সমকালীন বিশ্বের ভিন্নপাঠ: আলান কুর্দির মৃত্যু, মানবতাবাদী পশ্চিমা দুনিয়া এবং সংঘাতে লিপ্ত আরব জনগোষ্ঠী

Most people can get along better without a vote than without a roof over their heads. Or without their heads. – Diana Johnstone
Destabilisation is Washington’s tool and game in a time when America’s long-lost economic-capitalist hegemony is fading at an ever accelerating pace. – Paul Street

১৪৫৩ সাল। ২১ বছর বয়সী তুর্কি সুলতান মেহমেত (দ্বিতীয়) বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। দেড় হাজার বছর ধরে অজেয় থাকার পর এই নগরীর শেষরক্ষা আর হলো না। কনস্টান্টিনোপলের আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে পুরো ইউরোপ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। (হাত্তিনের যুদ্ধে কুর্দিশ সেনানায়ক বীর সালাহউদ্দিনের কাছে সম্মিলিত ইউরোপিয়ান ক্রুসেডারদের পরাজয়েও তারা এতটা আতংকিত হয় নি।) কনস্টান্টিনোপল পতনের প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর পর আরেক বার ইউরোপের সীমান্তে আরবদের আনাগোনা শুরু হলো। যথারীতি ভীত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল পশ্চিমা নাগরিকরা।

পার্থক্য একটাই। এই আরবরা নিরস্ত্র; ক্ষুধা গৃহযুদ্ধ আর স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর। ইউরোপে তারা নিরাপদ আশ্রয় চায়। গত দুশ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অক্লান্তভাবে (নিন্দুকেরা উল্টোকথা বলে থাকেন) কাজ করে চলেছেন, সেই পশ্চিমা দুনিয়া ঘরের দরজায় ক্ষুধার্ত ও আশ্রয়প্রার্থী মানুষ দেখে ভড়কে গেল। ভালো করে খিল এঁটে কানে হেডফোন লাগিয়ে জোরসে মিউজিক প্লেয়ার ছেড়ে দিল। এতদিন সে জোর গলায় সবাইকে বলে এসেছে, তার যেহেতু বিপুল পরিমাণ অর্থ-প্রাচুর্য আছে সে ‘উন্নত বিশ্বে‘ বাস করে। তার সেই বিশাল টাকার থলেতে হঠাৎ যেন টান পড়ল। যে কাঁধকে মনে হচ্ছিল হারকিউলিসের মতো চওড়া, অনায়াসে অনেক ভারী বোঝা বহনে সক্ষম; দেখা গেল সে কাঁধ বড় নাজুক।

অতঃপর গৃহযুদ্ধ আর নীরব দুর্ভিক্ষে অতিষ্ঠ উদ্বাস্তুর দল ডুবে মরতে শুরু করল বলকানের দুর্গম পথে, সাগরের নিঃসীম নীল জলে কিংবা কাঁটাতারের সীমানায় পৌঁছার পর তারই মতো কোনো দু-পেয়ের হাতে। বোশেখের দমকা হাওয়ায় তেলের কুপি যেভাবে নিভে যায়, অনবরত মানবাধিকারের বুলি আওড়ানো ঠোঁটগুলো সেভাবে বন্ধ হয়ে গেল। চোখের আড়ে পাহাড় লুকোনোর এই প্রচেষ্টা অনেকখানি সফল হয়েও গিয়েছিল। বাগড়া বাঁধাল তিন বছর বয়সী সিরিয়ান এক শিশু। আলান আল কুর্দি।

তুরস্কের সমুদ্র সৈকতে আলানের স্পন্দনহীন শান্ত-সৌম্য মৃতদেহ ইউরোপকে বাধ্য করল জোর করে বন্ধ রাখা চোখজোড়া মেলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসতে। বিরাট শোরগোল শুরু হয়ে গেল। একের পর এক বৈঠক-সম্মেলনে ক্ষমতাধর সব পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গুরুগম্ভীর আলোচনা করতে লাগলেন। সে সংবাদে ভরে উঠতে লাগল আমাদের খবরের কাগজের পাতা ও টেলিভিশনের পর্দা। ত্বরিত গবেষণার পর যথারীতি এবারও তারা সফলভাবে বলির পাঁঠা খুঁজে বের করলেন।

জ্ঞানভাণ্ডার কতটা সমৃদ্ধ হলো তা জানিনে, তবে আমরা জানতে পারলাম যে, এই শরণার্থী সমস্যা এরকম প্রকট রূপ ধারণ করার মূল কারণ সৌদি আরব, ওমান, কাতার, কুয়েতের মতো ধনী আরব দেশগুলোর নিঃস্পৃহ অমানবিক আচরণ। তারা যদি শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় দিত, তবে কি তারা ইউরোপে পাড়ি জমাত? আমাদের দেশের ফেসবুকি বুদ্ধিজীবীরাও পশ্চিমা মিডিয়া রচিত বেসুরো সেই গানে মহাউৎসাহে তবলা বাজানো শুরু করলেন। তাদের স্লোগান হলো- ‘ইউরোপীয় কিছু ফুটবল দল যেখানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে মানবতার ওপর এই বর্বর আক্রমণে ধনী আরবরা নীরব কেন‘। গরু মেরে জুতা দান করলে যে কখনো হাতেম তাই হওয়া যায় না, সেকথা কে বোঝাবে তাদের? (অবশ্য তারা কখনোই কোনো বিষয়ের গভীরে যাওয়ার বোকামি করেন না। তাতে বায়বীয় জগতের নতুন হুজুগে হুক্কা হুয়া করার সুযোগটা মিস হয়ে যাওয়ার বিরাট সম্ভাবনা থাকে।)

আসলে আমরা সবাই অদ্ভুত এক সময়ে বাস করছি। কোনো সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণ ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে ভাববার ফুরসত মেলে না কারো। কিছু ফটো বা ভিডিও দেখে মুহূর্তের আবেগে প্রবল্ভাবে উত্তেজিত হই, তারপর আবার আফিমগ্রস্ত কমলাকান্তের মতো ঝিমিয়ে পড়ি। ইউরোপিয়ান রাজনীতি ও পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির বর্ষীয়সী বিশেষজ্ঞ ডায়ানা জনস্টোন তাই আলানের মৃত্যুতে পশ্চিমাদের সহানুভূতির জোয়ার দেখে প্রশ্ন তুলেছেন: ‘One photo of a drowned toddler causes a media and political uproar. Are people surprised? Didn’t they know that toddlers were being torn to pieces by US bombing of Iraq, by US drones in Afghanistan, Pakistan, and Yemen? What about the toddlers obliterated by NATO’s war to free Libya’ from its ‘‘dictator’’? The current refugee crisis in Europe is the inevitable, foreseeable, predicted result of Western policy in the Middle East and North Africa.’ (১)

আরব দেশগুলোকে তিনটি কারণে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাচ্ছে না।

১. লক্ষ লক্ষ মানুষ মাতৃভূমি ছেড়ে অজানা দেশের পথে বাঁড়াতে যে বাধ্য হচ্ছে, তার জন্যে কি আরব দেশগুলি দায়ী?
সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান- প্রত্যেকটি দেশে বর্তমানে যে নৈরাজ্য চলছে, তার জন্যে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী পশ্চিমা দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির মনোযোগী দর্শকমাত্রই জানেন, আজ যে সিরীয়রা উদ্বাস্তু হয়ে (প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ, জনসংখ্যার ৫০%) তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারাই একদিন উদ্বাস্তু ইরাকিদের বুকে টেনে নিয়েছিল। দিয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়।

১৯৯০ সালে ইরাকিরা ঘর ছেড়েছিল অর্থনৈতিক অবরোধের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে। প্রায় ৩৩ লক্ষ ইরাকি (যার মধ্যে সাড়ে সাত লক্ষই শিশু) এই অবরোধে মারা যায়। (২) অর্থনৈতিক অবরোধ কে আরোপ করেছিল? আম্রিকা ও তার চ্যালা-চামুণ্ডারা। কেন আরোপ করেছিল? কারণ, ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম সকল প্রকার আন্তর্জাতিক নীতি উপেক্ষা করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কুয়েত আক্রমণ করেছিল। (যতদূর মনে পড়ে পানামা, কিউবা, লিবিয়া, ভিয়েতনাম, গুয়াতেমালা প্রত্যেকটিই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। তবে এ ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদের টোটকা শিরোধার্য- ‘রাজার পা** গন্ধ থাকে না‘) সাদ্দাম কুয়েতে হানা দেয়ার সাহস কীভাবে পেল এ আবার আরেক রহস্য। (৩)

ইরাকিরা সেই অবরোধের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই মার্কিনিরা ২০০৩ সালে ইরাক (একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র) আক্রমণ করল। সাদ্দামকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হলো। ভেঙ্গে পড়ল সে-দেশের অর্থনৈতিক প্রশাসনিক কাঠামো। শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। গত বারো বছরে যুদ্ধের কারণে সাত লক্ষ বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। ২৮ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লেবানন, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল উদ্বাস্তু পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা। তাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্যেই যে আজো আফ্রিকা যুদ্ধপীড়িত মহাদেশ তা এক প্রকার Open Secret। (উদাহরণস্বরূপ,বছর চারেক আগে পুরো পৃথিবীকে কাঁচকলা দেখিয়ে আফ্রিকার বৃহত্তম দেশ সুদানকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হলো। Thanks to US Diplomats & Mr. Handsome- George Clooney!) এতদিন যে আফ্রিকানরা ইউরোপে অবৈধভাবে পাড়ি দিতে পারে নি তার কৃতিত্ব মুয়াম্মার গাদ্দাফির। হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী মানুষকে শুধুই ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করেন নি তিনি, বরং টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমে নিজ দেশে ও লিবিয়ায় তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করেছিলেন। গাদ্দাফির পতনের পর আজ সেই লিবিয়া থেকেই প্রাণভয়ে পালাচ্ছে মানুষ। পালমিরায় অমূল্য প্রত্নসম্পদ ধ্বংস করছে বর্বর আইএসআইএস। পশ্চিমা মিডিয়ায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে খবর আর বিশেষজ্ঞদের বিলাপ প্রচার করা হচ্ছে। ফাঁকতালে তারা এটাও বলছেন যে এই অরাজকতা বন্ধ করতে হলে আসাদকে পদত্যাগ করতে হবে। এই জঙ্গি সংগঠনের উত্থানের দায়ভার কার? বাশার আল আসাদের, আরব রাষ্ট্রগুলোর নাকি খোদ বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের? (৪)

২. আসলেই কি ধনী আরব দেশগুলি প্রতিবেশী দেশের বিপদে এগিয়ে আসে নি?
খোদ UNHCR এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ সিরীয় শরণার্থী ইউরোপে নিরাপদ আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছে। অনেক দেন-দরবার করেও পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী দেশগুলো (যারা তথাকথিত উন্নত বিশ্বের সদস্য) একত্রিত হয়ে এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দিতে একমত হতে পারে নি। হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান কাঁটাতারের বেড়া ও প্রাচীরের দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে ঠেকিয়ে রাখছেন শরণার্থীদের। যারা সে-দেশের সীমানার ভেতরে ঢুকে পড়েছে তাদেরকে গরু-ছাগলের মতো মানবেতর অবস্থায় রাখা হয়েছে। সম্প্রতি চেক প্রজাতন্ত্রে একটি জরিপ করা হয়। ৭১% মানুষ কোনো শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার বিপক্ষে ভোট দেন। যেখানে সাড়ে তিন লক্ষ শরণার্থীকে ইউরোপের ৩৮টি দেশ মিলে আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে তুরস্ক, লেবানন, মিসর, ইরাক ও জর্ডানে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ৪০ লক্ষ সিরীয় শরণার্থী। এরপরও আরব দেশগুলোকে ক্রমাগত দোষারোপ করে গেলে ইউরোপের নির্লজ্জতা বড় অশ্লীলভাবে বেআব্রু হয়ে পড়ে।

৩.আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ জেনেও উদ্বাস্তুরা কেন ইউরোপে পৌঁছার জন্যে ব্যাকুল?
১৯১৬ সালে সাইকস- পিকটের চুক্তির আওতায় আরব বিশ্বকে ভাগ বাটোয়ারা করে তৎকালীন দুই পরাশক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স। আজকে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতার মূল কারণ ইউরোপের ভ্রান্তনীতি ( অবশ্যই ঠাণ্ডামাথায় করা ভুল)। মাশুল কিন্তু গুণতে হচ্ছে আরব নাগরিকদের। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, ইউরোপ বারবার তাদের আবেদন ফিরিয়ে দেয়ার পরও সিরীয় ও লিবীয় শরণার্থীরা কেন ইউরোপে পৌঁছার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে?

চোখ কান খোলা আছে এরকম প্রত্যেকটি সুস্থ মস্তিষ্কের আরব দিব্যি দেখতে পারছে যে ওই অঞ্চলের কোনো দেশই আর নিরাপদ নয়। গিলোটিনের নিচে এরপর কার মাথা ঢুকবে কেউ জানে না। কিন্তু, আজ হোক কাল হোক বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের স্থপতিরা তাদের গর্দান না নিয়ে ছাড়বেন না। তাই বাঁচতে হলে ইউরোপে পালাও। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের সনাতন Survival Instinct কখনো ভুল পরামর্শ দেয় না।
তাই সর্বস্ব বাজি রেখে আরবরা পাড়ি জমাচ্ছে ইউরোপের পথে। কারণ, একবার পৌঁছতে পারলে তারা মুক্তি পাবে দুঃস্বপ্ন থেকে। হঠাৎ উড়ে আসা কোনো মারণাস্ত্র নিমেষে ধূলায় মিশিয়ে দেবে না তার ঘর কিংবা মুহুর্মুহু গুলির শব্দে ভাঙ্গাবে না ঘুম। সকালবেলা পরিবারের কোনো সদস্য বা বন্ধুর লাশ বইবার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সে যে-কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।

আপনি যেহেতু নিরীহ বাংলাদেশের নিরীহ শান্তিকামী নাগরিক, মধ্যপ্রাচ্য আর ইউরোপের মধ্যে উদ্বাস্তু নিয়ে দড়ি টানাটানিতে আপনার আগ্রহ নাও থাকতে পারে। তবে বিষয়টা কী, এটা বিশ্বায়নের যুগ। শুধু প্রযুক্তি আর বিনোদন ও ক্রীড়া জগতেরই বিশ্বায়ন ঘটে নি, সন্ত্রাস-ও Globalized হয়েছে! আজকের পৃথিবীতে কোনো জাতির জীবনেই আড়াল আবডাল বলে কিছু নেই। বহু অর্থ খরচ করে বানানো লোহার ঘর সাপের হাত থেকে লখিন্দরের প্রাণ বাঁচাতে পারে নি। ছিদ্র থেকে গেছে ঠিকই। তাই, আগুন হয়তো লেগেছে অনেক দূর-গাঁয়ে, কিন্তু আপনার বসতবাটি পুড়তে কতক্ষণ? প্রযুক্তি তো শুধু ইন্টারনেটের গতি বাড়ায় নি, মারণাস্ত্রের সক্ষমতাও বাড়িয়েছে। সাধু সাবধান।।

তথ্যসূত্র:
১. http://www.counterpunch.org/2015/09/07/turning-the-cradle-of-civilization-into-its-graveyard/
২. ইরাকের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধে বেসামরিক প্রাণহানির ওপরে FAO এর পক্ষে একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেন ম্যারি স্মিথ ( অধ্যাপক, স্কুল অফ পাবলিক হেলথ,হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়) ও সারাহ জায়দি (পরিচালক, বিজ্ঞান বিভাগ, সেন্টার ফোর সোশ্যাল এন্ড ইকনোমিক রাইটস, নিউইয়র্ক)। সমীক্ষার ফলাফল ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ মেডিকেল এ্যাসোসিয়েশনের প্রভাবশালী সাময়িকী দি ল্যান্সেটে প্রকাশিত হয়।
৩. মার্গারেট থ্যাচার ফাউন্ডেশন ১৯৯০ সালে ইরাকে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এপ্রিল গ্ল্যাস্পি ও সাদ্দাম হোসেনের কথোপকথনের একটি ট্রান্সক্রিপ্ট প্রকাশ করে। তাতে জানা যায়, সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করার আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাথে কথা বলেন। এপ্রিল গ্ল্যাস্পি তাকে বলেন, ‘‘প্রতিবেশী দুটি আরব দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাবে না। কুয়েত ইস্যু আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না।’’ ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই (কুয়েতে ইরাকি আগ্রাসনের দুই দিন আগে) যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেলী কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেন- ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতকে রক্ষা করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয় এবং ইরাক যদি কুয়েত আক্রমণ করে তাহলে কুয়েতকে রক্ষা করার কোনো ধরনের ইচ্ছা আমাদের নেই।’’
৪. সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে, “The move by Russia to bolster the government of President Bashar al-Assad, who has resisted Mr. Obama’s demand to step down for years, underscored the conflicting approaches to fighting the Islamic State terrorist organization. While Mr. Obama supports a rival rebel group to take on the Islamic State even as he opposes Mr. Assad, Russia contends that the government is the only force that can defeat the Islamic extremists.”
কি পরিমাণ ঔদ্ধত্য থাকলে থাকলে এ কথা বলা যায় যে, আসাদের পদত্যাগ চেয়ে ওবামার যে দাবি, তা আসাদ resist করছেন! অর্থাৎ, আমেরিকার মূলধারার গণমাধ্যম এখন আর রেখেঢেকে না বলে সরাসরি বলছে- কোন দেশ কে শাসন করবে তা ঠিক করবে মার্কিনরা। যে-কোনো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার মতো এটাও মার্কিনদের মৌলিক অধিকার।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এতদিন ধরে মধ্যপন্থী বিদ্রোহীদের কথা বলা হলেও, বাস্তবে সিরিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তারা কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, সৌদি আরব ও কাতার। যারা এ কথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান, তাদের জন্যে-
ক) ২০১২ সালে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফ্যাবিয়াস বলেন, Al Nusra Front was “doing a good job on the ground. পরের বছর মার্চের ১৩ তারিখ তিনি ঘোষণা দেন, France and Britain were going to deliver arms to the rebels. খ) মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগন গত শুক্রবার বাশার আল-আসাদের বিরোধী সংগঠনগুলোর (সম্ভবত ইয়েতি জাতীয় প্রাণী- যা মর্ত্যের মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে) জন্য ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থগিত করেছে ।

পশ্চিমা বিশ্ব প্রযোজিত সোপ অপেরায় সর্বশেষ সংযোজন হলো জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী উরসুলা ফন ডার লাইয়েনের বক্তব্য। তিনি বলেন, ‘সিরিয়ায় আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী সংগঠনকে লক্ষ্য করে রাশিয়া যদি হামলা চালায়, তবে এতে রাশিয়ার স্বার্থও রক্ষা হবে না। আমাদের স্বার্থও রক্ষা হবে না।‘ এর চেয়ে পরিষ্কারভাবে আর কি বলা যায়?

৩,৫০৩ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “সমকালীন বিশ্বের ভিন্নপাঠ: আলান কুর্দির মৃত্যু, মানবতাবাদী পশ্চিমা দুনিয়া এবং সংঘাতে লিপ্ত আরব জনগোষ্ঠী”

  1. ইশরাক (২০০৮-২০১৪)

    কৌশিক ভাইয়া আপনার ডিবেটের ধার একটুকুও যায় নি। রিসোর্সফুল।। গর্ব হয় আমি আপনার হাউজের একজন। আপনার সান্নিধ্যে ছিলাম 🙂


      হারিয়ে যাইনি তবু এইত জরুরী খবর
      আকাঙ্ক্ষা আর হতাশায় হারিয়ে যাওয়ার কোন মানে নেই।

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    প্রথম দুটি উদ্ধৃতিই পারমানবিক বোমার মতোন শক্তিমান কথার উচ্চারণ।
    আর গোটা লেখাটাতে সেই সুদূর অতীত থেকে আজকের দিনটি পর্যন্ত ঘটমান নাটকের দৃশ্য ও দৃশ্যের অন্তরালের দৃশ্য সহজ সংক্ষিপ্ত আংগিকে উঠে এসেছে সুন্দর গ্রন্থনায়।
    তেল, গ্যাস, মোড়লীপনা, সোনা-দানা, টাকার কারখানা, অস্ত্র বেচার বেকুব আস্তানা ~ এই হলো সকল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা আর আগ্রাসনবাদের শেকড়। যাকে নির্মুল করতে গেলে সেই রূপকথার গল্পের রাক্ষসের মতোন প্রতি রক্তফোঁটায় জন্ম নেয় আরেক রাক্ষস।
    দারুন লিখেছো ভাই।

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      সাম্রাজ্যবাদ তার খোলস বদলে আধুনিক ও চলনসই হয়েছে। একই সাথে বিশ্বজুড়ে সবাই অজান্তে সেই ভয়াল রাক্ষসের পিঠে চেপে বসেছে। গন্তব্য যে নিরেট আঁধারে, তাতে তার খেয়ালই নেই।

      সিসিবিতে বেশ কিছুদিন অনিয়মিত থাকার পর গত মাসে ঢুঁ দিলাম।
      তারপর থেকে গভীর আগ্রহ নিয়ে আপনার লেখা পড়ছি। মন্তব্যগুলোও নিটোল মুগ্ধতা ছড়ায়।
      অনুপ্রাণিত হলাম, ভাইয়া 🙂

      জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    দূর্দান্ত আর্গুমেন্ট, আর প্রায় নিচ্ছিদ্র তথ্য+যুক্তিভিত্তিক সমর্থন।
    পুলাপাইন এতো বস হয় কি করে ::salute::

    সরাসরি প্রিয়তে......


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    নিজেদের প্রয়োজনে ওরা যাকে ইচ্ছা উপরে তোলে, যাকে ইচ্ছা আছাড় মারে!
    এক আজব জিনিস এই 'পশ্চিমা স্বার্থ'!

    লেখা দারুণ হয়েছে। :clap:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  5. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আজকে রাতের জন্যে চলে গিয়েও লেখাটিতে চোখ বোলাবো বলে রয়ে গেলাম।
    বেশ কদিন আগে এলেও খুব আসতে পারিনি এদিকে।
    ভাষা এবং যুক্তির উপর দখল দেখে ভীষণই মুগ্ধ হলাম।
    তোমার এটাই ব্লগ নয় যদিও, আমার মনে পড়ছেনা তোমার আগের লেখাগুলো পড়েছিলাম কি না।
    আরো লেখা চাই। সাম্প্রতিক বিশ্ব নিয়ে (অথবা যে কোন কিছু নিয়েই!) তোমার ভাবনাগুলো আমাকেও ভাবাচ্ছে।

    জবাব দিন
    • কৌশিক(২০০৪-২০১০)

      অনুপ্রেরণা যোগাল আপনার মন্তব্য, ভাইয়া। 🙂
      লিখতে তো আমিও চাই। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। কবিগুরু স্বয়ং তা বর্ণনা করেছেন-

      ' যতক্ষণ একটা লেখা চলতে থাকে ততক্ষণ মনটা বেশ শান্তিতে থাকে- সেটা শেষ হয়ে যাবামাত্রই আবার একটা নতুন বিষয়ের অন্বেষণে নিতান্ত দিশেহারার মত, লক্ষ্মীছাড়ার মত, চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে হয়।'

      আপাতত সেই 'ঘোরা'র ঘূর্ণিতে আছি। দু-একবার এরকম ঘুরপাক খাবার অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আপনারও হয়েছে? (সম্পাদিত)

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।