মডেল বিষয়ক অক্ষমতা আর তার পেছনের গল্প…

প্রশ্নটা করে উনি বেশ খানিকটা সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে, কেমন একটা কৌতুকমাখা নাকি ব্যঙ্গাত্মক এবং প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে, ঠিক বুঝে উঠতে না পারার আগেই স্বতস্ফূর্তভাবেই জবাবটা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে, “যদি আমি রাজি হই?”, ফিক করে হেসে ফেললেন উনি। আর মূহুর্তের মধ্যেই বদলে ফেললেন মুখে ধরে রাখা কোমলতার ছাপটা, আমি কি বুঝতে পারছি, উনার উত্তরটা ঠিক কি আসছে এক্ষুণি??…

উনার সাথে পরিচয় বোধহয় মিনিট দশেকেরও হবেনা। প্রচন্ড বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে দৌড়ে চারুকলার ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। সময় কাটানোটাই যখন প্রশ্ন, তো ঠায় দাঁড়িয়ে অসময়ের ঝুম বৃষ্টিকে জোর করে উপভোগ করার অভিনয়ের চাইতে জয়নুল গ্যালারিতে চলমান একক চিত্রপ্রদর্শনীতে ঢুঁ-মারাটাই কাজের কাজ বলে মনে হলো।

চিত্রকলা ব্যাপারটাই ঠিক এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। খুবই খারাপ আঁকিয়ে ছিলাম সহপাঠি অন্যদের চেয়ে, ড্রয়িং স্যারের হাতে মারও খেতাম বেদম, তবুও কেন জানি ভালোলাগাটা তৈরি হয়েছিল সেই ছোট্টবেলাতেই, নিজে থেকেই অনেকসময় কিছু কিছু পড়ার চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন সাইট ঘেঁটেছি, জীবনী পাঠ করেছি মহান শিল্পী অনেকের, ভ্রমনকাহিনি পড়েছি গোগ্রাসে তবুও আজো কোন ছবির সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন বোকা বোকা মনে হয়। তথাপি আকর্ষনটা কমেনি কখনো।

বাহ, আমার চোখে বেশ ভালোই লাগছে ছবিগুলো। গ্রামীণ পটে আঁকা ছবিতো অবশ্যই চোখজুড়ানো, কয়েকটা ছবির শিরোনাম পড়েই খুব সুন্দরভাবে ছবির বক্তব্যের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নেয়া যাচ্ছে, অনেক আঁকিবুকি আছে রঙের, বেশ লাগছিল। বেশ কয়েকটা ফিগার স্কেচ ছিল, কিউবিজমেও মনে হলো শিল্পী হাত মকশো করেছেন, নাহ বেশ ভালোই লাগলো।

শেষে এসে শিল্পীর নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো আমার, নিজের মাঝে গেঁড়ে বসা পুরুষ মানসিকতা আমাকে অবাক হতেই বাধ্য করলো, ড্রয়িংগুলো তাহলে একটা মেয়ের!! এবার আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য ন্যুড স্কেচ সেকশনের দিকে এগিয়ে গেলাম, (নাকি শেষবিন্দু থেকে পিছিয়ে)! যা হোক, মাথায় মূহুর্তেই দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল একটা, তেমন খোঁজার দরকার হলোনা, শিল্পী হলের মাঝামাঝি একটা টেবিল পেতে গোটা চারেক চেয়ার নিয়ে আরেকজনের সাথে গল্প করছেন। আমি গিয়ে দাঁড়ানোর মূহুর্তখানেক আগে ভদ্রলোক উঠে গেলেন, মিষ্টি হাসিতে শিল্পী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে।

হালকা দু’চারটা কথার পরে আমি প্রশ্নটা করেই ফেললাম আর কৃত্রিম খেদে জানালাম, আপনি নারী হয়েও আরেকজন নারীর ন্যুড স্কেচ করেছেন, তা নিয়ে আমার কোন আপত্তির প্রশ্নই আসেনা, কিন্তু ফিগার ড্রয়িংয়ে বিশেষ করে ন্যুড ছবির ব্যাপারে পুরুষের অংশগ্রহন এত কম হলে চলবে কেন? উনি খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা আমার তথ্য সংশোধন করে দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন, পুরুষের অংশগ্রহন একদম কম এটা কিন্তু ঠিক হলোনা। তবে আমাদের দেশে এমনতরো মডেল পাওয়াটাই মুশকিল, সে নারী-ই হোক বা পুরুষ।

সেটা অবশ্য জানাই আছে আমার। এমন সময়েই এলো সেল্ফ প্রোর্ট্রেটের কথা, ফ্রিদা কাহলোর প্রসঙ্গেও আলাপ হলো, স্বনামধন্য চিত্রকর ডিয়েগো রিভেরির সাথে ফ্রিদার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অথচ আবেগময় সম্পর্ক নিয়েও কথা হলো, এল নারীর নানান সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গে, বিশেষ করে যখন চারুকলার মতোন বিষয়ে এদেশে কেউ তার ক্যারিয়ার গড়তে চান।

তো তেমন সময়েই অনেকটা আলাপে আলাপে জবাবের ধরনেই বেরিয়ে এল প্রশ্নটা আমার মুখে, “যদি আমি রাজি হই?”, ফিক করে হেসে ফেললেন উনি। আর মূহুর্তের মধ্যেই বদলে ফেললেন মুখে ধরে রাখা কোমলতার ছাপটা, আমি কি বুঝতে পারছি, উনার উত্তরটা ঠিক কি আসছে এক্ষুণি?? তবে আমার মাথাটা শুন্য হয়ে গেল তাঁর কথার তীক্ষ্মতায়, “ধরুন, সবকিছু ঠিকঠাক মতোই এগুলো, একজন ন্যুড-মডেল হিসেবে আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে, তখন আমার নিরাপত্তাটা কি আপনিই নিশ্চিত করবেন?”

এতক্ষন আমি উনার সাথে চোখে চোখ রেখেই কথা বলে চলছিলাম, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম কোন জবাব নেই জেনেই হঠাৎ করে আমার মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে আর শিল্পীর ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে, উনি কি করুনা করে বলছেন, হায়রে পুরুষ!!

২,৯৫০ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “মডেল বিষয়ক অক্ষমতা আর তার পেছনের গল্প…”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    টানটান গদ্য।
    কয়েকটি কথা:
    ১। দর্শকের চিত্রশিল্পের জগতে বিচরণের অভিজ্ঞতা আছে অথচ শিল্পীর নারী-নাম দেখে 'পুরুষ মানসিকতা'-র হোঁচট খাওয়া। একেবারে আনকোরা দর্শক হলে না হয় কথা ছিলো।
    ২। দর্শক যখন নিজেই ন্যুড মডেল হবার প্রস্তাব আনছেন, তখন ই শুধু নারী শিল্পীর নিরাপত্তাটুকুই ইস্যু, অন্তত তাঁর নিজের কাছে? গল্পটা যখন এই প্রশ্নে থেমে যায় চট করে তখন যেন মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তরে কারো কিছু বলার নেই: না দর্শকের, না কোন পুরুষের, না সমাজের। আসলে কি তাই? এটি কি একেবারে চুপ করিয়ে দেবার মতো প্রশ্ন?

    তোমার লেখার হাত খুব ভালো, আগেও খেয়াল করেছি।
    চালিয়ে যাও।
    শুভেচ্ছা।

    জবাব দিন
    • রশিদ (৯৪-০০)

      প্রথমে কৃতজ্ঞতা জানাই ভাইয়া...
      আমার যতটুকু মনে হয়:
      ১) এখানে নারী শিল্পী বলে হোঁচট খাওয়ার একটা কারন হতে পারে, আমাদের দেশে বিখ্যাত নারী চিত্রকরের সংখ্যা আদৌ খুব বেশি নয়, আর আমরা যারা দূর থেকে এইসব শিল্পকলার উপর অনিয়মিতভাবে চোখ রাখি, তাদের জন্য এটা বোঝা হয়তো মুশকিল যে নারীরা কতটা এগিয়ে যাচ্ছেন আর গেঁড়ে বসা মানসিকতাটা উপড়ে ফেলা কি আদৌ সহজ? আমার মনে হয়না।
      এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত একজন নারীনেত্রীর ঘটনা বলতে চাই। প্রেসক্লাবে বসে আড্ডারত কয়েকজন সাংবাদিকের একটা আলাপ উনি শুনে ফেলেছিলেন, তারা বলাবলি করছিলেন আড্ডায় মেয়েদের উপস্থিতিতে বিরক্তির কথা, কারন তখন আরাম করে স্ল্যাং ব্যবহার করা যায়না, উক্ত নেত্রী খেদের সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছেন, নারীদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে আবার তাদের সাথে মিশতে এমন অস্বস্তিটা কি দ্বিচারিতা নয়??
      সে হিসেবে আমার গল্পের বর্ণনাকারি তো নেহায়েত একজন আম-আদমি!!

      ২) এটা নিয়ে আমিও ভেবেছি, এখানে আরো অনেক উপাদান আসতে পারে, যেমন একজন পুরুষের উপর নারীর বিশ্বাসহীনতার প্রাবল্য, যা হয়তো আজকের সমাজ বাস্তবতায় খুব স্বাভাবিক, পাশাপাশি এটা নারীর নিজের উপরও আস্থাহীনতা হতে পারে যে অমন সময়ে কোন জৈবিক অনুভূতি ক্রিয়াশিল হলে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারবে কি না, আবার এটা স্রেফ ছেলেটিকে বাজিয়ে দেখাও হতে পারে।
      এটা আমার অক্ষমতা যে বিচিত্র নারীমনকে বিস্তৃত করে তুলে ধরতে পারিনি:(

      আবারো ধন্যবাদ ভাইয়া উৎসাহের জন্য... আপনার মতামত পেলে খুব খুশি হবো।

      জবাব দিন
      • নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

        ঠিক বলেছো তুমি। আমার মনে হচ্ছিলো, শিল্পীর ব্যক্তিত্বকে আরেকটু উন্মোচন করা যেতো। আলাপচারিতা আরেকটু টেনে নেয়া যেতো চিত্রশিল্পের, বিশেষত ন্যুড মডেলের
        স্বল্পতাজনিত (বা তার কাছাকাছি কিছু) সমস্যা নিয়ে। কিংবা তেমন ডিটেইলে না গিয়ে শুধু তাঁর মুখভংগি বা মুখের রেখার পরিবর্তনগুলো ( দর্শকটির প্রতি কৌতূহলমাখা প্রশ্নের বিপরীতে) কে ধরলে আমরা একটা ধারণা পেতে পারতাম শিল্পীর সংকট সম্পর্কে।

        আরেকটি একেবারেই ব্যক্তিগত প্রসংগ। এই লেখাটি লেখার আগে শেষ কবে তুমি গ্যালারিতে গিয়েছিলে? যদি অনেক আগে গিয়ে থাকো, তবে আমি বলবো আবার যাও, আর গ্যালারি ঘুরতে ঘুরতে গল্পটা নিয়ে বারবার ভাবো, গল্পটাকে আবার দেখো। তারপোর ফিরে এসে আবার লেখার চেষ্টা করো। অনেক কিছু পাল্টে যাবে।
        তোমার লেখার ফরম্যাট একদম চৌকস, কিন্তু ডিটেইল কম। সে জায়গাগুলো ভরাট করতে হবে।

        জবাব দিন
        • রশিদ (৯৪-০০)

          ভাইয়া, আপনার সাথে পুরো একমত, আমি ডিটেইলে যেতে পারছিনা। এর কারন মুখ্যত অলসতা আর সময়বিন্যাসের অদক্ষতা 🙁 । তবে চেষ্টা করছি এগুলো কাটিয়ে ওঠার...

          গ্যালারিতে সর্বশেষ গিয়েছিলাম তাও প্রায় মাস চারেক। হ্যাঁ, প্রতিনিয়তই আমাদের মানস পরিবর্তিত হয়ে চলেছে এবং জানি এই গল্পে অনেক ইতিবাচক সমন্বয় আনা সম্ভব।

          আবারো অনেক ধন্যবাদ, আমি খুবই ইনস্পায়ার্ড...

          জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রশিদ (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।