কিশোর বেলার কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান…..অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার স্মৃতি…..

বেড়ে ওঠার দিনগুলোয় আমাদের মফস্বল শহর টাঙ্গাইলে বেশকিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছিল, যা প্রত্যক্ষ করার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার……..অনেকসময় আড্ডায় বসে অনেকের সাথে শেয়ার করেছি…………..

এক.

একসময় ভি.সি.আর./ভি.সি.পি.-র যুগে ক্যাসেট ভাড়া এনে সিনেমা দেখার খুব চল ছিল…….তো ক্যাডেট কলেজের ছুটিতে বাসায় আসার কদিন পরেই মুক্তি পেল শাহরুখ-মাধুরীর ‘কয়লা’ ছবিটি…….আমার ছোটমামার বন্ধুর যে দোকান থেকে সাধারনত ক্যাসেট আনতাম (১টা ১০টাকা, ২টা ১৫ টাকা আর ৩টা আনলে ২০টাকা…….আমি অবশ্য ২টাকা/৫টাকা দিতাম সকালের ‘বউনি’-হিসাবে, উপরি আইসক্রিম/চকলেট খেয়ে আসতাম, বাকি টাকা মামাই বোধহয় দিয়ে দিত), তাদের কাছে জেনে নিলাম কবে থেকে ভালো প্রিন্টের ছবিটা পাওয়া যাবে……

তো সেদিন সকালেই গিয়ে হাজির হলাম…….একেবারেই নতুন ছবি, তার উপর দিনের প্রথম ‘কাস্টমার’, তাই ৫টাকা দিয়েই নিলাম ক্যাসেটটা……নিরালা ব্রিজের পরে দোতলায় ছিল দোকানটা……কেন যেন ছোট বিল্ডিংটার সিঁড়িকোঠা ছিল দুটি……সামনে আর পিছনে…….আমি সামনেরটা দিয়ে উঠে তড়িঘড়ি করে নামলাম পিছনেরটা দিয়ে, দ্রুত বাসায় গিয়ে দেখতে বসবো ছবিটা……

কিন্তু নেমে আসার সময়েই হঠাৎ দেখি সব দোকানের শাটারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে……..অবস্থা বেগতিক দেখে নিচের তলায় এক দোকানে ঢুকে পড়লাম……বেশ কিছু সময় পরে আবার যখন স্বাভাবিক হয়ে এল চারপাশ, শাটারগুলো তুলে দেয়া হলো, তখন বের হয়ে শুনলাম……আমি যেখা থেকে ক্যাসেটটা কিনলাম, সেই ভিডিওর দোকানে এসে ঐ মামার পাড়ার প্রতিপক্ষের গ্রুপ এসে তাকে কুপিয়ে গেছে……(নামটা চেপে যাচ্ছি) দেখলাম রক্তাক্ত তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে অন্যরা……

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মামলা……আমাকে ঐ দোকানে পেলে অথবা সামনের সিঁড়ি দিয়ে নামলে ওদের সামনে পড়লে কি অবস্থা হতো, তা আর ভাবতে চাইনা…….

বাসায় ফিরে ঐ ছুটিতে আমার আর ছবিটা দেখা হয়নি……

দুই.

১৯৯৩ সাল। শহীদ কোচিং সেন্টারে ক্যাডেট কলেজে ভর্তির ক্লাস করি……একদিন ১১টার দিকে বের হয়েছি পাশের বেকারিটায় কিছু খেয়ে নেয়ার জন্য……কেক আর ফানটা নিয়ে বড় একটা গাছের গুঁড়িতে বসলাম আমরা ৩জন…….হঠাৎ সেই একই অবস্থা…….চারপাশের বাসাগুলোর দরজা-জানালা, দোকানগুলোর ঝাঁপ/শাটার সব বন্ধ হয়ে গেল……আমরা ৩জন মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম, কিন্তু ততক্ষণে কোথাও আর ঢোকার জো নেই……যখন ভাবলাম কোচিংক্লাসে ফিরে যাই, তখন হই হই রব তুলে দেখি এক যুবককে তাড়া করছে চাপাতি হাতে আর ৩/৪জন…….আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে আছি গাছের পেছনে…….মোড়টা ঘুরতে গিয়েই ভাঙ্গা রাস্তায় তাল হারিয়ে পড়ে গেল ছেলেটা……তারপর কোপ……কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, ওরা চলে গেল ওকে মেরে না ফেলেই…….আরো আশ্চর্য হলাম, যখন দেখলাম কোপের আঘাতে নেমে আসা বাহুটা অন্যহাত দিয়ে ধরে সে আর্তচিৎকার করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে চললো…….

তিন.

এটা আমার ছোট ভাইয়ের দেখা ঘটনা……হঠাৎ আমাদের বাসার গেটে একের পর এক ধাক্কা……আমার ভাইয়েরই আসার কথা সেসময়…….আমি, আম্মা দৌড়ে গেটে খুলতেই ৫ম শ্রেনী পড়ুয়া আমার ভাইটা আম্মার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো……বুঝলাম ও কোন কিছু নিয়ে প্রচন্ড শক্ড……..পরে যা শুনলাম তা আমি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা…….

ওরা ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময়েই হৈচৈ শুনেছিল……ছোট গেট দিয়ে বের হয়ে মাথা উচুঁ করে দেখে তাড়া খাওয়া এক যুবকের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেয়া চাপাতি বা এরকম কিছু একদম গলায় আঘাত করে মাথাটা প্রায় আলাদা করে ফেললো…….হতভাগাটা দৌড়ের উপর ছিল তাই হয়তো কিছু সময় মাথাটা ছাড়াই এগিয়ে গিয়েছিল……পরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়………

উফ! আমি জানিনা আমার ছোট্ট ভাইটা কিভাবে এটা সহ্য করেছিল…….আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া পরবর্তি সময়ে ওর উপর এটার কোন প্রভাব পড়েনি……….

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>

নাহ…..আর লিখতে ইচ্ছা করছেনা…..

২,১০২ বার দেখা হয়েছে

৪১ টি মন্তব্য : “কিশোর বেলার কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান…..অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার স্মৃতি…..”

  1. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)

    রশিদ, আমি টাঙ্গাইলা পোলা তাই বুঝতে পাচ্ছি এসব ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।রাস্তায় বের হলেই আদালত পাড়া থানা পাড়ায় কিছু সূর্য সন্তানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম হাতে ব্যান্ডেজ।কারো কবজি নাই,কারো বা তারো বেশি।ঐ অরা অরাই এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের কাউরে।কত শহীদ হইল, দেয়াল লিখন,পোস্টার দেখলাম।এরকম না হলেও কাছাকাছি একটা অভিজ্ঞতা আমার আছে।
    রোজার ঈদের দিন দুয়েক আগে সন্ধার পর আমি তখন সমবায় সুপার মার্কেটেরর কোন এক দোকানে পাঞ্জাবী দেখছিলাম।হঠাত বিকট শব্দে সব শাটার বন্ধ হচ্ছে।জানতে পারলাম বাপ্পিকে মেরে ফেলা হয়েছে তার বাড়ীর সামনেই।বুঝতেই পাচ্ছ কার গায়ে হাত দেয়া হয়েছে আর শহরের অবস্থা কি হতে পারে ! চারিদিকে আতঙ্ক।কিছুক্ষন পর শাটার খুলে দেয়া হলো।ভাবলাম গরম হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।লোকজন সবাই ছুটে যাচ্ছিল যার যার গন্তব্যে।রিক্সা পাওয়ার কোন প্রশ্নই উঠেনা।আমার বাসা বিশ্বাস বেতকা।গুপ্ত হত্যার ভয়ে চিপা গলি দিয়ে গেলামনা,যা হয় রাজপথেই হবে।অনেকটা দৌড়ে বাসায় পৌছে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।কেন্দ্রীয় মসজিদের ৪০ বছর ইমামতী করা ইমামও মারা গিয়েছিলেন বার্ধক্যজনিত কারনে।তারপরদিন দুইজনের একসাথে জানাজা হয় ঈদগাহ ময়দানে।সেই জানাজায় শরিক হয়েছিলাম। 🙁

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    বাক্যের শেষে দাঁড়ি না দিয়ে ডট ডট দেয়ার অভ্যাস দেখি অনেকেরই!
    দেখতে এবং পড়তেও বিশ্রী লাগে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  3. আব্দুল্লাহ্‌ আল ইমরান (৯৩-৯৯)

    চাপাতি নিয়া পোলাপাইন ও ঘোরে।অন্য সব ধরনের আর্মস ই থাকে।যাদের হাতে না থাকে তাদের দেখেও অন্য জায়গার লোকজন ভয় পায়।সবাই একটু ডেয়ারিং হয়।বাট এখন আর আগের অবস্থা নাই।অনেক শান্ত।ভয়ের কারন নাই। :grr:

    জবাব দিন
  4. আচ্ছা আপনি কি শবনম জেরিন লিটা দের ব্যাচে ছিলেন ? আমরা শহিদে থাকতে ৯৯ এ লিটা একবার আসছিল । মাই গড, সি ওয়াজ সো প্রিটি । আমরা তখন কয়েকদিন শুধু লিটা লিটা করছি ।

    আমরাও শহীদে থাকতে আদালত পাড়ায় একটা মার্ডার হইছিল । রানা-বাপ্পীর নাম তখন খুব শোনতাম । রানার ছোট ভাই বাপ্পার সাথে আমার এক ফ্রেন্ডের বোনের বিয়ে হইছে। বাট আজকাল ত টাঙ্গাইল অনেক ঠান্ডা ।

    জবাব দিন
  5. আশহাব (২০০২-০৮)

    পুরাই খুন খারাপি :duel:
    অফটপিক : ভাই, শবনম জেরিন লিটা আপার নাম আমরাও শুনছি, তাও আবার ২০০১ এ শহীদ কোচিং এ ক্লাস ৫ এ থাকা অবস্থায়, আপার ছবিও দেখসি তখনই |

    মাই গড, সি ওয়াজ সো প্রিটি । আমরা তখন কয়েকদিন শুধু লিটা লিটা করছি ।

    😡 😡 😡 😡


    "Never think that you’re not supposed to be there. Cause you wouldn’t be there if you wasn’t supposed to be there."
    - A Concerto Is a Conversation

    জবাব দিন
  6. ক্যাডেট কোচিং করার সময় একবার আমার-ও এরকম একটা সিচুয়েশনে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কোচিং এর উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছি আর মারামারি। দেখি এক বেটা আমার দিকে একটা রাম-দা নিয়ে দৌড়ায় আসছে (!!!) আমি তো ভয়ে....... পরে দেখি না, আমাকে ক্রস করে সামনের কাকে যেন chase করতে লাগল। ঐ সব লোকজনের হাতে firearms-ও ছিল। ঐ দিন প্রথম আমি সামনাসামনি কয়েক টাইপের customized বন্দুক দেখসি!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহমদ (৮৮-৯৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।