প্রাঙ্গণে মোর…

খুব সম্ভবত: আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্র। ক্যাডেট কলেজে এই শ্রেণিটি সুপরিচিত ‘ক্লাস এলিভেন’ নামে। এই শ্রেণির ছাত্রদের একটা বিশেষ প্রকটিত বৈশিষ্ট্য হলো-‘ফার্স্ট ইয়ার ড্যাম কেয়ার’। অনেক প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে প্রায় প্রত্যেকটি ছাত্রের ভেতর এই মনোভাব কমবেশি ফুটে উঠে। সেই সাথে চলে চারপাশের জগতের কাছে নিজেকে প্রতিনিয়ত আরো আধুনিক ও স্বতন্ত্র করে তুলে ধরবার প্রয়াস। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয় ফ্যাশন সচেতনতা আর নিজস্ব ভঙ্গিমা। আমাদের সময়টায় একাদশ শ্রেণির ছাত্রদের শ্রেণিপাঠ্যের সীমানা ছাপিয়ে মজে যেতে দেখেছি আধুনিক গল্প-উপন্যাস-সাহিত্য-কবিতা-গানে। ওষ্ঠের উপরে গোঁফের রেখা দিনে দিনে যত স্পষ্ট হতে থাকে, কিশোর বয়সে অঙ্কুরিত বালকসুলভ এডভেঞ্চারের নেশাও এই সময় ততোটাই পরিবর্তিত হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়।

মনে পড়ে, হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটি আমি প্রথম দেখি আমার বন্ধু ও ক্লাসমেট গোলাম ফারুকের রুমে। কলেজ লাইব্রেরি থেকে তুলে আনা। গোলাম ফারুক তখন আমাদের হাউসে বন্ধুদের মাঝে তারুণ্যের আইডল। আমরা সবাই তাকে কমবেশি অনুসরণ করি। সেই বয়সে আমার নান্দনিকতা-বোধ ছিল শিশুতোষ। আজ এই বইটির প্রচ্ছদ আমার বোধের ফুলদানিতে অনিন্দ্যসুন্দর একটি গোলাপের মহিমায় শোভিত। কিন্তু বয়ঃসন্ধির দিনগুলিতে সেটি ছিল একটি লজ্জা-মিশ্রিত অস্বস্তিকর নিষিদ্ধ নেশার মতো। সেই নেশা এমনই তীব্র সম্মোহনী যে, প্রচ্ছদ উল্টে ভেতরে ঢুকবার আগ্রহকে মুহুর্মুহু চাগিয়ে দেয়, একসময় উদগ্র করে তোলে।

অবশেষে একদিন বইটি পড়বার সুযোগ হয়। একটানে শেষ করে ফেলি প্রথমবার। তারপর ধীরে ধীরে, কল্পনায় প্রত্যেকটি ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে। সে সময় বেশ ক’বার বইখানা পড়েছি। এতবার হয়ত পড়বার দরকার ছিল না। কিন্তু তখনও হৃদয়ের অপচয়কে কৃপণের বাম মুঠি ভাবতে শিখিনি। পড়তে পড়তে একসময় আমি নিজেকে বইটির খোকা চরিত্রটির প্রতিরূপ ভাবতে শুরু করেছি। সেই খোকা, যার নিম্নমধ্যবিত্ত সুখ-দুঃখগুলো আমার ভালোবাসার অতি সাধারণ আকাশ জুড়ে মেঘের ভেলার মত ভাসতে থাকে। কখনো সাদা, কখনো ধুসর। মাঝে মাঝে আজন্ম সলজ্জ সাধ হয়ে আকাশে উড়তে চায় ফানুসের মত। কিন্তু ফের ভোকাট্টা ঘুড়ির মত আটকে যায় পাতা ঝরে যাওয়া গাছের মগডালে। সেখানেই আটকে থাকে অধরা আকাঙ্ক্ষার মত। তারা যেন অপূর্ণ বাসনার মতো, না পারে উড়তে আকাশে, না ছোঁয় মাটি। সেই খোকার প্রিয় গান, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়…’।

ক্যাডেট কলেজের গণ্ডির ভেতরে বাড়তি কিছু চাহিবামাত্র পাওয়া অনেক দুষ্কর! ক্ষেত্র-বিশেষে তা অসম্ভবও বটে। একাদশ শ্রেণিতে উঠবার পর বাসস্থান যদিও তিনতলাতেই থাকলো, তবু কক্ষ পরিবর্তন করে আমাদের চলে যেতে হলো পশ্চিমের ব্লকে। পশ্চিমে সীমানার ভেতরে ঘাস-ছনে ছাওয়া বিশাল মাঠ, বাইরে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত। মাঝে বড় শীর্ণদেহ-ধুসর-মলিন-অসহায়-ক্ষুদ্রকায় সীমানা প্রাচীর। আমাদের কক্ষে তিনটে জানালা; পুবে একটি, পশ্চিমে দু’টি। তবু দিগন্ত যে বহুদূরে — সেখান থেকে কোনরূপ সুর ভেসে আসবার উপায় নেই। অথচ কি সহজেই না পাশের বাড়ির জানালা গলে প্রিয় গানের সুর ভেসে এসে খোকার জানালায় পৌঁছোয়। ক্লান্তি-বিহীন ফুল ফোটানোর খেলা চলে খোকার মনে। বাইরের জগতের সাথে এই ছিল আমাদের মনজাগতিক পার্থক্য।

আমাদের এই সব অপ্রাপ্তির বেদনার ভার কিছু কিছু শিক্ষক বুঝতেন, কেউ কেউ একেবারেই বুঝতে চাইতেন না। যারা বুঝতেন, তাঁদের কাছে আমরা অনেক ঋণী। যারা বুঝতে চাইতেন না, তাঁদের কাছেও ঋণী। বাঁধ ভাঙা জোয়ারের যেমন আছে উচ্ছ্বসিত বেগ, বাঁধ বাঁধা জলাধারের আছে অমিত শক্তি। পছন্দ-অপছন্দের তালিকায় নাম লিখিয়েও এ কথাটি তারা আমাদের ভেতরে বুনে দিয়েছেন। কেউ প্রাণের উচ্ছ্বাসে, কেউ কর্তব্যের নিগূঢ় তাগিদে। আমাদের বিফল বাসনাগুলো মনের ভেতরেই ঘুরে ঘুরে গুমরে গুমরে কথা কইত। এক ধরণের অস্পষ্ট অলীক পাপবোধ আমাদের অভিব্যক্তিকে করে তুলত অধোবদন। সেও তো ওই ‘নন্দিত নরকে’-র রাবেয়ার ঘুরে ঘুরে সেই কথা ক’টি বার বার বলবার মতো। সেও তো রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে যাবার মতো।humayun ahmed

৪,৫৬৭ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “প্রাঙ্গণে মোর…”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    ওষ্ঠের উপরে গোঁফের রেখা দিনে দিনে যত স্পষ্ট হতে থাকে, কিশোর বয়সে অঙ্কুরিত বালকসুলভ এডভেঞ্চারের নেশাও এই সময় ততোটাই পরিবর্তিত হয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। - সব ক্যাডেট কলেজের সব একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য বোধ হয় এ কথাটা সার্বজনীন সত্য।
    কিন্তু তখনও হৃদয়ের অপচয়কে কৃপণের বাম মুঠি ভাবতে শিখিনি। - বাহ, কি চমৎকার করেই না বললে!

    অল্প কথায় একটা বিশেষ সময়ের, বিশেষ পরিবেশ পরিস্থিতিতে একটা বিশেষ বয়সের মনজাগতিক অভিপ্রায় অনুভূতিকে খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছো। খুব ভালো লাগলো তোমার লেখাটা পড়ে।
    সিসিবিতে আমার বিচরণ বেশীদিনের নয়, বছর দেড়েকের মত হবে। কিন্তু যখন এসেছিলাম, তখন সিসিবি খুবই প্রাণচঞ্চল ছিলো। এখন এটাকে ধূসর মরুভূমির মত মনে হচ্ছে। পোস্টের সংখ্যা খুব কম, মন্তব্য নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় এখানে তোমার প্রত্যাবর্তন দেখে খুবই আনন্দিত বোধ করছি। আশাকরি নিয়মিত আসবে এখন থেকে। এর আগে তুমি যখন এখানে লিখতে, তোমার লেখা পোস্ট ও মন্তব্যগুলো খুবই উপভোগ করতাম।

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
      কিন্তু তখনও হৃদয়ের অপচয়কে কৃপণের বাম মুঠি ভাবতে শিখিনি। - বাহ, কি চমৎকার করেই না বললে!

      নিজের কথা নয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দ ভৈরবী' থেকে ধার করা।

      লেখাটি পড়বার ও সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, স্যার। আমারও সেই প্রাণবন্ততায় প্রত্যাবর্তনের অভীপ্সা জাগে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করবার পর যেটুকু সময় বেঁচে যায়, তা নিতান্তই অপ্রতুল ও অবসাদে নিমজ্জিত। তাই হয়ে উঠে না। এজন্য সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
      • খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

        আমারও সেই প্রাণবন্ততায় প্রত্যাবর্তনের অভীপ্সা জাগে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রের চাহিদা পূরণ করবার পর যেটুকু সময় বেঁচে যায়, তা নিতান্তই অপ্রতুল ও অবসাদে নিমজ্জিত। তাই হয়ে উঠে না। - সেটা বেশ বুঝি। তার পরেও এই যে মাঝে মাঝে এসে আমাদের লেখাগুলো পড়ে যাও, এবং সময় পেলে মন্তব্যও করো, সেটার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

        জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লেগেছে।
    যদিও হুমায়ুন আহমেদ এর প্রতি কৈশোরের সেই মুগ্ধতা আর নেই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।