বসত

১.
“চারশো স্কয়ার ফিটের উপর হবে। দুই বেড, ড্রয়িং, ডাইনিং, দুটো বাথরুম; মাস্টার বেডরুমটা আবার দখিনমুখী, কোনায় একটা ব্যালকনী, বেশ চওড়া। এত সস্তায় এমন ভালো একটা ফ্লাট আর পাওয়া যাবে না। নিয়ে নেই, নাকি?”- একটানা কথাগুলো বলে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেই স্ত্রীর দিকে তাকালেন জামশেদ সাহেব। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই অনেকদিনের সাধ নিজেদের একটা বাড়িr। বোর্ড অফিসের সামান্য চাকরীতে মাসিক সঞ্চয় সামান্যই। পাশের টেবিলের রহমতউল্লাহ কিন্তু এই সামান্য চাকরীতেই অসামান্য অবদান রেখে শ্যামলীর মতো জায়গায় দু’দুটো প্লট কিনে ফেলেছেন। পঁচিশ বছরের চাকুরী জীবনে আজো জামশেদ সাহেবের সে সহবতটুকু শেখা হয়ে উঠেনি, আর তাই মাথা গুজবার জন্য ভাড়া বাসাটাই বহুকালের পুরানো সঙ্গি। দূর-সম্পর্কের ভাগ্নে শামীম এসেছিল সপ্তাহখানিক আগে। ছেলেটা কোন এক হাউজিং কোম্পানীতে চাকুরী পেয়েছে, দালালী করে; ও অবশ্য বলে এজেন্ট। একটা নতুন ফ্লাটবাড়ি তৈরী হচ্ছে। কোম্পানীকে বলে মামার জন্য বেশ কমে একটা ফ্লাটের ব্যবস্থা করেছে সে, বললো এর জন্য কোন কমিশনও সে নেবে না। একেবারে নিজের বাড়ি না হলেও ফ্লাট তো হবে, তাই বা কম কীসে।
শারমীনের মুখের দিকে চাইলেন তিনি- “কি? কিছু বলছো না যে?”
“আমি আবার কী বলবো! তুমি যা ভালো বোঝ , তাই করো। তবে একটা জমি কিনে নিজেদের একটা ছোটখাটো বাড়ি হলে ভালো হতো।”- দীর্ঘশ্বাস পেঁচিয়ে কথাগুলো বললেন শারমীন।
“ওটা অনেক টাকার ব্যাপার, প্রফিটেন্ড ফান্ডের টাকা আর হাউজ বিল্ডিঙ্গের সামান্য লোনে হয়তো শুধু জমিটা কেনা হবে। বাড়ি আর দাঁড়াবে না।”- খানিকটা ঝাঁঝের সাথেই বলে উঠলেন জামশেদ সাহেব।
একটু নরম স্বরে আবারো বললেন, “ইচ্ছে তো আমারো তেমনি ছিল, কিন্তু সাধ্যে যে কুলায় না।”
-“জায়গাটা কোথায়?”
“-সেটা তো জিজ্ঞেস করা হয়নি, আচ্ছা ওর আগামী সপ্তাহে অফিসে আসার কথা। তখন জেনে নেবো।”
শ্রাবণ সন্ধ্যায় বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দে কান পেতে দুই পড়ন্ত বয়সী নর-নারীর চোখে বোধহয় স্বপ্ন খেলা করে, জোড়াতালি দেয়া একটুকরো স্বপ্ন।

২.
“আউয়ালের বাপ, চালের কুনা দিয়ে মনে হয় পানি ঢুকতাছে। মাইয়াডা তো ভিজা গেলো।”- স্ত্রীর ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে যায় শাজাহানের। ছেড়া কাঁথাটা মুখের উপর থেকে সরিয়ে মাথা উঁচু করে। জীর্ণ চালার ফুটো দিয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে, পলিথিনটা বেশিদিন টিকলো না। এক রিকশা থেকে চুরি করেছিল এটা। মোড়ের উপর ঐ চায়ের দোকানে চায়ে ভিজিয়ে পাউরুটি খাচ্ছিল রিক্সাচালক, সে সু্যোগে নিয়ে এসেছিল। সুফিয়াকে ঠেলে উঠিয়ে দেয় শাজাহান, মেয়েটা কেমন ভিজে ভিজে ঘুমাচ্ছে, জ্বর না এলেই হলো। ভাত মেলে না; ওষুধ-পথ্যি কেনার টাকা আসবে কোথা থেকে!!! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাপড়ার এক কোনায় অযত্নে পড়ে থাকা ভাতের পাতিলটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, আন্দাজ করে ফুটোর উপরে চাপিয়ে দেয়। গত ক’দিনে অবশ্য ভাতের গন্ধ পায়নি এপাতিল। তাড়াতাড়ি ছাপড়ার ভেতরে ঢুকে পড়ে শাজাহান, ছেড়া ন্যাকড়াটা দিয়ে ভেজা চুল থেকে পানিটুকু নিংড়ে মুছে ফেলে শুয়ে পড়ে। নির্ঘুম চোখে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায়।
শখ করে সম্রাট শাজাহানের নামে বাবা নাম রেখেছিল, শাজাহান মৃধা। বিয়েও করেছিল পাচুরিয়ার শিকদার বাড়ির মেয়ে মমতাজকে, তবে তাজমহল আর বানানো হয়ে উঠেনি। গেলো বছরের বন্যায় জমি পৈত্রিক ভিটা আর চাষের জমিটুকু হারিয়ে গোয়ালন্দ বাঁধের উপরে আস্তানা গেড়েছিল। সেখান থেকে এসে উঠেছে এই টঙ্গী ব্রীজের পাশের এই বস্তিতে, ফাঁকা জায়গা পড়ে ছিল, তাতেই বানভাসী মানুষের সরগরম আবাস। দিন-মজুরী করে পেট চালায়; কখনো মাটি কাটা শ্রমিক, কখনো বাজারের মাল টানে। যা পায় তাতে অবশ্য আধপেটা খাওয়াও হয় না।
পাশ ফিরে শুতে গিয়ে মমতাজের ঘুম-জড়ানো কন্ঠ শুনতে পায়- “উপরে কিছু একটা দিয়া লাগবেনে। যেমনে বিরিষ্টি পড়তেছে, ডর লাগে, উপরের চালাটা না উড়ায় নিয়া যায়।” “পাশেই কুনখানে নাকি একখান বিল্ডিন উঠবো, রসুল চাচায় কইছে ঐহানে কাম পাওয়া যাইবো। তুই-আমি দুইজন মিলা গতর খাটাইলে মনে হয় একখান টিনের চালা দিতে পারমু সামনের মাসে।”- একটু স্বস্তির স্বরে জানায় শাজাহান। ওপাশ থেকে কোন সাড়া আসে না, বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। অদূরেই হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনতে শুনতে এক সময় চোখ বুজে যায়।

৩.
বেশ খুশীমনে আজ অফিস থেকে বের হয়েছেন জামশেদ সাহেব। লাঞ্চ আওয়ারে শামীম এসেছিল, কথাবার্তা ফাইনাল হয়েছে। অগ্রীম সাড়ে-পাঁচলাখ টাকা দিতে হবে, বাকীটা কিস্তিতে। কাজ নাকি শুরু হয়ে গিয়েছে, দু-আড়াই বছরের মাঝেই ফ্লাটে ওঠা যাবে। আজ চার তারিখ, সাত তারিখে ওদের অফিসে গিয়ে টাকা জমা দিলেই কাগজপত্র করে ফেলবে শামীম, ছেলেটা করিৎকর্মা বটে। ঘরে ঢুকে শারমীনের হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা দিতে দিতে হাসি মুখে কথাগুলো জানান। স্ত্রীর চোখেমুখে নেচে বেড়ানো আনন্দের ছায়ায় আশ্চর্য এক প্রশান্তি খুজে পেতে থাকেন।
“অ্যাপার্টমেন্টটা কোথায় হচ্ছে, জিজ্ঞেস করেছো?”- ছেলেমানুষী খুশীর ছটা ঝরিয়ে জানতে চান শারমীন।
“হ্যাঁ, ঢাকা থেকে যদিও একটু বাইরের দিকে, কিন্তু খারাপ না। ঐযে টঙ্গী জেনারেল হাসপাতালটা আছে না, বাঁধের উত্তরে, ওখানেই। ভাবছি তোমায় নিয়ে শুক্রবার দিন দেখো আসবো।”

স্বপ্ন ছোঁবার অনাবিল তৃপ্তিতে বিভোর হয়ে পড়েন জামশেদ দম্পতি।

( ডিসক্লেইমারঃ গত কয়েকদিন যাবৎ ব্লগে অসাধারণ কিছু পোষ্ট আসছে, এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করতে পারবেন না। তাই ভাবলাম সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দুই-চারটা অকম্মা-জগাখিচুড়ি পোষ্ট দেয়া উচিৎ। তাই অফচান্সে পোষ্টাইলাম। আপাতত এই গরমে কুন্ড :teacup: পান করুন। 😀 )

৪৬ টি মন্তব্য : “বসত”

  1. রবিন (৯৪-০০/ককক)
    গত কয়েকদিন যাবৎ ব্লগে অসাধারণ কিছু পোষ্ট আসছে, এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করতে পারবেন না। তাই ভাবলাম সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দুই-চারটা অকম্মা-জগাখিচুড়ি পোষ্ট দেয়া উচিৎ

    তাইলে তো আমারো দেয়া উচিত। আমি তো ভালো লেখার আসতেছে, তাই লিখি না

    জবাব দিন
    • রকিব (০১-০৭)

      ধন্যবাদ ভাইয়া।
      গোধূলী কথন নিয়ে আমি কয়েকবার বসেছি, কিন্তু আগাতে পারিনি। আসলে যত পর্ব আগিয়েছে ততই আমার ঝুলি খালি হয়ে পড়েছে। দাড়ান আবার বসছি ভাইয়া। এযাত্রায় বোধহয় ...।। 😕


      আমি তবু বলি:
      এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

      জবাব দিন
  2. অণুগল্প খুবই ভাল ছিল।

    তাই ভাবলাম সাম্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে দুই-চারটা অকম্মা-জগাখিচুড়ি পোষ্ট দেয়া উচিৎ।

    এই রকম ডিসক্লেইমার দেয়ার জন্য গরম গরম চা দিয়া লঙআপ হইয়া থাক।

    জবাব দিন
  3. জিহাদ (৯৯-০৫)

    ভাল্লাগসে।

    তাদের অগোচরেই স্বপ্নের বাধে বাঁধা পড়ে কিছু বানভাসী মানুষের টিকে থাকার স্বপ্ন।

    এই লাইনটা না দিলেও আমার মনে হয় তেমন ক্ষতি হতোনা। মনোযোগী পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন গল্পে কার স্বপ্ন ভেঙ্গে কার স্বপ্ন পূর্ণতা পাচ্ছে। এই লাইন ছাড়াই ফিনিশিংটা ছিমছাম লাগতো।

    গল্পটা ভাল্লাগসে। এইজন্য খুঁতখুঁতানিটাও জানায় গেলাম। 🙂


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  4. রাশেদ (৯৯-০৫)

    ঐ মিয়া সাধারণ-অসাধারণ পোস্টের মারপ্যাচে পোস্ট দেওয়া বন্ধ করলে খবর আছে। লেখা ভাল লাগছে আর খুতখুতানির ব্যাপারটা উপরে জানায়ে গেলাম। আরেকটা কথা লেখাটা মনে হয় আর অণুর সাইজে নাই 😉


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  5. দিহান আহসান

    ছোট ভাইয়া ডিসক্লেইমার কেন দিলে? বিনয় দেখাতে? 😛
    লেখা পড়ে খুব ভাল লেগেছে। পরীক্ষার মাঝেও সময় করে লেখা দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ 🙂
    কুল্ড :teacup: ভাল হয়েছে। থ্যাঙ্কস 😀

    জবাব দিন
  6. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    ছাজাহানের ছাজানো বাগান হুগাইয়া গেচেগা 😛


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  7. তৌফিক (৯৬-০২)

    ওপেনিং ভালো, ডেভলপমেন্টও ভালো। শেষ করার সময়, দুইভাবে শেষ করতে পারতি, একটা বড় সমাপ্তি আরেকটা ক্লাসিক ছোট গল্পের সমাপ্তি। শেষ করছস দুইটার মাঝামাঝিতে। ব্যাপার না, আমার মতামত গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট, আমলে না নিয়া লেখতে থাক। 🙂

    জবাব দিন
  8. দিহান আহসান

    তোমার দোকানের আবার বন্ধ কি? ভইন খেতে চাইলে মঙ্গল গ্রহ থেকে ও নিয়ে আস্তে হয়। 😡
    আর বোকা মিল্কশেইকতো আমি'ই বানাবো, এর জন্যে দোকান খুলতে হবে কেন? তুমি খেতে চাইলে আওয়াজ দাও। :grr:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রকিব (০১-০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।