আজ মন খারাপের দিনে

আজ সকালে তুহিন ভাইয়ের পোষ্ট দেখার পর থেকেই কলেজ জীবনের সবচেয়ে কষ্টের স্মৃতিটা খুব বেশি মনে পড়ছিল। অশ্রূ ভেজা দুটো চোখের সামনে আমার অসহায়ত্বের ছবি বারবার ভেসে উঠছিলো। সেই জমাট বাধা কষ্টের প্রলাপ বকেই আজ সিসিবিতে আমার ব্লগিং ইনিংসের শুরু হলো।
আমি ছিলাম বদর হাউসে আর আশিক হুনাইনে। যে কোন গেমসেই ওর মারাত্নক ভালো পারফরম্যান্সের জন্য অন্য কলেজের অনেকেই ওকে চিনতো। আশিকের মা অনেক দিন যাবৎ অসুস্থ ছিলেন, বেশ কবার ভারতেও গিয়েছিলান চিকিৎসার জন্য। সেবার ইলেভেনের এক্সকারশনের পর ছুটিতে গিয়েছি। সারাদিন ফার্মগেট নয়তো বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে গিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াই; হঠাৎ করেই আসার দুদিন আগে শুনলাম আশিকের মা মারা গেছেন। ওর কোন মোবাইল নম্ব্রর না থাকায় কল দিতে পারিনি। টার্মের শুরুতে কলেজে পৌছে দেখি আশিক তখনও ছুটিতে। ও আসলো তিনদিন পর। আমরা তখন গেমস করছিলাম, রাস্তা দিয়ে ওকে হেটে আসতে দেখেই দৌড়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলা উচিত, কেমন জানি একটা বেদনার্ত অনুভূতি হচ্ছিল। গাধার মতো জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছিস দোস্ত?” (প্রশ্নটা করেই বুঝতে পেরেছিলাম ভুল সময়ে এটা বলে ফেলেছি) একগাল হাসি দিয়ে আশিক বললো, “ভালো।” ওর ঐ চিরচরিত হাসির মাঝে খুব অপরিচিত একটা দুংখের ছায়া ঘুরে ফিরছিলো, একটা চাপা কান্না যেন গুমরে কেদে মরছিল ওর চাহনিতে। কলেজের অনেক নিয়ম আর শিক্ষার ভিড়ে শোকার্ত হবার ভংগিমাটা ভুলে বসেছিলাম, সান্তনার ভাষাগুলোও কেমন ফীকে হয়ে গিয়েছিলো।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। এক শুক্রবার কলেজে আর্মি ব্যান্ডদল হাজির হল। মনে হয়, তারা তখন সবগুলো কলেজেই ঘুরে ঘুরে পারফর্ম করছিল।ফ্রী-নাইটটা মাটি করে অডিটরিয়ামে গিয়ে বসলাম। আমি আর আশিক কোণার দিকে পাশাপাশি বসেছি। গান শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে আবিষ্কার করলাম কেন যেন আর মোটেও বিরক্তি লাগছে না, আসলেই ভাল গাইছিল। তো একেবারে শেষদিকে এসে ব্যান্ডের ভোকাল বললেন, “এবারে আমি ক্লোজআপ-ওয়ানের একটা গান গাবো (ক্লোজআপ-১, ২০০৫)।” রাশেদের (ক্লোজআপ-ওয়ানের সেরা ১০ এর একজন) “মা” গানটা শুরু করলেন উনি……মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। হঠাৎ টের পেলাম আশিক মাথা নিচু করে আছে, আর নিঃশব্দে ওর দু চোখ থেকে পানি ঝরছে। কাধে হাত রাখতেই আশিক আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না, আমার হাত চেপে ধরে ফুপিয়ে কেদে উঠলো, এতোদিনের চেপে রাখা কষ্টগুলো যেন বাধভাঙা স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছিল। ওকে সান্তনা দেবার জন্য আমার কোন ভাষা ছিল না, নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। ওর শোকাশ্রুর প্রতিটা ফোটা আমাকে ছুয়ে যাচ্ছিলো। ওকে ধরে বাইরে নিয়ে গেলাম। লনের একপাশে বসে যখন আশিকের কান্না দেখছিলাম, আমার নিজের ভিতরেও যে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। মায়ের মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল। ঘুরে ফিরে মনে পড়ছিলো, ছুটি থেকে আসার দুদিন আগে মায়ের সাথে ঝগড়া করার কথা। ওর ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজে আমি বারবার অসম্ভব বেদনায় কুকড়ে যাচ্ছিলাম। সেদিন কিছুটা হলেও অনুভব করেছিলাম মাকে হারানোর দুঃখ। ডিনারের তখনো খানিকটা বাকি ছিলো, এডজুট্যান্ট আর রকিবুল হাসান স্যার এসে আশিককে বাইরে নিয়ে যেতে বললেন। উনারাও বুঝতে পারছিলেন না, কী বলে সান্তনা দিবেন। বাইরে এসে ওকে নিয়ে গ্রাউন্ডের পাশের বেঞ্চে প্রায় নিশ্চুপ বসেছিলাম। আমার পোড়ামুখে কোন ভাষা ছিলো না যা ওর কষ্টের পাল্লাটা একটু হাল্কা করতে পারে। এ’কষ্টের ভাগ যে দেয়া কিংবা নেয়া কোনটাই সম্ভব ছিল না, তা আমি প্রতিটা মুহুর্তে অনুভব করেছি। ঐবার ছুটিতে গিয়ে ঘরে ঢুকেই মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ বসেছিলাম।
আজ অনেকদিন পর তুহিন ভাইয়ের ব্লগটা দেখে আমি যেন আবার সেই মন খারাপের দিনে হারিয়ে গিয়েছিলাম। সিসিবি পরিবারের সবার পক্ষ থেকে উনার মায়ের জন্য দোয়া রইল। ইনশাআল্লাহ আন্টি খুব তাড়াতাড়ি সুস্হ হয়ে উঠবেন।

( আনাড়ী হাতের এই লেখাটা যে তৃ্তীয় শ্রেণীর সমকক্ষও হয়নি, তা আমি নিজে পড়বার সময়ই বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবুও আজ খুব মন খারাপ ছিলো বলে সবার সাথে শেয়ার করলাম। 🙁 )

৩,৩৭২ বার দেখা হয়েছে

৪২ টি মন্তব্য : “আজ মন খারাপের দিনে”

  1. রেজওয়ান (৯৯-০৫)

    মায়ের প্রতি যে অনুভুতি কতটা তীব্র হতে পারে তা মা হারা সন্তান ছারা আর কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। যার কিঞ্চিত আমিও পেয়েছি। আমি জানি এটা কত কষ্টের একটা ব্যাপার। আমার সারা জীবনের একটাই দোয়া সবার জন্য কাউকে যাতে এই অনুভুতি বোঝার ভাগ্য না দেয়া হয়।
    তুমি বলছ এটা ৩য় শ্রেণী...??? একটু অপেক্ষা কর। দেখবে...এমন স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার এত আবেগ দিএ সুন্দর করে লিখেছ...তোমাকে অনেক ধন্যবাদ :clap: :clap: :clap: :clap:

    জবাব দিন
    • রকিব (০১-০৭)

      ভাইয়া, সত্যি বলতে এটা লেখার সময় কোন কিছু ভেবে লেখা হয়নি, পুরনো কথাগুলা মনে পড়ে যাওয়ায়... কিভাবে যে এটা চলে এসেছে...।।
      ভালো লেগেছে জেনে এবার সত্যি সত্যি লেখার জন্য সাহস পাচ্ছি।। :boss: :boss:


      আমি তবু বলি:
      এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

      জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আমার মা আমাদের সঙ্গেই আছেন। তবু রকিবের পোস্টের শেষ দিকে এসে চোখে ঝাপসা দেখছিলাম। :hatsoff:

    তুহিনের মায়ের জন্য শুভকামনা। আন্টি অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠবেন।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. শহীদ (১৯৯৪-২০০০)
    তুমি বলছ এটা ৩য় শ্রেণী…??? একটু অপেক্ষা কর। দেখবে…এমন স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার এত আবেগ দিএ সুন্দর করে লিখেছ…তোমাকে অনেক ধন্যবাদ

    খুবই সুন্দর একটা লেখা।
    আল্লাহ আমাদের সব মাকে যেন অনেক অনেক ভাল রাখেন...

    জবাব দিন
  4. হাসনাইন (৯৯-০৫)
    মায়ের প্রতি যে অনুভুতি কতটা তীব্র হতে পারে তা মা হারা সন্তান ছারা আর কারো বোঝার ক্ষমতা নেই। যার কিঞ্চিত আমিও পেয়েছি।

    এই ক্ষ্যামতা যেন আমার না হয়। 🙁
    রকিব, বড়ই সুন্দর একখান পোষ্ট।

    জবাব দিন
  5. আমি যখন ক্লাস ১১ তে আশিক তখন সেভেনে।আমারই হাউসের এই ছেলেটির মত দুর্দান্ত গেমস পারফর্ম্যান্স আমি আমার ৬ বছরের কলেজ জীবনে দ্বিতীয়টি দেখিনি। জসীম উদ্দিনের রূপাইইয়ের মত এই ছেলেটির মুখে হাসি ছাড়া কখনো কিছু দেখিনি।শত কষ্টের মধ্যেও ওর মুখে হাসি লেগেই থাকত।মাঝে মাঝে যখন সারা ক্লাসকে পানিশমেন্ট দিতে হত-ঘাম ঝরা মুখেও এমন একটা মায়াময় হাসি লেগে থাকত যে রাগ করতে পারতামনা।আশিকের মত ছেলে আমার কলেজ ভাই এবং সরাসরি আমার ক্যাডেট-এটা ভাবতে গর্বে আমার বুক ভরে যায়।
    দোয়া করি-সব দুঃখ ভুলে আশিক জীবন যুদ্ধে জয়ী হোক।
    আর রকিব-লেখাটা অনেক সুন্দর হয়েছে।মন খারাপ করা পোস্ট তো হল-এবার মন ভাল করা পোস্ট চাই।

    জবাব দিন
  6. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    মাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে...

    চোখটা ঝাপসা হয়ে আসার কারনে শেষের অংশটুকু পড়তে বেশ সময় লাগল…
    তবু রকিবের পোস্টের শেষ দিকে এসে চোখে ঝাপসা দেখছিলাম।

    লিখতে পারছিনা............।।

    জবাব দিন
  7. জিহাদ (৯৯-০৫)

    লেখা পড়তে পড়তে আবেগটা বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয়নি। খুব সুন্দর লিখসিস। খারাপ বলার কোন অবকাশ নেই। 🙂

    আন্টি যতদূর জানি অপারেশনের পর সুস্থ্যই আছেন। সবাই দোয়া করবেন।

    অফটপিক: সি সি বি তে আরেকটা সম্ভাবনাময় চারা গাছ এর জন্ম হৈলো। :-B


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  8. রহমান (৯২-৯৮)
    চোখটা ঝাপসা হয়ে আসার কারনে শেষের অংশটুকু পড়তে বেশ সময় লাগল…
    রকিব, মন ছুঁয়ে যাবার মতন একটি লেখা দিয়ে শুরু করলে, ভাই…

    লেখা ভাল হয়েছে রকিব। জুনায়েদের মতো আমারও একই দশা হওয়াতে ওর মন্ত্যব্যটা এখানে কপি করে দিলাম। লেখক হিসেবে ব্লগে স্বাগতম :hatsoff: ।

    আল্লাহ আমাদের সব মাকে যেন অনেক অনেক ভাল রাখেন
    জবাব দিন
  9. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    ভাই চমৎকার লিখছেন :boss: :boss: :boss:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  10. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    আনাড়ী হাতের এই লেখাটা যে তৃ্তীয় শ্রেণীর সমকক্ষও হয়নি, তা আমি নিজে পড়বার সময়ই বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবুও আজ খুব মন খারাপ ছিলো বলে সবার সাথে শেয়ার করলাম।

    তোমার এই লেখাটাই যে চোখ ভিজিয়ে তুলল ভাই.........।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  11. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    মা যে কি, মা মরে গেলে বুঝা যায়। আর এটা এমন একটা কষ্ট কারও সংগে শেয়ারও করা যায় না।

    তোমার লেখার হাত আসাধারন, রকিব। আমি পড়ার সময় বুঝতেই পাড়িনি এটা তোমার প্রথম লেখা। ব্লগে স্বাগতম।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  12. সামিয়া (৯৯-০৫)

    এসব সময়ে কোন কথা খুজে পাওয়া যায় না আসলে। সেই ছেলেটা জীবনে অনেক ভালো করুক, এই কামনা থাকল।

    আর,

    ( আনাড়ী হাতের এই লেখাটা যে তৃ্তীয় শ্রেণীর সমকক্ষও হয়নি, তা আমি নিজে পড়বার সময়ই বেশ বুঝতে পারছিলাম। তবুও আজ খুব মন খারাপ ছিলো বলে সবার সাথে শেয়ার করলাম। )

    থাপ্পর দিয়ে তোমার দাঁত ফেলে দেয়া উচিৎ অতিরিক্ত বিনয়ের কারণে।

    জবাব দিন
  13. জাবীর রিজভী (৯৯-০৫)

    মা গানটা যতবারই শুনতে চাই,কেন যেন পুরোপুরি শুনতে পারি না।ছুড ভাই,চক্ষু দুইখান যে ভিজায়ে দিলি :((

    হৃদয়ের কোমল আবেগ যখন আর্তি হয়ে ঝরে,তখনই এমন গানের জন্ম হয়।আরেকটি হৃদয় যখন ওই আবেগটুকুর নির্যসের স্বাদ পায়,তখনই এমন লেখার সৃষ্টি হয়।

    ধন্যবাদ,অনেক অনেক ধন্যবাদ

    জবাব দিন
  14. ইউসুফ (১৯৮৩-৮৯)

    রকিব, অসাধারন লেখা! সত্যিই অসাধারন।

    আমি আমার মা হারিয়েছি ৯৯ সালে। মা হারানোর কষ্ট কি তীব্র তা বোঝানোর মত না।
    পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অসংখ্য মিরাকলের মত আমি তখন একটা মিরাকল চাইতাম....

    আমি আমার সমস্ত ভাল কাজের বিনিময়ে পরকালে বেহেশত চাই না, চাই আমার মায়ের সান্নিধ্য।

    জবাব দিন
  15. মোঃ সাদাত কামাল [০১-০৭]

    কি ...... লিখব ...
    আমি সেই সময় আশিকের দিকে বোকার মতো করে তাকিয়ে ছিলাম।
    সেই কান্না আর সেই স্মৃতি আমার আজও মনে আছে।
    আর সে গান টা শুনলে আজও আমি আশিক কে ভাবি।
    আল্লাহ্‌ তাকে ভালো রাখুক...


    ভালো থাকা অনেক সহজ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রকিব (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।