার জন্য নয়, ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে দ্বারে ঘুরিয়া সেবার দ্বারা, আশ্বাসের দ্বারা, বিপন্নকে বাঁচাইয়া তুলিবার জন্য তাহার সেই আত্মবিস্মৃত উদ্যম কে না দেখিয়াছেন? ইচ্ছা করিলেই তিনি একটা মস্ত নেতা হইয়া পড়িতে পারিতেন, কিন্তু সে দুর্বলতা তাঁহার ছিল না বলিয়াই তিনি সারা দেশের হৃদয়ে একচ্ছত্র নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হইয়া ছিলেন। …

২.
সত্যি বলতে কি, আচার্য রায়ের আত্মজীবনী ‘আত্মচরিত’ পড়ার আগে তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমার। বইটি পড়ে আমি নিজে খুব অনুপ্রাণিত বোধ করেছি। মনে হয়েছে, ‘আত্মচরিত’ এদেশের সকল শিক্ষার্থীর পাঠ্য হওয়া উচিত। বাঙালি জাতির অনগ্রসরতার কারণ তিনি সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এই বইটিতে। আচার্য লিখেছেন–
বাঙালি আজ জীবন-মরণের সন্ধিস্থলে উপস্থিত। একটা সমগ্র জাতি মাত্র কেরানী বা মসীজীবী হইয়া টিকিয়া থাকিতে পারে না; বাঙালি এতদিন সেই ভ্রান্তির বশবর্তী হইয়া আসিয়াছে এবং তাহারই ফলে আজ সে সকল প্রকার জীবনোপায় ও কর্মক্ষেত্র হইতে বিতারিত। … জাতির ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাবৃত, তাহা বুঝিতে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, তাই বলিয়া আশা-ভরসায় জলাঞ্জলি দিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিলেও চলিবে না। ‘বৈষ্ণবী মায়া’ ত্যাগ করিয়া দৃঢ়হস্তে বাঁচিবার পথ প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে।
p c roy

P C

লর্ড মেকলে প্রণীত শিক্ষানীতি উদ্যোক্তার জাত, অভিযাত্রিকের জাত– বাঙালিকে নপুংসকে পরিণত করে। ‘তখন দেশের দারুণ দুর্দিন। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকারে দেশ পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল। আচার্যদেব দেখিতে পাইলেন বাংলার এই যুবক সম্প্রদায় অভিমানী, সংগ্রামবিমুখ, পরিশ্রমকাতর এবং পরমুখাপেক্ষী। বাঙালির প্রধান অবলম্বন চাকরি। কিন্তু চাকরি কোথায়? বাঙালি যুবককে চাকরির ভিখারি না হইয়া কর্মঠ ও স্বাবলম্বী হইবার আহ্বান তিনি জানাইলেন।’ (৩)

প্রফুল্লচন্দ্র রায় বুঝতে পেরেছিলেন যে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে হলে বাঙালিকে শিল্পোদ্যোক্তা হতে হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন বাঙ্গালীর মস্তিষ্ক আছে- কায়িক পরিশ্রম নিষ্ঠা ও ব্যবসায়বুদ্ধি তার সঙ্গে যুক্ত হলে বাঙ্গালীর দারিদ্র্য ঘুচবে। তাঁর বিশ্বাসের বাস্তব প্রমাণ বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস। বহুকষ্টে জোগাড় করা এক হাজার টাকা মূলধন ও দুইজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন এই প্রতিষ্ঠান। ৩৭ বছরের মাথায় এই কোম্পানির মোট সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ লক্ষ টাকা। প্রায় দুই হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ করত। বলাই বাহুল্য, ভারতবর্ষের বৃহৎ অ্যাসিড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল। বাঙালি ব্যবসা করতে জানে না– বলে যারা টিপ্পনী কাটত তারা আচার্যের এই সাফল্যে বিস্মিত হয়। সারাদেশেই তাঁর এই সাফল্য বহু তরুণকে অনুপ্রাণিত করে স্বাধীন পেশা বেছে নিতে।

৩.
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা বিদায় নিলেও এখনো রয়ে গেছে তাদের জংধরা শিক্ষাব্যবস্থা। যা ধারাবাহিকভাবে এতকাল সরবরাহ করে এসেছে দাস-মনোভাবসম্পন্ন একদল কেরানি। নেই সৃজনশীলতার চর্চা বা পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে সামগ্রিকভাবেই আমরা পিছিয়ে পড়েছি অনেকটা।

তবে, কয়েক শত বছরের নিষ্ক্রিয়তা ও হতাশার শিকল ছিঁড়ে জেগে উঠছে বাংলাদেশ। আপন ঐতিহ্য ও সুপ্ত সম্ভাবনার হিসাবনিকাশ নতুন করে শুরু হয়েছে। আঁধারের বুক চিরে সূর্যের প্রথম আত্মপ্রকাশের মতোই সুন্দর এই সময়ে অনুপ্রেরণার উৎস হোক বাংলার সেইসব কর্মীপুরুষ– যারা জাতির বুকে চেপে বসা নির্জীবতা অসাড়তার জগদ্দল পাথর সরানোর চেষ্টা করে গেছেন জীবনভর। কেননা, তারা জানতেন একদিন না একদিন সত্যিই সফল হবে এদেশের অনাগত প্রজন্ম।।

তথ্যসূত্র:
১. বড়ো মানুষদের চোখে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, শ্যামল চক্রবর্তী, দে‘জ পাবলিশিং, ২০১১
২. আত্মচরিত, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০১৫
৩. লোকসেবক –এ মুদ্রিত শ্রীজ্ঞানচন্দ্র ঘোষের স্মৃতিকথা থেকে

৫,৯৩৯ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “বিস্মৃত নক্ষত্রের আলোয়”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এমন একজন "বিস্মৃত নক্ষত্র" এর উপর আলোকপাত করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কৌশিক। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা আমাদের কৃ্তি সন্তানদের সম্বন্ধে খুব কমই মূল্যায়ন করে থাকি। আর তাদের আলোকজ্জ্বল জীবনীও ধীরে ধীরে স্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
    আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্পর্কে সত্যি বলতে কি, আমারও জ্ঞান খুবই সীমিত ছিলো।

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার এই উপলব্ধি যদি সবার হতো!
      আসলে তাঁর সম্পর্কে জানার পর মনে হলো, এরকম একজন মানুষের সম্পর্কে সিসিবির পাঠকদের জানানোটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
      আশা করি সময় করে 'আত্মচরিত' পড়ে নেবেন। নিঃসন্দেহে চিন্তার দরোজায় সজোরে ধাক্কা দেবে। (সম্পাদিত)

      জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      লুৎফুল ভাই,আপনার মতামত বরাবরই আমাকে অনুপ্রাণিত করে ভালো কিছু লিখতে।
      পূর্বপুরুষের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে, নিজেকে বাঙালি দাবি করা খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। সে- উদ্দেশ্যে পূরণেই এই লেখা। আর হাতেগোনা দু- চারজন খ্যাতিমানের নাম জানলেই কি হয়ে যায়? সৈয়দ আবুল মকসুদের একটি কলামে সেদিন এ ব্যাপারটা চমৎকারভাবে এসেছে-

      নদীর মূল স্রোতের সবচেয়ে পরিষ্কার পানিই নদী নয়, কাদামাটিমিশ্রিত সবটা পানি নিয়েই নদী। একটি-দুটি ফলভারনত বৃক্ষ দিয়ে ফলের বাগান হয় না, তাকে ফলের গাছ বলা যেতে পারে।
      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : লুৎফুল (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।