ফারাক

নভেম্বরের মাঝামাঝি । হিম পড়তে শুরু করেছে । দোতলা বাড়ির ছাদে বসে আছে শিপন । বাড়ির এদিকটায় অনেকগুলো সুপারি গাছ।তাদের ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে শিপনের বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। নাহ্ ! এত সৌ্ন্দর্য একা উপভোগ করা যায়না । এসময় বিশেষ কাউকে পাশে থাকতে হয়।এখন যদি অবন্তী পাশে থাকত,কাঁধে মাথা রেখে!অবন্তীর খোলা চুল হাওয়ায় দুলে দুলে শিপনের গালে সুড়সুড়ি দিত যদি! ভাবনাটা শিপনকে অস্থির করে দেয়। ও তাড়াতাড়ি ছাদ থেকে নেমে আসে। ডায়েরীর পাতা খুলে বসে।কষ্ট জমাট বাঁধলেই ও ডায়েরীর কাছে আসে। ডায়েরীর পাতায় কষ্টগুলো গলে গলে পড়ে।তাতে চোখের পানিও মেশানো থাকে।ডায়েরী ওর আরেকটা সত্তা হয়ে ওর কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নেয়।লিখতে লিখতে ওর এই সত্তাটা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে যায়।দু’বছর হল অবন্তীর সাথে ওর দেখা হয়না।দু’বছর আগে ডিভি নিয়ে ওরা সপরিবারে আমেরিকা চলে গেছে।তারপর থেকে সেভাবে যোগাযোগ নেই।ফেসবুক আর মেইলে যা টুকটাক যোগাযোগ চলে। অবন্তীকে কখনো মুখ ফুটে ভালবাসার কথা জানায়নি শিপন।কিন্তু তাই বলে এ কথাটা তো অবন্তীর অজানা নয়। শুধু অবন্তী কেন,গোটা স্কুলের প্রায় সবাই জানত শিপন অবন্তীকে ভালবাসে । অবন্তীর দিক থেকেও কিছুটা সম্মতি ছিল।কিন্তু সেভাবে সম্পর্ক শুরু করার আগেই অবন্তীরা চলে গেল।শিপনের এখন প্রতিটা দিন কাটে অবন্তীর স্মৃতিতে ডুবসাঁতার কেটে।ওর সাথে যে ক’বার কথা হয়েছিল তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে করার চেষ্টা করে।কথোপকথন চলার সময় অবন্তীর গলার স্বর কেমন ছিল,অভিব্যক্তি কে্মন ছিল,মুখে হাসি ছিল কি না-এ সবই শিপনের মুখস্ত। ক্লাসের পিকনিকে ক্লাসরুম সাজানোর সময় নানা ছুতোয় ও অবন্তীর হাত ছুঁয়ে দিত।সামান্য হাত ছোঁয়া,কিন্তু ওর কাছে মনে হত এ যেন বিশাল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে অবন্তীর কাছে আসা ।

আজকাল ডায়েরী লেখার সময় একটা চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজেকে অবন্তীর যোগ্য করে তুলতে হবে।নইলে হয়ত কোনদিন অবন্তীকে মুখ ফুটে মনের কথা বলা যাবে না।ও মনে মনে নানা পরিকল্পনা করতে থাকে।এইচএসসিতে ভাল রেজাল্ট করে IELTS এ দুর্দান্ত একটা স্কোর তুলতে হবে।তারপর জোর চেষ্টা চালিয়ে একটা স্কলারশিপ যোগাড় করে আমেরিকায় পাড়ি দিতে হবে।শিপন ওর বাবা-মাকে জানিয়ে দেয় এইচএসসির পর ও শুধুমাত্র IELTS এর কোচিং করবে।বাবা-মা এতে রেগে যান।কখনো বকাঝকা করেন,কখনো আদর করে বোঝানোর চেষ্টা করেন।কিন্ত শিপন তার গোঁ ছাড়ে না। শিপনের কোন উপায়ও নেই।শুধু ও আর ওর ডায়েরী জানে অবন্তীকে ছাড়া দিনগুলো কেমন দুঃসহ কাটছে।

আমেরিকা যাওয়ার পর প্রথম দু’তিন মাস অবন্তী খাপ খাওয়াতে পারছিল না।বন্ধুহীন চারপাশ,সবসময় ইংরেজীতে কথা বলা ওর অসহ্য লাগত।ওর পার্ট টাইম চাকরীটাও ও একদমই পছন্দ করত না ।তখন প্রায়ই মেইল করত শিপনকে। কিন্তু এখন এই জীবনে ও পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছে ।আমেরিকার ফ্রী লাইফে ও যে মজে গেছে তা ওর ফেসবুকের ছবি আর স্ট্যাটাস দেখলেই বোঝা যায়।ওর প্রচুর ইন্ডিয়ান বন্ধু।ওদের ওখানে পার্টি লেগেই থাকে। আর একেকটা পার্টিতে অবন্তীকে অপূর্ব সুন্দর দেখায়।ও কন্টাক্ট লেন্স পড়ে,সুন্দরভাবে মেক-আপ করে।হাইলাইট করা চুলগুলো রিবন্ডিংয়ের গুণে সবসময় ঝকঝক করতে থাকে। কিন্তু এক সময়কার লাজুক অবন্তীর পোশাক-আশাক দেখলে রীতিমত চমকে যেতে হয়।কখনো ওর পরনে বডি ফিটিং স্লিভলেস ডিপ নেক টপস আর হাফপ্যান্ট,কখনো অফ শোল্ডার গাউ্ন। অবন্তীর সৌন্দর্য এভাবে উন্মুক্ত হয়ে থাকবে সবার সামনে তা শিপন মেনে নিতে পারেনা।এ ধরণের পোশাক পরে ও বাবা-মার সামনে দিয়ে কিভাবে বেরোয় তা ভেবে পায় না । আবার নিজেই নিজেকে বোঝায়,ওসব দেশে তো এধরণের পোশাক পরা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।ও যে কালচারে বড় হচ্ছে সেখানে বাঙালিয়ানা বজায় রাখা সহজ ব্যাপার না ।বন্ধুদের মঝে ওই বা অপাংক্তেয় হয়ে থাকবে কেন! আজকাল অবন্তীর সাথে চ্যাট করতেও ও ভয় পায়।কি নিয়ে লিখবে ভেবে পায়না । অবন্তী নিজে থেকে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনা। শুধু শিপনের প্রশ্নের উত্তর দেয়।অবন্তীকে অনেক দূরের মানুষ মনে হয় ওর।নাহ্,এটা নিশ্চয় সাময়িক একটা ব্যাপার।একটা মানুষ কি এভাবে পুরোপুরি খোলস বদলে ফেলতে পারে ? এত সহজে নিজের মূল্যবোধকে ঝেড়ে ফেলতে পারে? সেই যে নরম সরম স্বভাবের অবন্তী – যে ছবি আঁকতে খুব ভালবাসত,শিপনের প্রসঙ্গ উঠলে যে লজ্জায় লাল হত,শিপনকে দেখলে যার চোখের দৃষ্টি চঞ্চল হত,সে কি এত তাড়াতাড়ি শিপনকে বাতিলের খাতায় উঠিয়ে দেবে ?

শিপনের দিন কাটতে চায়না।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ও আমেরিকা চলে যেতে যায়।একটা করে দিন যায় আর ও ভাবতে থাকে,যাক ! অবন্তীর সাথে দেখা করার একটা দিন তো এগিয়ে এল!ইদানীং শিকাগোর কোন খবর জানলে ওর হার্টবিট বেড়ে যায় ।অবন্তী ওই শহরে থাকে বলে ওটা এখন শিপনের প্রিয়তম শহর। এর মধ্যে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একদিন ওকে চরম ক্ষেপিয়ে দেয়।ওর সামনেই অবন্তীকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে ছাড়েনা ।শিপনও অবন্তীর পক্ষে গলা চড়াতে থাকে।অবন্তীর গায়ে ও কাদা লাগতে দেবেনা।কিন্তু টের পায় অবন্তীর পক্ষে ওর দাঁড় করানো যুক্তিগুলো নিজের কাছেই কেমন মেরুদণ্ডহীন লাগছে।শেষমেষ সংকোচ ঝেড়ে ফেলে অবন্তীর নাম্বার যোগাড় করে ওকে ফোন দেয় শিপন। কুশলাদি বিনিময়ের পর বলে, ‘অবন্তী তোমার ড্রেসআপ নিয়ে এখানকার ছেলেপেলেরা কথা বলে।আমার ভাল লাগে না।’ ‘হাউ ডেয়ার দে !ব্লাডি ফুলস! সব ক’টাকে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে রিমুভ করব !’ ‘না,না।এটা করোনা ! হাজার হোক তোমার শেকড় তো এখানে। ওদের সাথে তোমার সম্পর্ক নষ্ট করাটা ঠিক হবেনা !’ ‘হু সেইস দ্যাট ! আমার বয়ফ্রেন্ড সাউথ ইন্ডিয়ান।আমি ওই গডড্যাম্ড বাংলাদেশে ফিরছি না ! আমরা এখানেই সেটল করব।সো ওদের সাথে কোন রিলেশন মেইনটেইন করার দরকার তো নেই।’ অবন্তী এত স্বাভাবিকভাবে তার বয়ফ্রেন্ডের কথা বলল যে শিপন একবারও তাদের একসময়কার ভাললাগার প্রসংগ তুলতে পারল না।নিজের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করল না।বাঁকা বাঁকা কথা বলে অবন্তীকে আঘাত করতে পারল না।ফোন রাখার পর অনেকক্ষণ ওর বোধশক্তি ছিল না।সংবিৎ ফিরে পেয়ে খেয়াল করল ওর কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করছে।আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নটা থেকে থেকে বিষ ছড়াচ্ছে। ব্যাঙ্গ করে যাচ্ছে।অস্ফুট স্বরে ও নিজেই নিজেকে বলল,দুই বছর অনেকটা সময়।অবন্তী বলে কেউ এখন নেই।অ্যান্ড আয়্যাম নট গোয়িং টু আমেরিকা এভার!দিস অবন্তী ইজ আ ডিফারেন্ট সোল।

১,৫০৫ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “ফারাক”

  1. সামি হক (৯০-৯৬)

    তোমাকে দিয়ে হবে। গল্পের প্লট চমৎকার, ভালো লাগল পড়ে। লিখতে থাকো আরো, গল্পের শেষটা নিয়ে আবার চিন্তা করতে পার। অবন্তী যখন বলল তার বয়ফ্রেন্ডের কথা ঠিক তারপর থেকে

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    প্লট ভালো। লেখার হাতও ভালো।

    তবে গল্প পড়ে মনে হয়েছে কেউ দম বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে গল্প বলে চলছে। প্যারার ব্যবহার করলে সুন্দর হতো। কথোপকথন গুলো আলাদাভাবে দিলেও মনে হয় ভালো লাগতো।

    গল্পের শেষটা হয়তো তাড়াহুড়া হয়েছে। লিখতে থাকো।
    শুভকামনা।

    জবাব দিন
  3. আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

    পিয়া ,ভাল লাগলো। একদম বাস্তব তোমার গল্পের বক্তব্য। মাঝে মাঝে বিমানের জন্যে অপেক্ষায় থেকে, কাঁচের এপাশ থেকে কত বার শাপ-শাপান্ত করি এই এল্যুমুনিয়ামের পাখি টাকে।মুহূর্তের মধ্যে সে শুধু ভৌগলিক দূরত্ব অতিক্রম করে না,মানুষ গুলির মধ্যে সামাজিক ভাবে যোজন যোজন ফারাক সৃষ্টি করে দেয়।বদলে দেয় মূল্যবোধ- এক ফুঁৎকারে !
    ভাল থেকো ।


    Smile n live, help let others do!

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    বাহ্‌!
    তোমার আগের লেখাটাও বেশ ভালো লেগেছিলো, কিন্তু মন্তব্য আর করা হয়ে ওঠেনি।
    বেশ ডিটেইলে যেতে পারো তুমি। আমিও মনে করি তোমার লেখার হাত বেশ ভালো।
    আমিনের সংগে একমত, প্যারায় একটু ব্রেক দাও।
    শিপন শুধু অবন্তীর সংগে দেখা করার জন্যেই অত দূরদেশে যেতে চায়, কিন্তু মুখ ফুটে এখনো মনের কথাটি বলে উঠতে পারলোনা -- এটা ওর চরিত্রকে দুর্বল করেছে বলে আমার মনে হয়।

    আর অন্যদের লেখা, নতুন কিংবা পুরনো, বিখ্যাত বা অখ্যাত যেমন পাও, গোগ্রাসে গিলতে থাকো। আরেকটু নতুনভাবে, যেমনটা আমরা শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়িনি, গল্পগুলোকে বলবার জন্য প্রস্তুত হও।

    জবাব দিন
    • শিবলী (১৯৯৮-২০০৪)

      নুপুর দা কেমন আছেন ??? অনেক দিন পর ব্লগ এ আসলাম...এসেই দেখি আপনি......
      দাদা, এই পৃথিবীতে মনে হয় এমনও অনেক মানুষ আছে যারা নিজের কল্পনার জগতে অনেক হাতি -ঘোড়া মারার কথা কল্পনা করে কিন্তু কখন একট পিঁপড়াও মারতে পারে না......কষ্ট পায়,ভয় হয় পিঁপড়ার জন্য ।গল্পটা পড়ে আমার কাছে শিপনকে ঠিক এমনই কিছুটা দুর্বল এক মানুষ মনে হয়েছে......যে মনে মনে অনেককিছু করলেও করার বেলায় কিছূটা পিছিয়ে থাকে... ঠিক আমাদের মত, যারা অনেক কিছু চিন্তা করলেও লিখি না......অলস প্রকৃতি্‌ গাধা...

      জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ভাল লাগলো... আরো বেশি বেশি লেখা পোস্ট করতে থাক 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আজিজুল (১৯৭২-১৯৭৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।