পাগলের মেঘ, পাগলের বৃষ্টি

দুপুর ৩টা ১০, খুলনা রেলওয়ে স্টেশন। সাগর দাঁড়ি এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মকে নির্জন করে ছেড়ে গেল রাজশাহীর দিকে। হঠাৎই নির্জন হয়ে পড়ার একটা সৌন্দর্য্য আছে। তবে এটা খুব অদ্ভুত, আধার থেকে হঠাৎ তীব্র আলোয় বের হলে যেমন হয় আর কি। দূরে অপসৃয়মান ট্রেনের ঝিক ঝিক আর সাইরেন কে ছাপিয়ে ওভার ব্রীজ থেকে হঠাৎ প্রবল অট্টহাসি হেসে উঠে হাবা পাগলা। খুলনা স্টেশনে হাবা পাগলা যে কত বছর ধরে আছে তা বোধহয় একমাত্র বলতে পারবে “আলী রেলওয়ে টি স্টল” এর বৃদ্ধ আহমেদ আলী। হাবা পাগলার হাসির চোটে ৩ নং প্ল্যাটফর্মের অলস ওয়াগনগুলোর ওপর থেকে কাকগুল উড়ে যেতে লাগল। পাগলকে পাগল বললেও পাগোলের সাথে পাখির কি দারুন মিল! পাগল নিয়ে একটায় কবিতায় আছে, পাখির স্বাধীনতা আকাশে, পাগলের ভূমিতে। পাখির নীড় আছে, পাগলের হয়ত নেই। তবে, পাগলের রাত যাপনের একটা নির্দিষ্ট যায়গা আছে। পাখির মত পাগলেরও কিছু শৃংখলা আছে। রাত ৮টা বাজার বেশ অনেক পর সে আহমেদ আলীর দোকানের সামনে গিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকবে। অবশেষে বেচাকেনায় ব্যাস্ত আহমেদ আলী একসময় তার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে কয়েকটা বিস্কিট, একটা পাউরুটি আর একটা কলা বাড়িয়ে দেবে। তার ঠিক আধ ঘন্টা বাদে সে আবার আসবে। আহমেদ আলী তখন একটা স্টার সিগারেট খাওয়াবে। যারা রাত ৯টার সীমান্ত এক্সপ্রেসের যাত্রী, এটা তারা দেখে থাকে।

অট্টহাসি শেষে ওভার ব্রীজ থেকে নেমে আসতে থাকে হাবা পাগলা, হাতে একটা লোহার রড দিয়ে সিড়ির রেলিং্যে ঘটাং ঘটাং শব্দ করতে করতে। দু-একজন ঘরহীন উদবাস্তু দুই নাম্বার প্ল্যাটফর্মের এখানে সেখানে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, কুলিরা এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মের টিন শেডের ছায়ায় বেঞ্চে শুয়ে বসে ঝিমোচ্ছে। এভাবেই দুপুরের সেই অপার্থিব নির্জনতাকে বার বার ভাঙ্গে সে। ওভার ব্রীজ থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে সে হাটতে থাকল প্ল্যাটফর্মের দক্ষিণ দিকের শেষ মাথায়, যেখানে রেলওয়ের পার্শ্বেল গোডাউন। গোডাউন বলতে সেটা আসলে একটা অর্ধেক দেয়াল, তার ওপর অর্ধেক শিক দেয়া ঘর। সামনে লেখা “প্রবেশ নিষেধ. তবে হাবার সেখানে অবাধ যাতায়াত। কোন কিছুতে হাত দেয় না জন্য তাকে পার্শ্বেল বিভাগের কর্মচারিরা কিছু বলেও না। এখানে তার দৈনন্দিন কাজ একটাই। ব্রিটিশ আমলের একটা গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক আছে ঢাউস আকৃতির। ১৩০ বছরের চাবি দেয়া সেই ঘড়ি এখন অচল। গোডাউনে ঢুকে হাবা ঘড়ির বিশাল পেন্ডুলামটা হাত দিয়ে দোলাবে। রশিতে বাধা কোন কিছু দেখলে বাচ্চারা যেমন হাত দিয়ে দোলায়। পাগল বোধ হয় শিশুদের মতই আবুঝ; হয়ত নিশপাপও। গোডাউন থেকে সে আপন মনে কোন এক সুর ভাজতে ভাজতে বেরিয়ে পরল স্টেশন থেকে। ধীরে সুস্থ্যে হেলতে দুলতে সে গেল স্টেশনের মুখোমুখি সোহাগ রেস্তোরায়। মাঝে মাঝে এখানে সে পানির ড্রাম বাইতে সাহায্য করে, তাই দুপুরে এলে কিছু কিছু খাবার জোটে, কোনদিন বা অনেক উচ্ছিস্ট খাবার। হাবা পাগলার জীবনটা এখন পর্যন্ত একপেশে মনে হলে ভুল হবে। তার জীবন কিন্তু ভীষন বৈচিত্রময়। এই তো সেদিন কি মনে হল তার, ট্রেন ছাড়ার ঘন্টিটাতে মনের খেয়ালে “একটা ট্রেন দুইটা ট্রেন/ঘন্টা কিন্তু একটাই/ টিটি ব্যাটা টিকটিকি ঘন্টাটা তাই বাজাই…” গাইতে গাইতে ঠং ঠং করে বসিয়ে দিল কয়েকটা বাড়ি। কপাল ভাল ট্রেন ছাড়তে গিয়ে ট্রেনের গার্ড অবাক হয়ে ঘড়ি দেখেছিল, নইলে সেদিন হাবার কপালে দুঃখ হলেও হতে পারত। তার এই ছন্দজ্ঞান এল কোনখান থেকে, তা কেবল ইশ্বর জানেন। রাতে কুলিরা প্ল্যাটফর্মে চট দিয়ে ঢালাও বিছানা পাতলে সেখানে হাবার শোয়া হয়। শোবার আগে কিছুক্ষন তার সাথে কুলিদের রঙ তামাশা। মধ্য বয়স্ক আমজাদ আর চন্দ্রনাথ কুলির সাথে তার বড়ই দোস্তি।

তো আজ হাবা তেমন বৈচিত্রময় কিছু পেল না ঘটানোর মত। যেদিন তার জীবনে কোন বৈচিত্র আসে না, সেদিন রাতে কুলিদের সাথে ঘুমানোর আগে শুয়ে শুয়ে কাল্পনিক কোন এক ময়না বিবিকে তার এক লজ্জাস্কর ঘটনা বলে। ওভার ব্রীজের ওপর সে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য যেই না …………, ওমনি……থাক, পাগল প্রকৃতির সন্তান, আমরা তাকে লজ্জা না দেই। এই গল্প বলার সময় একদল হাসত, এখন তারা অভ্যস্ত, আরেকদল মনে মনে বিরক্ত হয়।

আজ দুপুরে খাওয়ার পর আপন মনে বকতে বকতে হাবা যখন ষ্টেশনে ঢুকেছে, দেখে টিকেট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এক চর্বিদার-ভুরিদার লোক টিকেট নিচ্ছে। তার পেছনে দাঁড়িয়ে এক মাঝ বয়সি শুটকো লোক, একেবারে পাটকাঠি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনকে কিছুক্ষন দেখল সে। তারপর ফিক করে খুলনার ভাষায় মোটা লোকটাকে বলল, “নাহয় তোর পিঠের ঘামাছি চুলকায় দেয় নাই, ঐজন্যে ওর সব খাবার খাইবানি? ও যে শুকায় মরবানি!” হাবার বেশভূষা দেখে মোটা লোকটা বিরক্ত হয়ে কিছু না বললেও আশেপাশে দাঁড়ানো লোকেদের হাসি লোকটাকে সহ্য করতে হল। প্ল্যাটফর্মে গিয়েই দেখা হয়ে গেল কুলি রহমত মিয়ার সাথে। হাবাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কোচকাল সে। রহমত মিয়ার একটা স্বভাব হল কাঠমিস্ত্রীদের মত, পেন্সিলের মত ডান কানে গোঁজা থাকে বিড়ি। তাই রহমতকে কাছে পেলেই পেছন থেকে বিড়িটা চুরি করার চেষ্ঠা করে হাবা। এমনিতে হাবা কখনই সুবিধা করতে পারে না। তবে রহমত একবার যদি ভারি মাল তুলেছে, তো কেল্লা ফতে!কানে বিড়ি গুজে রাখা রহমতের নেশার মত। বিড়ি শেষ হয়ে গেলে কানের বিড়িটা ধরায় আর তারপর যদি কানে গোজার জন্য বিড়ি না পায়, তখন তাকে দেখা যায় কানের ঐ অংশ চুলকাতে। হাবাকে দেখেই আড়াল খুজতে লাগল সে, নাহ! শান্তি নেই হাবার উৎপাতে। কি একটা লোকাল ট্রেন আসবে, তাই প্ল্যাটফর্মে বেশ লোক সমাগম। রহমত তেমনি এক ভিড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল। কিছুক্ষন তাকে খুজে হতাশ হয়ে হাবা আনমনে ওভার ব্রীজে উঠতে লাগল। হাতে লোহার রড কিন্তু সে কোন শব্দ করল না। প্ল্যাটফর্ম সরব থাকলে সে কখনও শব্দ করে না। শব্দের সাথে পাল্লা দেয়া পাগলের কাজ নয়, শব্দ দিয়ে নিরবতা ভাঙা পাগলের কাজ। ওভার ব্রীজে পায়চারি করতে করতে সে কয়েকটা সমস্যার সমাধান করে ফেলল। তেলের দাম কমাতে বেশি বেশি মাছের চাষ, দ্রব্য মূল্য কমাতে স্টেশনের ঘন্টা বাজান(হাবার মতে, স্টেশনের ঘন্টাটা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া উচিত!) এবং আয়ু বাড়াতে গান গাওয়ার উপকারিতা নিয়ে আগামী সংসদে সে কী বক্তব্য দেবে, তারও একটা অনুশীলন হয়ে গেল জোর গলায়। এই সময়টা একান্তই তার নিজের। এসময় তাকে জ্বালান বারন। তার সংসদীয় বক্তব্যে কেবল মাছ চাষের ব্যাপারটা উত্থাপন করেছে, এমন সময় বেনাপোল বন্দর থেকে লোকাল ট্রেন “বেনাপোল কমিউটার” প্ল্যাটফর্মে এসে তার নিচ বরাবর এসে দাড়াল। ওভার ব্রীজ থেকে নিচে প্ল্যাটফর্মের লোকজনকে ছোট মনে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হাবার কাছে এটা একটা বিশেষ ব্যাপার। ওপর থেকে সে লোকজনকে ডানহাতের কনিষ্ঠা দিয়ে মাপে এসময়। “ঐ সাদা পাঞ্জাবী! আমার আঙ্গুলের অর্ধেক। ঐ কালা প্যান্ট! এক আঙ্গুল! সব আমার চেয়ে ছোট! হা হা হা!” আপন মনে কিছুক্ষণ হাসে হাবা। তারপর হঠাৎ বিরবির করে ওঠে, “আচ্ছা, আমি ঠিক কত বড়?” নিচের আঙ্গুলে নিজেকে মাপার চেষ্ঠা করে হাবা। মাথা থেকে গলা পর্যন্ত বেশ কয়েক আঙ্গুল হতেই আত্নতৃপ্তির হাসি দিয়ে ওঠে, “হুম, আমি অনেক বড়। রহমতের ব্যাটা রহমত শালা দেখি আমার আঙ্গুলে দেড় আঙ্গুল!” এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে রহমত তখন মাথায় একটা স্যূটকেস মাথায় নিয়েছে। হাবার বিরবির চলতেই থাকে, “আমার চেয়ে এত ছোট, তাও এত ডাঁট! আমাকে বিড়ি দেয় না। শালার ব্যাটাকে ওভার বিরিজে আইনে দেখাবনি, আমি কত বড়!” এই বলে ওভার ব্রীজ থেকে প্ল্যাটফর্মে রহমতকে খুজতে গিয়ে ওর চোখ আটকে গেল এক উজ্বল বর্ণের লোকের দিকে। সাদা শার্ট কনুই পর্যন্ত গোটানো, সাথে খয়েরি প্যান্ট পড়া লোকটা প্ল্যাটফর্মে নেমে একা একা কেমন অদ্ভুদভাবে চারদিকে দেখছে আর ঠোটের নড়াচড়া দেখে মনে হবে যে বিরবির করছে আপন মনে। হাবার মাথায় ঠঙাস করে একটা টিনের ক্যানেস্তারা বেজে উঠল। হাতের রডটা ওভার ব্রীজেই ফেলে রেখে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি করে নেমে আসল প্ল্যাটফর্মে, এগতে থাকল লোকটার দিকে। লোকটা হাবাকে তার দিকে আসতে দেখে একটা রুমাল দেখিয়ে বলে, “এই রুমালটা কার বলতে পারেন ভাই? নিজের রুমাল কেউ ফেলে যায়?” হাবা জবাব দেয়, “ঠিক কথা, ঠিক কথা! কিন্তু এইটা পাইলেন কই?” লোকটা ফোস করে একটা শ্বাস ফেলে, “আরে ভাই ট্রেনের উঠার সময় দেখি এই রুমাল পড়ে আছে প্ল্যাটফর্মে।” হাবা চুকচুক করে, “আহারে! তারপর?” লোকটা বলে যেতে থাকে, “সারা রাস্তা ট্রেনের মানুষগুলারে জিজ্ঞাস করি, সবাই দেখি হাসে। অবাক হয়ে গেলাম ভাই, আমি আজকে ট্রেনে সব পাগলগুলোর সাথে আসছি।” রুমালটা হালকা নীল রঙের। হাবার বেশ পছন্দ হয় রুমালটা।

ওদিকে প্ল্যাটফর্ম মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গেছে, যাত্রীরা চলে গেছে। দুই পাগলের আলাপ দেখতে কুলিদের জটলা জমে গেল। রুমালটা হাবাকে দেয়া ঠিক হবে কিনা, এই নিয়ে যখন দুই জনে আলাপ চলছে, তখন টিকেট কাউন্টারের ওপাশ দিয়ে স্টেশনে হাজির হয় দুই যুবক। বয়সে দুজনেই পচিশোর্ধ্ব। তাদের মধ্যে একজনের ঝাকড়া চুল, জিন্স আর সাদা টি শার্ট; সে পাশের জনকে বলল, “রবি কোথায়? ট্রেন যাত্রী নামায় গেছে তো প্রায় দশ মিনিট হইল। ওর তো স্টেশনেই থাকার কথা।” কথা শেষ হতে না হতেই তার সঙ্গী সাদা পাঞ্জাবী পড়া যুবক খেপে ওঠে, “এই জন্যই খালাকে বললাম রবিকে একা পাঠাবেন না। ও এখনও ভাল হয় নাই, ওর অবস্থা এখনও অতটা ভাল না।” সেসময় তিন নাম্বার প্ল্যাটফর্মের ওপাশে ট্রেন ওভার হেড ওয়াশিংযের জন্য প্রায় চার তলার সমান উচু যে ট্যাঙ্ক, সেটা ভর্তি হয়ে ওভার ফ্লো হতে লাগল। পানি আছড়ে পড়তে লাগল নিচে কঙ্ক্রীটের ওপর। সেই শব্দে সচকিত হয় সেই দুই যুবক। শব্দের উৎসের দিকে তাকাতে গিয়ে ওদের খেয়াল হয় একটা জটলা। “জাবের, চল ঐদিকে যাই। আমার মন বলে ওখানেই আছে।” জটলাটার দিকে তর্জনি দিয়ে দেখায় ঝাকড়া চুল। ওরা যখন এসব কথা বার্তা বলছিল, ওদিকে তখন হাবা আর রবি নামের উজ্বল বর্ণের সেই সুদর্শন লোকটার দারুন আলাপ জমেছে। “ঐদিকে কি পানি পড়ে নাকি?” পানির শব্দের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে রবি। “বৃষ্টি পড়ে, ঐ টেঙ্কিতে আকাশের মেঘ জমে।” হাবা দারুন জবাব দেয়, “যখন আমি গান গাই তখন…।।” “আচ্ছা, বৃষ্টিতে ভিজি|?” সহসা রবি প্রশ্ন করে। “সুখে থাকবেন বৃষ্টিতে ভিজলে।” হাবা পাগলা এই কথা বলার সাথে সাথেই সে দৌড় দেয় ঐদিকে। যাত্রীশূণ্য হওয়া বেনাপোল কমিউটার ততক্ষণে গ্যারেজের দিকে রওনা হয়েছে। এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মের পরে ব্রডগেজ লাইনদুটো পার হয়ে, দুদ্দাড় দৌড়িয়ে দুই নাম্বার প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে ঘুমন্ত দুই উদ্বাস্তুর ঘুম ভাঙিয়ে, এদিক থেকে হা করে চেয়ে থাকা কুলিগুল আর হাবার অবাক চোখের সামনে দিয়ে হারিয়ে গেল ওয়াগনগুলর আড়ালে। কয়েক মুহূর্ত পর রবির গানের গলা ভেসে আসে ওয়াগনগুলর ওদিক থেকে, “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কণ্যে দান……” আর সেই মুহূর্তে জটলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রবিকে খুজতে আসা জাবের আর তার সঙ্গী। ঝাকড়া চুল বলে, “এদের জিজ্ঞেস করে দেখ তো।” ঐ ‘দেখ তো’-তেই তাকে আটকে দেয় জাবের, “ফিরোজ, ঐদিকে শোন…” গানের উৎসের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেয় সে, “এটা রবি না হয়ে হয় না। ঐদিকে ওয়াগনগুলোর দিকে মনে হয়, চল গিয়ে দেখি।” এই বলে দুজনে যেই না পা বাড়িয়ে এগোনর উপক্রম করেছে, অমনি তাদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা হাবা পথরোধ করে। সে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। “কি করবা? নিষ্পাপ লোকটারে ধইরে নেবা? লাভ নাই বুঝলা, তোমরা যতসব পাগলের দল ভাল মানুষগুলারে ধইরে পাগল বানাইতে চাও?” এই কথায় ওরা দুজন অবাক হয়ে যায়। হাসতে হাসতে চন্দ্রনাথ কুলি এসে বলে, “এ তো পাগল, এর কথা না শুইনে আপনারা যারে নিতে আসছেন তারে নিয়ে যান।” ওরা এগতে গেলে হাবা আবার তাদের আটকে ধরে, তখন কয়েকজন কুলি তাকে যাপটে ধরে। হাবার সাথে তাদের ধস্তা ধস্তি শুরু হয়, প্রাণপনে হাত পা ছুড়তে থাকে, কিন্তু তিনটা কুলির সাথে পেরে ওঠে না সে। একসময় দূর্বল হয়ে আসে তার প্রতিরোধ, কুলিরা ছেড়ে দেয় ওকে। বিমর্ষ হয়ে হাবা বসে পড়ে প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে। কিছুক্ষণ পর ওয়াগনের আড়াল থেকে রবির কন্ঠে চিৎকার শোনা যায়, “ওই! আমাকে ছাড়, আমি বৃষ্টিতে ভিজব।” শব্দ না শুনতে পেলেও হাবা বোঝে ওপাশে তখনও ধস্তাধস্তি চলছে। “ঐ শালা হারামীর বাচ্চারা ছাড়, ছাড় আমাকে, খুন করে ফেলব তোদেরকে!” রবির চিৎকার আস্তে আস্তে দূর্বল ও দূরে আপসৃত হতে থাকে। এপাশে বিষন্ন হয়ে বসে থাকে হাবা পাগলা। ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আমজাদ বলে ওঠে, “বুঝলা হাবা, রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু আর পাগলে চেনে পাগলরে।” ওর কথায় হা হা করে হেসে ওঠে সবাই। হাসতে গিয়ে বুকে বিড়ির ধোয়া আটকে চন্দ্রনাথ কুলির বিষম অবস্থা হয়, কাশতে থাকে। হঠাৎ হাবার চোখ জ্বলে ওঠে, “হ্যা, ঠিক কথা বলছ দেখি। এই যেমন তোমরা চিনলা ঐ পাগল দুইটাকে, চিইনে আমাকে সরায়ে দিলা ওদের জন্য।” “কেন?” চন্দ্রনাথ আরেকটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে জিজ্ঞেস করে, “আমাদের পাগল বল কিজন্যে?” “তোমরা বল, মানুষের বৃষ্টিতে ভিজতে কোন সমস্যা আছে?” বিজ্ঞের মত প্রশ্নটা ওদের দিকে ছুড়ে দিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে হাবা। “না” চন্দ্রনাথ উত্তর দেয়। “আচ্ছা, বৃষ্টি হইলে আমি যখন ভিজি, তোমরা সব বইসে থাক স্টেশনের টিনের তলে আর আমারে বল পাগল ভিজিস না। ওভার বিরিজে ফকিন্নির পোলাগুলা ভিজলে কোন দোষ নাই, আর আমার ভিজা যাবে না। তোমাদের সব কয়টিরে পাগল বলবনি এখন থেইকে।” হাবার অকাট্ট যুক্তি, কেউ খন্ডাতে পারে না। চন্দ্রনাথের বিড়িটা ওর হাত থেকে নিয়ে উদাস কয়েকটা টান দিয়ে হাবা বলতে থাকে তার যুক্তিময় কথা, “রহমত মিয়া, তুমি তো কও ছোটকালে নাকি ভালই ছিলা। ছোটকালে কি বৃষ্টিতে ভেজ নাই? এখন আমি বৃষ্টিতে ভিজলে তুমি বইসে থাক টিনের তলে। ঐ ভাল মানুষটারেও ভিজতে দিলা না। আমার রুমালটাও নেয়া হইল না।” সবাই নির্বাক হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ এ পরিবেশে হাবা আনন্দে বলে ওঠে, “বৃষ্টিতে ভিজ মিয়ারা, মাথায় বৃষ্টির পানি দিয়া মধু ঢুকে, ট্রেনের ধোঁয়া বাইর হইয়ে যায়।পাগলামি সাইরে যায়। আমারে দেখ কত সুখে আছি। আর তোমরা পাগলরা যত কথা কও- বৃষ্টিতে যাইস না, ঘন্টা বাজাইস না, চিল্লা-চিল্লি করিস না। পাগল, যত্তসব।” শেষের দিকে কথাগুলো বলছিল আনমনে, যদিও সবই শোনা যাচ্ছিল। বিড়িটা শেষ হয়ে আসছিল, লাইনের ওপর ছুড়ে ফেলে আনমনে হাবা এগোতে থাকে ঐ ওয়াগনগুলোর দিকে। লাইন দুটো পেরিয়ে দুই নাম্বার প্ল্যাটফর্মে উঠেছে মাত্র, এমন সময় এপাশ থেকে ওকে ডাক দেয় চন্দ্রনাথ, “ও হাবা! মানলাম তুমি ভাল আর আমরা সবে পাগল। তা তুমি কই যাও?” “ক্যান, বৃষ্টিতে ভিজব।” হাবার সরল উত্তর। রহমত হেসে ওঠে, “তা টেঙ্কির পানিরে যদি বৃষ্টি কও, তাইলে তো তুমিও পাগল।” থেমে উলটো ঘুরে দাঁড়ায় হাবা, “পাগল ছাগল যতসব! তোমরা কি ঐসব বুঝ? আমি জানি, ঐ টেঙ্কিতে মেঘ ভরা আছে জান না? আমি যখন গান গাই, তখন মেঘ নাইমে আসে টেঙ্কিতে। পরে আমারে বৃষ্টি দেয়। পাগলের দল, তোমরা বুঝবা না।” এলোমেলো শিস দিতে দিতে সে এগিয়ে যায় তিন নাম্বার প্ল্যাটফর্মের ঐ ট্যাঙ্কিটার দিকে, তারপর হারিয়ে যায় ওয়াগনগুলোর আড়ালে।

[আগের ব্লগে(স্টেশন ডায়েরী)স্টেশনের পাগলকে নিয়ে যে গল্পের কথা বলেছিলাম, এটা সেই গল্প। ২৩ নভেম্বার, ২০১১, স্টেশনে বসে এই গল্পের শুরু। ]

 

১,৩৫৮ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “পাগলের মেঘ, পাগলের বৃষ্টি”

  1. মীম (২০০৬-২০১১)

    আমি ১ম।
    সিসিবি'র আগের পোস্ট গুলতে দেখলাম আগে সবাই কম্পিটিসন দিতো ১ম কমেন্ট দেয়ার জন্য।

    লেখাটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমরা চাইলেও অনেক কিছু নিজের খেয়ালমত করতে পারি না আর যারা পারে তাদেরকেও কেন যেন ভালো চোখে দেখতে চাই না। মানুষ যেমন অদ্ভুত, তার চিন্তা-চেতনা আর বাস্তবের বহিঃপ্রকাশটাও তেমন অদ্ভুত।

    ভালো লাগলো ভাইয়া। :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    তোমার লেখার হাত আছে - এটা আগের লেখাতেই বুঝেছিলাম।
    রেলস্টেশন গুলো গল্পের একেকটা খনি। কত লোকের আনাগোনা সেখানে, বসে বসে কাটিয়ে দিলেও আমার একটুও বিরক্ত লাগেনা।
    আরো লেখো।খুব উঁচুমাপের ছোটগল্প আশা করছি তোমার কাছে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সুষমা (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।