সোনালি ডানার চিলগুলো

HE REPROVES THE CURLEW

O CURLEW, cry no more in the air,
Or only to the water in the West;
Because your crying brings to my mind
passion-dimmed eyes and long heavy hair
That was shaken out over my breast:
There is enough evil in the crying of wind.

[The Wind Among the Reeds, W.B. Yeats, 1899]

হায় চিল

হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর কেঁদো নাকো উড়ে-উড়ে ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে!
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আনো? কে হায় হৃদয় খুঁড়ে
বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে!

[মহাপৃথিবী, জীবনানন্দ দাশ, ১৯৪৪]

ইয়েটস এর ‘Curlew’ জীবনানন্দে শুধু ‘চিল’ নয়, ‘সোনালি চিল’ও নয়, বরং ‘সোনালি ডানার চিল’। ‘চিল’টি যেন একই সাথে বাস্তবের ও স্বপ্নলোকের। ‘চিল’টি নয়, চিলের ডানাটি সোনালি। সোনালি ডানার মাঝে একটি চমৎকার নন্দনতাত্ত্বিক আবহ সঞ্চারিত হতে দেখি। সোনালি ডানাটি চিলেরই কি শুধু? মনে হয়, শুধু তাই নয়। এ কি তবে কবির স্বপ্নভূক উড়ুক্কু মন? বুঝি, কবিকে ক্লাসিসিজম নয় রোমান্টিসিজমই টানে বেশী। তিনি পুরাণ কিম্বা স্ক্রিপচার থেকে ‘ইকারূসের ডানা’কে উপমা হিসেবে আহরণ না করে তাঁর চারদিককার জীবন ও প্রকৃতির হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে সোনালি ডানার চিলকেই জীয়ন্ত তুলে আনেন। খাঁটি দেশাল।

অসাধারণ কোমল বিষন্ন এক চিল। উড়ুক্কু, গগণবিহারী, উদাসী, স্মৃতিভূক, হিংস্রতা বিবর্জিত। এক একটা দিন স্বপ্নজীবি ডানা মেলে সারাদিন উড়ে বেড়ায়, উড়ে উড়ে দেখে তার ‘ম্লান চোখ’, আর বাতাসে ছড়ায় হারানোর বেদনার ঘ্রাণ। এই মাটি-জল, এই ধানসিঁড়ি নদীটির পাশ, একদিন রাঙা রাজকন্যার মতো ছিল, আজ নেই, পৃথিবীর আরো অনেক বিলুপ্ত মাটি-জলের মতো সেও রূপ নিয়ে দূরে চলে গেছে।

একজন ইংরেজি ভাষাভাষী কাব্যমোদীর কাছে ‘Cry no more in the air’ কথাটির আবেদন হয়তো অনেক গভীর, কিন্তু জীবনের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে খাঁটি দেশজ স্বাদে ‘মন ও মননের মধু’ যারা পান করতে ভালোবাসেন তাঁদের কাছে ‘কেঁদো নাকো উড়ে উড়ে’ অনেক বেশী ঐশ্বর্য্যমন্ডিত মনে হয়। ক্রম বিলুপ্তি কবলিত আপন মাটি-জলের সমস্ত কান্নাকে বুকে নিয়ে এই চিল উড়ে উড়ে বাতাসে কান্নার ঘ্রাণ,  বেদনার হাহাকার ছড়াতে থাকে। ‘The water in the West’ ‘ধানসিঁড়ি নদীটি’র ভাবার্থক। তবে আমাদের আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, কবি নিজস্বতাকে সাথী করে বাংলার মায়া ভরা পথেই হাঁটছেন। এখানেই রুপসী বাংলার কবিতে কবিসত্ত্বার উন্মেষ। তেমনি ‘ম্লান চোখ’ ও ‘passion-dimmed eyes’ হয়তো সমার্থক। কিন্তু সেই ‘ম্লান চোখ’ ‘বেতের ফলের’ উপমার নির্ভেজাল জীবনানন্দীয় নিজস্বতায় একেবারে দেশজ হয়ে উঠে।

ইয়েটসে ‘long heavy hair’ আর জীবনানন্দে ‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো রূপ’। ‘দূরে’ কি অনন্ত যাত্রার ইঙ্গিতবাহী? সীমার মাঝে কি অসীমের সুর, Sublime? জীবনানন্দে পাই, ইয়েটসে পাইনা।

‘আবার তাহারে কেন ডেকে আনো’ তো বার বার ফেরারই আকুতি।

সবচেয়ে মোহিত করে সেই চুম্বক পঙক্তিটি, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’, ইন্দ্রিয়ানুভূতির কী অপূর্ব যূথচারী অনুরণন, ‘There is enough evil in the crying of wind’ এর চাইতে অনেক বেশী কাব্যময়, মাদকতাময় নয় কি?

No poet, no artist of any art, has his complete meaning alone. His significance, his appreciation is the appreciation of his relation to the dead poets and artists. You cannot value him alone; you must set him, for contrast and comparison, among the dead. I mean this as a principle of aesthetic, not merely historical.

[Selected Prose, T.S. Eliot, 1958]

ইংরেজি সাহিত্য জীবনানন্দকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করেছিলো। অনুকরণের চোরাবালিতে নিমজ্জিত করেনি। বুঝি, কতটা সচেতনভাবে তিনি সৃজনশীলতার পাত্রটি ভরেছেন ভিন্নসাধের সমৃদ্ধতর প্রাণমদিরায়। তাই তো তিনি বিশাল সুন্দরবনের সুন্দরীগাছ। সজনের কাছে অবিদিত ছিলেন, কিন্তু প্রতিদিনই আবিস্কৃত হচ্ছেন মহৎ হতে মহত্তর রূপে।

২,০৪৯ বার দেখা হয়েছে

২৭ টি মন্তব্য : “সোনালি ডানার চিলগুলো”

    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
      চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা ...
      long heavy hair ...

      পার্থক্যটুকুন দেখুন।

      আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, প্রথমটিতে কবি 'চুল'-কে সাথে 'নিশা' অর্থাৎ রাত্রির রূপকে প্রস্ফুটিত করেছেন, তাই তো! দ্বিতীয়টিতে, অর্থাৎ 'long heavy hair' কোন রূপকের ব্যবহার নেই। সেখানে আছে 'long' ও 'heavy' বিশেষণ জুড়ে দিয়ে 'hair' কে বিশেষায়িত করবার প্রয়াস।

      আবার প্রথমটিতে ফিরে আসি। এমনটা কল্পনা করে দেখি তো!

      মনে করি, কবি প্রথম লিখেছিলেন,
      'চুল তার নিশা'
      রাত্রির রূপকে চুল এলো তো! এলো তবে তেমন করে এলো না। কবির মন কাড়তে পারলো না।

      তারপর ভাবলেন দূর অতীতে যে বিদিশা নগরী, সেই নগরীর অন্ধকারের রূপটি বুঝি চুলের ঘনত্বকে আরো চমৎকার করে তুলবে। লিখলেন,
      'চুল তার বিদিশার নিশা'
      প্রবল সৌন্দর্যবোধ সম্পন্ন কবির তাও মনে ধরলো না। তার কাছে 'বিদিশা'-কে বর্তমানের অন্যান্য নগরীর মতো দিনের আলোয় উদ্ভাসিত বলে মনে হলো।

      তাই কেটে-কুটে আবার লিখলেন,
      'চুল তার অন্ধকার বিদিশার নিশা'
      এই বার বুঝি হলো। উঁহু, সে তো আপনার আমার কাছে। জীবন বাবুর কাছে তো নয়! কারণ তিনি তো এসেছেনই অভুতভাবিত বচনে আমাদের চমকে দিতে।

      আমাদের চমকে দিয়ে তাই লিখলেন,
      'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা'
      সেই সাথে অনুপ্রাসের কেমন মোহন দোলা, 'চুল তা কবেকা অন্ধকা বিদিশার নিশা'।
      এমনই পারফেকশনিস্ট ছিলেন আমাদের এই কবি। (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মোস্তফা ভাই,
    কবিতার এমন নিবিষ্ট পাঠকের কাছ থেকে একটি নিবিড় আলোচনা পেয়ে, প্রিয় কবির প্রিয় কবিতার, ভাষা খুঁজে পাই না। ঠিক এ জিনিষটিরই অভাব বোধ করছিলাম বড়, জানেন? কবিতার পেছনের গল্প যে কবিতাকে বুঝবার কী পরিমাণ রসদ যোগায়!

    এমন আরো বহু আলোচনার পথ চেয়ে রইলাম

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      আমার মতে, ব্লগের একটা বিশেষ সুবিধা হলো, পোষ্ট করা একটি লেখায় শুধু লেখকের অবদান থাকে না, মন্তব্যে-প্রতিমন্তব্যে, আলোচনায়-সমালোচনায় লেখাটিকে সবাই সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করে তোলেন। চলতে থাকে মন্তব্যের পিঠে প্রতিমন্তব্য। ব্লগ তো শুধু এমন নয় যে, নিজের লেখা পোষ্ট করলাম, আত্মতৃপ্ত হবার জন্য কে কেমন প্রশংসা করলেন তা এসে দেখলাম, তারপর মিহি ভাষায় ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলাম। এখানে প্রতিটি লেখায় প্রতিটি ব্লগারের অবদান রাখার সুযোগ আছে। তা যত ক্ষুদ্র আর বিপুল হোক। আসো না কেন, আমাদের যার যতটুকুনই আছে তা নিয়েই আমরা এই সংস্কৃতি জোরে-সোরে শুরু করি। মন্তব্যে-পাল্টা মন্তব্যে জমে উঠুক আসর। তবেই তো আর পথ চেয়ে বসে থাকতে হয় না। পথই পথিককে টেনে আনে। (সম্পাদিত)


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
    • লুৎফুল (৭৮-৮৪)

      নূপুর, একদম ঠিক বলেছো। এই মিথস্ক্রিয়াটিই আমি চাইবার আকুতি উচ্চারণ করছিলাম।
      বেশ ক'দিন আগে বলছিলাম। এমন যদি হতো লেখা নিয়ে ল্যাবের টেবিল ঘিরে বসলাম আড্ডায়।
      তবে ছুরি হাতে সবাই সমান দক্ষ নয়, এমনকি সেভাবে পারংগমও নয়।
      আমাদের সেই ঘাটতি মনে হয় উবেছে। এমন আড্ডা চলুক। আমাদের আরো শানিয়ে তুলুক।
      মোস্তফার ছুরিতে আমরা চকমকি দেখি মুগ্ধতায়।
      চলুক। জোর চলুক।

      জবাব দিন
  2. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    কাব্য সাহিত্যের আলোচনা সমালোচনা গুলি সচারচর বেজায় কঠিন, নীরস এবং মূল লেখার চেয়ে বেশী দূর্বোধ্য লাগে আমার কাছে। মোস্তফার লেখাটা উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম। জীবনানন্দের এই কবিতাটা আমার বিশেষ প্রিয়। সুন্দর আলোচনা, উপরি পাওনা হিসাবে ইয়েটস-এর কবিতার সাথে প্রতিতুলনা, ফলাফলে চিল আমার আরো আপন হল। "বেত ফলের মত" চোখ- বলতে কি এমন অদ্ভূত অথচ সার্থক উপমা বোধ হয় খুব বেশি নেই।

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      মাহবুব ভাই, মন্তব্যে ভীষণ নাড়িয়ে দিয়ে গেলেন।

      passion-dimmed eyes
      বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ

      প্রথমটিতে কোন উপমা নেই, দ্বিতীয়টিতে আছে। বেতের ফল যে দেখেছে সে এই উপমার সার্থকতা পরিমাপ করতে পারবে, যে দেখেনি সেও কি কল্পনা করবে কম কিছু?
      কেউ একজন বলে গেছেন, 'উপমাতেই কবিত্ব'!


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    জীবনানন্দ সহ ত্রিশের কবিরা ভালোমতো পশ্চিম গুলে খেয়েছেন। এটা পশ্চিমের কাছে আমাদের এক ধরণের ঋণ।
    আশার কথা অনুবাদে বা ভাবানুবাদে বা যেভাবেই বলি না ক্যানো কবিতাগুলো নতুন করে স্বার্থক কবিতা হয়েছে।

    অনেক টা মাখনের কারবারির কাছ থেকে কিছুটা মাখন নিয়ে ঘি বানানো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ইকারুসের ডানা এই কারণে আসবে না কারণ ইকারুসের ডানায় স্বপ্ন যেমন আছে তেমন স্বপ্নভঙ্গের প্রগাঢ় বেদনা আছে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)

      ইকারুসের ডানায় যুগপৎ স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের প্রগাঢ় বেদনা আছে, কথাটা সত্যি। চিলের ডানার ক্ষেত্রেও তাই। স্বপ্নটি প্রচ্ছন্ন ও অনুচ্চারিত, বেদনাটি প্রকটিত ও প্রকাশিত,

      কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

      'ক্লাসিসিজম' আর 'রোমান্টিসিজম'-এর আলোচনা অন্য কোন দিনের জন্য তোলা রইল। 🙂


      দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

      জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    দেশীয় উপমার অলংকরণে শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ এর মত এতটা সিদ্ধহস্ত আর কেউ ছিলেন বা আছেন কিনা জানিনা।
    Yeats এর কথাগুলোও বর্ণনাত্মক, তবে উপমাহীন। passion-dimmed eyes and long heavy hair নিশ্চয়ই descriptive, তবে "বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ" শুধু descriptive ই নয়, reflective ও বটে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।