রিভিউ: দ্য ভেজিটেরিয়ান

এ বছর ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ বিজয়ী উপন্যাস দক্ষিণ কোরীয় লেখক হ্যান ক্যাং এর ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’। লিটারারি থিওরি পড়া নেই, ভাল ক্রিটিকও পড়িনি। বলা যেতে পারে একজন ‘নাইভ’ পাঠকের বিশ্লেষণ এটা।
কিছু অদ্ভূত স্বপ্ন দেখার ফলে নিতান্ত সাদামাটা বিশেষত্বহীন ইয়াং হাই হঠাৎ ভেজিটেরিয়ান হয়ে যায়। তাকে ‘স্বাভাবিক’ খাদ্যাভ্যাসে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের সদস্যরা জোর চেষ্টা চালায়। ইয়াং হাইয়ের এই পরিবর্তনের ধাক্কায় তার কাছের মানুষদের জীবনের অনেক কিছুই আর আগের মত থাকে না। দু’কথায় বলতে গেলে উপন্যাসের কাহিনী এমনটাই।
বইটাতে নিঃসঙ্গতা-একাকিত্বের আবহ আছে। ইন্ডিভিজুয়ালিজম শব্দটা কোথাও নেই, কিন্তু আধুনিক মানুষের এই বৈশিষ্ট্য অবধারিতভাবে চরিত্রগুলোর ডিএনএতে গাঁথা । উপন্যাসের প্রতিটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রই একা। কেউ কাউকে বুঝতে পারে না। প্রত্যেকের নিজস্ব সংগ্রামে সে একা অংশ নেয়, অন্য কেউ তাতে সঙ্গী হয় না। আলাপ-বোঝাপড়া-লড়াই সব নিজের সাথেই। কমিউনিকেশন অনেকক্ষেত্রেই ব্যর্থ। পুরো উপন্যাসে একটা বিষণ্ণ সুর।
চরিত্রগুলো একা হলেও সমাজের আওতার বাইরে নয়। গণ্ডির বাইরে এক পা রাখলেই নিয়মভঙ্গের সাইরেন বেজে ওঠে এখানে। একে নিয়মতান্ত্রিক সমাজ, তার ওপর পিতৃতান্ত্রিকতা এসে নারীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় তথাকথিত ‘নারীসুলভ’ বাধ্যতা (Obedience)। ইয়াং হাই মাংস এবং অন্যান্য প্রাণী-জাত খাবার খেতে অস্বীকৃতি জানালে সমাজ যেমন তার গায়ে ‘অস্বাভাবিক’ লেবেল লাগিয়ে দেয় তেমনি তার বাবা তাকে মাংস খেতে বাধ্য করে পিতৃসুলভ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় ।
স্বপ্ন এই উপন্যাসের একটা প্রধান ফ্যাক্টর । ইয়াং হাই এর প্রথমে ভেজিটেরিয়ান হওয়া এবং ধীরে ধীরে গাছে রূপান্তরিত হওয়ার ধারণা স্বপ্নলব্ধ । রক্ত, মাংস, পাশবিকতা, নৃশংসতা ইয়াং-হাইয়ের স্বপ্নের নিয়মিত উপাদান। স্বপ্নে সে নিজেকে রক্তপিপাসু-নৃশংস-মাংসাশী পিশাচ হিসেবে দেখতে পায়। নিজের নৃশংসতায় নিজেই আঁতকে ওঠে। স্বপ্নের পাশবিকতার প্রায়শ্চিত্ত করতে সে বাস্তবজীবনে মাংস খাওয়া বন্ধ করে।
অন্য দুই প্রধান চরিত্র ইন হাই এবং ইন হাইয়ের স্বামীও স্বপ্ন দেখে । তাদের স্বপ্ন ইয়াং হাইয়ের স্বপ্নের মত সর্বগ্রাসী না হলেও তাদের কমবেশি প্রভাবিত করে । ইন হাই এর স্বামী স্বপ্ন দেখে ইয়াং হাইয়ের সারা শরীর ফ্যাকাশে সবুজ রঙ ধারণ করেছে । পুরুষ্টু পাতা ছিঁড়লে যেমন রস বেরোয়, তেমন রস বেরোচ্ছে তাদের মিলনের ফলে। আর ইন হাই স্বপ্ন দেখে ঘন অরণ্যে একটা গাছ মৃত মানুষের আত্মার মত কাঁপছে । সে আরও স্বপ্ন দেখে তার চোখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে । ইন হাই এবং তার স্বামীর স্বপ্ন ইয়াং-হাইয়ের গাছে রূপান্তরিত হওয়ার ধারণার সাথে সম্পর্কিত । এই স্বপ্নগুলো যেন ইয়াং হাইয়ের সাথে তাদের একটা যোগসূত্র স্থাপন করে ।
ইয়াং হাই এর এই সব স্বপ্নের পেছনে আছে তার অবচেতনে সংরক্ষিত শৈশবের অনেক ঘটনা। অনেক অমানবিক-নিষ্ঠুর ঘটনা ইয়াং হাইয়ের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে । ন’বছর বয়সে তাকে কুকুর কামড়ালে তার বাবা অত্যন্ত নৃশংসভাবে সেই কুকুরটাকে মেরে ফেলেছিলেন । গ্রামের প্রথা অনুযায়ী এরপর সেই কুকুরের মাংস রান্না করে ইয়াং হাইকে খেতে দেয়া হয়। সেই মাংসের ঝোলে ইয়াং হাই যেন সেই মুমূর্ষু কুকুরের অসহায় চোখ দেখতে পায়।
এ উপন্যাসে ইয়াং হাইকে আমরা দেখি তার স্বামী মি. চেয়ং, বোন ইন হাই এবং ইন হাইয়ের স্বামীর চোখ দিয়ে । মাঝে মাঝে তার স্বপ্নদৃশ্যও তার সম্পর্কে আমাদের কিছুটা আভাস দেয় । মি. চেয়ং গড়পড়তা ক্যারিয়ার-সচেতন মাঝারী যোগ্যতার সাদামাটা মানুষ । যা কিছু সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণের বাইরে (স্ত্রীর ভেজিটেরিয়ান হওয়া, ব্রা না পড়া), তা সে সহ্য করতে পারে না ।
ইন হাইয়ের স্বামী একজন আর্টিস্ট । স্বভাবতই সেন্সিটিভ । নিজের আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন খুঁজতে ব্যস্ত। সমাজের নিয়ম-কানুন রক্ষায় মাথাব্যথা নেই, প্রথাভঙ্গের বিদ্রোহও নেই। কোনকিছু কারও ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নয় । উপন্যাসে সে যতটা স্বাভাবিকভাবে ইয়াং হাইকে গ্রহণ করে, অন্যরা তা পারে না। ইয়াং হাই তার সাথেই ছিল সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ।
ইন হাইও সেন্সিটিভ । সেইসাথে সেন্সিবল, রেসপন্সিবল । তার শুভাকাঙ্ক্ষায় কোন খাদ নেই, কিন্তু সে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার অনুসারী । তাই ইয়াং হাইয়ের প্রথা-বহির্ভূত আচরণ তার কাছে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ।
শুরুতে ইয়াং হাই মাংস এবং প্রাণী-জাত খাবার খাওয়া বাদ দেয় । প্রাণীহত্যা তার কাছে নৃশংস এবং অমানবিক মনে হয় । উদ্ভিজ্জ খাবারে তার আপত্তি নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে উদ্ভিজ্জ খাবারও সে ছেড়ে দেয় । গাছ-পালার মত আলো এবং পানির ওপর নির্ভর করে বাঁচতে হয়। তাহলে কি উদ্ভিদ-হত্যাও তার কাছে নৃশংস মনে হতে শুরু করে ? নিজের জীবন ধারণের জন্য অন্য কিছুর জীবন নিতে সে অনিচ্ছুক ? মানুষের স্ব-ঘোষিত শ্রেষ্টত্বের বিরোধী ? নিজেকে সে জীবজগতের অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদ থেকে ‘সুপিরিয়র’ মনে করতে চায় না ।
এর আগে হ্যানক্যাং কাছাকাছি থিমের একটা গল্প লিখেছিলেন -‘ফ্রুট অব মাই ওম্যান’। সেখানে মেয়েটি সত্যি সত্যি গাছে রূপান্তরিত হয় । এ উপন্যাসে তেমনটা হয় না । তাহলে কি ইয়াং-হাই স্রেফ একটা ইল্যুশনাল ওয়ার্ল্ডে বাস করছে ? সে কি স্কিৎজোফ্রেনিক নাকি সে আসলে ‘দ্য কাইন্ডেস্ট সোল’ যে কিনা একটা প্রাণকেও ধ্বংস করতে চায় না ?
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, হ্যান ক্যাং ছাত্রজীবনে কোরীয় সাহিত্যিক ই স্যাং এর কবিতার একটা লাইন নিয়ে ঘোরগ্রস্ত ছিলেন – ‘আমি বিশ্বাস করি মানুষের উচিত গাছ হওয়া’।
আর সেজন্যই হয়ত তার একাধিক লেখা এই আইডিয়ার ওপর ভিত্তি করে লেখা। হ্যান ক্যাং এর মানবিকতার ধারণা শুধু মানুষের প্রতি মানবিক আচরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অন্য যে কোন জীবের প্রতি আচরণকেও তা এক্সপ্লোর করে।

৪,১০৬ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “রিভিউ: দ্য ভেজিটেরিয়ান”

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।