ঘুমন্ত-স্বপ্ন-সুন্দরী

একসাথে অনেকগুলো বই কিনে ফেলার অনেক হ্যাপা। কোনটা ছেড়ে যে কোনটা পড়ব তা কিছুতেই মনঃস্থ করে উঠতে পারি না। একাঝাঁক সুন্দরী ললনা চারদিক ঘিরে লীলারত। কাকে ছেড়ে কাকে প্রেম দেব?

অমিতাভ রায়ের ভাষান্তরে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর গল্পসমগ্রটি কেনার পর সেটি একরকম অবহেলা অনাদরেই সেলফের এককোণে পড়ে ছিল। আজ সময় হলো হাতে তুলে নেবার। শুরুতেই একটি চমৎকার গল্প! বাংলা ভাষান্তরে ‘সুপ্ত সুন্দরী ও বিমান’ আর মূল স্প্যানিশে ‘El avión de la Bella Durmiente’ এর নাম। যাদু-বাস্তবতা? নাকি মার্কেসের বাস্তব জীবনেরই রোজনামচা।

গল্পে মার্কেস একজন প্রৌঢ়। বিমানের প্রথম শ্রেণিতে ভ্রমণ করছেন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইউরোপে। মার্কেস যা প্রায়শঃই করতেন। আবার গল্পের প্রৌঢ়টির সাথেও মার্কেসের জীবনের অনেক মিল। তাই বর্ণনা যত পাখা মেলতে থাকে, গল্পটির সাথে বাস্তবের বহুবিধ মিল ততই পরিষ্কার হয়। এয়ারপোর্টে দেরী হওয়া, পথে নানাবিধ বিঘ্ন, সাত নম্বর সিটের বদলে চার নম্বর সিট পসন্দ করা, ‘তুমিই শুধু চার নম্বর পসন্দ করলে’, কাউন্টারের ভদ্রমহিলার একথা বলে উঠা, এসবের বিস্তারিত বর্ণনায় গল্পটি তো বাস্তবেরই অনুষঙ্গ হয়ে উঠে।

তবু কোথায় যেন গল্পটি একটি রূপকথার মতো।  শিরোনামটিতে কি? ‘ঘুমন্ত সুন্দরী…’, আহা!

মার্কেস কি গল্পটিতে বাস্তবের সাথে স্বপ্নের মিশেল ঘটিয়েছেন? তাই কি মনে হয়, ‘বাস্তব কখনো কখনো কল্পনার চাইতেও অভিনব’?

গল্পের প্রৌঢ় নায়কটির ‘ভাগ্য’ বেশ সুপ্রসন্ন। গল্পের প্রৌঢ়টি বিমানবন্দরে সুন্দরী রমণীটিকে দেখতে পায়। তার কথা ভাবতে থাকে, মনে মনে তাকে কামনা করতে থাকে। তারপর সে সাত নম্বর সিটের বদলে চার নম্বর সিট পসন্দ করে। আর সবশেষে কাকতালীয়ভাবে সুন্দরীটির সিটের পাশেই তাঁর সিট পড়ে। সুতরাং গল্পটার অনেকটা জুড়ে যে মিহি দানায় মিশে আছে সৌভাগ্যের কিছু সুখকর উপকরণ, একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবু সৌভাগ্যের আনুকূল্য লাভের পরেও সুন্দরীটি অবশেষে অধরাই থেকে যায়। তাই মনে করি, গল্পের থিম হলো, ‘তৃপ্তির অতৃপ্তি’। নাকি ‘অতৃপ্তির তৃপ্তি’?

ওহে সুন্দরী, তুমি ঘুমন্ত, স্বপ্ন দেখছ হয়ত, অথবা তুমি নিজেই তো একটি স্বপ্নের মতো, কিংবা স্বপ্ন জাগানিয়া, নিখুঁত সুখের মতো, — বড় অপার্থিব।

তবু তো তোমার বিচরণ এই বাস্তবে, দিবাস্বপ্নের পিলসুজে দীপাবলি জ্বালো, ঘুমন্ত গোলাপ কুঁড়ির মত, — বড় পার্থিব।

মুহূর্তেই মনোলোক ছুঁয়ে যাও তুমি, তবু থেকে যাও স্পর্শের অতীত।

তাই তো স্বপ্নই তুমি, নাকি স্বপ্ন সেটিই — যেটি আমি রচনা করি হৃদয়ের অতল গহনে?

২৪ টি মন্তব্য : “ঘুমন্ত-স্বপ্ন-সুন্দরী”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    বেশ লাগলো মোস্তফা ভাই। পুরো গল্পটি পড়তে ইচ্ছে করছে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    🙂 🙂 🙂 🙂

    ঈদের ভোজ শেষে রাতে একশো বছরের সেরা গল্প নিয়ে শুয়ে ছিলাম নিচতলার কাউচে। সমরেশ মজুমদারের সম্পাদনায় এই বইটি শুরু হয়েছে রবি ঠাকুরের গল্প দিয়ে। বহুবার পড়া ক্ষুধিত পাষাণ পড়তে পড়তে আবারও কোথায় যে হারিয়ে গেলাম! শুরুর গল্পটি শেষ হতেই আমি শেষেরটির দিকে গেলাম। মতি নন্দীর জলের ঘূর্ণি ও বকবক শব্দ পড়লাম একটানে। ছোট গল্পের এই যে শেষ হইয়াও হইল না শেষ আবহটি মনের গলি ঘুপচিতে ঘুরপাক খায় অনেকক্ষণ। লেখকের আঁকা একটি ছবি, একটি দৃশ্যকাব্য ফিরে ফিরে আসে বারবার!

    দুটো সোনালি বড়ি সাথে না থাকলে কি মাকর্েজের এই গল্পটি অন্য রকম সুরভি ছড়াতো? কল্পনায় কত সহজেই না ছুঁয়ে আসা যায় সুদূরের মানুষটিকে, পাশের জন হয়তো চির অধরাই থেকে যায়!

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      ধন্যবাদ বোন, শুরুতেই কবুল করে নেই আমার পাঠ পরিধি বড় সীমিত। ঈদের ভোজনের অবস্থাও তথৈবচ। আমার 'শুধু দু'টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ'। আর কদাচিৎ একটু আধটু গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়া। তবে হ্যাঁ, আমি দ্রুত ও বহুপঠনে অপটু হলেও খুব নিবিষ্ট পাঠক। কবিতা কিম্বা গল্প নিয়ে মাঝে মাঝে পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখলে তাই সামগ্রিক জ্ঞানের স্বল্পতাহেতু একটি কবিতা বা গল্পের উপরই আলোচনা সীমিত রাখতে হয় আমাকে। তোমার উদ্ধৃত 'ক্ষুদিত পাষাণ' পড়েছি বটে, তবে মতি নন্দী পড়িনি। শুনেছি তিনি লিখেন ভালো।

      দুটো সোনালি বড়ি সাথে না থাকলে কি মাকর্েজের এই গল্পটি অন্য রকম সুরভি ছড়াতো?

      বইটি আমার হাতের কাছেই আছে। অমিতাভের অনুবাদে আক্ষরিক কোন 'সোনালি বড়ির' সন্ধান পেলাম না। তবে কি তুমি সুন্দরী ও শ্যাম্পেন এই দুইয়ের কথা বলতে চাইছো? স্বল্পবোধ মানুষের জন্যে একটু খোলাসা করেই না হয় বল!


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
      • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

        মনে পড়ে মেয়েটি বিমানে উঠে খাবার জল চেয়েছিল স্টুয়াডর্ের কাছে? When he brought the water, she placed a cosmetics case with copper corners, like a grandmother’s trunk, on her lap, and took two golden pills from a box that contained others of various colours.

        জবাব দিন
        • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

          হ্যাঁ, আমার মনে হয় এটিও রূপকের একটি চমৎকার ব্যবহার। সেই বাক্সে তো নানা রংয়ের অনেকগুলো বড়ি ছিল। তবে সে সোনালি বড়ি বের করলো কেন? আমার মনে হয়, বাক্সটির ভেতরে রাখা বড়িগুলি তার একেকটি চারিত্রের প্রতিভূ। 'সোনালি', সেটি হয়ত স্বপ্নিলানুভূতি ছড়াবার অনুষঙ্গ। সেই অর্থে এই গল্পে সুন্দরীর অন্যকোন রঙের বড়ি বের করা দুঃসাধ্য ছিল। অন্ততঃ লেখক তা হতে দিতেন না।


          দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

          জবাব দিন
          • সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

            লেখকের মনের কথা শত রূপকে লেখা যেতে পারে। কে জানে মেয়েটি হয়তো দীর্ঘ ফ্লাইটটি সতি্য সতি্যই ঘুমোতে চেয়েছিল! At last she pulled down the shade on the window, covered herself to the waist with a blanket without taking off her shoes, put on a sleeping mask, turned her back on me, and then slept without a single pause, without a sigh, without the slightest change in position, for the eight eternal hours and twelve extra minutes of the flight to New York.

            জবাব দিন
            • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

              তাও হতে পারে। গল্পটিতে যে ডজন ডজন বাস্তবের অনুষঙ্গ আছে, আমি তো তা আগেই বলেছি। কিন্তু আবার দেখ, একেবারে বাস্তবানুগই যদি হবে তবে 'like a grandmother’s trunk' শব্দগুচ্ছই বা এলো কেন? পাঠককে দূর অতীতে নিয়ে স্বপ্নালু করে তুলবার জন্যে? এমনটি তাঁর 'One Hundred Years of Solitude'-এ মুহূর্মুহূ ঘটতে দেখি।


              দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

              জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      রাজীব, গল্পটি সত্যিই অনন্য। তবে আমি মনে করি সেটি যাদু বাস্তবতার কারণে নয়? আমার কাছে 'যাদু বাস্তবতা'-কে নতুন কোন প্রপঞ্চ বলে মনে হয় না। আমাদের লোক-কাহিনীগুলোতে অমন যাদু-বাস্তবতার কত্ত উপকরণ ছড়িয়ে আছে। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  3. সাইদুল (৭৬-৮২)

    বড় ঝকঝকে লেখা। তবে তার চেয়ে ভালো এই লাইনটাঃ

    আমাদের লোক-কাহিনীগুলোতে অমন যাদু-বাস্তবতার কত্ত উপকরণ ছড়িয়ে আছে। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলি


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
      আমাদের লোক-কাহিনীগুলোতে অমন যাদু-বাস্তবতার কত্ত উপকরণ ছড়িয়ে আছে।

      জানেন স্যার, প্রথিতযশ অনেক অধুনান্তিক লেখক-অনুবাদকের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। তাঁরা এটা মানতেই চান না। আমিও আমার মতে অনড়। যাক ক্বচিৎ মতের মিল খুঁজে পেলে খুব শান্তি লাগে, অন্তত একঘরে হয়ে যাবার শঙ্কাটা কাটে।


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    "ওহে সুন্দরী, তুমি ঘুমন্ত, স্বপ্ন দেখছ হয়ত, অথবা তুমি নিজেই তো একটি স্বপ্নের মতো, কিংবা স্বপ্ন জাগানিয়া, নিখুঁত সুখের মতো, — বড় অপার্থিব।
    তবু তো তোমার বিচরণ এই বাস্তবে, দিবাস্বপ্নের পিলসুজে দীপাবলি জ্বালো, ঘুমন্ত গোলাপ কুঁড়ির মত, — বড় পার্থিব।
    মুহূর্তেই মনোলোক ছুঁয়ে যাও তুমি, তবু থেকে যাও স্পর্শের অতীত।
    তাই তো স্বপ্নই তুমি, নাকি স্বপ্ন সেটিই — যেটি আমি রচনা করি হৃদয়ের অতল গহনে?" - বড় চমৎকার লাগলো এই কথাগুলো।
    শিরোনামটাও বড় চিত্তাকর্ষক!

    জবাব দিন
  5. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    স্বপ্নের পিলসুজে দীপাবলি জ্বালো, ঘুমন্ত গোলাপ কুঁড়ির মত,
    মনোলোক ছুঁয়ে যাও, তবু থেকো স্পর্শের অতীত।

    মার্কেজের "যাদু বাস্তবতা" তো নয় যেনো "বাস্তবতার কথকতায় বোনা কোনো যাদুটোনা" !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।