আমি বাংলায় কথা বলি (কিঞ্চিৎ আপডেটেড)

[ ডিসক্লেইমারঃ প্রায় এক বছর আগে লেখা, নিজের ব্লগের কোনায় ফেলে রেখেছিলাম। একটু ঝেড়ে মুছে ঢাললাম আজ।
বানান এবং লেখা সংক্রান্ত যে কোন পরামর্শ আমন্ত্রিত। ]

অ.

জন্মের সাথে সাথেই নাকি আমি কাঁদিনি, সবাই খানিকটা আশঙ্কিত ছিলো- বাক-প্রতিবন্ধী নয় তো! ডাক্তার সাহেব কষে দু’ঘা লাগাবার পরই চিৎকার করে অস্তিত্বের জানান দিলাম। তবে কথা বলতে খুব একটা দেরি করিনি; বছর পেরুবার আগেই বেশ ভালো বুলি ফুটেছিল। অনন্য-সাধারণ কিছু রাগিণীর স্রষ্টা হয়ে বাড়ি মাতাতে মোটেও কুণ্ঠিত ছিলাম না। দ্রুতগতির বাক্য প্রয়োগের কারণে স্কুলে আমার নাম হয়ে গেলো রেলগাড়ি ঝমাঝম। তখনও জানতাম না, অদূর ভবিষ্যতেই কখনো বাংলায় প্রাণ খুলে কথা বলবার জন্য আঁকুপাঁকু করতে হবে। পেরুলো সময়, পেরুলো কাল; আর আমি পাড়ি জমালাম- বহুজাতিক এক নগরীতে। এখানে নানান ভাষার ছড়াছড়ি; যথারীতি এক ইংরেজিই যে কত ঢং-এ শুনতে হয়, তার ইয়ত্তা নেই। সপ্তাহ খানিকের মাঝেই ভয়াবহ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। দু’দণ্ড বাংলায় কথা বলবার; নিদেনপক্ষে একটা বাংলা গালি দেবার অদম্য ইচ্ছেটা খুটখুট করে মনের ভেতর বাড়াবাড়ি রকমের ভেজাল করত। সপ্তাহান্তে হঠাৎই একদিন হায়দ্রাবাদী রিয়াজ আমাকে ক্যাফিটেরিয়ার কোনের টেবিলে দেখিয়ে দিলো; একটু নাদুস নুদুস চেহারার এক হাসিখুশি ছেলে আড্ডা জমিয়ে বসে আছে। ওর সাথে টেবিলের পাশে দাঁড়ালাম, একটু আড়ষ্ট ভঙ্গিতেই। পুরো মার্কিনী উচ্চারণে ইংরেজির তুবড়ি ছুটিয়ে তখন পুরো আসর মাতিয়েই চলেছে ছেলেটা। প্রমাদ গুনলাম; প্রথম পরিচয়েই হয়তো, “ইয়ো ম্যান! হোয়াস’সাপ?”- এর এক পশলা বাড়ি খেতেই হচ্ছে। আমাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে সের খানিক হাসি দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “কি খবর মিয়া? কবে আসছো? তোমাকে বোধহয় প্রথম দেখছি।” এরপর সেই যে গল্প শুরু হয়েছিল তার শেষ আজো হয়নি। এতদিন পরেও বেশ বুঝতে পারি, মনের ভেতর আটকে থাকা কথাগুলো সেদিন হড়বড় করে বলে ওকেই খানিকটা চমকে দিয়েছিলাম। কৃতজ্ঞতাটুকু কখনোই জানানো হয়নি সেদিন মুক্তির স্বাদ দেবার জন্য।

আ.

ফেব্রুয়ারি আসলেই বেশ মাতামাতি শুরু হয়ে যায়, আবার মাস পেরুলেই হয়তো প্রায় পুরো আমেজটাই হয়তো কিছুটা চুপসে যায়। যদিও আবেগের দাঁড়িপাল্লাটা কখনোই কমে না। ব্যক্তিগত উপলব্ধির কথা বলি। বছরের একটা দিন কিংবা একটা মাসকে ঘিরে এত আলোড়ন হয়তো কিছুটা বাহুল্য মনে হতে পারে। তবে মন অন্য কথা বলে। বাংলা ভাষাকে আমরা সবাই বারো মাসই ভালোবাসি। একুশে ফেব্রুয়ারিটা একটা উপলক্ষ, যাকে কেন্দ্র করে আমাদের ভালোবাসা, ভাষা শহীদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আসলে শুধু উপলক্ষ বললে বোধহয় এটাকে ছোট করা হয়। ২১ তো কেবল একটা সাধারণ সংখ্যা কিংবা শুধু মাত্র একটা ইতিহাস নয়। একটা ভাষা আর সে ভাষাভাষীদের টিকে থাকবার জন্য সংগ্রামের গল্প। আর এ গল্পের প্রকাশমূল্যঃ রফিক, শফিক, সালাম, জব্বারসহ সকল ভাষাশহীদের তাজা রক্ত। এটা মানি, এ আত্মত্যাগ কেবল একদিনের কোঠায় সীমাবদ্ধ নয়; কিন্তু এ দিনটা বিশেষ সমারোহে উদযাপনে আমার আপত্তি নাই। কেন যেন মনে হয়, এভাবে ভালোবাসা জানান দিতেও অদ্ভুত শান্তি মেলে।

ই.

বাংলা লিখা বা পড়ার চর্চাটা বেশ কমে গিয়েছিলো। হাতের কাছে বাংলা বই পেতাম না তেমন, আর প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন না থাকায় সেভাবে লেখা হতো না। মাঝে মধ্যে ক্যালকুলাস নোটগুলোয় বাংলা শব্দগুলো আঁকিবুঁকি করতাম, ওটুকুই যেন ছিলো আমার যেমন ইচ্ছে লিখবার বাংলা খাতা। এরই মধ্যে ২০০৮ এর গোড়ার দিকে, একদিন পুরনো অভ্যাস বশত “বাংলাদেশ ক্যাডেট কলেজ” লিখে সার্চ করতে গিয়ে ওয়ার্ডপ্রেসে সিসিবির পুরানো প্লাটফর্মটা খুঁজে পাই। লেখা ছিলো সব মিলিয়ে ৫-৬টা; কিন্তু অনেকগুলো মন্তব্য। প্রতিদিন ক্লাস থেকে এসে গুঁতোতাম। কিন্তু মন্তব্য করার সাহস হতো না, লেখা দেয়া তো দূরের কথা। পাঠক জন্মকে সার্থক করতে প্রতিদিন নতুন লেখা খুঁজি, না পেলে পুরানোটাই মুখস্থ করি। এরই মাঝে একদিন অভ্রের সন্ধান পাই। তারপর, একটু একটু করে প্রতিদিন সাহস জমা করে, একদিন ঝপ করে একটা মন্তব্য করে ফেলি। প্রতি-মন্তব্যটা সম্ভবত আদনান ভাইয়ের ছিলো। এভাবে সিসিবির প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার আমার চিরচেনা ভালো লাগার, ভালোবাসার বাংলায় ফিরেছিলাম।

ঈ.

ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগের এই মাসে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি সকল ভাষা শহীদদের প্রতি; যাদের জন্য আমি আজ বাংলা বলছি, পড়ছি এবং লিখছি। আর বিশেষ ধন্যবাদ দুটি ভিন্ন মঞ্চের জন্য বরাদ্দ। সিসিবি আর ওমিক্রন ল্যাব (অভ্র কি-বোর্ড)- যাদের জন্য আমি আবারও উপলব্ধি করেছি; বাংলায় লিখতে পারা বাঙ্গালির জন্য কত সাবলীল, কতটা সুখকর।

ছবি সৌজন্য: নাসির ভাই
ছবি সৌজন্য: নাসির ভাই


আজকে কোন গান শেয়ার করবো না, বরং কবিতা আবৃত্তি শোনা যাক। আবৃত্তি করেছেন; থাক বলবো না। বরং নিজেরাই দেখে বলুন চিনতে পারেন কী না!! (সাউন্ড কোয়ালিটির জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)

আমি কি রকম বেঁচে আছি- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় [আবৃত্তি- নন্দঘোষ (ছদ্মনাম)]

এ’কবিতার শেষাংশটুকু বড় নাড়া দেয়ঃ

নিজের দু’হাত যখন নিজেদের ইচ্ছে মতো কাজ করে
তখন মনে হয় ওরা সত্যিকারের। আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় একপলক সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশী নেই আর।

২,৯১২ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “আমি বাংলায় কথা বলি (কিঞ্চিৎ আপডেটেড)”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    ইমোশনাল ব্লগ, সিরিয়াস ব্লগ, ঝাড়ি দিতে পারছি না বলে গা কুটকুট করতেসে...
    তাছাড়া ভাল মেজাজে আছি, বাংলাদেশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখে পুরাপুরি বিমোহিত (ভারতের জি-সিরিয়ালটুকু ছাড়া)...
    লেখা অত্যন্ত আবেগীয় হয়েছে...

    জবাব দিন
    • রকিব (০১-০৭)

      কাটা ঘাঁয়ে আর নুনের ছিটা দিয়েন না। নিজের মাটিতে বিশ্বকাপ আর আমি কানাডায় বইসা অনলাইন স্ট্রিমিং-এর লিঙ্ক খুঁজি :(( :((
      অফটপিকঃ মন্তব্য বড় আবেগীয় হয়েছে। :grr:


      আমি তবু বলি:
      এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

      জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    লেখার স্পিরিটটা খুব ভাল লাগলো।

    আমি শুনেছি, টরন্টোতে কেউ কেউ গ্যাড়াকলে পড়ে কখনো কখনো ইংরেজিতে কথা বলে 😀

    তুই-ফেইক ভাই আবৃত্তি সলিড ছিল 🙂


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন
  3. সাব্বির (৯৮-০৪)

    এখানে তৌফিক ভাইয়ের পুরা পারফরম্যান্স বোঝা যাচ্ছেনা। ক্লাশ নাইনে থাকতে "স্বাধীনতা তুমি" নিয়ে স্টেজ এ উঠসিলাম ওনাদের সাথে। জুনিয়র থাকায় বিনয় দেখায়া না না করলেও, ভালো পজিশন পাবার আশা নিয়া, শেষে তব্দা লাইগা ছিলাম কিছুক্ষন। তৌফিক ভাই ফার্স্ট ১০৭ পয়েন্ট নিয়া আর আমি থার্ড ৯৮। যে সেকেন্ড (ওমর ভাই) তার পয়েন্ট ১০২।
    তার পরও মন্দের ভালো যে "লাল" চ্যাম্পিয়ন হয়ছিলো ব্যাপক লিডে B-) ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : বন্য (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।