স্বপ্ন

নিজের সদ্যোজাত সন্তানটিকে কোলে নিলে রমিছা বানুর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। এ কি তার সন্তান, তার গর্ভজাত সন্তান ! মোমেনা চাচী বলে, ‘রমিছা ! তোর পোলা তো দুনিয়া আলো করব রে ! এত্ত সোন্দর পোলা ! গায়ের রঙ য্যান ফাইট্টা পড়তাছে ! সাহেবগোর পোলাপাইনের মত দ্যাখতে হইছে রে !’

আক্ষরিক অর্থেই দুধে-আলতা ফর্সা একটা বাচ্চা, গোল সুন্দর মুখ- যেন রসে টুপটুপ রসগোল্লা। লাল টুকটুক ঠোঁট দেখে মনে হয় রক্ত লেগে নেই তো!

বাদলের মা বলে, ‘পোলা, সুন্দর হইব না ? অর বাপ তো সোন্দর। ছুডবেলায় যে সোন্দর আছিল! আর অহন ! রোদে পুইড়া অনিয়ম কইরা গায়ের রঙ গেছে জইলা।নেশা কইরা গেছে শরীর!’

জমিলা বলে, ‘ তা অর বাপ অহন কই ? পোলারে দ্যাখব না ?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমিছা বলে, ‘পোলার মুখ দ্যাখনের সময় আছে তার! ভ্যাদাইম্যা-আকাইম্যার গুস্টি! কই পইড়া আছে, কে জানে!’

জমিলা রমিছার পিঠে হাত রেখে বলে , ‘ পোলার মুখ একবার দ্যাখলে কইলাম এমুন মায়া পড়ত যে ১০ দিনেও ঘর থাইকা বাইর হইতে পারত না!’

‘হ, ঠিকই কইছস।’ সায় দেয় বাদলের মা। ‘ এই পোলা অর বাপের চাইতেও সোন্দর হইছে। দাদীর লাহান হইছে!অর দাদীরে তো তোরা দ্যাখস নাই! এমুন গায়ের রঙ, টোকা দিলে য্যান রক্ত পড়ব!’

রমিছার বড় ছেলে তৌকির এতক্ষণ মার্বেল খেলায় ব্যস্ত ছিল। তার একটা ভাই হয়েছে শুনে সে খেলা ফেলে ছুটে আসে। ‘ মা, অরে আমার কোলে দেও।’

‘ না, না, না!’ আঁতকে ওঠে রমিছ। ‘ এই নোংরা শইলে না! যা,গোছল কইরা আয়!’

ছেলেটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রমিছা আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার এই চাঁদের টুকরা।

তৌকির কোন রকমে গোসল করে ভেজা গায়েই চলে আসে।

‘এই গায়ে তুই তর ভাইরে ধরবি! আয় এদিক আয়!’ মোমেনা চাচী ওকে ডাকে। তারপর গামছা দিয়ে ভাল করে গা মুছিয়ে দেয়।

তৌকির নবজাতককে কোলে নেয়। তৌকির পুরোপুরি মায়ের মত দেখতে। সেই একই মিশমিশে কাল গায়ের রঙ, একই ছিরিছাঁদহীন মুখ। কৃষ্ণবর্ণ তৌকিরের কোলে গৌরবর্ণ নবজাতককে দেখে মনে হয় না তারা একই মায়ের পেটের সন্তান।

 

২.

রমিছা তার ছোট ছেলের নাম রেখেছে চিত্রনায়ক সালমান শাহর নামে। সালমান শাহর ঘোর ভক্ত সে। তার মন বলে, বড় হয়ে তার সালমান চিত্রনায়ক সালমান শাহ্ কেও ছাড়িয়ে যাবে। রমিছা সালমানের কপালে কাজল দিয়ে বড় করে একটা নজরফোঁটা এঁকে রাখে। এত মানুষ তার ছেলেকে নজর দেয় ! না জানি কার কুদৃষ্টি লেগে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে যায়! আগাম সতর্কতা হিসেবে রমিছা মসজিদের হুজুরের কাজ ছেকে একটা তাবিজ বানিয়ে এনে ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। সালমান হওয়ার ৭ দিনের মাথায় রমিছাকে কাজে ফিরতে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী সে। অফিসরুম ঝাড়ু দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা তার কাজ। এক রত্তি বাচ্চাটাকে ঘরে রেখে কাজে আসতে মন সায় দেয় নি তার।তৌকিরের বেলায় রমিছা  অবশ্য ওকে প্রতিবেশী কারও ঘরে রেখে কাজে আসত। কিন্তু ছোটটার বেলা সে সাহস হয়নি। কখনো সালমানকে কোলে নিয়েই ঝাড়ু দিয়েছে , কখনোবা শিল্পী বা কল্পনাদির জিম্মায় রেখে কাজ করেছে। অবশ্য কিছুদিন পরে সে ঝামেলাও চুকে গেল। হলের মেয়েদের নজরে পড়ে গেল সালমান। ওরাই ওকে কোলে নিয়ে ঘোরে। কে আগে কোলে নেবে তা নিয়ে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে যায়! কেউ কেউ আবার ওকে রুমে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।রমিছা অবাক হয়ে দেখে, সুইপারের বাচ্চা বলে কেউ সালমানকে ঘেন্না করে না! অবলীলায় কোলে তুলে নেয়, চুমো দেয় গালে-কপালে। রমিছার গর্ব হয়। তার সোনামানিক সবার মন কেড়েছে। বাইরের মানুষের এত ভালবাসা দেখে রমিছার মাঝে মাঝে রাগ হয় সালমানের বাবা রমযান আলীর ওপর। এত সুন্দর ছেলে যার ঘরে, তার নেই সংসারে মন! রূপবান পুরুষদের বুঝি এই দোষ হয়! কিন্ত নাহ্! সালমানকে সে এমন কুঁড়ে হতে দেবে না! ছেলেকে সে চোখে চোখে রাখবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবে। রমিছা কল্পনায় দেখতে পায়, তার সালমান বড় হয়েছে। কোট-টাই পড়ে বিশাল  গাড়ি হাঁকাচ্ছে। আর সালমানের ড্রইংরুমের নরম সোফায় বসে পা দোলাচ্ছে রমিছা।

 

 

৩.

সালমান  দু’বছর পেরোনোর পর রমিছার আর ভাবনা থাকে না। সকালবেলা ওকে হলের সীমানায় ছেড়ে দিলেই হল। টলমল পায়ে সে হলময় হেটে বেড়াবে।সারাদিন ওর কোন খোঁজ পায় না রমিছা। মাঝে মাঝে সে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে চলে যায় তার ‘আন্নি’দের রুমে। রমিছা হলের মেয়েদের দেখিয়ে তাকে শিখিয়েছিল, ‘এরা হইল তোমার আন্টি’। আন্টি সে বলতে পারে না, আন্নি বলেই ডাকে সবাইকে।কখনো আবার দেখা যায় ময়লাওয়ালার সাথে সেও ময়লার গাড়ি ঠেলার চেষ্টা করছে। কখনো আবার অন্যদের দেখা দেখি  খালি কার্টন মাথায় নেওয়ার চেষ্টা করে।কখনো মায়ের দেখাদেখি ঝাড়ু দিতে গিয়ে ঝাড়ুর ভারে উলটে পড়ে রাস্তায়।খাওয়ার সময় হলে পুরো হল চষে বেড়াতে হয় সালমানকে খুঁজে পেতে। হয়ত  কোন মেয়ের রুমে গিয়ে খেলা করছে। নয়ত হলের বিড়ালগুলোকে তাড়া করছে। হয়ত ক্যান্টিনবয়দের কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।নয়ত হলের মুদী দোকানীর কাছ থেকে চিপস বা চকলেট চেয়ে নিয়ে অপরিত্যক্ত বড় কার্টনের ভেতরে বসে  খাচ্ছে। মুদী দোকানী সুমন ওকে রোজরোজ একটা কিছু দেবেই। হলের মেয়েরাও ওকে কিনে দেয় চকলেট-চিপস-বিস্কুট-জুস।বিকেলবেলা হাউসটিউটরদের ছেলেমেয়েরা  হলের মাঠে খেলতে আসে। ওদের মাঝে মিশে যায় সালমান। রমিছা চোখ ভরে দেখে বড়লোকের ঘি-ননী খাওয়া দামী দামী কাপড়চোপড় পরা ছেলেমেয়েগুলোর মাঝেও সালমানকে আলাদা করে চোখে পড়ে! সালমান ধুলোতে মাখামাখি হলেও সেসবের তোয়াক্কা না করে সবাই কত আদর করে ওকে কোলে তুলে নেয়! আর কেমন কলকল করে হেসে ওঠে তার ছেলে ! ফেরেশতা ! তার ছেলে সাক্ষাত ফেরেশতা!

একদিন হলের এক হাউসটিউটর শারমিন ম্যাডাম রমিছাকে ডেকে নেয়।

‘ রমিছা, ছেলেটাকে নিয়ে তোমার পরিকল্পনা কি ?’

‘ অরে আমি হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার বানামু আপা।’

‘হুম। তোমার ছেলের মাথায় তো খুব বুদ্ধি।’

‘হ আপা! অর মাথায় মনে হয় বুদ্ধি গিজগিজ করে।  এত্তটুকুন বাচ্চা এত দুষ্ট হইছে!’

‘তা ওকে যে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বানাবা, বস্তিতে থাকলে সেটা হবে ?’

‘ কি আর করুম আপা! তয় আমি ট্যাকা জমাইতাছি! হলের আপুরাও আমারে মাঝেমইধ্যে ওর লাইগা ট্যাকা দেয়। অরে আমি ভাল স্কুলে পড়ামু।প্রাইভেট মাস্টার রাখমু! ’

‘তবু, পরিবেশের একটা ব্যাপার আছে রমিছা! আমার বড় বোন সেদিন সালমানকে দেখেছে। আপার তো সালমানকে খুব পছন্দ হয়েছে।দেখ, তোমার ছেলের জন্য ও কি পাঠিয়েছে!’

সুন্দর প্যাকেট থেকে বের হয়  লাল টুকটুকে শার্ট, কালো প্যান্ট আর একটা লাল ক্যাপ।

শারমিন ম্যাডাম বলেন, ‘শোন, আমার বোনের ১৫ বছরের সংসার।কিন্তু কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই। আমার বোন তোমার সালমানকে পালতে নিতে চায়।’

‘এইটা কি কইলেন আপা!’

‘তোমার তো আরও একটা ছেলে আছেই! আর তুমি চাইলে আরও দশটা ছেলের মা হতে পারবা! কিন্তু আমার বোন তো পারবে না। আমার বোন খুব দিলখোলা মানুষ। ও তোমাকে টাকা দিয়ে খুশি করে দেবে!সেই টাকা তুমি তোমার বড় ছেলের পেছনে খরচ করলা।আমাদের কাছে থাকলে সালমান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে। তুমি নাহয় মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসবা ছেলেকে।’

‘ না আপা, এইটা হইত না ! আমি আমার কইলজার টুকরারে ছিঁইড়া দিতে পারুম না!’

রমিছা হন হন করে চলে আসে সেখান থেকে।

আজ বেশ কয়েকদিন পর সালমানের বাবা ঘরে ফিরেছে। রমিছা লোকমুখে শুনেছে রমযান আলী কমলাপুর বস্তিতে অন্য এক মেয়ের ঘরে থাকছে। রমযান আলীর এই দোষ নতুন নয়।রমিছা তাই সে বিষয়ে তর্কাতর্কিতে গেল না। আজ তার মন জুড়ে সালমানকে হারানোর ভয়।

‘ অ তৌকিরের বাপ, পোলারে নিয়া তোমার কুনো চিন্তা নাই ?’

‘ক্যান , কি হইছে ?’

‘ মাইনষে তো অরে ট্যাকা দিয়া কিন্যা নিবার চায়! সোন্দর পোলা! কহন যে ছেলেধরায় ভুলায়-ভালায় নিয়া যায়!’

‘কে কিনবার চায় ? অনেক বড়লোক ? কত দিব ?’

রমিছা বুঝতে পারে রমযান আলীকে এ কথা বলে সে কত বড় ভুল করেছে। নেশারুর কাছে সন্তানের চেয়ে মদ-গাঁজার মূল্য অনেক বেশি।

‘তা শুইন্যা তোমার লাভ কি ? তুমি বেচবা নাকি আমার পোলারে ?’

‘ আরে না! এমনে জিগাইলাম ! আমার এত সোন্দর পোলারে আমি বেচুম! তোমার মাথা খারাপ নাকি ?’ সালমানকে কোলে নিয়ে রমযান আলী আদর করতে থাকে।

 

 

৪.

দিনকে দিন সালমান যেন সুন্দর হতে থাকে। রমিছা ফুটপাত থেকে বেছে বেছে শার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি কেনে সালমানের জন্য।অবশ্য এত বাছাবাছির কোন দরকার পড়ে না । সালমান যা-ই পরে তাতেই ওকে সুন্দর দেখায়। হলের এক মেয়ে সেদিন ওর জন্ম তারিখ লিখে নিয়ে গেল। তারা নাকি সালমানের জন্মদিন পালন করবে!সত্যি ছেলেটা তার ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে! অথচ ছেলের বাপের কোন খবর নাই!

বেশ কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকার পর রমযান আলী ঘরে ফেরে। এবং রমিছাকে অবাক করে দিয়ে হাতে এক হাজার টাকা তুলে দেয়।সুমতি ফিরল নাকি তার সোয়ামীর! এত দিন পর কাছে পেয়ে আধো আধো বোলে ছেলে বাপের সাথে কত কথা বলে যায়!রমিছার মুখে হাসি ফোটে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।কিন্তু রাতের বেলা রমযান আলীর আসল উদ্দেশ্য টের পাওয়া যায়।সে আরেকটা বিয়ে করেছে এবং ছেলেকে তার নিজের কাছে নিয়ে যাবে। রমিছার মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিছুতেই সে সালমানকে নিতে দেবে না! অবাধ্য স্ত্রীকে ঝাড়ু দিয়ে পেটাতে শুরু করে রমযান আলী। বিছানায় খেলতে থাকা সালমান কান্না জুড়ে দেয়। রমযান আলী রমিছার চুলের মুঠি ধরে বলে, ‘ কাইল্যা মাগী! এই ধলা পোলা তোর ? এই পোলা আমার লাহান দ্যাখতে।এইটা আমার পোলা!’ আশেপাশের ঘর থেকে লোকজন ছুটে এসে সেবারের মতন রমযান আলীকে নিরস্ত করে।

 

৫.

রমিছার যেন ঈদ লেগেছে। ছেলে তার স্কুলে যাবে! সালমানকে বানিয়ে দিয়েছে নতুন ইউনিফর্ম,কিনে এনেছে নতুন বই,খাতা-পেন্সিল। ঝকঝকে ইউনিফর্ম পড়ে সালমান যখন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন কে বলবে সে বস্তির ছেলে ! রমযান আলী ছেলের কোন খোজ-খবর নেয় না, কোন টাকা পয়সা দেয় না। রমিছা এ নিয়ে আফসোস করেনা।ছেলেকে সে অনেক বড় বানাবে। এর জন্য যত খরচ হয়,হবে! দরকার হলে সে রক্ত বেচে ছেলেকে পড়াবে! আজকাল সালমানের আর হলে যাওয়া হয় না, স্কুল থেকে ফিরে সে সমবয়সী ছেলেপুলের সাথে খেলাধুলায় ব্যস্ত থাকে। হলের অনেক মেয়েই রমিছার কাছ থেকে সালমানের খোঁজখবর নেয়। রমিছা তাদের হাসিমুখে জবাব দেয়, ‘ছেলে আমার স্কুলে ভর্তি হইছে আপা।এইহানে আসার সময় পায় না।’

আজ জমিলার কাছ থেকে খবরটা পাওয়ার আগ পর্যন্ত ছেলেকে নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিল রমিছা।বিকালে কাজ থেকে ফেরার পর জমিলা তাকে ডেকে নিয়ে বলে,

‘ বুবু! পোলার দিকে নজর দেও না ? সোন্দর পোলা তোমার! একটু চোখে চোখে রাখবা না ?’

‘ক্যান? কি করছে ?’

‘আইজকা সকাল ১০-১১টার দিকে দেখি, আজিজার-রতন-রাজু আরো কয়েকটা পোলা অরে শ্যাষ মাথার চিপায় নিয়া গিয়া প্যান্ট খুইলা শোয়াইয়া…আমি তো সব কয়ডারে কইষ্যা ঝাড়ি দিছি!’ জমিলার কথা শুনে রমিছার পাগল পাগল লাগে। ‘আমার পোলা…আমার পোলা’ বলে সে ঘর থেকে ছুটে বের হয়।জমিলা ওকে টেনে ধরে বিছানায় এনে বসায়।

‘মাথা ঠান্ডা কর বুবু।কিছু হয় নাই তো।আর সালমান তো পোলা, মাইয়া তো আর না! অত ডরাও কেন? ’ রমিছার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল কাকলী। জমিলা হাঁক ছাড়ে,

‘অ কাকলী, সালমানরে দেখছস ?’

‘হ্যায় তো বল খেলতাছে।’

‘অরে গিয়া ক’বি অর মা ডাকতাছে। ’

কিছুটা শান্ত হবার পর রমিছার চিন্তার মোড় এবার ঘুরে যায়।সে আপনমনে বকে,

‘১০টায় সালমান এইহানে কি করতাছিল ? অর না স্কুলে থাকার কথা!’

কাকলী এসে খবর দিয়ে যায়, ‘হ্যায় অহন আসত না।’

সালমান সন্ধ্যায় ঘরে ফিরলে রমিছা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

‘বাপ আমার, তুই সুস্থ আছিস তো ?’

‘হ ।’

‘কই আছিলি সারাদিন ? স্কুলে গেছলি আইজকা ?’

রমিছার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্তিসূচক স্বরে সালমান বলে,

‘হ, গেছি তো! তোমার এত খবরদারি ভাল্লাগে না মা !’

রমিছা এবার চড়াও হয় ছেলের ওপর।

‘তাইলে দশটার সময় তুই এইখানে কি করতেছিলি হারামী ? রাজু-আজিজারের লগে তুই কি করতেছিলি ? জমিলা আমারে সব কইয়া দিছে!’ সালমানকে হ্যাঁচকা টান মেরে জিজ্ঞেস করে রমিছা।

‘কাইল্যা মাগী! তুই ছাড় আমারে!’

রমিছা হতভম্ব হয়ে ছেলেকে ছেড়ে দেয়। বাপের সেই গায়ের রঙ নিয়ে খোঁটা দেওয়া গালি এখন তার ছেলেও শিখে গেছে!

পড়াশুনায়  মতি ফেরানোর জন্য রমিছা  ছেলেকে কোচিংয়ে পাঠায়।সন্ধ্যাবেলা বই নিয়ে পড়ায় বসিয়ে দেয়। ছেলের জন্য রোজ রোজ দুধ-ডিমের ব্যবস্থা করে। একেবারে আঁটঘাট বেঁধে সে নেমেছে ! ছেলে তার ভাল রেজাল্ট না করে যাবে কোথায়! মাস দু’য়েক পর ধোপদুরস্ত শাড়ি পরে রমিছা  ছেলের স্কুলে যায়। খুঁজে বের করে সালমানের শ্রেণী শিক্ষককে। মনে মনে ঠিক করে শিক্ষকের সাথে কিভাবে কথা বলবে। সার আমার পোলা কেমন করতাছে? নাহ ! এইটা তো শুদ্ধ হইল না! রমিছা এবার আওড়াতে থাকে – সার, আমার সালমান কেমন করছে?

হ্যাঁ এইবার হইছে ! নিজের কথায় নিজেই সন্তুষ্ট হয় রমিছা। স্যারের কাছে এ প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন,

‘ সালমান ! ক্লাস ফাইভে পড়ে যে ?’

‘জে স্যার।’

‘পড়াশুনায় একদম মন নাই।গেল বছর দয়া করে ওকে পাশ করায় দেওয়া হয়েছে।এ বছরও যে অবস্থা, তাতে পাশের কোন আশা নাই।’

রমিছার কালো মুখ আরও কালো হয়ে যায়।তার চালাক-চতুর ছেলে এত পড়াশুনা করেও কেন পাশ করতে পারছে না রমিছার সরল মন তা বুঝতে পারেনা। ওর জানা হয় না সন্ধ্যাবেলা পড়ার নাম করে  বইয়ের ফাঁকে লুকিয়ে সালমান আসলে পর্নো ম্যাগাজিন দেখছে। কোচিংয়ে না গিয়ে যাচ্ছে সিনেমা দেখতে বা মার্বেল খেলতে, নয়ত গাঁজা টানতে।

 

সেদিন রমিছা আগেভাগেই ছুটি নিয়ে ঘরে ফিরেছে।ছেলের ওপর নজরদারি করা দরকার। ছেলেটা দিনকে দিন কেমন জানি হয়ে উঠছে। শরীর খটখটে,চেহারায় সেই আগের লাবণ্য নেই। ফর্সা মুখে প্রকট হয়ে ওঠে চোখের নিচের কালি। সালমান ঘরে নেই। ক্লাবে যায়নি তো ? বস্তির ছেলেরা খুলেছে এক ক্লাব ঘর।সেখানে যত্তসব শয়তানীর আখড়া। সালমানকে খুঁজতে রমিছা ক্লাবঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে দরজা আটকানো।রমিছা ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়।আধো অন্ধকারে দেখা যায় দু’টো শরীর জড়াজড়ি করে আছে।বস্তির ত্রিশোর্দ্ধ লতিফার ওপর শুয়ে আছে তার এগার বছরের সালমান।

 

 

৬.

হলের ক্যান্টিনে আজ দুপুরবেলা বেজায় ভিড়। মেয়েরা খেয়ে চলে যাচ্ছে, আর তাদের এঁটো বাসনগুলো দ্রুতহাতে তুলে নিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে জায়গাটা মুছে দিচ্ছে সালমান। একটা মেয়ে হাঁক ছাড়ল , ‘এই ছেলে, এই জায়গাটা মুছে দিয়ে যা!’

হলের যে মেয়েরা ছোটবেলায় সালমানকে দেখেছে তারা সবাই পড়াশুনা শেষ করে হল ছেড়ে চলে গেছে।এখনকার মেয়েরা জানে না সেই ছোট্ট সালমানের কথা, তাদের কাছে সালমান শুধুই ক্যান্টিনবয়। ক্যান্টিনসংলগ্ন বারান্দা ঝাড়ু দিতে এসে থমকে দাঁড়ায় রমিছা। চেয়ে থাকে ডাইনিংয়ের ময়লা পরিষ্কার করতে থাকা তার ছেলের দিকে, চেয়ে থাকে তার ধুঁকেধুঁকে মরে যাওয়া স্বপ্নের দিকে।

১২ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন”

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।