অসংলগ্ন

নাহরীন মৌলি চ্যাটার্জীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে কি যেন খোঁজে। লাল স্লিভলেস ব্লাউজ। কালচে খয়েরী শাড়ি। গলায় অ্যান্টিক নেকপিস (কাঠমাণ্ডুর জুয়েলারি বোধহয়, ফেসবুকে কালারস অফ কাঠমাণ্ডু পেজটাতে এমন একটা নেকপিস দেখেছে)। চোখের ঢাউস চশমায় চেহারায় একটা গম্ভীর পড়ুয়া-ভাব। আরেকটা ছবিতে চশমার নিচে দুরন্ত চোখ, ঠোঁটে ছেলেমানুষী। গম্ভীর গভীর গাঢ় নীল আর উচ্ছলতার হলুদ মিলে সবুজ সতেজ। নাহরীনের মনে রঙের উপমাটাই এল। মৌলির সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বের বলয়ে ঢুকে পড়তে না পড়তেই ঈর্ষাবাহী একটা তরঙ্গ মাথা থেকে নামে পায়ে। নিজের প্রিয় শাড়িপরা ছবিটা বের করে দেখে একবার। স্লিভলেস ব্লাউজ পড়ার ইচ্ছা থাকলেও বহনকারী রিকসাওয়ালা থেকে শুরু করে রাস্তাঘাটের আমজনতার হাঁ করে তাকানো আর অশালীন মন্তব্যের ভয়ে হাফস্লিভ ব্লাউজ বেছে নিতে হয়েছিল। টিয়া সবুজ ব্লাউজ, আকাশনীল শাড়ি। রাজস্থানি মালা। মুখে স্মিত হাসি। ছবিটায় একটু লাজুকভাব, একটু আড়ষ্টতা। নাহরীন এবার আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মৌলির মুখ হয়ত তার চেয়ে সুন্দর। কিন্তু শরীর? মৌলির ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখেছে সে। তার মত বাঁকা চাঁদের কোমর নেই ওর। টি-শার্টের হাত গুটিয়ে স্লিভলেস বানায় নাহরীন। নাহ্, এমন সাপের মত হিলহিলে হাতও মৌলির নেই। নিজেকে মাঝে মাঝে ফেমিনিস্ট হিসেবে ভাবতে সেভালবাসে। তখন ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’- এইসব প্রবাদ-প্রবচনের ঘোর বিরোধী। অথচ মৌলির ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে তার স্ট্যাটাস না, লেখাজোকার লিংক না, নাহরীন বরং তার ছবিগুলোই ঘাঁটতে বসল। আবার এ-ও ঠিক, মৌলির গুণের কীর্তন না শুনলে তার প্রোফাইল দেখার কৌতূহল হয়ত কখনোই হত না। কলকাতার মেয়ে মৌলি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছে। নিউ ইয়র্কার তার লেখা ছেপেছে। ভার্সিটির জার্নালগুলোতে লেখালেখি ডালভাত।
নাহরীন এবার যায় মেহনাজ মুস্তফির প্রোফাইলে। কাজল-আঁকা ধূসর চোখের ইরানী মেয়ে। মাস্টার্স করছে ওই কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতেই, ফিল্ম স্টাডিজে। এবার নিজের থেকেই বাধা আসে–না, না, চেহারাসুরত পরে, প্রথমে ওর কাজ। ইরানের শহরতলীতে শ্যুট করা দশ মিনিটের একটা শর্টফিল্ম। সেটা দেখতে গিয়ে নাহরীন অভিনেত্রীর সাথে প্রোফাইল পিকচারের মেহনাজকে মেলায়। হ্যাঁ, এটা মেহনাজই, সে-ই অভিনয় করেছে। পরিচালনা ভাল হয়েছে-ভাল কথা, অভিনয় খারাপ হতে পারত। অভিনয়ও ভাল হয়েছে-ভাল কথা, চেহারাটা সাদামাটা হতে পারত! হীনম্মন্যতায় নাহরীনের ইনভিজিবল ম্যান হয়ে যেতে ইচ্ছা করে!
সুযোগ বুঝে প্রমা ইসলামের মুখটাও উঁকি দেয়। তার প্রোফাইলেও ঢুঁ মারা দরকার। প্রমা অবশ্য কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে কিছু করে না, থাকে বোস্টনে। তবু ওর খবর জানা চাই, কারণ নিউইয়র্ক থেকে বোস্টন ট্রেনে মাত্র তিন-চার ঘন্টা। বোস্টনের প্রবাস থেকে প্রমার লেখা ঢাকার পত্রপত্রিকায় এসে পৌঁছে, আর পৌঁছে ওর ফটোগ্রাফির খবর। দারুণ পোর্ট্রেট তোলে–স্টিল ফটোর মুখগুলো যেন কথা বলে! এক্সিবিশন হয়ে গেছে বোস্টনের এক আর্টগ্যালারিতে। এত গুণ সত্ত্বেও নাহরীন হয়ত খুব একটা বিচলিত হত না যদি প্রমাকে সুন্দরী বলতে বাধত। বাজারে চালু আছে, সচরাচর সুন্দরীদের ঘটে তেমন বুদ্ধি থাকে না, মেধাবিনীরা হয় সাদামাটা। বিউটি উইথ ব্রেইন রেয়ার স্পিশিজ। ইমরান কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পর সেই বাজারচলতি ধারণা আরও পাকাপোক্ত হলে নাহরীন স্বস্তি পেত। কিন্তু ইমরান গেছে, আর তার পিছু পিছু গেছে স্বস্তি শব্দটাও।


নাহরীনের আজকাল মনে হয় ওর জীবনটা একটা বদ্ধ ডোবা। মশা-মাছি-কচুরিপানার মত ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স আর ইনসিকিউরিটির অভয়ারণ্য। ওর এইসব দীর্ঘশ্বাস আর হতাশ ভাবনা গলাগলি হাঁটে। অন্যমনস্ক স্বয়ংক্রিয় আঙুল মোবাইলের স্ক্রীনে দৌড়ায়। ফেসবুক ফ্রেন্ডদের হালচাল খানিক দেখে, আবার ঠিক দেখেও না। মৌলিতে এসে আটকে যায় চোখ। ফ্রানজ কাফকার ওপর লেখা একটা নোট। ক’দিন আগে লিখেছিল চমস্কি আর সার্ত্রেকে নিয়ে। এতকিছু এ বয়সেই মেয়েটার আয়ত্তে? বয়স খুব বেশি তো নয়, তার চেয়ে তিন-চার বছরের বড় হবে। আগামী তিন-চার বছরেও মৌলির মত করে ফিলসফি নিয়ে ভাবতে পারবে ?
একেকটা দিনের হিসাব আওড়ায় নাহরীন। ঘন্টা পাঁচেক চলে যায় ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা-ক্লাসে। টিউশনিতে দু’ঘন্টা। টুকরো টুকরো জোড়া দিলে ঘন্টা দুয়েক ফেসবুকে। মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা, সিনেমা-টিভি সিরিজ দেখা। খবরের কাগজ আর সহজপাচ্য গল্প-উপন্যাস পড়া। কখনো সময় যায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে অলস ভাবনায়। ইমরান যখন দেশে ছিল তখন অবশ্য শুক্র-শনি ওর সাথেই কাটত। আর প্রতিরাতে ঘন্টা খানেকের মোবাইল-প্রেম। পিএইচডি করতে ইমরান কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে চলে যাবার পর অলস ভাবনারা ফাঁকা সময়ের দখল নিল। আর তখনই নাহরীনের খেয়াল হল এই অল্প বয়সেই জীবনটা যেন একঘেঁয়ে পুনরাবৃত্তির সাইকেলে ঘুরপাক খাচ্ছে। গড়পড়তা জীবন, তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নেই। সাড়ে বার হাজার কিলোমিটার উড়ে নিউইয়র্কে যাবার পর ইমরান যেন উঁচুমঞ্চে উঠে গেছে। ইমরান-মৌলি-মেহনাজ-প্রমারা সেই মঞ্চে পারফর্ম করে আর নাহরীন নিচে বসে দর্শকের সারি থেকে মুগ্ধদৃষ্টিতে হাততালিই দেয় কেবল। মৌলি-মেহনাজ-প্রমাদের ভিড়ে ইমরানের কি আর নাহরীনকে ভাললাগবে ? খুব সাধারণ মনে হবে না? সেই ইনসিকিউরিটি অনবরত পিন ফোটায় আর ও ইমরানের ফেসবুক ওয়াল আর ফ্রেন্ডলিস্ট ঘেঁটে খুঁজে বের করে দেখে মৌলি-মেহনাজ-প্রমাদের। ইমরানের কথায় বুঝতে চায় ওদের কারো প্রতি আবেগ ঘন হয়ে উঠছে কি না। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ক’টা মেয়েকে ও চোখে চোখে রাখবে ? এভাবে দূর থেকে পাহারাদারী-গোয়েন্দাগিরি যে চূড়ান্ত রকম হাস্যকর তা বোঝার বোধটুকু ওর আছে। নিজের এইসব কাণ্ডকীর্তির বিরুদ্ধে ভেতরের অপরিপক্ব ফেমিনিজমও ঝাঁজিয়ে ওঠে।
ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা জড় স্থবির ফার্নিচার না, ওর একটা জ্যান্ত অংশ। এর সামনে দাঁড়িয়ে ওর নিজের সাথে আলাপ চলে। আজ আয়নার সামনে নিজের গহীনে ডুবসাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ ওর মনে হয়, লেখালেখিও একটা আয়না, একটা সেলফি। নিজে নিজেকে দেখা, নিজে নিজেকে দেখানো। এই প্রথম লেখক হওয়ার ইচ্ছা নাহরীনের ভেতর ফড়ফড় করে। শুঁয়োপোকার খোলস ছিঁড়ে প্রজাপতি হওয়ার আগমুহূর্তের মত।
সাহিত্যে-দর্শনে ওর কৌতূহল বরাবর। সে আগ্রহ ছোটখাট-ছিমছাম পাঁচিলঘেরা বাগান ভালবাসার মতো, দুর্গম অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার না। ভেবেছে গহিনের জটিল, দুর্বোধ্য, আপাত নীরস বিষয়ে ওর দরকার নেই। এখন মনে হচ্ছে তার সাদামাটা সরল চোখে দেখা-কানে শোনা জগতের বাইরে, গতানুগতিক উপলব্ধির বাইরে, খাওয়া-দাওয়া-সাজগোজ-ঘুরে বেড়ানো, ছোটখাট মান-অভিমান-রাগ-ক্ষোভ-চাওয়া-পাওয়ার বাইরে শিল্পের, সাহিত্যের, দর্শনের যে বিশাল অদেখা জগৎ আছে তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়া ওয়ার্ল্ড ট্যুরের চেয়েও হয়ত রোমাঞ্চকর। মৌলি-মেহনাজ-প্রমার আছর পড়ল নাকি?
নাহরীন বিকালে বেরিয়ে পড়ে। শাহবাগে পাঠকসমাবেশ কেন্দ্রে পা রেখে নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয় কিছুক্ষণ। তক্ষুণি ইমরানকে ভাইবারে মেসেজ লেখে- তুমি যাওয়ার পর প্রথম এলাম পাঠক সমাবেশে। বইয়ের তাকে ঢাউস আনা কারেনিনা-টা তেমনি আছে। রুশদীর নতুন বই এসেছে- ঝকঝকে, টাটকা। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির ছাদ-ছোঁয়া বইয়ের দেয়ালের গোলকধাঁধায় তুমি ঘুরপাক খাও। পাঠক সমাবেশের জন্য তোমার কি আর মন কেমন করবে? এখানে এসে তোমার জন্য আমার মন কেমন করছে…।
ইমরান যে ধরণের বইগুলো নাড়তচাড়ত, নাহরীন আজ সেগুলোরই পাতা ওল্টায়, গন্ধ নেয়। মৌলির কাফকাবিষয়ক নোট উঁকি দেয় চিন্তায়। ফ্রানজ কাফকার মেটামরফসিস কিনে ফেলবে নাকি? সামনের তাকে পিটার ব্যারির বিগিনিং থিওরি বইটা স্পষ্ট হয়ে নিজেকে দেখায়, বাকি সব আউট অব ফোকাস। ইমরান ওকে একবার পিড়াপিড়ি করেছিল এটা পড়তে।
সন্ধ্যায় মেটামরফিস আর বিগিনিং থিওরি বুকে চেপে রিকসায় বাড়ি ফেরার সময় নাহরীনের মনে হয় হয়ত ইমরানের কাছ ঘেঁষল একটুখানি।


কাপড় ছাড়ার সময় আয়নায় নিজেকে দেখে নাহরীন। নার্সিসাসের মত আত্মপ্রেম নিয়ে দেখতে থাকে। নার্গিসফুলের আলো আলো আভা নিজের শরীরে । যৌবনের আলো? ইমরান, ইমরান! অস্ফুটস্বরে ও ডাকতে থাকে, প্রার্থনায় ইশ্বরকে ডাকার মত।
দরজায় দমাদম বাড়ি –‘নাহরীন, নাস্তা খেতে আয়।’ তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাহরীন বেরিয়ে আসে।
মা বাড়িতেই রসগোল্লা বানিয়েছে। নাহরীন চামচে কেটে রসগোল্লার অর্ধেকটা মুখে পোরে। মা এবার বলেন,
‘রসগোল্লা বানানোটা শিখে ফেল। শ্বশুরবাড়িতে খাওয়াতে পারবি।’
নাহরীনের কোন সাড়া না পেয়ে তার গলার সুর বদলে যায়, ‘বিয়ে শাদী করবি কবে? মাস্টার্স তো প্রায় শেষই হয়ে গেল।’
বিয়ে-শাদী থেকে বাঁচতে ও আবার রসগোল্লায় ফিরিয়ে আনে মাকে। ‘রসগোল্লাটা তোমার কাছে শিখতে হবে। কালোজামটাও। বাসায় চিজ আছে? কালকে পাস্তা বানাব।’
মাকে সরাতে পারলেও নাহরীন নিজে গর্ত থেকে উঠতে পারে না। বিয়ে নিয়ে ইমরানের সাথে স্পষ্ট আলোচনা হয়নি কখনো।
‘বিয়ের কথা শুনলেই আমার দমবন্ধ লাগে, মন পালাই-পালাই করে। এইসব তুলে রাখ পরের জন্য।’
নাহরীন ভেবেছে, প্রেম করতে ভাল লাগছে, করি। বিয়ের কথা তুলে ভড়কানোর কি দরকার। বিয়ের সময় হলে ও যদি রাজি না হয়, হবে না! দুনিয়ায় ছেলের আকাল নাকি! এইসব গোঁজামিল ভাবনায় নিজেকে শান্ত করেছে তখন। ভেতরে ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাসও শিখা অনির্বাণের মত জ্বলেছে–তাকে হারানোর ভয়ে কি ইমরান বিয়েতে রাজি হবে না!
আর এখন ইমরান যখন এত দূরে, যখন পড়াশোনায় ভীষণ মগ্ন, যখন তার চারপাশে সুন্দরী বিদুষীর অভাব নেই, যখন বিশ্বখ্যাত ইন্টেলেকচুয়াল হওয়ার স্বপ্নে সে বিভোর, যখন সে কেবল ওপরের উঁচু আকাশের দিকে তাকিয়ে, তখন বিয়ের প্রসঙ্গ নিতান্তই প্যানপ্যানানি ঠেকবে তার কাছে।
আর দুনিয়ায় ছেলের অভাব না পড়লেও যেনতেন ছেলেকে কি নাহরীনের পছন্দ হবে? ইমরান পছন্দের একটা ছাঁচ তৈরি করে গেছে। ভাল পরিবারের ভাল চাকরিঅলা বাজারচলতি সুপাত্ররা তার সংবেদনশীল, অনুভূতিপ্রবণ মনের নাগাল পাবে তো?
নাহরীনের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে চলে যেতে ইচ্ছা করে। তার মায়ের মত রসগোল্লা বানানো গড়পড়তা জীবন থেকে দূরে। জমজমাট শিল্প-সাহিত্যের আসরে। যেন মৌলি-প্রমাদের দেখলে মুখ লুকিয়ে ফেলতে না হয়। যেন তাকে পাশে নিয়ে চলতে ইমরানের গর্ব হয়। নাহরীন ভাবে, যদি কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে না-ও হয়, আশপাশের কোন শহরের অখ্যাত কোন ভার্সিটিতে কি কিছু হবে না? হ্যাঁ, আশপাশের শহরেই, দূরে নয়। যেন বিদেশ বিভূঁইয়ে নিঃসঙ্গ-বিষণ্ণ লাগলে অদূর উইকেন্ডের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা পাওয়া যায় আর সপ্তাহ শেষের সন্ধ্যায় ছুট দেয়া যায় ইমরানের ফ্ল্যাটে।


সায়েমের সাথে নাহরীনের দেখা আমেরিকান ড্রীমে। জিআরই কোচিং সেন্টারের বাহারী নাম! তিনটা ফ্রী ক্লাসের অফার দিয়েছিল আমেরিকান ড্রীম। এরপর কেউই আর কোচিং এর পথ মাড়ায়নি, কিন্তু তিনদিনে আলাপ লতিয়ে-পেঁচিয়ে জড়িয়ে গেছে । সায়েমের জোরালো ধারালো লেখা নাহরীনের নজরে পড়েছে এই আলাপের বহু আগে। ফেসবুক প্রোফাইলে থাকা ছবি দেখে চেহারাটা চেনা, যদিও তারা ফেসবুক ফ্রেন্ডও নয়।
দু’জনই মুখচোরা, অন্তর্মুখী। আগ বাড়িয়ে কথা বলা ধাতে নেই কারও। তবু সহজভাবে শুরু হয়। উপরিতলের কথা ধীরে ধীরে গভীরে হাঁটে, পুরনো বন্ধুর সাথে হাঁটার স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে।
‘আপনি পড়াশোনা করছেন কেমিস্ট্রিতে। আর ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে মাস্টার্স করতে ইউএস যাইতে চান! যদিও সরাসরি বলেন নি, তাও আন্দাজ করে নিতে পারি আমেরিকা-যাত্রা বয়ফ্রেন্ডের কাছাকাছি থাকার জন্য! হুম…ইন্টারেস্টিং!’
নাহরীনের কান লাল। গরম ভাপ বেরোতে থাকে।
‘ইন্টারেস্টিং না বলে কি উইয়ার্ড, স্ট্রেঞ্জ বলতে চাইছিলেন? আর শুধু ইমরানের জন্য তো না, আমার নিজের সাহিত্যে ঝোঁক আছে। আমার কথা হয়ত আপনার কাছে হাস্যকর লাগতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয়, আমার ভেতরে একটা লেখক হয়ত ঘাপটি মেরে আছে। আলসেমিতে সে বেরোয় নাই এতদিন। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।’ মুখ ফসকে এটুকু বেরোতেই নাহরীন শরমে মরমে মরে যায়। নিজেকে ধমকায়–এরকম বেহায়ার মত কেউ নিজের ঢোল নিজে পেটায়! কথার মোড় ঘোরাতে এবার সায়েমকে আক্রমণ, ‘আচ্ছা, আমারটা বাদ দেন। আপনি কেন আমেরিকা যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছেন? আপনাকে ছেড়ে যাওয়াটা কত বড় ভুল হইছে সেটা আপনার এক্স-গার্লফ্রেন্ডকে বোঝাইতে?’
‘সেটা আমি কখন বললাম! আমার চালচুলাহীন লাইফটাকে আসলে গোছানো দরকার। আর ওখানে গেলে একটা ইন্টেলেকচুয়াল এনভায়রনমেন্ট পাব। দেশে দলাদলি খুব। আর ওর সাথে কিছু না হওয়ায় ভালই হইছে। ও ভেতরে ভেতরে খুব ক্যালকুলেটিভ, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক। ও ওর পথ ধরছে, আমি আমারটা। তা ইমরান ভাই ওখানে কেমন করতেছেন?’
‘ফ্যান্টাস্টিক!’
‘রেগুলার কথা হয়?’
‘সপ্তাহে একদিন। আর মাঝে মাঝে ভাইবার-হোয়াটস অ্যাপ চ্যাটিং।’
‘মাত্র একদিন? লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ মেইনটেইন করাটা তো আজকাল অনেক সহজ। কালিদাসের মেঘদূত লাগেনা। ভিডিও কলিং চাইলেই করা যায়।’
‘লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ অত সোজা না। আর সবাই পারেও না। ও ওখানে খুব ব্যস্ত। আজ টেস্ট, কাল পেপার সাবমিশন, পরশু প্রেজেন্টেশন, তরশু সেমিনার। পার্টি-টার্টির কথা আর নাই বললাম!’ নাহরীন বলতে বলতে ভেতরে রাগ-অভিমানের তাপ টের পায়।
‘উনি আপনাকে স্পাউস ভিসায় নিয়ে গেলেই তো পারেন!’
নাহরীন মনে মনে বলে, কমিটমেন্ট নড়বড়া, বিয়ার পায়ের তলায় মাটিই নাই আর স্পাউস ভিসা ধরাছোঁয়ার বাইরে পূর্ণিমার চাঁদের মত ভাসতেছে, ভেংকি কাইটা হাসতেছে! সায়েম চালাকি করে প্রশ্নটা তুলল নাকি? সম্পর্কের ভিত বুঝতে চায়?
মুখে অবশ্য বলল, ‘স্পাউস ভিসায় যাব কেন? নিজের যোগ্যতা নাই নাকি?’
‘না, না, তা বলি নাই, কিন্তু আপনি একটু হুইমজিক্যালি ডিসিশান নিয়ে ফেলতেছেন বোধহয়। আরেকটু প্র্যাকটিক্যালি ভাবেন। ইমরান ভাই আপনাকে গাইড করতেছে না?’
‘ও তো জানেই না। কিছুই তো ঠিক নাই, তাই জানাইনি। যদি শেষপর্যন্ত অ্যাডমিশন পাই, তাহলে সারপ্রাইজ দেব।’
এ কথায় ও কথায় এই প্রসঙ্গ নেড়ে, ওই বিষয় ঘুরে নাহরীন উঠি উঠি করলে সায়েম বলে,
‘নীলক্ষেতে একটা পুরান বইয়ের দোকানে যাব। যাবেন নাকি?’
‘আচ্ছা চলেন।’
হাঁটতে হাঁটতে নাহরীন দপ দপ জ্বলে। গড়গড় করে ইমরানের কথা বলতে গিয়ে সায়েমের কাছে নিজেকে নির্ঘাত ফেলনা বানিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে!
নীলক্ষেতে চিতই পিঠা ভাজছে বেশ মা-মা চেহারার এক মহিলা। সামনে কয়েকরকম ভর্তা–শুঁটকি, কাঁচা মরিচ, সর্ষে, ধনে পাতা। আর গুড়ের বাটি। এই ভর্তাগুলোর গন্ধের মত অ্যাপেটাইজার আর হয়?
সায়েমের খিদে নেই না হুঁশ নেই কে জানে! সে গলিতে ঢুকে পড়ছে। নাহরীন উসখুস করতে করতে বলেই ফেলে, ‘পিঠার গন্ধ পাননি ? খান না?’
‘না, না, খুব পছন্দ করি।’
‘তাহলে কি কিপটামি? এত বক বক করালেন, এত দূর হাঁটালেন। একবার পিঠার কথা তুললেন না!’
‘আরে কি বলেন! আমি তো ভাবছি আপনি রাস্তার ধুলাবালি লাগা পিঠা খাবেন না!’
ঝাঁঝালো সর্ষে ভর্তা মেখে পিঠা খেতে খেতে নাহরীনের মনটা হাওয়াই মেঠাই এর মত হালকা আর মিষ্টি হয়। আমেরিকার বরফ-পড়া শীতে সে গরমগরম চিতই পিঠা ভাজছে (পাশে ইমরান দাঁড়িয়ে–হাসিমুখ), ঝাল ঝাল মরিচের ভর্তা মাখা চিতইয়ে কামড় দিয়ে শীতকে কাবু করে ফেলছে! কল্পনা কিছুক্ষণ আগের রাগটাকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেয় ।
নীলক্ষেতের গলির ভেতর ঢুকে একবার ডান, আরেকবার বাম করতে করতে সায়েম একটা ঘুপচি দোকানের সামনে এসে থামে। সেই দোকানে দোকানী ছাড়া বড়জোর তিনজন এঁটে যায়। ভাগ্যিস সে সময় আর কোন ক্রেতা ছিল না। বইয়ের সারি মেঝে থেকে ছাদ ছোঁয়। মেঝেয় কিছু বই এলেমেলো ছড়ানো। উবু হয়ে বই দেখতে দেখতে সায়েম বলে, ‘একেকটা ইংরেজী বইয়ের অরিজনাল কপির যে দাম, সে টাকায় আমি সাত-আটটা পুরান বই কিনে ফেলি!’
নাহরীন একবার ভাবে এখান থেকে কিছু কিনবে কি না। কিন্তু পোকায় খাওয়া, মলিন, দাগঅলা, ধুলোমাখা বইগুলোকে নিজের বিছানায় বালিশের পাশে রাখার কথা ভাবতে নাক কুঁচকে যায়। সায়েম বেশ কয়েকটা বই উল্টেপাল্টে লম্বা-চওড়া বক্তৃতা করে উচ্ছ্বসিত গলায়। এত বক্তৃতার পরও ও কিছু কিনছে না দেখে ভেতরে ভেতরে খানিকটা রাগ করেও থাকতে পারে। নাহরীন মনে মনে নামগুলো আওড়ায়। পরে কখনো অরিজিনাল কপি কিনে ফেলা যাবে।
সায়েম বেশ কয়েকটা বই কিনেছে। গলি থেকে বেরিয়ে নাহরীনের রিকসা নেবার সময় এগিয়ে দেয় উমবার্তো একোর ‘অন লিটারেচার’!
‘আপনি তো নিজে থেকে কিছু কিনলেন না…নেন, এটা পড়েন!’

সে রাতে নাহরীনের মন ফুরফুরে। বালিশের পাশে বইটাকে রেখে দেয়। তার সাদা বিছানার চাদরে একটু ময়লা লাগুক, নিয়মভঙ্গ হোক। পর্দা থেকে একক নায়ক ইমরানের ছবি সরুক।


নাহরীন দোনামোনা করছিল– এখানে আসবে কি না। এই অনুষ্ঠানগুলোতে কখনো কখনো ওর নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণী মনে হয়। নিঃসঙ্গ নীরব দর্শকের মত দূর থেকে দেখা। পুরোটা সময় বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি মোড়ানো। কেমন বেখাপ্পা!
ছোটবেলার বান্ধবী মুনিয়ার গায়ে হলুদে সেটারই পুনরাবৃত্তি হওয়ার কথা। দীর্ঘদিন দেখা-সাক্ষাত নেই, যোগাযোগ বলতে ফেসবুক–ছবিতে-স্ট্যাটাসে লাইক। দাওয়াত পাবে ভাবেনি। সময়ে ভাব-ভাষা বদলে গিয়ে তারা তো এখন অপরিচিতই।
আজ মুনিয়াদের ছাদে ঘরোয়া হলুদের আয়োজনে বলিউডি গানে ওর শরীর হঠাৎ ঝমঝম বেজে উঠল! চমকে ওঠে নাহরীন। কৈশোরের রোমন্থন শরীরী ভাষায়? সেই ছটফটে কৈশোর–বলিউডি সিনেমায় চোখ রেখে জীবনকে দেখত যখন। নিজেকে সিনেমার নায়িকা ভাবা আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলিউডি নাচ নাচা, শাহরুখ খান-সালমান খানদের জন্য দিন গুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলার সরলতা আর ন্যাকামো ছিল যখন। জিনিয়া নাহরীনের হাত টেনে ধরে বলল, ‘চল! আমরা ইটস দ্য টাইম টু ডিসকোর সাথে নাচি! দেখি স্টেপস মনে আছে কিনা!’
স্কুলের সেই স্টাইলিশ তমা সবুজ-সোনালী লেহেঙ্গা পরে এসেছে। ওকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন, ‘কোত্থেকে কিনলিরে এই লেহেঙ্গা? জোস হইছে!’
‘সোনাম কাপুরের একটা লেহেঙ্গার ডিজাইন দেখায় আমার টেইলরকে দিয়ে বানায় নিছি।’
নাহরীনের মনে পড়ে তারও একসময় হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকাদের মত সালোয়ার-কামিজ বানানোর শখ ছিল। একবার ‘কাসৌটি জিন্দেগী কি’ সিরিয়ালের প্রেরণার মত ড্রেস বানাতে দিয়েছিল খুকুমণি টেইলার্সের লোকটাকে। কাগজে এঁকে, হাত-পা নেড়ে খুঁটিনাটি সব বুঝিয়ে দেওয়ার পরও ঠিকঠাক বানাতে পারেনি বলে লোকটার ওপর কি চোটপাট করেছিল!
নাহরীন এদিক-ওদিন তাকায়। অনেকগুলো চেনা মুখ। হাসি বিনিময় আর কেমন আছিস-ভাল আছিসের রেকর্ড বেজেই চলছে! সামনে দিয়ে যে ছেলেটা গেল তার চেহারা ঠিকমত বোঝা যায় নি। তবু এতদিন বাদে নাহরীনের বুকে বিদ্যুৎঝলক! আন্দাজ হয় ওটা নাসিফ ভাই। এদিকে একবার মুখ ফেরাতেই চোখাচোখি।
তখন ক্লাস এইটে। জুনিয়র স্কলারশিপের কোচিং শেষে মুনিয়াদের বাসায় গিয়েছিল। টিভিতে স্টার গোল্ডে কুছ কুছ হোতা হ্যায়। দুই বান্ধবীর চোখ সেঁটে গেল স্ক্রীনে। মুনিয়ার দু’বছরের বড় ভাই নাসিফ কি একটা খুঁজতে এসেছিল এ ঘরে। সেও বসে পড়ল।
তখন শাহরুখ-রাণীর প্রেম চলছে –‘তুম পাস আয়ে, ইয়ু মুসকুরায়ে…’ । সংক্রামক ভাইরাসের মত প্রেম জড়িয়ে পড়ল বাতাসে। নাসিফের সাথে চোখাচোখি হলে নাহরীনের বুক ধকধক। কিউপিড-সাইকির মিথোলজি তদ্দিনে পড়া হয়ে গেছে। মনে হল, সোজা কিউপিডের তীর এসে বিঁধল বুকে!
কোথাকার জল কোথায় গড়াল, শাহরুখের রাণী-অধ্যায় শেষ, এবার কাজলের উত্থান–সামার ক্যাম্পে। প্রবল বাতাস কাজলের বুক থেকে শাড়ি সরিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শাহরুখ তাকিয়ে দেখছে। নাহরীন আড়চোখে তাকায় নাসিফের দিকে। আর মনে মনে ডাকে, নাসিফ, নাসিফ! নাসিফ সত্যিই ওর দিকে তাকায় তখন, আবছাভাবে।
সিনেমা শেষে নাহরীনের রক্তে প্রেমের বুদবুদ। আচ্ছা, নাসিফ ভাইয়ের চুলগুলো শাহরুখ খানের মত না? হাসলে অনেকটা শাহরুখের মত লাগে না?
কুছ কুছ হোত্যা হ্যায় ফ্যান্টাসিতে চরে বেড়াল কিছুদিন। নাসিফ তার ক্লাসের একটা মেয়ের সাথে প্রেম শুরু করলে কিছুদিন চোখের জল-দীর্ঘশ্বাস যার যার কাজ চালায়, তারপর ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত দেয়।
আজ আবার ওর কৌতূহল হয় নাসিফের ব্যাপারে। মুনিয়ার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে খুঁজে বের করে নাসিফকে। একটা হিউম্যান রিসোর্স কন্সালটেন্সি ফার্মে চাকরি করছে। খুব ঘুরে বেড়ায় দেশে-বিদেশে–ফেসবুক ভর্তি ট্যুরের ছবি। নাসিফ কি এখন প্রেম করছে?
এরকম একটা ছেলেকে একসময় বিয়ে করতে চাইত নাহরীন। ভাল চাকরিঅলা, হই-হুল্লোড়বাজ, ঘুরতে-টুরতে ভালবাসে। যার সাথে ওয়ার্ল্ড ট্যুরের প্ল্যান করা যায়, যার ঘাড়ে মাথা রেখে রোম্যান্টিক বলিউডি সিনেমা দেখা যায়, ডিজে পার্টিতে বেহুঁশ নাচা যায়, ঝমঝম বৃষ্টিতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় লং ড্রাইভে। ব্যাস, এতটুকুই।
পছন্দের এই ধরণ বহু আগেই বাতিল হয়ে গেছে। যে নাসিফের জন্য কতদিন চোখের জল ফেলেছে, আজ সে হাঁটু গেড়ে বসে উইল ইউ ম্যারি মি বললে নাহরীন শীতল কঠিন চোখেই চাইবে। কোন ছেলের মধ্যে প্রেম খোঁজার আগে ও এখন খোঁজে–ছেলেটা বই পড়ে তো ? বই শেষ করে ওর সাথে তর্ক করা যাবে তো? সত্যজিতের সিনেমা দেখতে বসে হাই তোলে না তো? রবীন্দ্রসংগীত ভালবাসে ? লালন-হাসন-রাধারমণ?
শাহরুখ-সালমান এখন স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় ছত্রাক পড়ে নষ্ট হওয়া পুরনো ছবির মত।
কলেজে পড়ার সময় ইংরেজীর নিখিল স্যার হয়ত নাহরীনকে বদলে দিয়ে থাকবেন। নিখিলচন্দ্র ধর সিলেবাসের দৈর্ঘ্য-প্রস্থে হাঁটতেন না। ইংরেজী-বাংলার ভেদ ছিল না, দু’টো সাহিত্যই সমানে পড়তেন। আর ক্লাসে চলত তার একক সাহিত্যালোচনা, কেউ শুনছে কি শুনছে না সে খেয়াল ভুলে। সেবছরই বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচিতে জুড়ে গিয়েছিল নাহরীন।
হয়ত তাকে বদলে দিয়েছে ভার্সিটির সাহিত্য সংগঠনের বিকালের আড্ডা। ফিল্ম সোসাইটিতে বেগার খাটতে খাটতে তারাকোভস্কি, কিয়োরোস্তামি, কুস্তুরিকাদের ছায়া পড়েছে। আর সবশেষে ইমরান। এবড়োথেবড়ো পাথুরে গড়ন থেকে তাকে বের করে খোদাই করে গেছে নিজের সাক্ষর।
ঘুড়ি, পমপম, স্বচ্ছ টিস্যু শাড়ি, চীনা ল্যান্টার্ন আর লাল-নীল মরিচবাতির আলোর ঝালর ছাদটাকে ঝলমলে তাঁবুর মত ঘিরে রেখেছে। আলোকসজ্জার ফাঁক-ফোঁকরে আকাশ। মরিচবাতির ফূর্তি ফূর্তি আলো নাহরীনের গায়ে লাগে। আবার হঠাৎ হঠাৎ অন্তহীন আকাশ কেমন শীতল হাহাকারের প্রতিধ্বনি তোলে গভীরে। অলস নস্টালজিয়ায় নিজেকে ছেড়ে দিয়ে নাহরীনের মনে হয় রুচি-পছন্দ সব আগের পথে হাঁটলে হয়ত এত প্যাঁচালো পথের গোলকধাঁধায় তালগোল পাকিয়ে ফেলত না।
বলিউডি সিনেমার গানে ওর শরীরে আবার ঢেউ ওঠে। গভীর ভাবনায় হারিয়ে যাওয়ার সময় এটা না। হিন্দি গান শোনা কবেই ছেড়ে দিয়েছে। আজকের গানগুলো একদম নতুন ঠেকছে। নাসিফ ভাই আর মুনিয়ার কাজিনেরা নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। ঘোমটা দেওয়া হলুদ মাখা মুনিয়াকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে এনেছে নাচাতে। জিনিয়া নাহরীনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।
নাচতে নাচতে নাহরীনের পালকের মত হালকা লাগে। হিন্দি গানের আবহে কড়া মেক-আপ করা জমকালো শাড়ি পরা বান্ধবীদের বেশ সুখী দেখায়। নাক-চোখ কুঁচকে যাদের গায়ে ‘শ্যালো’, ‘টিপিক্যাল’ লেবেল ও অনায়াসে লাগিয়ে দেয়, তাদের ঝলমলে জীবনের পাশে আর্ট-কালচার-ফিলোসফির বাতাবরনে যে ইন্টেলেকচুয়াল জীবনের স্বপ্ন সে দেখছে সেটাকে এ মুহূর্তে মলিন সুতি কাপড়ের মত মনে হয়। হয়ত কাল সকালেই নেশা কাটবে, মত পাল্টাবে, কিন্তু আজ রাতের জন্য এটাই সত্যি।


নাহরীন আয়নার সামনে। নিজের চোখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে। অতলে সে কি চায়, তা যদি ছাপার অক্ষরের মত স্পষ্ট হত…বিমূর্ততা, দুর্বোধ্যতা, সাংকেতিকতার ধাঁধাঁময় অলিগলি পেরিয়ে যদি কানের কাছে একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে রহস্যভেদ করত- তুমি চাও এই, তুমি চাও ওই!
তুমি মেরুদণ্ডহীন নও, পরগাছা নও…কেন অন্যের গায়ে ঠেস দিয়ে কিংবা শিকড় গজিয়ে দাঁড়াতে হয় তোমাকে?
ভেতর ঘরে দুই সতীনের ঝগড়া। একজনে চায় আরাম-আয়েশ-নিশ্চয়তা-সরলপথ-মেঘের মত হালকা জীবন। চায় শক্ত খুঁটি, লতার মত পেঁচিয়ে ওঠার অবলম্বন। আরেকজনে টেনে ঢোকাতে চায় অন্ধকার সুড়ঙ্গে, অজানায়। ভবিষ্যতকে বন্ধ করে রাখে ভবিষ্যতের বাক্সে। সম্ভাবনাকে শতাংশের চুলচেরা হিসাবে ফেলে কম-বেশি মাপতে চায় না। হতেও পারে, নাও হতে পারে–এই তার সরল অংক।
মুনিয়ার বিয়েতে নাসিফ ভাইয়ের সাথে দেখা হবার পর তারা এখন ফেসবুক-বন্ধু। হাই-হ্যালো হয়ে গেছে ইনবক্সে। কৈশোরের বুক ধুকপুকানি বারকয়েক দপদপ জ্বলে উঠে মিলিয়ে গেছে।
সায়েম সেদিন কল দিয়েছিল। বলেছে একদিন শাহবাগ আসতে–আড্ডা দেয়া যাবে কিছুক্ষণ। সায়েমের সান্নিধ্যের লোভ ছিল ওর, তার চেয়ে বেশি লোভ ছিল সাহায্যের। আমেরিকা-যাত্রা কি আর সোজা কথা! জিআরই-ভিসা-অ্যাডমিশনের পুলসিরাতে কেউ হাত ধরলে ভরসা পেত। কিন্তু এখন সে আগ্রহও মিইয়ে গেছে।
আয়না আজ নাহরীনকে শান্ত করতে পারে না। ছন্নছাড়া লাগে । চোখ-নাক-গাল তুবড়ে কান্নার তোড় আসে। পিটার ব্যারি উলটে আছে বিছানায়। সোফায় উমবার্তো একো। তারা জানে না তাদের নিয়ে নাহরীন কি করতে চায়।
ফেসবুকে ওর অন্যমনস্ক আঙ্গুল। মৌলি চ্যাটার্জীতে এসে হোঁচট। সামনের মাসে ঢাকা আসছে মৌলি!
নাহরীনের সে মুহূর্তে মনে হয়, মৌলির সাথে দেখা করলে কেমন হয়? হয়ত তার মুঠোয় থাকবে একখণ্ড কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি। হয়ত ইমরানের ইদানীংকার জীবনযাপনের আবহ খানিকটা পাওয়া যাবে সেই সাক্ষাতে। হয়ত খুব সরল মনে অকপটে নাহরীন তাকে জানাবে তার হায়ার স্টাডিজের স্বপ্নের কথা। হয়ত নতুন যে বইগুলো পড়ছে আজকাল তার প্রসঙ্গ তুলে নিজের বিদ্যার বহর জাহির করতে চাইবে। হয়ত অতি উৎসাহে বলেই দেবে, আমি ইমরানের প্রেমিকা! হয়ত তাকে দেখে নিজেকে ঢেলে সাজানোর ইচ্ছাটা জমাট বেঁধে পোক্ত হবে। নিজেকে ভেঙে-গড়ে ইমরানের ‘মানসপ্রতিমা’ হয়ে উঠতে যে অনুকরণ, যত কাঠ-খড় পোড়ানো তা হয়ত একসময় নাহরীনের ডিএনএ বদলে দেবে। শুধু প্রেমের জন্যই কি? হয়ত সেই বদলানো নাহরীন তখন প্রেমকেই ভুলে যাবে, তলানীতে পড়ে থাকবে ইমরান, থিতিয়ে পড়া অপদ্রব্যের মত। আঘাত লাগা আত্মসম্মানে এসব ভাবনারা মালিশের মত উপশম দেয়।
কিংবা হয়ত মৌলি তার সংক্ষিপ্ত ঢাকা-সফরে অজ্ঞাত-অপরিচিত নাহরীনের সাথে দেখাই করতে চাইবে না!
নাহরীন ইমরানকে মেইল করে–মৌলি চ্যাটার্জী আসছে ঢাকায়, আগামী মাসে। ইচ্ছা করছে তাকে বলি যেন তোমাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে আসে আমার জন্য।
ইমরানের মেসেজ আসে খানিক পরে। অপ্রত্যাশিত উত্তর–তুমি জেনে গেছ! আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম! আমিও আসছি, একই সময়ে!
অনেক দুঃখ-কষ্টের পালা শেষে হ্যাপি এন্ডিং এর মত ও চোখের জলে হাসতে চায়। তাতা থৈথৈ আনন্দে নাচতে চায়। ইমরান আসছে! কিন্তু হঠাৎই পেট মুচড়ে একটা ভয়ের ঘূর্ণি উঠে আসে। ইমরান কি দেশে আসছে মৌলিকে ঢাকা দেখাতে? সারপ্রাইজের কথাটা কি ওর জন্য কনসোলেশন প্রাইজ?
ভয়ের চড়কিতে ঘুরতে ঘুরতে নাহরীন রেহাইয়ের পথ খোঁজে। ভয়টাকে নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখার কোন পথ। তার গা থেকে স্বস্তির আবরণ মরা চামড়ার মত খসে পড়ছে,কালো ধোঁয়ায় ভেতরটা গুমোট। একটা ভেন্টিলেটর দরকার। কিছু লিখতে ইচ্ছা হয় ওর। রিয়েলিটি ঢুকে পড়ুক ফিকশনে, ফিকশন থেকে বেরিয়ে আসুক রিয়েলিটি।

৫,১৯৮ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “অসংলগ্ন”

মওন্তব্য করুন : সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।