পশ্চিম পর্ব (ভূমিকা পর্ব )

বজ্র পর্বতের পায়ে ছোট্ট একটা শহর। শহরে একটা মল, কিছু সাধারন দোকান আর গোটাকয়েক আবাসিক এলাকা। স্বল্প আয়তন, অল্প মানুষ আর গোছানো পরিসরে ছবির মত সাজানো শহরটার নাম সিয়েরা ভিস্তা। মেক্সিকোর সীমান্ত ঘেঁষা হুচুকা মাউন্টেনের পায়ের কাছে এই শান্ত শহরটাতে মাস সাতেক বাস করতে হয়েছিল আমাকে।

সিয়েরা ভিস্তা, নামটাই তো কেমন অন্যরকম। কিশোর বেলায় পড়া ওয়েস্টার্ন গুলোতে এই নামটা ছিলো কিনা মনে নেই, তবে পাশেই টুসন, নগালেস, টুবাক, টুম্বস্টোন অথবা একটু দূরের এল পাসো তো আমার বহুদিনের চেনা শহর। আরিজোনা, টেক্সাস ,সান্তা ফে , সান্তা বারবারা কেমন নস্টালজিক সব শব্দ আমার কাছে। আরিজোনা মানে বিলি দ্যা কিড, শ্যানন, এরফান কিংবা অন্য কোন টাফ গাই। বুনো গন্ধ মাখা নাম গুলোর মতোই সাহসী, সামর্থ্য, একরোখা আর ভীষণ রকম পুরুষ কিছু মানুষ। ধুলা মলিন জীর্ণ শার্ট, চওড়া ব্রিমের নিচে রোদে পোড়া তামাটে মুখ, এক জোড়া শীতল চোখে সাবধানী দৃষ্টি, রঙ জ্বলা জিন্স পড়ে বাকস্কিনের পিঠে নিঃসঙ্গ রাইডার। আমার ভাবনায় তখনো পশ্চিম মানে উঁচু নিচু ঘাসের জমিতে ধূসর প্রলেপ, একাকী পথে শুন্যতার শব্দ, পাইন বনে শীতল রাতে শিশিরের টুপটাপ, একলা রাতে ছোট্ট আগুনের নরম ওমে বেডরোলে ঢুকে যাওয়া সওয়ারী আর সিডার ঝোপের পাশে নির্ঘুম ঘোড়ার পা ঠোকার শব্দ। বহুদূরে কোন এপাচির তামাটে শরীরে আগুনের রঙ পিছলে যাওয়া, তার বন্য চোখে শিকারের নেশা।

এইসব কিশোর কল্পনার সব রঙ চোখে মেখে এক এলোমেলো সন্ধ্যায় আমার সিয়েরা ভিস্তায় প্রবেশ। নিয়ন বাতির ভুতুড়ে আলোয় কিছু বিশাল ক্যাক্টাস ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়েনি তখন। শুধু টুসন হতে সিয়েরা ভিস্তার পথে সন্ধ্যার চাপ চাপ অন্ধকার আর জমাট বাঁধা নিরবতাটাকে বিদীর্ণ করে একবার জন পঁচিশ বাইকারের একটা দলকে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখে মনে হয়েছিল এটাই হয়ত বদলে যাওয়া সময়ের পসি। ছন্নছাড়া, আর বোহেমিয়ান মানুষেরা আজো আছে, বদলে গেছে কেবল ঘর ছাড়ার ধরন ধারন। কল্পনার অনেক কিছুই মিলল না আধুনিক পশ্চিমের সাথে। ব্যাট উইং ডোর আজ হারিয়ে গেছে কাঁচের স্বচ্ছতায়, স্পারের শব্দ মিলিয়েছে নরম সোলের নৈশব্দে, সেকালের হিচরেইলগুলো আজ শুধু পার্কিং এর হলুদ সাদা দাগ, স্টালিয়ন আর বাকস্কিনেরা এখন কেবল সৌখিন কোন অতীতচারীর বার্ষিক বিনোদন। আর সত্যিকারের গান ফাইট? নেভার।

তবু তেমন করে হতাশ হইনি। কারণ ধুধু প্রান্তর জুড়ে বুনো ক্যাক্টাস, আর ঘাসের বনে বাতাসের শিসকাটার শব্দ এখনো তেমনি আছে, এখনো দিগন্তে দাড়ালে একজোড়া সন্ধানী চোখ বহুদূরের ঠিকানা খুজে নিতে পারে, মানুষ বদলেছে, বদলেছে জীবন ও নির্মাণ, তবে বুনো পশ্চিম তার প্রকৃতি ও পরিবেশে আজ অবধি খুব বেশি আঁচড় ফেলতে দেয়নি বদলে যাওয়া মানুষগুলোকে। পশ্চিমে এখন অশ্বক্ষুরের শব্দ নেই, স্বর্ন সন্ধানী, শেরিফ, গান স্লিংগার, বার টেন্ডার, আন্ডার টেকার, রাসলার, কাউ হ্যান্ড, ফোরম্যান আর র‌্যাঞ্চার এর অহংকারী তরুনী কন্যা, কিশোর বেলার চরিত্রগুলো একটাও নেই। আছে দীর্ঘ্য গাড়ির সারি, সভ্য জীবন যাত্রা। তবে খোলা আকাশের নিচে পশ্চিম সেই আগের মতই, রুক্ষ, বুনো আর কঠিন। দূরের পাহাড় সারি এখনো অসীমের পথে ডাক দেয়, ক্রীকের ধারে পাইন, সিডার আর বুনোঝোপের সারি এখনো লুকোচুরি খেলে আলো, ছায়া, অন্ধকারে।

কিশোর কালের ফ্যান্টাসী, ভাবনার মিল অমিল, ভাল লাগা, না লাগার পশ্চিম, আমেরিকা দর্শনের সাতকাহন নিয়ে লেখার একটা চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিছু দিলখোলা কালো মানুষ, একটা মায়ার্দ্র , অন্যরকম আমেরিকান দম্পতি, কিছু দেখা আর একজন মায কে নিয়ে লিখব ভাবছি অনেক দিন। কিন্তু শব্দহীন আমি কি সত্যি পারব একজন মায কে নিয়ে লিখতে?

চেষ্টা করে যাই, কাটি, লিখি আবার কাটি।

১,৬৬৯ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “পশ্চিম পর্ব (ভূমিকা পর্ব )”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মায়ের পাঠানো আচারের বয়মটি আমি প্রথমে অনেকদিন নেড়েচেড়ে দেখি, ঢাকনা খুলে শুধু সুবাস নিই।চেখে দেখতে ইচ্ছে করেনা এভাবে বেশ কিছুদিন, ভয় হয় যদি ফুরিয়ে যায়?
    তেমনি তোমার সুস্বাদু লেখাটির আভাস পেয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি একে, ফিরে ফিরে পড়ছি। এখনো পুরো পড়িনি।কিছু বাক্য, শব্দ চেখেই ঝপ করে কৌটো বন্ধ করে দিয়েছি, আবার আসবো বলে।

    জবাব দিন
    • রেশাদ (১৯৯৩ -৯৯)

      অনেক কিছু বলে ফেলতে ইচ্ছে করছে, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্যই খুশিতে।
      তবু বলেই ফেলি, এই লেখাটার শেষে একজন মানুষের কথা আছে। একজন এক্স ক্যাডেট, একজন বীর শহীদ। আমেরিকায় যার শেষ কতগুলো দিনে আমি তার সান্নিধ্য পেয়েছি। লেখাটার শেষ পর্বে তাঁকে নিয়ে লিখব বলেই এই লেখাটার শুরু। লিখতে বসেও বারবার ভাবছিলাম, আমি কি পারব? এখনো সেই একই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায়।পারব কি পারব না।
      তার পরও লেখাটা শুরু করে দেয়ার পর মনে হচ্ছিল, দেখা যাক----- ।
      এমনিতেই নতুন হিসেবে আমার লেখা খুব বেশি পরিচিত নয় বলে খুব বেশি কমেন্ট এমনিতেই আমি আশা করি না, তবে প্রথম থেকেই আপনি, জিতু, আমিন -- - - , আমি সত্যি ভীষন আপ্লুত।
      তবে আপনার আজকের এই কমেন্টটার জন্য হয় জীবনের সেরা সাধুবাদ ধরে নিয়ে আর কোন দিন লেখাই উচিত না নয়ত --------।
      একটু হতাশই হয়ে যাচ্ছিলাম, ডাক্তাদ্দা কিছু বলে না কেন? তারমানে কি এই লেখাটা ভাল হচ্ছে না?
      প্রশংসা আমারা অনেকেই করি কিন্তু অনুপ্রেরণার ভাষা সত্যি অন্যরকম, ধন্যবাদ নূপুরদা।

      জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        আমি আসলে অনেকসময় সময় নিয়ে মন্তব্য করি। জুতসই ভাষা না পেলে মন্তব্য করেই উঠতে পারিনা।অনেক লেখাই বিশেষত সিসিবির গল্পগুলো নিয়ে আমার তেমন কিছু বলাই হয়না (গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশের ব্যর্থতার ভয়ে)।
        তোমার লেখার আচ্ছন্ন করে ফেলার একটা ক্ষমতা আছে। প্রতিটি নতুন লেখায় আগেরটিকে ছাড়িয়ে যেও।
        আমার কথাগুলো তোমাকে অনুপ্রাণিত করেছে জেনে সত্যি ভালো লাগছে।কিন্তু আমি জানো তোমাকে অনুপ্রেরণা দেবো বলে ঠিক লিখিনি।লক্ষ্য করলাম হাতে সময় আর মুড ঠিক থাকা সত্ত্বেও তোমার লেখাটা একটু ছুঁয়েই চলে যাচ্ছি। একটু ভাবতেই মনে হলো, আমি এটিকে একবারে পড়ে শেষ করবোনা।এই আর কি।

        একজন পাঠক ভেবে মন্তব্য করতে পারেন, না ভেবেও। যা খুশি। তা লেখককেও নাড়া দেবে।দিক না! কিন্তু লেখক আপনমনের নির্দেশ মেনে চলুক লেখার সময়ে। সেখানে সে বড় একা, আপনার জগতের সম্রাট।এমন নিস্পৃহতার বড় প্রয়োজন।
        পাঠকের প্রশংসা বা তিরস্কার তাকে যেন সীমানা ছাড়িয়ে স্পর্শ না করে।

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেশাদ (১৯৯৩ -৯৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।