বেতাল

কখনো ডায়েরি আর কলমটাকে কোলের ওপর ফেলে রেখে দেয়ালের দিকে শূন্যচোখে তাকিয়ে থাকা, কখনো গিটারের তারে আঙুলের নানা মাপের চাপে-টোকায় সুর খোঁজা, কখনো ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখ বুঁজে বুঁদ হওয়া। নিলয় যতক্ষণ বাসায় থাকে, ততক্ষণ এ তিনটা দৃশ্য চোখে পড়ে। ডায়েরি, গিটার আর ইয়ারফোনের তিন ইয়ারী কথা আদতে একটা গল্পই বলতে চায়। নিলয়ের তন্ময়তা চোখে পড়ে, অস্থিরতার আঁচ পাওয়া যায়। ভেতরে ভেতরে বেসুরো-বেহাল এক বাদ্যযন্ত্রের মত নিলয় প্রায় নীরব ও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।
এ ক’টা দিন বহির্মুখী, দখলদারী। সেমিস্টারের শেষে এসে ক্লাসটেস্ট, রিপোর্ট সাবমিশন, প্রেজেন্টেশন দিনগুলোকে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। যেটুকু বাকি থাকে সেটুকু ডায়েরি-গিটার-ইয়ারফোনের কব্জায়। বিশ্বাসঘাতকের মত সুযোগ বুঝে গলাটা বসে গেছে–খানাখন্দে ভরা এবড়োথেবড়ো রাস্তার মত। গানের লিরিকটাও ঠিক জুতসই হচ্ছে না। ডায়েরির পাতায় পাতায় কাটাকুটি। ছন্দ মেলাতে গিয়ে নির্মমভাবে কাটা পড়েছে প্রিয় শব্দ। কাটছাঁটের পর যে চেহারা নিয়েছে তা নিতান্ত সাদামাটা চলনসই সুবোধ বালক গোছের। কখনো শোনাচ্ছে শিশুতোষ ছড়ার মত।
কথার খামতি সুরে পোষাচ্ছে না। যে ক’টা গানে আগে সুর দিয়েছে নিলয়, তারাই খানিকটা চেহারা বদলে হাজির হচ্ছে। বারবার শোনা কোন প্রিয় গানের সুর হঠাৎ হঠাৎ ঘাই মেরে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে আটঘাট বাঁধা সুর ধরার চেষ্টা। সুরের ভাণ্ডারে এখনই টান পড়ল নাকি?
হাতড়ে হাতড়ে নিলয় যখন কিছুই পাচ্ছে না তখন ইয়ারফোনে পৌঁছে যায় মৌসুমী ভৌমিক, সলিল চৌধুরী, অঞ্জন দত্তের কাছে। শুনে শুনে নিজের ভোঁতা হয়ে যাওয়া সুরে শাণ দেওয়ার চেষ্টা। হঠাৎ হঠাৎ স্ফুলিঙ্গের মত কোন সুর ছিটকে ওঠে। নিলয় মুহূর্তের জন্য উল্লসিত হয়। কিন্তু সেই ফুলকি আবার মিলিয়েও যায়।
অথচ কালচারাল ফেস্টের বেশিদিন বাকি নেই।

শীতের অকাল সন্ধ্যায় কলেজের খোলা মাঠে ছোটখাট একটা জটলা। কুড়মুড়ে চিনাবাদাম, চোখে জল আনা ঝালমুড়ি, জিভপোড়ানো রঙ চা আর সাথে নিলয়ের গান। নিলয় গিটার বাজায় আর গায়। সুরে, বেসুরে, ভাঙা গলায়, হেড়ে গলায়। বিকাল থেকেই ও হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। প্রথমে শুধু বন্ধু ক’জন, ধীরে ধীরে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের দল ভারী। নিলয়ের গানের রুচিতে একনিষ্ঠ প্রেম নেই–বহুগামী প্রেমিকের মত সে প্রায় সব ধরণের গানেই যাতায়াত করে। পাবলিক ডিমান্ডে অনুপম রায় দিয়ে শুরু করে চন্দ্রবিন্দু, মহীনের ঘোড়াগুলি, পিঙ্ক ফ্লয়েড ঘুরে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ে এসে থামে। এর ফাঁকেফোকরে বিটলস, লিনকিং পার্ক, জন ডেনভার গুঁজে দেয়। কখনো রবীন্দ্রসংগীতের ঢিমে তেতালা সুরকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। কখনো চটুল বাজারচলতি কোন গানকে ধীরলয়ের কোমল সুরে ফেলে দেয়। তুড়ি বাজিয়ে, গিটারের শরীরকে তবলা বানিয়ে, শিস দিয়ে নিজের ঢঙে বদলে নেয় একেকটা গান।
এই দিনগুলো রেণুর মত দিনাজপুরের বাতাসে ভেসে বেড়ায়। নিলয় তখনো ঢাকামুখো হয়নি। একটুআধটু গান লিখত, তাতে সুর বসাত, গাইত তো বটেই। ঢাকা চলে আসার পর দিনাজপুর সরকারি কলেজের মাঠ থেকে এই ছবিটা উধাও। পিছু পিছু এসে জুড়তে পারতো ঢাকার বুকে। ডাকসুতে, টিএসসিতে, হলের মাঠে কতজনই তো গানের আসর জমায়। ছেলে হলে থাকলে রাজনীতি করবে, উচ্ছন্নে যাবে। বাবা-মার জোরাজুরিতে তাই বড়বোনের বাসায় আস্তানা গাড়ায় হলজীবন আর হলের মাঠে আসর–দু’টোই বাদ পড়ল। ডাকসু-টিএসসি বাদ গেল ডাঙায় তোলা মাছের অসহায়ত্বে। হয়ত কোন একটা আসরে গিয়ে একবার বসে পড়লেই হয়। একবার ওদের সাথে কণ্ঠ মেলালেই হয়। হয়ত গলার স্বরেই বুঝে ফেলবে ওরা, বলবে–আপনি গান করেন নাকি?
কিন্তু কি এক জড়তা পায়ে ঝিঝি ধরার মত ওকে অবশ করে রাখে। দিনাজপুরের চেনা হাওয়ায় এসবের কোন বালাই ছিল না। এখানে আসার পর নিলয় টের পেল লজ্জা-সংকোচ-দ্বিধা ওর ভেতরের কোন অন্ধকার গুহা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে আর ওকে ঠেলে পাঠাচ্ছে নিজের গর্ভে।
অথচ নিলয়ের স্বপ্নগুলো গান থেকে ভেসে ওঠা। গান ওর পেয়ালা কানায় কানায় পূর্ণ করেছিল ছোটবেলাতেই। ছোট চাচা গানপাগল মানুষ। গাইত না, তার ছিল শোনার নেশা। ভার্সিটির ছুটিছাটায় যখনই দিনাজপুরে আসত, সাথে থাকত নতুন নতুন ক্যাসেট। চাচার সাথে ঘুরে ঘুরে এখানে ওখানে গান শুনতে শুনতে নিলয়ের ভবঘুরে গায়ক হওয়ার ইচ্ছা হত। চাকরি-বাকরি, সংসার-টংসার, পিছুটান কিচ্ছু নেই। শুধু ঘুরতে ঘুরতে গাওয়া, আর গাইতে গাইতে ঘোরা। ডায়েরিতে লিখেছিল একবার, ‘কোন এক গেরুয়া জঙ্গলে জংলী পাখির গান শুনে যে গান ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়বে মাথার ভেতর, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্বরলিপির ঝাপটায়। শুকনো পাতা, নদীর জল আর হাওয়ায় বোনা সারগাম।’ নিলয় ভাবত, রোজনামচা লেখার মত রোজ লিখবে একটি গান। গল্পকথকের মত গল্প বলবে গানে।
কৈশোরে আনাড়ি হাতে লেখা একটা গান তার নিজেরই বেশ মনে ধরেছিল।
পোষা ময়না, এ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ
পোষা কুকুর, টবে লতানো গাছ
পোষা দুঃখ- আরও যত্নে পোষা
ভেতরে শাঁস আর বাইরে মরা খোসা
খোসা ছাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলে কেউ
অথৈ সাগর, ঢেউয়ের ‘পরে ঢেউ
তারও অতলে প্রাণভোমরা ওড়ে
গোপনে একা তোমার তালাশ করে
পোষ মানবে বলে।
বশ মানবে আপন খেয়ালে
বাঁধতে হবে না দেয়ালে দেয়ালে
হাতটি বাড়িও চিনতে পেলে
থমকে দাঁড়াবে যাযাবর ছেলে
শুধু
পোষ মানবে বলে।
প্রথমবার যখন বন্ধুদের শুনিয়েছিল স্বীকার করেনি এটা আগাগোড়া তার গান। দ্বিধা ছিল, আদৌ এটা গান হয়েছে তো?
‘এই গানটা একটা নতুন ছেলে গাইছে। নামটাও মনে নাই…পলাশ-শিমুল এই টাইপ কিছু হবে। গানটা ব্যাটা আরেকটু ভাল গাইতে পারতো।’ আলাপটা উসকে দিতে চেয়েছিল নিলয়।
মেহেদী বলেছিল, ‘মিউজিকটা ফ্ল্যাট লাগতেছে। আরেকটু ভেরিয়েশন থাকলে ভালো হইত।’
চন্দন বলেছিল, ‘ব্যাটা অনুপম রায়কে কপি করতে চায় নাকি?’
নিলয় তখন বলেছিল, ‘চল, সুরটা বদলায় পলাশ-শিমুলের বারোটা বাজায় দেই।’
সেই আসরেই ওরা সবাই মিলে সুরের চেহারাসুরত পালটে দিয়েছিল। সমান চেহারায় বাঁক এনেছিল, কোথাও পাহাড়ে চড়িয়ে খাদে ফেলে দিয়েছিল। এরপর নিলয় নিজেও আরও কয়েকবার সুরটাকে নেড়েছে-চেড়েছে।
এরপর এইচএসসি, অ্যাডমিশন টেস্টের ধাক্কায় একটা বছর গেল গানহীন। বাবার ধমকধামক, মার চাপাচাপিতে এ সময়টা গিটার বাক্সবন্দি রইল। দিনাজপুর ছেড়ে ঢাকায় থিতু হওয়া, বন্ধুবান্ধবদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া। এই বছরটা ওলটপালটের। গিটারের জন্য প্রাণ উশখুশ করা এই সব দিনে অ্যাডমিশন টেস্টের ঢাউস গাইড বইয়ের এক কোণে লিখেছিল–
বাক্সবন্দী গিটার
শেকলবন্দী মন
গৃহবন্দী শরীর
নজরবন্দী ক্ষণ
সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করার ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন করে সুর বসিয়েছিল কথাগুলোয়।
এখন গিটার আবার তার হাতে, কিন্তু দিনাজপুর সরকারি কলেজের মাঠের অনুরাগী শ্রোতাদের সে ঢাকায় কোথায় পাবে!
নিলয়ের ইদানীং মেহেদীকে বেশ মনে পড়ে। ঠোঁটকাটা মেহেদী গান পছন্দ হলে হৈহৈ করে লাফিয়ে উঠবে, অপছন্দ হলে নাক-চোখ কুঁচকে বলবে, ‘ধূর! কি গাইলি এইটা!’
মেহেদী গায় না, কিচ্ছু বাজায়ও না। তবু কখনো গানের দল করার কথা ভাবলে প্রথমেই মেহেদীর কথা মনে আসে। নিলয়ের মেহেদীকে ডেকে বলতে ইচ্ছা করে, তুমি আমার পাশে বন্ধু হে
বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো..।
মনে মনে মেহেদীর সাথে আলাপ চালাতে চালাতে নিলয় ভাবে, ধূর! ব্যাটাকে কলই দেই!
একটা রিং এর পরই মেহেদীর গলা—
‘আরে মেধাবী ছাত্র! কি মনে কইরা?’
‘ধূর ব্যাটা! ফাইজলামি থামা!’
‘ফাইজলামি কি! আমরা তো আর তোমার মত ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ার চান্স পাই নাই! আমরা পইড়া আছি রাজশাহী ভার্সিটিতে।’
‘থাম না রে ব্যাটা! মন-মেজাজ ভাল নাই।’
‘ভাল নাই কেন? গান-বাজনা যায় কেমন? ঢাকায় ভক্ত-টক্ত জোটাইলি কেমন ?’
‘ফাইজলামি বাদ দে না! গানের ইন্সপিরেশন নাই। ছুটিছাটা পাইলে তোর ওখান থেকে ঘুরে আসব।’
‘ইন্সপিরেশন শর্ট পড়লো কেন? নিজের ট্যালেন্টের অপচয় করলে তো হবে না!’
‘এখানে তোরা নাই। উৎসাহ পাইনা।’
‘আরে ব্যাটা! এতদিন দিনাজপুরে পড়ে ছিলি। এখন আছিস ঢাকা। তোর অডিয়েন্স তো বড় হইছে।’
‘এইখানে কেউ জানেই না আমার গানের খবর।’
‘না জানলে জানা! ফেসবুকে গান আপলোড কর!’
‘ধূর! এইভাবে হয় না।’
‘সামনাসামনি নিজের ঢোল পিটাইতে না পারলে পর্দার আড়ালে গিয়াই তো পিটাইতে হবে। তোর ওই গানটা আছে না? পোষা ময়না , এ্যাকুয়ারিয়ামে মাছ–ওইটা আপলোড দে। তুমি বোরখা পইড়া মুখ ঢাইকা ঘুরবা, আবার রূপের প্রশংসাও চাইবা–তা তো হয় না!’
নিলয় দোনামোনা করতে করতে শেষে বোনকে ডেকে ভিডিও করিয়ে নেয় গানটা। তারপর দ্বিধা-সংকোচ আর উত্তেজনাসমেত ফেসবুকে আপলোড। ফেসবুকের স্ক্রীনে চোখ সেঁটে নোটিফিকেশনের অপেক্ষা–কে কে লাইক করলো, কেউ কমেন্ট করে কি না। প্রথম প্রথম তেমন সাড়া নেই, অনেকটা নিশ্চুপই। কিছু লাইক, অল্প কয়েকটা কমেন্ট, দিনাজপুরের বন্ধুদের খানিকটা হৈচৈ।
নিলয়কে সান্ত্বনা দিতেই কি না, মেহেদী শেয়ার করেছিল গানটা। খুব আশ্চর্যজনকভাবে তার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা এক বিখ্যাত গায়কের নজরে আসে তখন। ব্যস্ত মানুষ, কোন খেয়ালে ভিডিওটা দেখে শেয়ার করেছিলেন কে জানে! সেই এক শেয়ারে মানুষ ‘হুমড়ি খেল’ বললে বাড়িয়ে বলা হবে, তবে অনেকেরই নজরে পড়ল। এক গানেই নিলয়ের প্রায়-বাজিমাত।
ডিপার্টমেন্টের কারোরই জানা ছিল না মুখচোরা সাদামাটা এই ছেলেটা গান লেখে, সুর করে, আবার গায়ও। হঠাৎ পাওয়া গায়কখ্যাতিতে নিলয়ের কিছু বন্ধু জুটে গেল রাতারাতি। টিএসসিতে ওকে ঘিরে গানের আসর বসল। গানের দল বিহঙ্গ একদিন আমন্ত্রণ জানিয়ে গেল তাদের সাথে গাইতে।
ডিপার্টমেন্টের সিনথিয়া নামের মেয়েটা– আগে যার দিকে তাকালে অবজ্ঞায় মুখ ঘুরিয়ে নিত, তার কঠিন ভাব উধাও, হালকা হাসির রেখায় মোলায়েম ।
খুশি তাজা থাকতেই নিলয় আবার ডায়েরি-গিটার-ইয়ারফোন নিয়ে বসল। এ গানের রেশ থাকতে থাকতেই আরেকটা গান নাজিল হোক। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরাও ধরে বসল, ‘কালচারাল ফেস্টে তোর নিজের একটা গান চাই, ব্র্যান্ড নিউ!’
একটা নতুন গানের পেছনে ছুটতে গিয়ে নিলয় ডায়েরির পাতা কাটাকুটিতে ভরিয়ে ফেলে। দিশাহারা হাতের আঙুল গিটারের তারে জখম করতে করতে তার মনে হয়, একটা বিকল বাতিল বাদ্যযন্ত্রের মত সে পড়ে আছে অন্ধকারে। বাজনা থেমে গেছে।

‘নিলয়, কি অবস্থা? গান-বাজনা কেমন চলছে?’ ফেসবুকে সেই বিখ্যাত গায়কের মেসেজ পেয়ে নিলয় গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। তার গান নিলয়কে তেমন টানে না, কিন্তু কৃতজ্ঞতার টান তো আছেই। আর খ্যাতিওয়ালাদের সাথে খাতির পাতানোর গরজ থাকা চাই তার মত উঠতি গায়কের।
‘ভাল না ভাইয়া…একটি লিরিক মোটামুটি রেডি…কিন্তু মিউজিকটা হচ্ছে না। গলার অবস্থাও ভালো না।’
‘এরকম হয় মাঝে মাঝে…ডোন্ট ওয়ারি। তবে সব কিছু তোমাকেই করতে হবে কেন? লিরিকস যেহেতু রেডিই আছে, মিউজিকটা অন্য কাউকে দিয়ে করাও। অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াও।’
‘গানের লোকজনের সাথে আমার তেমন জানাশোনা নাই… নিজেই আরেকটু দেখি। আপনার কি অবস্থা? কোন নতুন গান-টান?’
‘সামনে একটা মিউজিক ভিডিও করবো।’
‘দারুণ খবর! গান রেডি?’
‘আরে নাহ! কিছুই হয় নাই। শোনো, তোমার লিরিকস লেখার হাত ভাল। আমাকে কয়েকটা ভাল লিরিকস দাও। সেখান থেকে একটা সিলেক্ট করি।’
গায়কের সাথে আলাপ শেষ করে নিলয় দমে যায়। অন্যের জন্য গান লিখতে সে চায় না। গান এখনো তার খুব ব্যক্তিগত জিনিস, পজেসিভ প্রেমিকের মত তার প্রবল অধিকারবোধ। আর ‘গীতিকার’, ‘লিরিসিস্ট’এর পরিচয়ে তার রীতিমত আপত্তি। গানটা কে লিখল, সুর কে দিল তা নিয়ে অল্প ক’জনেরই কৌতূহল। সবাই শুধু গায়ককে বাহবা দেয়, যেন গানটা তার একার। যেন গানের কথাগুলো তার নিজের কথা, আর সুরটা আপনাআপনি এসেছে গলায়। জ্বলজ্বলে তারকা ইমেজের পাশে গীতিকার-সুরকারের দল বড়জোর মিটমিটে জোনাকি।
নিলয় যেমন অন্যের জন্য গান লিখতে চায় না, তেমনি চায় না অন্যের লেখা গান গাইতে। মৌসুমী ভৌমিকের মত নিজের নির্যাস থেকে বেরিয়ে আসুক আশ্চর্য সব কথা। সেই কথার আত্মাকে ধরতে পারে যে সুর তা গুনগুনিয়ে উঠুক বুকে।
হারমোনিয়ামে-তানপুরাতে গান শেখা হয়নি নিলয়ের। গলা সাধেনি, রেওয়াজ করেনি ব্যকরণ মেনে। কখনো গানের দলে ভেড়েনি। গানকে ভালবাসা নিজের মত করে, নিজের কাঁচা মনে। ‘তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে’। তার ভেতরে ভবঘুরে গায়ক হবার স্বপ্ন যেমন সত্য, তেমন সত্য এটাও আদতে সে বেপরোয়া-লাগামছাড়া গোছের নয় । নিজের পুরো জীবনটাকে গানের পায়ের তলায় সঁপে দেওয়ার শক্তি-সাহস নেই এখনো। কিন্তু হয়ত কখনো হবে! অনুপম রায় যেমন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি-বাকরিতে থিতু ছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে চলে এলেন কলকাতার মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। হয়ত তারও এমন ডাক আসবে!
হঠাৎ নিলয়ের ভেতর অপরাধবোধ খচখচ করে। সেই গায়ক তার কাছে খুব বেশি কিছু তো চাননি। সামান্য একটা লিরিকসই তো। অনেকেই হয়ত এমন সুযোগ পেলে খুশিতে বাকবাকুম করতো। আর তার কেমন কৃপণের অন্তরজ্বালা! নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকতে থাকতে খুব রক্ষণশীল আর সংকীর্ণমনা হয়ে গেল নাকি!

কয়েকটা দিন হীনম্মন্যতায়, হতাশায় ডুবে ছিল নিলয়। ছোটবেলায় বিজ্ঞান স্যারের মুখে শুনেছিল, ‘সাউন্ড ক্যাননট ট্র্যাভেল থ্রু ভ্যাকুয়াম’। নিলয়ের মনে হয়েছে বাতাসহীন ফাঁপা গোলকের ভেতর সে–যেখানে কোন সুর ওঠে না। এই শূন্যতার মধ্যেই তাড়াহুড়ায় কালচারাল ফেস্টের গানটাকে দাঁড় করাতে হয়েছে।
ক্লাস শেষে সেটাই গেয়ে শোনাচ্ছিল।
‘আমি খুঁজছি আমার কেন্দ্রবিন্দুকে
বুকের এখানটায়
কোন এক গোপন সিন্দুকে।’
নিলয় গানটা শেষ করে চারপাশে তাকায়। কয়েকজনের হাততালি।
‘কেমন হয়েছে?’
‘ভাল হইছে, গুড সং!’ পাশে দাঁড়ানো জিসান বলে। মুমু নামের মেয়েটা বলে, ‘হুম ভাল…বাট গানটা একটু ভারী হয়ে গেল না ? বেশি হাই থটের।’
সুমন চোখ কুঁচকে বলে, ‘একটু রোম্যান্টিক গান-টান লিখতে পারলি না?’
জিসান এবার সায় দেয়, ‘হুম…একটু ফূর্তি-ফূর্তি মার্কা গান হইলে ভাল হইত। ইটস আ ফেস্ট, ম্যান।’
নিলয়ের কান গরম হয়ে যায়। অস্বস্তি হয়। অপমানের কিছু হয়নি, তবু ঝাঁ ঝাঁ অনুভূতি। সিনথিয়াও এখানে বসে আছে–ভাবলেশহীন। সে কিছু বলেনি ঠিকই, কিন্তু ওর সামনে কেমন ছোট হয়ে গেল। হ্যাঁ, তার রুচির সাথে সবার রুচি না মিলতেই পারে। কে কি ভাববে তাই ভেবে তো সে গান করতে পারেনা! আর সমালোচনা হজম করার শক্তি থাকতে হবে তো! মেহেদীর চাঁছাছোলা নিন্দামন্দে সে তো কখনো রাগেনি।
নিলয়ের ভয় হয়, এই যে ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা–যারা তাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে নাচল ক’দিন, হয়ত ফেলে দিতেও দেরি করবে না। হয়ত আছাড় মেরে ফেলে দেবেনা, হয়ত আলগোছে নামিয়ে দেবে।
চোখ মাটির দিকে রেখে নিলয় গেটের দিকে যাচ্ছিল। তখন সিনথিয়া এগিয়ে এলো ।
‘এ্যাই! তুমি কি আপসেট? আমার কিন্তু গানটা ভালই লাগল! ডিফরেন্ট।’
মুহূর্তে নিলয়ের মনে হল একটা অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরে অনেকগুলো বাতি জ্বলে উঠল। উত্তেজনায় ঝকঝক, ধকধক!
সিনথিয়া এবার বলে, ‘তুমি তো ভাল গাও। ক্লোজআপ-ওয়ান টাইপের কম্পিটিশনগুলোতে যাচ্ছ না কেন?’
‘আমার খুব একটা ইন্টারেস্ট নাই। তাছাড়া কয়জন ক্লোজআপ-ওয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে আছে?’
‘ফেমাস তো হইছে! যারা সাস্টেইন করতে পারেনি সেটা তাদের ফেইলিওর। কেউ কেউ তো পারছে! গানের অ্যালবামের কথা কিছু ভাবতেছো?’
‘এখনি? গানই তো রেডি নাই! আর আজকাল অ্যালবাম কেউ কেনে না।’
‘সেইটা ঠিক বলছো। কিন্তু তোমার মধ্যে অ্যাম্বিশনের অভাব আছে।’
‘কনফিডেন্সের অভাব আছে সেইটা বলতে পারি।’
‘স্ট্র্যাটেজি নিয়ে চলতে হবে! তোমার কানেকশনস কেমন? ফেসবুক কিন্তু পুওরলি ম্যানেজড। এই যুগে যার কোন গুণ নাই, সেও ঢাক-ঢোল পিটাইতে থাকে ফেসবুকে। আর তোমার তো ট্যালেন্ট আছে! তা তোমার কোন মিউজিক্যাল গ্রুপ নাই?’
‘নাহ ! ওয়ান ম্যান শো বলতে পারো।’
‘ধূর! এভাবে হয় নাকি? শুধু গিটারে কি আর ভাল মিউজিক হয়? কী বোর্ড -ড্রামস এইসব বেসিক ইন্সট্রুমেন্টস তো লাগবেই! যাই হোক, অনেক অ্যাডভাইস দিলাম। এগুলা কিন্তু ফ্রী না!’
নিলয় হাসে। ‘ট্রিট চাও নাকি?’
‘নাহ ট্রিট না। আমার বোনের বিয়ে ইন টু মানথস। আমি ওকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই। আমি ওদের লাভস্টোরিটা তোমাকে বলবো। তুমি সেটা নিয়ে একটা গান কম্পোজ করে বিয়েতে গাইবা!’
‘সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং!’
মুখে খুব আগ্রহ দেখালেও সিনথিয়া চলে যাবার পর নিলয় অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কোন প্রেমের গল্প শুনে একটা গান তৈরির ইচ্ছা ফড়ফড় উড়তেই পারে। কিন্তু সিনথিয়ার বোনের প্রেমের কাহিনী যদি হয় একদম গড়পড়তা-বিশেষত্বহীন- ছাঁচেফেলা-ক্লিশে, যদি সেই গল্প নিলয়ের ভেতরের একটি বাতিও জ্বালাতে না পারে, তাহলে গানটা কি নিলয়ের গান হবে? সিনথিয়ার বোন-দুলাইভাইয়ের মন ভরাতে বানিয়ে বানিয়ে একগাদা অমরপ্রেমমার্কা লোকদেখানো কথা বলতে চায় না নিলয়। ফরমায়েশী গান ছক-কাটা। ডাইনে যাও, বাঁয়ে যাও, সামনে আর এগিও না, পেছন ফেরো। খাঁচাবদ্ধ! সিনথিয়া, আমি তোতা পাখি নই!
নিলয়ের মনে হয়, ওর গানের নির্জন জগৎটায় কেমন ভিড়ভাট্টা বেড়ে যাচ্ছে। কারো রুচির সাথে তাল মিলিয়ে, কারো আবদার মিটিয়ে, কারও প্রত্যাশার চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হতে হতে ওর ভালবাসার জায়গাটায় কেমন দায়বদ্ধতার দেয়াল পড়ছে।
কিন্তু একটা বড় সুযোগও তো হাত নাড়ছে! সিনথিয়ার কাছাকাছি আসার। ওর পরিবারের নজরে পড়ার।

আজ ডায়েরি খুলে নিলয়ের একটা প্রেমের গান লিখতে ইচ্ছা করে। সহজ ধরণের কোন গান। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুবান্ধবেরা তো কালচারাল ফেস্টের জন্য রোম্যান্টিক গানই খুঁজছিল।
আমি সাদামাটা ছেলে
সাহস ছিল না আমার
তোমার দিকে নিজেকে ঠেলে
তোমার সামনে থামার
তুমি দেবী আমি পূজারী
আমি কবি, খুব মাঝারী
তাই সাহস ছিল না আমার
তোমার দিকে নিজেকে ঠেলে
তোমার গভীরে নামার
একটানে এ্যাদ্দুর লিখে ফেলে নিলয়। পুরো গানটা দাঁড়ায় নি এখনো। তবু মাথায় ঘুরতে থাকা একটা সহজ সুর ঝটপট বসিয়ে দেয় এতেই। কি এক অস্থিরতা ওকে চড়কির মত ঘোরায়। ধৈর্য ধরার স্থিতিটুকু নেই। আধাআধি গানটাই রেকর্ড করে মেহেদীকে পাঠিয়ে দেয়। খানিকপর মেহেদীর ফোন আসে,
‘হইছে টা কি তোর? এই অবস্থা কেন? এইরকম লুতুপুতু গান কেন লিখছিস? খুবই সস্তা হইছে। সুরটাও ম্যাড়মেড়া হইছে।’
‘এইটা এই আধঘন্টা আগে লিখছি। কথা-সুর কিছুই ফাইনাল হয়নি। মনে যা সুর আসছে তাই বসায় দিছি। কেমন অস্থির অস্থির লাগতেছিল… আধখ্যাচড়া জিনিস– নাহ্, তোকে এখনি পাঠানো ঠিক হয় নাই ।’
‘তা তো হয়-ই নাই। আর শোন, এইসব প্রেম-ট্রেমের গান বাদ দে, গান লিখার আর কোন টপিক নাই? বাংলাদেশের সিংগাররা দশটা গান গাইলে নয়টাই গায় প্রেমের গান। সবখানেই প্রেমের কপচানি। তুই এগুলা বাদ দে!’
‘প্রেমের গান ভাল হয় না ?’
‘হয়, কিন্তু তোরটা হয় নাই। ডেপথ নাই! তোর প্রেম খাঁটি মনে হইতেছে না ! নাকি প্রেমের জোয়ারে বুদ্ধিটুদ্ধি সব ভাইসা গেছে? গান লিখা শুরু করছিস যখন, একটু কবিতা-টবিতা পড়ার অভ্যাস কর।’
মেহেদীর সাথে কথা শেষে নিলয় কেমন মরিয়া হয়ে ওঠে। একটা প্রেমের গান লিখতেই হবে তাকে। এই এক্ষুণি! নিলয়ের জেদী কলম তেজের সাথে ছোটে।
পুব থেকে এসেছি আমি
পশ্চিম থেকে তুমি
তুমি পেরিয়ে নীল সাগর
আমি মরুভূমি
তোমার পায়ে জলের কণা
আমার পায়ে ধুলো
তোমার হাতে গাঙচিল
আর শঙ্খ যতগুলো
আমার হাতে রোদের চিহ্ন
ক্যাকটাস কাঁটাঅলা
আমার কণ্ঠ শুষ্ক রুক্ষ
তোমার ভেজা গলা
মরীচিকার ধাঁধাঁ পথে
আমার হাঁটাচলা
তবু সত্য ছিল কিছু
হয়নি এখনো বলা
আমার গলা শুষ্ক রুক্ষ
আমার কণ্ঠ বোঁজা
ইশারার নিশ্চুপ পথে
শব্দ হাতড়ে খোঁজা

এতটুকু লেখার পর নিলয়ের কলম থমকায়। কই যাচ্ছে গানটা? গন্তব্য কোথায়? তার প্রেমের গান লেখার কথা, অথচ স্পষ্ট করে প্রেমের কথা বলা নেই একবারও। ভালবাসা শব্দটা অন্তত একবার থাকুক।
এরপর নিলয়ের কলম থেকে বেরোয় চারটা লাইন। কম পছন্দের, কিন্তু দরকার ছিল হয়ত।
সরলতম শব্দটা
হয়ত এখন বাসি
বাতাসে দেখো কান পেতে
ভালবাসি ভালবাসি

খানিক আগে নিলয় ফেসবুকে নোটিফিকেশন পেল জাহিদ হোসেন তার গানটা শেয়ার করে তাকে ট্যাগ দিয়ে লিখেছে– প্রাউড অফ ইউ নিলয়! বিখ্যাত হয়ে বন্ধুদের ভুলে যাস না যেন!
পোস্টটা দেখে নিলয়ের হাসি পেল, রাগও হল। ব্যাটা মশকরা করে নাকি?
কিছুটা ধান্দাবাজ গোছের এই জাহিদের সাথে যোগাযোগ নেই বছর চারেক। তার আগেও যে ঘেঁষাঘেঁষি ছিল তা না। শত্রুতাও নেই, মিত্রতাও নেই। যেহেতু ক্লাসমেটদের বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং ক্লাসমেট হয়ে উঠতে কোন বিশেষ যোগ্যতা লাগে না, তাই জাহিদকে ক্লাসমেট শ্রেণীভুক্ত করা যায়। সেই জাহিদের তরফ থেকে ‘ভুলোনা আমায়’ টাইপ অনুরোধ !
নিলয় ভাবে, কখনো নাম-টাম করে ফেললে, যারা তাকে পাত্তা-টাত্তা দেয়নি এবং সে-ও যাদেরকে পাত্তা-টাত্তা দেয়নি, তারাও কি ‘বন্ধু, বন্ধু’ বলে ছুটে আসবে?
এই যে সিনথিয়া, কতটুকু চেনে নিলয়কে? গানের বাইরের নিলয় কতটা বিরক্তিকর, কতটা সহনীয়, কতটা দুর্দান্ত, কতটা একেলে, কতটা সেকেলে, কতটা রুচিতে রুচিতে মেলে, কতটা ঠোকাঠুকিতে–কিছুই তো জানে না! এখন সে একটা স্টার শেপড বেলুন, সত্যিকারের তারা নয়। যে কোন মুহূর্তে ফুটো হয়ে যাবে। যদি সত্যিকারের তারার মত আকাশে ঠাঁই না হয়, তাহলে সিনথিয়া কি তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আসল তারা খুঁজতে খুঁজতে বলবে, ‘আকাশের ওই মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা’? নিলয়ের একটা পুরনো বাংলা গান মনে পড়ে যায়। সুবীর সেনের গাওয়া। এতো সুর আর এতো গান/ যদি কোনদিন থেমে যায়/ সেইদিন তুমিও তো ওগো/ জানি ভুলে যাবে যে আমায়।
এই যে ঝর্ণা ফুপু, এক বড়লোকের সাথে বিয়ে হবার পর সে আর নিলয়দের আত্মীয় হিসেবে গোনে না। সেও কি দাওয়াত দিয়ে খাইয়ে আত্মীয়তা ঝালাই করবে, যদি নিলয়ের নাম-ডাক হয়? এই যে বাবা, যিনি একদিন মাঠের গানের আসরে এসে গালিগালাজ করতে করতে নিলয়কে চড় মেরেছিলেন, তিনিও কি পরিতৃপ্ত মুখে লোকজনকে বলে বেড়াবেন ‘আমার ছেলে নামী গায়ক!’?
সৌজন্যের পরতে ঢাকা পড়বে সবকিছু? শুধু বিগলিত ভালমানুষী চেহারা দেখাবে লোকে? কোথায় থাকবে তাদের সোজাসাপ্টা আদি, অকৃত্রিম অকপট চেহারা? তার আর সবার মাঝে থাকবে খ্যাতির দূরত্ব। যত বেশি খ্যাতি, তত দীর্ঘ দূরত্ব! খ্যাতির বলয় ডিঙিয়ে সে নিজেই হয়ত বেরোতে চাইবে না! তখন কি নিরন্তর অন্য গায়কদের সাফল্য দেখে গায়ে জ্বর আসবে? টেক্কা দেওয়ার জেদ বনবন ঘুরবে মাথায়? নিজে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার নেশায় নেশাখোরের মত ছটফট করবে? আরও ভাল, আরও ভাল, আরও ভাল! যতক্ষণ না মাথা মহাশূন্যে ঠেকে! তারকাখ্যাতির নেশা কি সহজে কাটে?
একবার আকাশের তারা হয়ে গেলে খসে পড়াটা কত নির্মম! একটা মাত্র গান গেয়ে সামান্য যে খ্যাতি সে পেয়েছে, সেটুকু হারানোর ভয়েই তার এত হা-হুতাশ।
জনপ্রিয়তা-খ্যাতি শব্দগুলোকে নিলয়ের কখনো এত ভয়ংকর মনে হয়নি। এই মুহূর্তে নিলয়ের আবার মেহেদীর কথা মনে পড়ে। কল দেয়। ব্যাটা ধরল না।
নিলয় মনে মনে মেহেদীর সাথে কথা চালায়।
মেহেদীর রাগী স্বর,
‘সুখে থাকলে ভূতে কিলায়–এই দশা তোর। একটু নাম হইছে, সেইটা হজম হচ্ছে না। তোর গানের জন্য মানুষ যদি তোকে দাম দেয় তাইলে সমস্যাটা কি? তোর ভাবটা এমন যে মানুষ তোর গায়কসত্তাকে ভালবাসে, তোকে না। তুই তোর গায়কসত্তাকে তোর থেকে আলাদা করে দেখতেছিস কেন? আরে ব্যাটা, তুই-ই তো তোর গায়কসত্তা!’
‘কিন্তু গান তৈরি তো আমার সহজাত প্রবৃত্তি না…আনায়াস না…গান আপনাআপনি আসে না…সৃষ্টি করতে হয়।’
‘সৃষ্টির ক্ষমতাটা তো তোরই…সব কিছুকে খণ্ড খণ্ড করতেছিস কেন?’
‘মানুষ সবসময় ক্রিয়েটিভ থাকে না…শুধু তার ক্রিয়েটিভিটির জন্য তাকে ভালবাসলে সেটা টেমপোরারি।’
‘যা-ই ক্ষণস্থায়ী, তুই তাকেই তোর থেকে বাদ দিবি? জীবনে কতদিন বাঁচবি তাই-তো জানিস না। এই মুহূর্তে যদি একটা সুন্দর গান গাইতে পারিস, তাহলে এই মুহূর্তটাকে ভালবাস না! লোকে গানটা ভালবাসবে কি না, ভালবাসলে সেটা খাঁটি কি না, ভবিষ্যতে এমন গান লিখতে পারবি কিনা এইসব সুদূরপ্রসারী ভাবনার কোন মানে হয়? তোর আসল সমস্যা ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স। তুই যে এইসব ডিজার্ভ করিস, সেইটা মানতে পারতেছিস না।’

সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়েছে নিলয়। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ওর বোন উঠে এসেছিল। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলেছিল, ফ্রীজে ব্রেড আছে, জেলী আছে। খেয়ে যা।’
নিলয় তবু মুখে কিছু না দিয়েই বেরিয়েছে। মোহাম্মদপুর থেকে হেটে এসেছে শাহবাগ। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিনে খেয়েছে পরোটা-ডাল আর রঙ চা। কার্জন হল পর্যন্ত এসে পা আর চলতে চায় না । নিলয় এবার রিকসা নেয়। রিকসা চলে পুরানঢাকা–শাঁখারী বাজার। রিকসা থেকে নেমে নিলয় আবার হাঁটে। অলিতে গলিতে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার নাম দেখে। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছায় সদরঘাট। ফুটপাতে বসে খায় খিচুড়ি ডিমভাজা। সেখান থেকে বাস ধরে গুলিস্তান। গুলিস্তান থেকে ফের বাস ধরে হাইকোর্ট-শাহবাগ-ফার্মগেট-মহাখালী-বনানী-বিশ্বরোড-উত্তরা। উত্তরায় নেমে এক কাপ চা, পাউরুটি আর কলা খেয়ে এবার মোহাম্মদপুরমুখী বাসে ঝুলে পড়া। কালশী-মিরপুর-শ্যামলী হয়ে মোহাম্মদপুর এসে যায়। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় ফিরে গোসল সেরে নিলয় গিটার হাতে ছাদে যায়।
কাল হয়ত আবার বেরোবে সে। ঘুরবে তেজগাঁও, গুলশান, বারিধারা। আরেকদিন গ্রীন রোড, হাতির পুল, ইস্কাটন। আজকের দিনটায় নিলয় এমন ঘোরগ্রস্ত হয়ে আছে যে বাসায় ফেরার পর বোন যখন জিজ্ঞেস করল, ‘এত সকাল সকাল কই গেছলি?’ তখন শুধু ‘কাজ ছিল’ বলেই চুপ মেরে গেছে।
ছাদে হাসনাহেনার ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে সুগন্ধী বাতাস বুক ভরে নেয়। নর্দমার গন্ধ, পেট্রোলের গন্ধ, বাসে মানুষের ঘেমো গন্ধ–সারাদিন কত রকম গন্ধ তার নাকে এসেছে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে, রিকসায় ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে, বাসে যাত্রীদের দেখতে দেখতে আর জানালা গলে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত কিসিমের মানুষজন, কত দোকান, কত যানবাহন তার চোখে পড়েছে। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর নিলয়ের মনে হয় আজ ঢাকার অনাত্মীয় ভাবটা একটু গেল। এতদিন ছিল ‘আমার দিনাজপুর’ আর ‘তোমাদের ঢাকা’, আজ কেমন আমার ঢাকা-আমার ঢাকা মনে হচ্ছে। ‘এই শহর, জাদুর শহর, প্রাণের শহর ঢাকা রে’–চিরকুট ব্যান্ডের মত সেও কবে বলতে পারবে ?
অন্তহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে নিলয়ের কেমন নিরাসক্ত লাগে। শূন্য শূন্য মহাশূন্য! নিলয় ভাবে, কাল বিকালে সে গিটার হাতে টিএসসির মাঠে বা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে গিয়ে বসবে। নিজের মত গাইবে। কেউ শুনতে আসলে আসুক, না আসলে নিজের কাজে মগ্ন থাকুক। খুব কি তফাত আছে?

৫,১৫৪ বার দেখা হয়েছে

৩ টি মন্তব্য : “বেতাল”

মওন্তব্য করুন : আল-মামুন (১৯৮৫-১৯৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।