অপরাধী

চেয়ারম্যান বাড়ির কাছারিতে সালিশ বসেছে । আসামী গ্রামের সিরাজ শিকদারের ছেলে মন্টু ও হাসান মাস্টারের মেয়ে বকুল । আসামীদের অপরাধ ভয়ঙ্কর । দুজনকে একসাথে নদীর ধারে দেখা গেছে। শুধু তাই না, মন্টু নাকি বকুলের হাতও ধরেছিলো ! কি ভয়ানক নাজায়েজ কাজ_কারবার ! এদের উচিত সাজা হওয়া উচিত । তা না হলে গ্রামের যুব সমাজ রসাতলে যাবে ।
ঘরভর্তি মানুষ । এক কোনায় হাসান মাস্টার মাথা নিচু করে বসে আছেন । তার মেয়ের জন্য আজ মাথা হেট, না না দোষটা আসলে তারই, এবয়সে মেয়ের মন উড়াল দিতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তার উচিত ছিলো মেয়ের দিকে ভালোমত খেয়াল রাখা, মেয়েকে দেখেশুনে রাখা, তিনি তা পারেন নি বলেই আজ এই অবস্থা , মনে মনে ভাবতে থাকেন তিনি।
অনেকটা সময় পর ধীরে সুস্থে ঘরে প্রবেশ করলেন চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন । সাথে সাথেই গুঞ্জন থেমে গেলো । উনি বেশ রাশভারী মানুষ , বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, সাদা চুল-দাড়ি বয়সের সাক্ষ্য দেয়। গ্রামের মানুষের কাছে তিনি অনেকটা বটবৃক্ষের মত , যেকোনো ধরণের কাজে পরামর্শের জন্য ছুটে আসে তাঁর কাছে। ন্যায়বিচারক হিসেবেও বেশ সুনাম তাঁর । সবাই বেশ সন্মান করে তাঁকে।
“ ঘটনা কি হইছে, কেউ খুইলা কও তো দেখি” চেয়ারম্যান সাহেব হাঁক ছাড়লেন।
“ হুজুর খুব শরমের কথা , কেমনে কই, এই পোলা- মাইয়া দুইডা গেরামের ইজ্জত ধুইয়া ফেলছে, রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে আকাম কুকাম কইরা বেড়াইতাছে। ” মুখ খুললো মোখলেস ।
“মিছা কতা, চেয়ারম্যান সাব, আমার পোলা ভোলা ভালা, সরল সোজা, সব দোষ এই মাগীডার , এই মাগী আমার পোলারে ভুলাইয়া ভালাইয়া বশ করছে, আমার পোলা আগে এরাম আছিলো না” বকুলের দিকে অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ক্ষোভ ঝাড়লো সিরাজ শিকদার ।
“ দাঁড়াও মিয়া, এমনে কইলে তো হইবো না, যা করছে বড় গোনাহের কাজ সন্দেহ নাই, এইগুলান হারাম এবং এগুলার শাস্তি কঠিন। কিন্তু বিচারের কিছু আইন কানুন আছে। ১। চাইরজন সাক্ষী লাগবো, ২। নিজ মুখে সস্বীকার করন লাগবো, ৩। প্রমাণ লাগবো। ” গম্ভীর কন্ঠে বললেন চেয়ারম্যান সাহেব।
“ তা সাক্ষী আছে চাইরজন ?”
বিশ – পঁচিশজন মানুষ হাত তুললো । হাত তোলার মত মানুষের অভাব নাই গ্রামে । যারা দেখেনাই তারাও হাত তুললো।
“এইবার, মন্টু মিয়া, তুমি বল , তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি সত্য?”
“ হুজুর, আমি বকুলরে মেলা পছন্দ করি, বকুলও আমারে করে, এইডা সত্যি। কিন্তু খোদার কসম। ওর সাথে উলটা পালটা কিছু করি নাই। খালি হাত ধরছি একটু , আল্লাহ সাক্ষী।”
“নালায়েকের বাচ্চা কয় কী? শুয়ারের বাচ্চা পাপ কইরা আবার খোদার নাম নেয়” পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো।
“ থামো! আমার সামনে মুখ খারাপ করে কেডারে? ধমকে উঠলেন চেয়ারম্যান।
এরপর তিনি ফিরলেন মন্টুর দিকে, পরনারী- পরপুরুষের সাথে দেখা করা হারাম। দেখলে চোখের জেনা, কথা কইলে মুখের জেনা, ভাবনা চিন্তা করলে অন্তরের জেনা। এরজন্য বেগানা নারীর সাথে দেখা করা কথা কওয়া পর্যন্ত গোনাহ। বুঝবার পারছ?”
মন্টু কিছু বলে না, চুপচাপ মাথা নীচু করে থাকে। সে জানে সে অপরাধী, কিন্তু কেন জানি নিজেকে অপরাধী মানতে ইচ্ছা করে না, আবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে সে উপায়ও নেই।
“ যাইহোক, বিচারক হিসাবে ন্যায়বিচার করা আমার দায়িত্ব , না হইলে আগুনে পুড়া লাগবো পরকালে । শরিয়ত অনুসারে অগোর শাস্তি ১০০ টা কইরা বেতের বাড়ি। দুইডারে ছাতিম গাছের সাথে বান্ধ কেউ” শাস্তি ঘোষণা দিয়ে দিলেন চেয়ারম্যান সাহেব, বকুলের কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। অপরাধ প্রমাণ হয়ে গেছে আগেই। আর তাছাড়া , মেয়ে মানুষের আবার কথা কি? বকুলেরও আসলে বলার কিছু ছিলো না। শুধু টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়ছিলো। হাসান মাস্টারও কাঁদছিলেন ,একজন অপরাধীর জন্য যদিও প্রকাশ্যে কাঁদা উচিত না, তবু হাজার হোক, নিজের মেয়ে তো।
দুইজনকেই গাছের সাথে বাঁধা হলো। বেত মারা উদ্বোধন করলেন চেয়ারম্যান সাহেব নিজে, তারপর বেত মারার দায়িত্ব এলাকার দুজন জোয়ান ছেলেকে দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। তারা অতি উৎসাহে সপাং সপাং বেত চালাতে লাগলো। উপস্থিত গ্রামবাসী ন্যায়বিচারে মুগ্ধ । তারা হাততালি দিয়ে বেত মারায় উৎসাহ দিতে লাগলো । অতি উৎসাহী কেউ কেউ ঢিল ছুড়তে শুরু করলো। এইসময় চেয়ারম্যান ধমক দিলেন, যা শাস্তি সেটা কার্যকর করা হচ্ছে, এখানে ঢিল ছোড়া উচিত না।
বেত মারা শেষ হওয়ার আগেই বকুল অজ্ঞান হয়ে গেলো। গাছ আর মাটি রক্তে মাখামাখি। মন্টু অজ্ঞান হয়নি , কিন্তু তার শরীরও রক্তে মাখামাখি। চেয়ারম্যান সাহেব বাঁধন খুলে দিতে বললেন। দুজনেরই ক্লান্ত অবসন্ন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। উপস্থিত গ্রামবাসী তামাশা দেখতে লাগলো। কেউ কেউ হাসাহাসি করতে লাগলো।
“এইখানে না দাঁড়ায় থাইকা তামাশা না দেইখা যার যার বাড়িত যাও, কাম নাই তোমাগো?” গর্জে উঠলেন চেয়ারম্যান।
ধমক খেয়ে আসতে আসতে জটলা কমতে লাগলো, মন্টুকে নিয়ে ওর বাড়ির লোকজন চলে গেল। কি করবেন বুঝতে না পেরে হতবিহবল হয়ে মেয়ের পাশে বসে থাকেন শুধু মাস্টার সাহেব।।

রাত দশটা। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে নিজের কক্ষে প্রবেশ করেন চেয়ারম্যান আনোয়ার সাহেব। আজকে অনেক পেরেশানি গেছে, হাসান মাস্টারের জন্য তাঁর একটু খারাপই লেগেছে, কিন্তু কিছু করার নেই, আল্লাহর আইন অনেক শক্ত। আর এদের কঠিন শাস্তি না দিলে গ্রামের আরও পোলাপান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, তিনি যা করেছেন ভালই করেছেন , ভাবতে থাকেন তিনি।
অনেক পেরেশানির পর একটু আরাম আয়েশের দরকার, গা টা ম্যাজ ম্যাজ করছে, মালিশ করানো দরকার।
“ কইগো, ছোড বউ। ঘরে আহ” , ভাবতে ভাবতে ডাক দেন তিনি।
ডাক শুনে তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী জমিলা ঘরে প্রবেশ করে। পনের বছর বয়সী কচি স্ত্রীর দেহের দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যানের চোখ চকচক করে, মুখ দিয়ে লালা ঝরে। সে দৃষ্টি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে উঠে কিশোরী মেয়েটি। সে বুঝতে পারে আজকে আরো একটি ভয়াল রাত কাটাতে হবে। ভয়াল বিভীষিকাময় রাত ।।

২,০৭১ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “অপরাধী”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    চমৎকার ভাবে কিছু নির্মম বাস্তব ফুটিয়ে তুলেছো। উপস্থাপনা ভাল লেগেছে।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।