অপার্থিব

ধুপ ধাপ হুলুস্থুল শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় জাভেদের । ঘড়ির কাটা সাতটা ছুঁই ছুঁই । এই সাতসকালে রুমি পুরো রুমটা মাথায় নিয়ে নাচছে।
“ এই রুমি? কি শুরু করলি?” বিরক্তি ঝরে পরে জাভেদের কণ্ঠে ।
“ আজকে পহেলা বৈশাখ , ভুলে গেলি? আর তাছাড়া আজ অনেকদিন পর সায়মার সাথে দেখা হবে । এই জন্য আমি অনেক এক্সাইটেড। কতদিন ওকে দেখি না!”
“ কিইইইই !!! সায়মা বের হবে? ও না বের হতে চায় না?” একটু বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো জাভেদ।
“ আজকে স্পেশাল দিন না? আর মহারাণী কি সহজে রাজি হয়? অনেক কষ্টে রাজি
করিয়েছি। ওর যে কি হয়েছে সেটাই ধরতে পারছি না”
“ আমাকে নিবি সাথে? অনেক দিন তো আমিও দেখি না। জাস্ট দেখা করেই চলে আসবো। তোদের প্রাইভেসিতে বাধা দিবো না , প্রমিজ” বলে একটু ফিচেল হাসি
হাসলো জাভেদ।
হাসি দেখে গা জ্বলতে শুরু করলো রুমির। কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে ভস্ম করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না সে।
সকাল আটটার মধ্যেই পাঞ্জাবি পরে টিএসসিতে হাজির রুমি। সাথে রুমমেট জাভেদ। যদিও জাভেদকে নিয়ে আসতে চায় নি, কিন্তু সে পিছ ছাড়লো না। রুমি কিছু বলতে পারে না, সইতেও পারে না। নিজে তো একটা প্রেম করতে পারে না, অন্যের প্রেমে খালি ডিস্টার্ব , বিরক্তিকর। সাথে সাথেই ফোন দিলো সায়মাকে ,
“ দুঃখিত এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহ করে একটু পর আবার ডায়াল করুন”, শুনে পাংশু হয়ে যায় রুমির মুখ । এরপর যতবারই ট্রাই করে একই ঘটনা।
“ নাহ মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা গেল না । কখন যে কি করে কোন ঠিক নাই, সকাল আটটার মধ্যে এখানে থাকার কথা ”
“ এই মেয়ের সমস্যা কি? এত এরকম করে কেন, আসবে শিউর তো? , দুই ঘন্টা পার করে ফেললাম, বলে ফেললো জাভেদ।
“ দোস্ত, ওকে আমি গত পাঁচ বছর ধরে চিনি, আসলে সেই এক্সিডেন্টের পর থেকে…”
“ থাক ওটা আর মনে করিস না। তুইও তো ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছিস , তিন দিন তোর সেন্স ছিলো না”
“ বাট আই ফট ব্যাক এজ ওয়েল , কিন্তু সায়মা না সেই ট্রমা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বাস এক্সিডেন্টে যদিও ওর মেজর কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু আমার ফেসের স্ট্রাকচার এত ভয়ঙ্করভাবে চেঞ্জ হয়েছিলো , সে নাকি সেটা মেনে নিতে পারেনি। চোয়ালে আয়রনের প্যালেট লাগানোর পর আমি এখন আয়রনম্যান । হা হা হা” ।
“ শালা তুই সাইকোপ্যাথ একটা, নিজের এক্সিডেন্ট নিয়া হাসাহাসি করিস।”
“ কিন্তু কথা সেটা না, সায়মা ফোন খুলে না কেন? ” অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকে রুমি। এদিকে সময় গড়িয়ে চলে আর জাভেদ বসেই থাকে।
চারদিকে এত অসহ্য আওয়াজ , এত মানুষ , কিন্তু রুমির কাছে সব যেন ফাঁকা লাগে। আরো অনেকক্ষণ পার হয়ে যায় । এবার জাভেদ উঠে দাঁড়ায় ।
“ দোস্ত কিছু খাবি না?
“ না , আগে সায়মা আসুক, না আসলে আজকে ওর বাসায় যাবো”
এবার জাভেদ বলে, “ দোস্ত একটা কথা বলি?”
“ বল”
“ দোস্ত, সায়মা আসবে না”
“ হোয়াট ! কেন তোর মনে হল?”
“ কারণ, কারণটা তোকে এই মুহূর্তে বোঝানো অনেক কঠিন। আসলে কি বলবো, শাটার আইল্যান্ড মুভিটাতো দেখছিস। অনেকটা অইরকমই । সায়মা নেই।”
“ গাঁজা কত টন খাস ডেইলি? নাকি আরো কিছু খাস?”
“ না দোস্ত, সত্যি”
“ তাহলে আমি কার সাথে ফোনে কথা বলি?”
“ বললাম না? , ওইটা হ্যালুসিনেশন”
“ হ, এখন বল আমি সিজোফ্রেনিয়া রোগী”
“ অনেকটা তাই”
“ দূর হয়ে যা লাত্থি খাওয়ার আগে”
“ না বন্ধু, তোকে আসলে সবটুকু খুলে বলা উচিত। এখানে আসলে আমার বিশাল বড় ভুল হয়েছে । সেই এক্সিডেন্টে সায়মা আসলে স্পট ডেড । তোর সেন্স ছিলো না। যখন সেন্স আসলো তখন এই খবরটা তোকে দিইনি কারণ ভেবেছিলাম তুই হয়ত নিতে পারবি না। এটাই আসলে মস্ত বড় ভুল। তুই সুস্থ হওয়ার পর তোর আচরণে অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লো। আমি জানি সায়মা ডেড কিন্তু তুই প্রত্যেকদিন ফোনে কথা বলিস সায়মার সাথে । আমি আগেই বলতাম কিন্তু তোর আনন্দমাখা মুখটুকুতে বিষাদ দেখতে চাইনি আমি, আর সবকিছু তো ভালই চলছিলো, তাই এই দুইমাসে বলা হয়ে উঠেনি । বিশ্বাস না হলে তুই দেখ, অপেক্ষা কর। ফোন করে দেখ । ”
ধপ করে বসে পড়লো রুমি। মোবাইল চেক করতে শুরু করলো , কল লগ, কিংবা মেসেজেই প্রমাণ করা যাবে। কিন্তু মেসেজ তো নেই! কল লিস্ট তো খালি! মাঝে মাঝেই সব ডিলিট করে সে, এবং অবশ্যই জাভেদের মেসেজ পড়ার ভয়ে । তাই বলে একটা মেসেজও থাকবে না! নাকি আসলেই সব হ্যালুসিনেশন! চিন্তা করতে থাকে , হিসাব মিলাতে থাকে আর চলে বিশ্বাস – অবিশ্বাসের যুদ্ধ। পাশে চুপচাপ বসে থাকে জাভেদ।
অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর রুমি ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে থাকে যে জাভেদের কথা হয়ত সত্যি । সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা বাস্তব, পরাবাস্তবে আর অবাস্তবের পার্থক্য করতে পারে না, তার মস্তিস্কের একটি অংশ হয়ত সায়মার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি তাই এরকম হচ্ছে।কত মুভি দেখেছে আর কত বই পড়েছে সে এগুলো নিয়ে! কিন্তু নিজের জীবনে এরকম হবে কখনও ভাবেনি সে। ভাবনার ছেদ পরে একটি ফোন কলে। ফোন বের করে দেখে, একী ! সায়মার ফোন ! আবার হ্যালুসিনেশন ! পাশে বসা জাভেদকে দেখায় । এইবার জাভেদের ও চোয়াল ঝুলে পরে , এ কিভাবে সম্ভব!
ফোন পিক করে রুমি, “হ্যালো”
“ পিছনে তাকা”
রুমি পিছনে তাকিয়ে দেখে, নাদিয়া দাঁড়িয়ে, রুমির ডিপার্টমেন্ট এর সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড। নাটকের তখনো অনেক বাকি।
“ তুই???? সায়মার ফোন পেলি কোত্থেকে ?, কেন নাটক করলি আমার সাথে? ”
“সায়মার ফোন থেকে সিম চুরি করেছি। জানি কাজটা অনেক খারাপ হয়েছে । হয়ত তুই আমাকে অনেক খারাপ ভাববি। কিন্তু আসলে কি জানিস এক্সিডেন্টের পর তোকে যখন দেখতে গেলাম তখন তোর মুখ দেখে এত্ত খারাপ লাগছিলো যে বলে বোঝাতে পারবো না । সায়মার মৃত্যু তুই সহ্য করতে পারবি না বলে আমি এই নাটকটা করি। চেয়েছিলাম যতদিন পারি তোকে হাসিখুশি রাখি । আর হ্যাঁ আমি তোকে অনেক ভালবাসিরে , এই ভালোবাসাটুকু নাটক না। মাফ করে দিস পারলে। ” বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো মেয়েটা।
রুমি আসলে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। চুপচাপ বসে ছিলো । কতদিন পর আশা নিয়ে এসেছিলো যে সায়মাকে দেখবে। আর তার বদলে এত টুইস্ট আর টার্ন। সে নিতে পারে না। হঠাত তার মধ্যে বোধোদয় হয়, সায়মা নেই। চকিতে সে দাঁড়িয়ে যায়। ভীষণ চিৎকার দিয়ে উঠে। সোজা দৌড় দেয় রাস্তায়। আর ঠিক তখুনি, একটি প্রাইভেটকার সজোরে ধাক্কা দেয় রুমিকে। রুমি সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায়। জাভেদ দৌড়ে যায়। মানুষের কাছে সাহায্যের জন্য চিৎকার করে , কিন্তু কোন লাভ হয় না। মানুষগুলো সব স্বার্থপর । কিন্তু তবুও সে চিৎকার করতেই থাকে , করতেই থাকে।

রাত প্রায় বারোটা। রোগীর কক্ষে প্রবেশ করে ডক্টর রফিক ও ইন্টার্ন ডাক্তার সারাহ।
“ প্যাশেন্টের অবস্থা কি এখন?” ডক্টর রফিক জিজ্ঞেস করলেন
“ এখন মুটামুটি ভালো স্যার, কড়া ডোজ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ” সারাহ উত্তর দিলো।
“ ছেলেটার জন্য অনেক খারাপ লাগে , বুঝলে সারাহ, অনেক ট্যালেন্টেড ছিলো, শুধু এই সমস্যাটা না থাকলে।”
“জ্বী স্যার, আচ্ছা স্যার, এক্সিডেন্টটা কিভাবে হয়েছিলো?”
“ মা-বাবার সাথে প্রাইভেটকারে করে যাচ্ছিলো । অন্য একটি বাস এসে ধাক্কা মারে। মা- বাবা সাথে সাথে স্পট ডেড । ছেলেটা অনেক ছোট ছিলো তখন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় । কিন্তু সেই ট্রমা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মানুষ হয়েছে খালার কাছেই । কারো সাথে তেমন মিশতো না। না মিশতে মিশতে নিজের চারপাশে একটি আলাদা জগত তৈরি করে ফেলে সে। অসংখ্য কাল্পনিক ক্যারেক্টার তৈরি করে সে এবং তাদের কেউ কেউ বীভৎস ভাবে মারা যায়। রুমি, সায়মা, নাদিয়া সব কাল্পনিক। চিন্তা করে দেখ সারাহ, প্রতিদিন কি পরিমাণ অমানুষিক যন্ত্রণার যায় ছেলেটি। ”

বাইরে ভরা পূর্ণিমা । জানালা গলে জ্যোৎস্না এসে ঢুকেছে ঘরে। কেমন যেন স্বর্গীয় আলো। সে আলোয় বিছানায় বেঘোরে ঘুমানো জাভেদ নামক অচেনা ছেলেটির দুঃখী ও নিস্পাপ মুখখানি দেখে সারাহ কেন জানি প্রচন্ড ভালোবাসা অনুভব করে। প্রচন্ড ভালবাসা।

১,০৬৫ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “অপার্থিব”

  1. সাইদুল (৭৬-৮২)

    শোন এই গল্পটা ভালো হয়েছে সত্যি, তবে পড়তে গিয়ে অনেক মানসিক যন্ত্রণা হয়েছে। এরপর সোজা করে লিখবে, যেন আমার মত গাধাও একবারে বুঝতে পারে


    যে কথা কখনও বাজেনা হৃদয়ে গান হয়ে কোন, সে কথা ব্যর্থ , ম্লান

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    বাহ, বেশ কয়েকদিন পর পাওয়া গেল তোমাকে। অনেক ভেবেছ গল্পটা নিয়ে - শেষ স্তরে গিয়েও আরেকটা বাঁক আছে তা ভাবিনি। ভালো লেগেছে মোটের ওপর। তবে যেহেতু জানি তোমার লেখার হাত কেমন তাই প্রত্যাশাটা একটু বেশিই থাকে।

    দুটো পর্যবেক্ষণ:
    ১। দু'জন ডাক্তার যখন কেস নিয়ে আলোচনা করছেন , তখন যে যে চরিত্রগুলো কাল্পনিক তাদের নামসহ বলাতে বোঝা যাচ্ছে -- গল্পকার এ তথ্য পাঠকের কাছে পেশ করছেন। গল্পকারের পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করের দরকার নেই বলে মনে হয় আমার। পাঠক সেটা বের করে নেবে নিজ প্রয়োজনেই।
    ২। একদম শেষের প্যারাটা পুরোপুরি হুমায়ুন আহমেদিয় হয়ে গেছে -- ও থেকে বেরুতে হবে।

    জবাব দিন
  3. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    জটিল (ভাল অর্থে) গল্প।
    ব্রেনে সর্ট সার্কিট বাধানো টাইপের।
    রিয়েল আর আন রিয়েলের জট পাকানো।
    পড়তে বসে আমিও সাইদুল ভাইএর মত বিপদে পড়ে গেলাম।
    তবে বুনন টা বেশ.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মঞ্জুর (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।