আমি,ফেসবুক ও আমার ফেক আইডি

তখন ২০০৮ সাল। ইন্টার পরীক্ষা শেষ হইল কয়েকদিন আগে। সুকান্তের সেই বিখ্যাত ১৮ বছরে পদার্পণ করার পর থেকেই যত আজাইরা চিন্তা ভাবনা ঘুরে মনের মধ্যে।আর পড়ালেখা শিকেয় তুলে সব আজাইরা কাজ কাম বাস্তবায়ন করার ইন্ধন যোগাতে সেই সময় এগিয়ে এল ফেসবুক। কোন এক কুদিনে খুলে ফেললাম একটা ফেসবুক একাউন্ট। আগে ইয়াহু মেসেঞ্জারে টুকটাক চ্যাটিং করতাম। “হাই, হ্যালো? এ এস এল প্লিজ?মেল? ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ,বাই” টাইপ। কিন্তু এফবিতে পুরাই অন্যরকম অবস্থা। তখন আবার প্রাইভেসির কোন বালাই ছিল না। যতজনের একাউন্ট আছে সবার স্ট্যাটাস সহ সবকিছু দেখা যাইত। তাই কোন মেয়ের নাম লিখে সার্চ দিলে ওই নামে হাজার হাজার মেয়ের স্ট্যাটাসসহ আইডি চলে আসতো। আমার তখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত অবস্থা। পাঠিয়ে দিলাম কয়টারে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট। মনে মনে খুশীতে বাকবাকুম। এইবার আমার প্রেম করা ঠেকায় কে? রিকুয়েস্ট গ্রহণ করলেন উনাদের কয়েকজন। চ্যাটও হইল। কিন্তু আমি বেশিদূর আগাইতে পারি না। কারণ যেইটারেই টার্গেট করি সেইটার ওয়াল,ছবি ও সব জায়গাতেই তৈলাক্ত পোস্ট ও কমেন্টে ভরপুর। তখন আবার যে কেউ যেকোনো জায়গায় কমেন্ট দিতে পারতো। আমার স্টকে আবার এত তেল ছিল না। তাই কারো সাথেই ফ্রেন্ডশিপ আর আগাইল না।এরই মধ্যে একদিন সাজেশনে দেখলাম তিশার আইডি আসছে। চোখ বন্ধ করে দিলাম রিকুয়েস্ট পাঠাইয়া।সে আমার রিকুয়েস্ট গ্রহণ করল। চ্যাটও হইল।আমি তো তখন পুরাই আকাশে। ফ্রেন্ডদের বইলা বেড়াইলাম, জানস তিশার সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ হইসে,খুব ভালো সে, কত ফ্রিলি আমার সাথে চ্যাট করল সে।আমি তো ইম্প্রেসড ।পরে মনে হইল, আরে সব সেলিব্রিটিদের ই তো একাউন্ট থাকতে পারে। এইবার সার্চ দিলাম জয়া আহসান।মিনিমাম ১০০ টা জয়া আহসান আসলো আমার সামনে।সাথে সাথে তিশা লিখে সার্চ দিলাম আবার। একই রেসাল্ট। চকিতে বোধোদয় হইল আমার। ফেক আইডি কথাটা ওই সময় আমার মাথায় আসলো।সঙ্গে সঙ্গে নুশরাত ইমরোজ তিশা সহ সব আননোন আইডি নগদে ডিলিট। আমার আইডিটাও বাস্তবের মত নারীবিবর্জিত হইল আবার।

এইবার মাথায় ঢুকল অন্য কুবুদ্ধি। আচ্ছা একটা ফেক একাউন্ট খুললে কেমন হয়? সাথে সাথে গুগল মামার কাছ থেকে একটা ছবি নিয়ে মনিকা নামে খুললাম একটা আইডি। কাউরে রিকুয়েস্ট পাঠানো লাগে না। চুপচাপ বসে থাকি। দৈনিক ৫০ ৬০ টা করে রিকুয়েস্ট আসে। এক্সসেপ্ট করি। সাথে সাথে মেসেজ, ইউ আর সো কাইন্ড, সো গুড।অনলাইনে গেলেই নক আসে। ঠিকমতো আনসার দিলেই পটে যায়। প্রথমে গুড ফ্রেন্ড বানায়,তারপর বেস্ট ফ্রেন্ড বানায়,তারপর প্রপোজ।সেই তালিকায় সুদুর দুবাইয়ের প্রবাসী শ্রমিক থেকে শুরু করে ভার্সিটি স্টুডেন্ট, সব ই আছে। আমার ফেক আইডিটা আবার একটু ভদ্র টাইপের ছিল। যখন দেখতাম কারো অবস্থা বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে তখন আস্তে করে তাকে ব্লক মেরে দিতাম। কেউ ডিরেক্টলি প্রপোজ করলে বলতাম,সরি আমার বয়ফ্রেন্ড আছে। এতে এই আইডি টা যে ফেক না এই বিশ্বাস আরও প্রবল হয়ে উঠত। সেই দুবাই প্রবাসী লোকটার কথা এখনো ভুলতে পারি নাই। তার সাথে একদিন মাত্র আধাঘণ্টা চ্যাট করার পর সে মেসেজ পাঠাইছিল।“চন্দ্র,সূর্য, আকাশ পাতাল সাক্ষী ,তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড” আমার রিপ্লাই ছিল একটাই, “ এত আতলামি শিখছেন কোথায় ?” তারপর ব্লক।
দিন যায়,ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে,এক্সসেপ্ট করি।মজা নেই। একদিন আমার একটা ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসলো। ভাবলাম তারে একটু নাচাই। কিন্তু দেখলাম, তারে নাচানো লাগে না,সে দেখি এমনেই নাচে। চ্যাটে বসলে কি সুন্দর সুন্দর কথা বলে। একদিন খালি একটু ডাউট দিছিল,আমি ডিরেক্ট বলছি, “ আপনার যদি কোন সন্দেহ থাকে তাইলে রিমুভ করে দিন, কোন আপত্তি নাই আমার” তারপর আর তার রিপ্লাই দেই না, পরে দেখি সে লম্বা একটা মেসেজ পাঠাইছে। “ হাজারো ফেকের ভিড়ে তুমি যে আসল সেটা বুঝতে পারিনি আমি,কিছু মনে করোনা প্লীজ”। কি আর করবো,রাগ ভাঙ্গলাম,সব স্বাভাবিক। বন্ধু আবার আমার কাছেই এসে গল্প করে, কোন সুন্দরী মেয়ে নাকি তার পিছনে ঘুরে, কিন্তু সে একদম পাত্তা দেয় না। আমি মনে মনে হাসি।চ্যাটের কাহিনি তো সব আমিতো জানি, ইউ লুক টু ইনোসেন্ট কে লেখে সেইটাও তো আমি জানি। কিন্তু বন্ধুর ভুল ভাঙ্গাইলাম না।বেচারা সুখে আছে,সুখেই থাকুক।
এরই মাঝে ঢাবির সমাজকল্যাণ বিভাগের মাস্টার্সের এক ভাইয়া, যে রেগুলার আমার ফেকের সাথে চ্যাট করত সে হঠাৎ চ্যাটের মধ্যে বলে বসলো, “ আমার মা তো আমার বিয়ের জন্য পাত্রি খুজতেছে,আমি কি তোমার কথা বলব?” সেই মুহূর্তেই ডিসিশন নিলাম অনেক হইছে,আর না।মানুষকে এত বোকা বানানো উচিত হচ্ছে না।দুই বছর আগের কোন এক সন্ধায় একাউন্টটাকে ডিএক্টিভেট করে দিলাম। এরও কিছুদিন পর যখন ওই বন্ধুর সাথে দেখা হয় তখন তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, “ কিরে,তোর মনিকার খবর কি?”
ওর উত্তর ছিল, “আর বলিস না,পাত্তা দিতাম না তো, তাই রাগ করে মনে হয় আমারে ব্লক করে দিছে” । ওই মুহূর্তেও তাকে আসল কথাটা বললাম না আমি। সে যদি মনিকার কথা চিন্তা করে সুখ পায়,পাক ।আমার তাতে ক্ষতি কি?
এরপর অনেকদিন হয়ে গেছে। এখন মাঝে মাঝেই কিছু ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাই,ফেক আইডির। বিরক্ত হয়ে গালি দেই,শালাদের কি কোন কাজ কাম নাই। পরক্ষনেই মনে পড়ে,এই ফেক একাউন্ট দিয়েই কি আকাম কুকাম গুলাই না করেছি আমি।

২,৩৮৭ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “আমি,ফেসবুক ও আমার ফেক আইডি”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    আহারে কত্তগুলান ছেলের স্বপ্ন নিয়া তুই ছিনিমিনি খেললি 😉
    অভিশাপ লাগবো কিন্তু :grr:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. দিবস (২০০২-২০০৮)
    দোস্ত অভিশাপ মনে হয় অলরেডি লাগছে

    কথা সত্য 😀

    আর বলিস না,পাত্তা দিতাম না তো, তাই রাগ করে মনে হয় আমারে ব্লক করে দিছে

    পুরাই বাংলার হিরু B-)


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  3. তপু (৯৯-০৫/ককক)

    কিছু বল্লাম না । আমার একটা ফেক id এখনো বিদ্দমান। মজা লাগে পলাপানের আকুলতা দেখে। কিন্তু অই id টাতে ডুকিনা প্রায় এক বসর হইছে।বিদেশে জেশব বাংলাদেশি ভাই থাকেন এদের মনে হই ফেক id বিশয়ক কোনো ধারনা নাই।
    মজা পাইলাম রে ভাই। :)) :)) :))

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মঞ্জুর (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।